এক সমুদ্র প্রেম পর্ব -বোনাস

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(বোনাস পর্ব)

ধূসর সব সময় রাত করে বাড়ি ফেরে। অফিসে যাওয়ার পর থেকে,মাঝেমধ্যে ফিরতে দেড়টাও গড়ায়। পিউয়ের সঙ্গে আরো একটি মানুষের চোখ ততক্ষণ বন্ধ হয়না,যতক্ষণ না আসছে সে। রুবায়দা বেগম, ঘরে থাকলেও সজাগ থাকেন। নিস্তব্ধ রাতে বাসার নীচে ধূসরের বাইকের শব্দ,সদর দরজার লক খোলার আওয়াজ,আর সিড়িতে তার লম্বা পদচারণ ওনাকে নিশ্চিত করে ছেলেটা ফিরেছে। রুবাইদা যখন বুঝতে পারেন ছেলের আগমন, তখন নিশ্চিন্তে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমান। অথচ আজ ঘড়ির কাটায় দুটো পার হলো,ধূসর আসার নাম নেই। রুবায়দা বেগমের চোখ লেগে আসতে আসতেও ঘুম ছুটে গেল। ছেলেটা যে বাইরে! এমন এমন কাজ করে, বিপদ সর্বদা সঙ্গে নিয়ে ঘোরে। উল্টোপাল্টা কিছু হলো না তো? ছটফটে মন নিয়ে আরো দশ মিনিট অপেক্ষা করলেন তিনি । এর বেশি সইতে পারলেন না। পাশ ফিরে ঘুমন্ত আফতাবকে দেখলেন একবার। একবার ভাবলেন ডাকবেন ওনাকে, পরমুহূর্তে থেমে গেলেন। সারাদিন খাটা-খাটুনি করে একটু ঘুমোচ্ছে,থাক বরং। তিনি নিজেই ফোন উঠিয়ে চললেন বারান্দায়। কল দিলেন ধূসরকে। লাগাতার কয়েকবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো। রুবায়দা বেগম হরভড় করে বললেন,
‘ হ্যাঁ রে ধূসর তুই কোথায়? এত রাত হয়ে গেল আ….’
ওপাশ থেকে জবাব এলো,
‘ আন্টি আমি ইকবাল!’

পথিমধ্যে আটকে গেল কথা। রুবায়দা অবাক হয়ে বললেন,
‘ ইকবাল! তোমরা কি এখনও পার্লামেন্টে? ‘
‘ না আন্টি। আমি আমার বাড়িতে।’
‘ তাহলে ধূসর কোথায়?’
‘ ধূসর এখানে, আমার বাড়িতে। ওয়াশরুমে গিয়েছে। ‘
রুবায়দা বিচলিত হয়ে বললেন,
‘ ও ফিরবেনা আজ? কিছু কি হয়েছে বাবা,সত্যি করে বলোতো আমায়!’
‘ না না আন্টি,কিচ্ছু হয়নি। আসলে দু বন্ধু মিলে অনেকদিন আড্ডা দেইনা তো,তাই….’

রুবায়দা মেনে নিলেন,শান্ত হয়ে বললেন,
‘ ও। আচ্ছা ঠিক আছে, খেয়েছে ও?’
‘ জি। ও বের হলে আপনাকে কল করতে বলব।’
‘ না থাক,বিশ্রাম নিক। আমি রাখি বরং। আচ্ছা ইকবাল তুমি বাসায় আসছোনা কেন বাবা? ধূসরের সঙ্গে একদিন চলে এসো।’
‘ জি আন্টি আসব। ‘
‘ আচ্ছা ভালো থেকো,আল্লাহ হাফেজ।’
‘ জি আসসালামু আলাইকুম।

ইকবাল লাইন কে*টে ঠোঁট ফুলিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। ধূসর আজ বাড়ি যাবেনা। গোঁ ধরল এখানেই থাকবে। সেও কিছু বলেনি। এতবার ফোন বাজল ধরলোওনা। শেষমেষ তাকেই রিসিভ করতে হয়েছে। ধূসরের ফোন মুঠোয় নিয়ে কিয়ৎক্ষন চেয়ে রইল ইকবাল। আচমকা একটা দুষ্টু বুদ্ধি উদয় হলো মাথায়। ফোনের প্যাটার্ন তার আয়ত্তে। এই সুযোগে পিউকে একটা মেসেজ পাঠাবে না কী? হ্যাঁ পাঠাক।
লিখবে
‘ আই লাভ ইউ জান। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। বাঁচতে হলে একসঙ্গে বাঁচব,ম*রতে হলে একসঙ্গে মর*ব। আমাকে ছেড়ে যেওনা, প্লিজ জান।’

ইকবাল এক এক করে বাক্য সাজাল। এখন এটাই টাইপ করে পিউকে পাঠাবে। মেয়েটা বুঝবে ধূসর পাঠিয়েছে। তখন যত রা*গ, সব বরফের ন্যায় গলে যাবে । এই মান অভিমানের পালা দেখতে দেখতে সে ক্লান্ত। ইকবাল সতর্ক চোখে একবার বারান্দার দিক দেখে নেয়। পাছে ধূসর এসে পরে! তারপর প্যাটার্ন টেনে খোলে। হোম স্ক্রীনে, মুহুর্তমধ্যে ভেসে ওঠে পিউয়ের জ্বলজ্বলে একটি ছবি। বহু আগের ছোট্ট পিউ। পড়নে কালো গাউন। ছবিটা গত কয়েক বছরেও বদল হয়নি। ঠিক এই কারণেই ধূসর কাউকে ছুঁতে দেয়না ফোন। পিউয়ের ঠোঁট ভর্তি উচ্ছল হাসিটা ইকবালের ভেতরটা নাড়িয়ে দিল। বিবেক বলল,

” না,এটা করা ঠিক হবেনা ইকবাল। এতে পিউকে ঠকানো হবে। মেয়েটা আবার আশায় বুক বাধবে। তার চেয়ে, যার বলার সেই বলুক।’

ইকবাল আর ইনবক্স অবধি গেল না। ফোন অফ করে বিছানার ওপর ছু*ড়ে মারল। তিঁ*তিবির*ক্ত সে, গিয়ে দাঁড়াল বারান্দার দরজায়। ধূসর মেঝেতে বসে, পিঠ দেয়ালে ঠেকানো। এক পা ছড়ানো,অন্য পা ভাঁজ করা। ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট জ্বলছে। বড় আয়েশ করে টান দিচ্ছে সেখানে। ইকবাল ভ্রুঁ কুঁচকে দেখল কিছুক্ষণ। থমথমে গলায় বলল,
‘ আন্টি ফোন করেছিলেন।’
উত্তর নেই। ইকবাল অপেক্ষা করল ক্ষনকাল। ছেলেটা নিশ্চুপ। শেষে ছোট্ট শ্বাস ফেলে সে নিজেও দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পরল পাশে। প্যাকেট থেকে সিগারেট তুলে ঠোঁটে ভরল। লাইটার দিয়ে আগু*ন জ্বা*লাতে জ্বা*লাতে বলল,
‘ বাড়ি যাবিনা?’
ধূসরের জবাব ‘ না।’
‘ কদিন দূরে সরে থাকবি?’
ধূসর নিশ্চুপ।
ইকবাল ধোয়া আকাশে উড়িয়ে বলল,
‘ একবার ওকে বোঝানোর চেষ্টাও করলিনা,সবটা পরিষ্কার করে বললিওনা,যে ও যা ভাবছে ভুল,ভ্রান্ত। তাহলে কী করে আশা করছিস, এতকিছুর পরেও ও তোর সাথে লুতুপুতু করবে ?’

ধূসর চোখ রা*ঙিয়ে তাকাল। ইকবাল দাঁত কেলিয়ে বলল,
‘ ভাবছিলাম, তোর ফোন থেকে পিউকে আই লাভ ইউ লিখে মেসেজ পাঠাব।’
ধূসর চকিতে তাকিয়ে বলে,
‘ পাঠিয়েছিস?’
ইকবাল মুখ গোমড়া করে বলল ‘ না।’
পরমুহূর্তে চেতে বলল,
‘ কিন্তু তুই এরকম চুপচাপ থাকলে আমি ঠিকই পাঠিয়ে দেব কিছু একটা। আই লাভ ইউ না হোক,অন্য কিছু দেব। লিখব যে আমি আরেকজনকে ভালো বাসি। তার সাথে আজ আমার বিয়ে। ‘

ধূসরের ওষ্ঠদ্বয় বে*কে এলো এক পাশে। হাসতে দেখে ইকবাল নাক ফুলিয়ে বলল,
‘ তুই হাসছিস ধূসর? এ্যাম আই জোকিং উইথ ইউ?’

ধূসর তার রা-গটুকু পাত্তাই দিলোনা। শান্ত গলায় বলল
‘ কাল পিউয়ের পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। ‘
‘ সেটা আমিও জানি। হলে যাবি না একবার?’
ধূসর ভাবনায় মিলিয়ে গেল। জবাব না দেওয়ায় ক্ষে*পে গেল ইকবাল।
‘ ধ্যুস শালা! সিগারেটে আমার রা*গ পরছেনা,যাই মদ নিয়ে আসি। ‘
সে উঠতে গেলে ধূসর থামিয়ে দেয়। পুরু কণ্ঠে নিষেধ জানায়,
‘ না। ‘
ইকবাল দমে গেল। দু এক টান বসানো সিগারেট ফেলে দিয়ে বলল,
‘ শালার আমার কপালটাই খা*রাপ! এত সহজ সরল মানুষের কপালে এমন ঘাড়ত্যা*ড়া বন্ধু জোটালে কেন আল্লাহ? একটা ভালো ছেলে দিতে, মাথায় তুলে রাখতাম।’

আরো নানান কিছু বকবক করল সে। সবটাই ধূসরকে উদ্দেশ্য করে। অথচ এসবে মন নেই ছেলেটার। সে ভাবছে,ভীষণ ভাবছে দুপুরে পিউয়ের আচরণ গুলো। যতবার ভাবছে কো*পিত হচ্ছে,হচ্ছে য*ন্ত্রনা। বুকটা ভে*ঙে আসছে। ধূসর চিবুক শ*ক্ত করল। আধপো*ড়া সিগারেটের মাথাটার দিক চেয়ে থাকল কিছু সময়। আচমকা সেটাকে চে*পে ধরল হাতের তালুতে। ইকবাল চমকে গেল। বিস্মিত তার কান্ডে। উদ্বেগ নিয়ে ছাড়িয়ে নিল হাত।
‘ কী করছিস কী?’
ধূসরের জবাব এলো না। সে অনবহিত নেত্রে তাকাল দূরের দালান- কোঠার দিক। ইকবাল সিগারেট ওরটাও ফেলে দেয়। উঠে গিয়ে ফার্স্টএইড বক্স আনে। পু*ড়ে গেছে জায়গাটা। লাল হয়েছে,ফো*স্কা পরবে হয়ত। ইকবাল ক্ষততে বার্নের মলম লাগাতে লাগাতে বলল,
‘ জীবনটা ছেলেখেলা নয়। তেঁজ নিজের সঙ্গে না দেখিয়ে শান্ত হ,যার জন্যে এসব করছিস তাকে বোঝা। বাচ্চা মেয়ে পালতে গিয়ে নিজেও বাচ্চা হয়ে যাস না। লোকে নির্বোধ বলবে,বলবে বুদ্ধিহীন লোক ভবিষ্যতে নেতা হতে এসছে। হাসবে তোকে নিয়ে,সাথে আমাকেও টানবে। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলবে ‘ ওই দ্যাখ একটা গাধার বন্ধু যাচ্ছে। তখন আমি মুখ লুকোতে ড্রেনে লাফ দিতে পারব না। সরি! ‘
ধূসর বিদ্বিষ্ট চোখে তাকাল। মৃদু ধমকে বলল,
‘ মুখটা বন্ধ রাখবি? যা ঘুমা গিয়ে।’
‘ আর তুই?’
‘ আমি ঠিক আছি।’
‘ আমিত বলিনি আমি ঠিক নেই! তুই এখানে বসে থাকলে আমিও থাকব। এই যে বসলাম, তুই না উঠলে নড়ছিনা।’
ধূসর হতাশ দম ফেলল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ আয়।’
ইকবাল হেসে রওনা করল পেছনে। ধূসর রুমে ঢুকে শুয়ে পরল বিছানায়। সিলিংয়ের দিক চেয়ে আওড়াল,
‘ সাতাশ বছরের এক যুবক, বিধ্ব*স্ত, এক সতের বছরের কিশোরির প্রে…..’
বলতে বলতে থেমে গেল। ইকবাল মিটিমিটি হেসে
বলল ‘ পরেরটুকু আর উচ্চারন করিস না ভাই। তোর মত নিরামিষের মুখে মানাবেনা।’
ধূসর কটমট করে বলল ‘ চুপ কর।’
ইকবাল বলল ‘ উচিত কথার ভাত নেই!’

****
রাতে এক ফোটা ঘুমালো না পিউ। চোখের সামনে বই মেলে রাখলেও সামান্য অক্ষর পড়েনি। ধূসর ফেরেনি সে জানে। রুবায়দা বেগমের মতো ছটফট করলেও,সে ফোন করতে ব্যর্থ। ইকবালের থেকে খোঁজ নিয়েছে অবশ্য। যখন শুনল ধূসর আসবেনা বাড়িতে,মেয়েটা আবার কেঁ*দেছে। দোষা*রোপ করেছে নিজেকে। তার ওসব বলা উচিত হয়নি। ধূসর ভাই ক*ষ্ট পেয়েছেন। সে তো ওভাবে বলতেও চায়নি। জ্বিভ খ*সে বেরিয়ে এসেছে। বেহায়া তো! একা একা সমস্ত ক*ষ্ট বুকের মধ্যে পুষে রাখতে গিয়ে, হাঁপিয়ে গেছিল যে!

প্রথম পরীক্ষার দিন,অথচ পিউয়ের মধ্যে নার্ভাসনেস নেই। না আছে চি*ন্তা। কী লিখবে,কী করবে,প্রশ্ন কেমন হবে,কমন পরবে কী না, স্বল্প দুঃ*শ্চিন্তা অবধি এলো না মাথায়। তার মন যে অন্য কোথাও। যে মানুষের পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অবধি ধ্যানমগ্ন ধূসরের নামে, তার ভেতর অন্য কিছুর প্রভাব পরতে পারে?

পিউ কোনও রকম ফ্রেশ হয়ে ইউনিফর্ম পরে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। পরীক্ষা দশটা থেকে শুরু। প্রতিটা পরীক্ষায় আগের রাতে ফাইল গুছিয়ে প্রস্তুত থাকতো সে। অথচ আজ কিচ্ছু করেনি। এতটা উদাসীন কেউ হয়না বোধ হয়!
পুষ্প নাস্তা রেখে গেছে টেবিলের ওপর। তার প্রিয় চিকেন স্যান্ডউইচ। অথচ সে ফিরেও দেখল না। খিদে নেই। স্কেল, পেন্সিল,কলম,সব একে একে ফাইলে গোছানোর সময় ঘরে ঢুকল সাদিফ। পিউ শব্দ পেয়ে তাকাল। সাদিফ বলল,
‘ বের হচ্ছিস?’
‘ হু।’
‘ প্রিপারেশন ভালো?’
পিউ মৃদূ কন্ঠে জানাল,
‘ ওই আর কী।’
সাদিফ জ্বিভে ঠোঁট ভেজাল। কয়েক দিন ধরেই পিউয়ের চুপসে যাওয়া লক্ষ্য করেছে। একই গাড়িতে এসেছে সেদিন,অথচ সারা রাস্তায় পিউয়ের কথা ফোটেনি। নাস্তার টেবিলে পায়না,ঘর থেকে বার হয়না। দুষ্টুমি করেনা, ছোটেনা বাড়িময়। পিউকে এতটা নির্জীব তার সহ্য হয়না,একটুওনা। এই চঞ্চলতার জন্যে তার প্রিয় চশমাটা ভে*ঙেছিল। কত কী বলল,ব*কল সেদিন। অথচ এখন, এখন বলতে ইচ্ছে করছে,
‘আমি ওরকম আরো কয়েকশ চশমা তোর পায়ের তলায় বিছিয়ে দেই পিউ,তুই ছোট। ভা*ঙ, ভে*ঙে টুকরো টুকরো করে ফ্যাল। তবুও এমন চুপ করে থাকিস না। ক*ষ্ট হয় আমার।

‘ কিছু বলবেন ভাইয়া?’
সাদিফের ধ্যান ছুটল। নড়েচড়ে বলল,
‘ হু? না। ভাবছিলাম তুই বের হচ্ছিস যখন তোকে এগিয়ে দেই। ‘

পিউ ছোট্ট করে বলল ‘ দরকার হবেনা। পারব যেতে।’
‘ জানি পারবি,আমি এগিয়ে দিলে সমস্যা?’
‘ না। তা কখন বললাম?’
‘ তাহলে চল।’
পিউ হার মানল। ফাইল বুকে চে*পে বের হতে নিলে সাদিফ বলল,
‘ চুল আচড়াবিনা?’
পিউ চুলে হাত বোলাল। অনিশ্চিত কণ্ঠে বলল,
‘ আচড়াইনি?’
সাদিফ মনঃস্তাপ নিয়ে তাকাল। পিউ মলিন হেসে বলল ‘ খেয়াল করিনি আসলে৷ ‘

তারপর আয়নার সামনে দাঁড়াল গিয়ে। আচড়ানো তো দূর, সেই যে মিনা বেগম চুল বেধে দিয়েছিলেন,তারপর আর হাতই দেয়নি। কোনও রকমে খোপা করে রেখেছিল ।

পিউ তাড়াহুড়ো করে ঝুঁটি বাঁধল। পুরোটা সময় চেয়ে থাকল সাদিফ। এমন অগোছালো তো পিউ নয়। বরং দিনের মধ্যে একশ বার আয়না দেখে,সাজগোজ করে।
কী হয়েছে ওর? ওকে এত অচেনা লাগছে কেন?
‘ চলুন।’
সাদিফ ফোস করে এক শ্বাস ফেলে বলল ‘ আয়।’

পুষ্প নাস্তা খেয়ে বসেছে সোফায়। ফোন নিয়ে মেসেঞ্জার অন করতে করতেই দেখল, পিউ নামছে। বোনকে দেখে ফোন রেখে দিলো। উঠে এসে,জিজ্ঞেস করল,
‘ নাস্তা খেয়েছিস পিউ?’
পিউ মাথা ঝাঁকায়,বোঝায় খেয়েছে। মেয়ের উপস্থিতি টের পেয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মিনা। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন,
‘ হ্যাঁ রে মা, প্রস্তুতি ভালো তো?’
‘ হু।’
‘ একদম ভাববিনা কেমন! প্রশ্নপত্র পেয়ে আগে তিনবার দুরুদ পড়বি,তারপর বিসমিল্লাহ বলে শুরু করবি লেখা। ‘
‘ হু।’
‘ সব নম্বর একটু একটু টাচ করবি,কিচ্ছু যেন বাদ না পরে। ঠান্ডা মাথায় লিখবি, তাড়াহুড়ার দরকার নেই। আর প্রথম পৃষ্ঠায় কা*টাকা*টি করবিনা একদম। ‘

পিউ মাথা কাত করল। বলল ‘ হু।’
মিনা বেগম অসহায় নেত্রে পুষ্পর দিক চাইলেন। প্র‍তিটা পরীক্ষায় তিনি এসব বলেন,মেয়েটা রে*গে যায়,ঘ্যানঘ্যান করে আর বলে,
‘ আম্মু আমি এসব জানি। মুখস্থ হয়ে গেছে শুনতে শুনতে, আর বলতে হবেনা। ‘
অথচ আজ হু হা ছাড়া জবাব নেই ! পরিবারের সবাই টুকিটাকি পরামর্শ দিল পিউকে। তার হাস্যহীন মুখ দেখে বলল ঘাবড়ে না যেতে। ভালো হবে সব।
পিউ সবেতে শুধু মাথাই নেড়েছে। রুবায়দা বেগম নীচে নেমে এলেন তখন। হাতে মুঠোফোন। পিউকে দেখে বললেন,
‘ পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিস?’
‘ হু।’
তিনি হেসে এগিয়ে এলেন। মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ যা, খুব ভালো হবে। দোয়া করি।’
পিউ ম্লান মুখে হাসল। নিশ্চল চোখে চেয়ে দেখল রুবায়দাকে। মনে মনে অভিমানী কণ্ঠে বলল,
‘ ধূসর ভাইয়ের বউ হিসেবে আমায় ভাবলে না কেন মেজো মা? ভাবলে কি খুব ক্ষ*তি হতো?আমি সেরা বউমা হয়ে দেখাতাম তোমায়।’

‘ যা তাহলে, দেরী হয়ে যাবে আবার। ‘
পিউ নিজেকে সামলে হাঁটতে গেল,রুবায়দা বেগম পেছনে পুষ্পকে বললেন,
‘ ও পুষ্প, তোর কাছে মারিয়ার ফোন নম্বর আছে?’
যত্র থেমে গেল সে। পুষ্প বলল,
‘ আছে। হঠাৎ ওর নম্বর দিয়ে কী করবে? ‘
‘ একটা ফোন করতাম,কবে ঢাকা ফিরেছে শুনতাম আর কী।’
‘ হ্যাঁ দিচ্ছি।’

পিউ বেদনার্ত ঢোক গে*লে। খ*ণ্ডবিখ*ণ্ড হয় বক্ষস্থল। রুবায়দা বেগমের মারিয়ার প্রতি গদগদ ভাব শ্বাস প্রশ্বাস ভারি করল ফের। মেনে নিতে পারল না। পারার কথাও তো নয়! মেজো মা কেন মারিয়ার নম্বর খুঁজছে তার আন্দাজ করতে খুব একটা অসুবিধে হয় না। নিশ্চয়ই অতি শীঘ্রই ওনাদের বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাবেন বিয়ের। আর তারপর! তারপর ধুমধাম করে ধূসর ভাইয়ের বউ বানিয়ে তুলে আনবেন ঘরে। পিউ এর বেশি ভাবতে পারেনা। এক পৃথিবী যন্ত্র*না গলা চে*পে ধরল। সাদিফ বলল,
‘ কী হলো,চল।’
পিউ খুব ক*ষ্টে পা বাড়ায়। বিব*শ হয়ে আসছে চোখদুটো। একটু বিছানায় শুয়ে কাঁ*দতে পারলে ভালো হতো!

****

সাদিফ তাকে নামিয়ে দিলো গেটের বাইরে। হাসিমুখে “অল দ্যা বেস্ট” জানাল। পিউ কান দিয়ে শুনল তবে খেয়াল করেনি,উত্তর ও দেয়নি। আস্তেধীরে হেঁটে ঢুকে গেল ভেতরে। অন্যমনস্কতায় বাইরে টাঙানো সিট প্ল্যান অবধি দেখেনি। কোন দিকে হাঁটা দিয়েছে নিজেও জানেনা। দুপা এগোতেই একজন পেছন থেকে ডাকল,
‘ ভাবি।’
পিউ ফিরল না। ডাকটা অাবার এলো। আগের মত বলল,
‘ পিউ ভাবি শুনছেন?’
এবারে থামল মেয়েটা। ঘুরে তাকাল। এতদিন বাদে, একটা স্বল্প পরিচিত চেহারা দেখে কপাল কোঁচকাল। সেই ছেলেটি না? কদিন আগে খাবার দিয়ে গিয়েছিল যে ? হ্যাঁ, সেইতো। পল্লব এগিয়ে আসে। হেসে শুধায়,
‘ কেমন আছেন?’
অন্য সময় জবাব তৎপর দিলেও আজকের এই জবাব, পিউয়ের দূর্বোধ্য ঠেকল । সে কি ভালো আছে? এক বিন্দুও ভালো নেই।
অথচ বলল ‘ ভালো। আপনি? ‘
‘ এইত এলাম। আপনি সিট প্ল্যান দেখলেন না,বসবেন কোথায়?’

পিউয়ের হুশ এলো। গোটানো ভ্রুঁ মিলিয়ে গেল। সতর্ক কণ্ঠে বলল ‘ ও হ্যাঁ, ভুলেই গেছি।’
দেখার জন্যে এগোতেই পল্লব বলল ‘ দেখতে হবেনা। আমি দেখেছি, দোতলায় ক্লাস,জানলার পাশের ছয় নম্বর বেঞ্চে। ‘

পিউ অবাক হয়ে তাকাল। পল্লব নম্র কণ্ঠে বলল,
‘আপনার যাতে ক*ষ্ট করতে না হয় তাই আর কী!’
‘ কে বলেছে আপনাকে এসব করতে?’
‘ ভাই বলেছে। ‘
পিউ আশাহত শ্বাস টানে। জানে,অজ্ঞাত ভাইয়ের পরিচয় জিজ্ঞেস করলেও ছেলেটা বলবেনা। তার যে মুখ খোলা বারণ। ওদিকে পরীক্ষার দেরী হচ্ছে। মনটাও বিষাদে ভরা। সে ছোট করে বলল,
‘ ধন্যবাদ ভাইয়া,আসি।’
ঘুরে হাঁটতে গেলেই পল্লব উচু কণ্ঠে বলল,
‘ কোনও সমস্যা হলে জানাবেন ভাবি। আপনার পরীক্ষা শেষ না হওয়া অবধি ভাই আমাকে নড়তেও বারণ করেছেন।’
পিউ মহাবির*ক্ত হলো। তবে হ্যাঁ -না কিচ্ছু বলল না। কোন চূলোর ভাই,আবার তার চামচা! সে ম*রছে নিজের জ্বা*লায়!

****
তানহা আর পিউয়ের রোল নম্বর আগে পরে। তাই বেঞ্চও সামনে পেছনে পরে। পিউ এসে বসতেই সে বই বন্ধ করে ঘুরে তাকাল। একটু হেসে বলল,
‘ কেমন আছিস?’
পিউ ক্লান্ত চোখে তাকাতেই মুখ কালো করে বলল,
‘ সরি! পড়েছিস সব?’
পিউ দুদিকে মাথা নাড়ে। বলে,
‘ যা আগে পড়েছিলাম সেই ভরসায় এসছি। জানিনা কী করব!’
‘ কিছু না পারলে আমিত আছি। ভাবিস না।’
পিউ নিরুত্তর । তানহা ভাবল একবার কালকের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে। ধূসরের সাথে কথা -টথা হয়েছে কী না। পরক্ষনে থেমে গেল৷ ঠিক করল একবারে পরীক্ষা শেষেই শুনবে না হয়। তক্ষুনি দুজন ইনভিজিলেটর কক্ষে ঢুকলেন। শিক্ষার্থীরা তটস্থ হয়ে বসল। একজন বই -পত্র জমা করতে বললেন টেবিলের ওপর। সবাই একে একে উঠে বইখাতা নোট, রেখে এলো। পিউয়ের যেতে হয়নি। বই-তো আনেনি সাথে । তারপর ঘন্টা বাজল। আস্তেধীরে পরীক্ষা শুরু হলো।
হলে পড়ল কড়া গার্ড । ঘাড় অবধি ঘোরানো গেল না। পিউ প্রথম দিকে ভালোই লিখছিল, হঠাৎ মাথা এলোমেলো হয়ে পরে। গত সাতটা দিনের কথা একে একে ভেসে ওঠে চোখে। মন নেতিয়ে গেল,হৃদয়ে বইল সুনামি। ধূসর ভাই! মারিয়া! তার ধূসরকে আগলে,পেঁচিয়ে ধরা সেই দৃশ্য। রুবায়দা বেগমের প্রতিটি কথা, তীক্ষ্ণ ভাবে কানে বাজে,চোখে লাগে। পিউয়ের হাত থমকায়। অধর কেঁ*পে ওঠে। মাথা চক্কর দেয়। কা*ন্না পায়। যা পড়েছিল,যা পারত তাও ভুলে বসে। প্রথম দুটো পৃষ্ঠা ভর্তি করে লিখলেও আর পারছেনা। চলছেনা হাত। বাকী সব পাতা সাদা পরে থাকে। ঝিমিয়ে যায় মস্তিষ্ক, থিতিয়ে আসে স্মৃতিশক্তি। কারো থেকে সাহায্য নেওয়ারও উপায় নেই।
পিউ অসহায় হয়ে বসে থাকে। দুহাতে মাথা চে*পে ধরে। চেষ্টা করে,খুব চেষ্টা। স্নায়ুর প্রতিটি কোষ যেন বিশ্রামে। সাড়া দেয়না তারা।
‘ ধূসর ভাই আমায় ভালোবাসেন না,তিনি মারিয়ার,আমার নয়। এমন শতশত স্লোগানে ভরিয়ে ফেলে উলটে । সবটা গরমিল হয়ে যায়। আশাহত হয়ে ভ*গ্নহৃদয়ে বসে থাকে সে । দুটো ঘন্টা পার হয়,অথচ পিউ লিখেছে কেবল দুই পাতায়।

পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই সে উঠে খাতা জমা করে দিলো। তানহা লেখা থামিয়ে তাকিয়ে থাকল। স্যার প্রশ্ন করলেন ‘ লেখা শেষ? ‘

তার ছোট জবাব ‘ অসুস্থ লাগছে।’
তারপর বেরিয়ে গেল। বলতে গেলে সাদা খাতা জমা করেছে । ফেল আসবে নিশ্চিত । আর এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে ফাইনালেও বসতে পারবেনা। পিউয়ের বুক তোলপাড় করে কা*ন্না পায়। কোথাও আর দাঁড়াল না। মুখ চে*পে ধরে কাঁদ*তে কাঁ*দতে গেট থেকে বার হলো।

সূর্যের কড়া আলো মাথার ওপর নিয়ে পিউ হাঁটতে থাকে। চোখ ফে*টে উপচে আসে বিশ্রামহীন জল। আগেভাগে বেরিয়ে আসায় বাড়ির গাড়ি পৌঁছায়নি। সে ঠোঁট ভে*ঙে নিশব্দে কাঁ*দছে। আশেপাশের অনেকেই কৌতুহল নিয়ে চেয়ে চেয়ে দ্যাখে। কোথায় যাচ্ছে, কোনদিকে যাচ্ছে, কিচ্ছু জানেনা পিউ। আগের য*ন্ত্রনা গুলোই কি যথেষ্ট ছিলোনা? আজ যে সাথে যোগ হয়েছে আরো। এখন পরীক্ষায় খা*রাপ করলে বাড়িতে কি জবাব দেবে?

পিউ দিক বিদিক খুইয়ে ফেলল। উল্টোদিক থেকে ধেঁয়ে আসা গাড়িগুলোকে হঠাৎ মনোযোগ দিয়ে দেখল। জীবনের এই অল্পদিনের নিপীড়ন মনে করে, তৎক্ষনাৎ ক*ঠিন এক সিদ্ধান্ত নিলো। বেচে থাকলে ধূসর ভাইয়ের সংসার দেখতে হবে। মুখোমুখি হতে হবে আরো অনেক কুৎ*সিত পরিস্থিতির। সে পারবেনা। সে যে শক্তিহীন, দূর্বল। তার চেয়ে আজ ম*রে যাবে। চাকায় পি*ষ্ট হয়ে রাস্তায় পরে থাকবে। তার ছোট্ট মস্তিষ্ক সেই ক্ষনে ভরে গেল উদ্ভট চিন্তায়। পিউ চোখ মুছল। ফাইলটা পরল পায়ের কাছে। মুখ শক্ত করে ফুটপাত থেকে ব্যস্ত রাস্তায় নামল। একেকটা গাড়ি প্রবল বেগে যাচ্ছে। পাশ কা*টালেও উড়ে উঠছে চুল,স্কার্ফ।
ক্ষানিকপর অপর দিক থেকে ছুটে আসে বাস। কী মারাত্মক গতি তার! পিউ দাঁড়িয়ে থাকল। চোখ বুজে, দাঁত খি*চে। বাস কাছাকাছি আসা মাত্র লাফ দেবে সামনে। ড্রাইভার ব্রেক কষার সময় পাবেন না,ওপর দিয়ে চলে যাবে তার। বাচার ও সম্ভাবনা থাকবে না তাহলে।
বাস কাছাকাছি এলো,পিউ উদ্ভ্রান্তের মতো ঝাঁপও দিলো। কিন্তু পরার আগেই পেছন থেকে হাতটা টেনে ধরল একজন।
চমকে তাকাল সে। মারিয়া আঁতকে বলল,
‘ কী করতে যাচ্ছিলে পিউ?’

পিউয়ের অচল মস্তিষ্ক সময় নেয় বুঝতে। যখন সম্বিৎ ফিরল,মারিয়াকে দেখতেই দাউদাউ করে জ্ব*লে উঠল। মনে হল,এই মেয়ের জন্যেই ধূসর ভাই তার হয়নি। মারিয়া বড় বড় চোখে তাকিয়ে। উতলা হয়ে তাকে টেনে আনল কাছে। উৎকন্ঠিত হয়ে বলল,
‘ এই পিউ,তোমার কি হয়েছে? আরেকটু হলেইত…
‘ ম*রে যেতাম। মুক্তি দিতাম তোমাদের, তাইত?’

মারিয়া বুঝতে না পেরে বলল ‘ কী বলছো? কীসের মুক্তি?’
পিউ হাতটা ঝাড়া মারল ওমনি। ক্ষু*ব্ধ কণ্ঠে বলল,
‘ নাটক কোরো না মারিয়াপু। তোমার জন্যে আজ আমার এই অবস্থা! কেন এরকম করলে আমার সাথে? এর থেকে গলা টি*পে মে*রে ফেলতে,তাও ভালো হতো। ‘
শেষ দিকে কন্ঠে ভে*ঙে এল তার। মারিয়া হতবাক হয়ে বলল,
‘ মানে! আমি কী করেছি পিউ? জেনে-বুঝে তোমার কোনও ক্ষ*তি আমি করতে পারি?’
‘ পারো। অবশ্যই পারো। পারো বলেইত ওসব করলে। আমার জীবন থেকে আমার খুশিটুকু ছি*নিয়ে নিলে তুমি।

মারিয়া কিছু বলতে ধরে,পিউ আগেই হাত জোড় করে বলল,
‘ দয়া করো মারিয়াপু! তুমি বা ধূসর ভাই কেউই আমার ধারেকাছে এসোনা। একটু রেহাই দাও, শান্তি দাও আমায়।’

ধূলোর ওপর পরে থাকা ফাইল তুলে,কদম ফেলল সে। মারিয়া মূর্তি বনে থাকল। মেয়েটা কী বলল,কেন বলল, আদোতেই কিচ্ছু বোঝেনি।

***
পিউ শ্রান্ত ভীষণ। শরীর চলছেনা। বাড়িতেই ঢুকে কাউকে চোখে পরেনি। রান্নাঘর থেকে টুকটাক শব্দ আসছে। এছাড়া সব নিরিবিলি। ভালোই হলো! এত আগে চলে আসায় কত রকম জবাব দিহি করতে হতো নাহলে! বেচে গেল তার থেকে।
পিউ সোজা রওনা করল কামড়ায়। কা*ন্না পাচ্ছা খুব। হাঁস*ফাঁস করে কেঁ*দেও ফেলল। টেবিল থেকে খাতা কলম নিয়ে বসল বিছানায়। আধশোয়া হয়ে এক হাতের ওপর খাতা রেখে লিখতে শুরু করল,

‘ ধূসর ভাই! আপনি এই পৃথিবীর সবচেয়ে নি*ষ্ঠুর ব্যক্তি। আমি কেন আপনার প্রেমেই পড়তে গেলাম বলুনতো! মাদকেও মানুষ এতটা আসক্ত হয়নি, যতটা আপনার প্রতি হয়েছি আমি। ফেলে আসা তিনটে বছর সাক্ষী,প্রতিটা মুহুর্তে বড় যত্নে বুকের মধ্যে আপনাকে পুষেছি। নিজে বড় হওয়ার সাথে বৃহৎ করেছি আপনার প্রতি আমার অনুভূতিদের। আর সেই আপনি আমায় পায়ে ঠেলে মারিয়াপুকে বিয়ে করবেন। ওনার সাথে ঘর বাঁধবেন। মেজো মাও তো আমাকে ভালোবাসল না। সারাক্ষণ মা মা বলে, আম্মুর ব*কার থেকে আমাকে বাচায়,অথচ আপনার মত একটা মূল্যবান জিনিসের পাশে আমাকে ভাবলেন না উনি। ভাবলেন মারিয়াপুকে। কেন? আমি কি খুব খা*রাপ বউ হতাম? না। আপনাদের কাছে উজাড় করে দিতাম নিজেকে। তাহলে কেন উনি আপনার সাথে মারিয়াপুর বিয়ে ঠিক করলেন ধূসর ভাই? সত্যিই কি আপনিও ওনাকে পছন্দ করেন? আমাকে নয়! মেজো মা জিজ্ঞেস করেছিলেন আমাকে ‘ আপনার পাশে মারিয়াকে মানাবে কী না!
আমি চিৎকার করে বলতে চেয়েছিলাম ‘না, মানাবে না। আমার ধূসর ভাইকে আমার পাশে ছাড়া কারোর পাশে মানাবেনা। কিন্তু পারিনি। আমার এই না পারার পেছনে আপনি দ্বায়ী। কেন আমায় ভালোবাসলেন না ধূসর ভাই? আমাকে কি ভালোবাসা যায়না?

পিউয়ের আঙুল গুলো কাঁ*পছে। আর লিখতে পারল না। বুক চি*ড়ে যাচ্ছে। সকাল থেকে না খেয়েদেয়ে সে অসুস্থপ্রায়। তার ওপর গোটা রাত নির্ঘুম। বিছানার স্পর্শে সমস্ত অবিসন্নতা যেন জেঁকে বসে। চোখ ছাপিয়ে নেমে অাসে ঘুম। খাতাটা বুকে চে*পে ওভাবেই ঘুমিয়ে পরল সে।

**
পুষ্প ভার্সিটি শেষে কেবল ফিরেছে। ঘড়িতে তখন আড়াইটা। পিউয়ের পরীক্ষা ছিল একটা অবধি। এতক্ষণে ফিরেছে নিশ্চয়ই! সে ফ্রেশ হলোনা। রুমে ব্যাগ রেখেই চলল বোনের ঘরে দিক। ইদানীং ওর চিন্তায় নিজেরও ঘুম হচ্ছেনা। দরজা চাপানো। পুষ্প হাত দিয়ে ঠেলে ভেতরে তাকাল। পিউ আধশোয়া হয়ে ঘুমোচ্ছে। মাথায় বালিশটাও নেই। পুষ্প আস্তে আস্তে ঢুকল কামড়ায়। ইউনিফর্মও পাল্টায়নি মেয়েটা। পুষ্প মৃদূ হেসে দুপাশে মাথা নাড়ে। বোনের মাথায় হাত বোলায়। কপালে চুমু দেয় আলগোছে। তার ভাইয়ের অভাব নেই, কিন্তু বোন এই একটাই। বক*লেও,খেইখেই করলেও পিউটা যে তার কলিজার টুক*রো।

পুষ্প একটা বালিশ নিয়ে পিউয়ের মাথায় গুঁজে দিতে গেল। ওর বুকের সাথে চেঁপে রাখা খাতার ওপর নজর পরল তখন। পুনরায় হাসল সে। ভাবল, পড়তে পড়তেই ঘুমিয়েছে। পিউয়ের হাত ছুটিয়ে খাতাটা সরাল৷ সে। টেবিলে রাখতে গিয়ে লেখাগুলোতে চোখ আটকাল। শুরুর সম্বোধন দেখতেই সদাজাগ্রত হয়ে তাকাল পুষ্প। শশব্যস্ত হয়ে পড়া শুরু করল। পড়তে পড়তে মাঝপথে এসে মাথা চক্কর কা*টল। হতচেতন হয়ে, বড় বড় চোখে পিউকে দেখল একবার। পুরোটা এক নিঃশ্বাসে পড়ল। ওষ্ঠযূগল নিজ শক্তিতে আলগা হয়ে বসে। সে খাতাটাকে ফেলে রেখেই হুড়মুড়িয়ে ছুট্টে বেরিয়ে গেল। পিউকে ঠিকঠাক করে শুইয়ে দেয়ার কথাটাও ভুলে বসল নিমিষে।

****
বিছানার বোর্ড থেকে মাথাটা হেলে পরতেই পিউয়ের ঘুম ছুটে গেল। উঠে বসল তৎক্ষনাৎ। ইউনিফর্ম এখনও পরে? নিজেই নিজের ওপর বির*ক্ত হলো। চোখ ডলে নেমে দাঁড়াল বিছানা থেকে। খাতাটা পরে আছে মেঝেতে। ভাবল, ঘুমের মধ্যে নড়াচড়ায় পরেছে। হাতে তুলে লেখা গুলোর দিক তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরপর পৃষ্ঠাটা ছি*ড়ে কু*চিকু*চি করে ফেলে দিল ঝুড়িতে। লোকে ডায়েরী লিখে ভরে ফেলে,আর সে লেখে রাফ খাতায়। লিখলে ক*ষ্ট হাল্কা হয়। তারপর ব্যস্ত হাতে পাতাটা ছি*ড়ে ঝুড়িতে ফেলে দেয়,ঠিক এইরকম। কখনও পানিতে ভেজায়। এই অভ্যেস তো আজ নতুন নয়!

পিউ জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। শীতের ভেতর ঠান্ডা পানিতে লম্বা শাওয়ার নিলো। বের হতেই দেখল রাদিফ রুমে এসছে। খেতে ডাকছে সবাই। এতক্ষণ নিচে বসে ডেকে ডেকে শেষমেষ ওকে পাঠিয়েছে।
পিউ দ্বিরুক্তি না করে রওনা করল। গিয়ে বসল টেবিলে। আফতাব ব্যাতীত বাড়িতে পুরুষ কেউ নেই। গ্রাম থেকে আসার পরপরই সাংঘাতিক ঠান্ডা লেগেছে তার। শুকনো কাশি,ফ্যাচফ্যাচে সর্দি। আমজাদ সিকদার অফিসমুখী হতে ক*ড়া কণ্ঠে মানা করেছেন। ভাইকে অমান্য করে তিনিও রয়ে গেলেন বাড়িতে।

মিনা বেগম শুধালেন,
‘পরীক্ষা কেমন হলো?’
মুখের সামনে ভাত ধরেও পিউ থেমে গেল। ব্য*থিত নয়নে তাকাল মায়ের দিকে। কী করে বলবে এখন! আজ যে জীবনের সবচেয়ে বা*জে পরীক্ষাটা দিয়েছে। জ্বিভ ঠেলে
মিথ্যে বলল,
‘ ভালো।’
পুষ্প এলো মাত্র। চেয়ারে বসতে বসতে পিউয়ের দিকে তাকাল কয়েকবার।
আফতাবের খাবার ঘরে দিয়ে এসেছিলেন রুবায়দা। এঁটো থালাবাসন সমেত রান্নাঘরের দিক যাচ্ছিলেন। এর মধ্যেই বাড়িতে ঢুকল ধূসর। তার পায়ের আওয়াজ উপস্থিত সকলের কানে পৌঁছায়। মনোযোগ ঘোরায়। একদিন পর বাড়িতে ঢোকায় মিনা বেগমের চোখমুখ চকচকায়। রুবায়দা ছেলেকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেলেন। ধূসর ডানে বামে না তাকিয়েই, গটগটিয়ে এসে মায়ের মুখোমুখি দাঁড়াল। চোখমুখ টকটকে লাল। তিনি হেসে বলতে গেলেন কিছু, সম্পূর্ণ হলোনা। ধূসর সোজাসাপটা, ভণিতা হীন প্রশ্ন ছু*ড়ল,
‘ তুমি মারিয়ার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছো?’

চলবে।

এই জায়গায় থেমে যাওয়ার জন্যে, আসুন,মিলেমিশে হার্ট অ্যা*টাক করি🤝🤝

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here