একই সুতোয় বাঁধা পর্ব ১০

#একই_সুতোয়_বাঁধা

পর্ব-১০

সপ্ত শীখা

সায়ন উদ্দেশ্যহীন ভাবে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। মাথাটা কেমন ফাঁকা লাগছে। সেই দুপুরে বের হয়েছে হাসপাতাল থেকে। এখন সন্ধ্যে পেরিয়ে রাতে নেমেছে। নাওয়া নেই খাওয়া নেই… রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছে সায়ন। নিজের মাথার চুল খামচে ধরছে মাঝে মাঝে। প্রচণ্ড অপমান আর অনুশোচনার যন্ত্রণায় স্থির বসে থাকতে পারছে না এক জায়গায়। জীবনের একটি মাত্র ভুলের জন্য এমন সাজা পেতে হবে !

কেন যেন খুব মনে পড়ছে আজ পুষ্পকে। ভীষণ মিস করছে ওকে সায়ন। মনে আছে ওর… ছোটবেলাতে সায়ন খুব মুখচোরা ছিল তাই যেকোন সমস্যাই ও পুষ্পের সাথে শেয়ার করত। পুষ্প এমনভাবে বকত সে অপরাধের জন্য ! কিন্তু সে বকাটাই ঝড়ো বাতাসের কাজ করে সায়নের মধ্যেকার যন্ত্রণাটাকে উড়িয়ে নিত। ইশশ… আজ পুষ্পটা কেন পাশে নেই !!

💚💚💚💚💚

— পুষ্প তুই কান্নাটা বন্ধ কর প্লিজ। প্লিজ পুষ্প !

একুশবারের বার যখন এই কথাটা বলল নীরা… বেশ জোরের সাথেই বলল। তাতে পুষ্পর কান্নার বেগ আচমকাকমে আসায় একের পর এক হেঁচকি উঠতে শুরু হয়েছে। কিছুতেই আটকাতে পারছেনা ও। শেষে পানি খেয়ে পিঠ চাপড়ে চাপড়ে হেঁচকি থামানো হল ওর।

— নীরা… সায়ন ভাই… ওর গার্লফ্রেন্ড আছে !

— সায়ন ভাই ! একে কোথায় পেলি !

— গতকাল আব্বার সাথে ঢাকা গেলাম না ! আব্বা আমাকে দাঁড় করায়ে ব্যাঙ্কে ঢুকেছিল। আমি দোকানে ঘুরতেছি এমন সময় এক মেয়ে দেখি দৌড়ে এসে গাড়ি চলার রাস্তাতে। তখনি একটা গাড়ি ওকে ধাক্কা দেয়। আমি গিয়ে তাকে হাসপাতালে দিয়ে ফিরব ফিরব এমন সময় সে এল।

— আহহহ… কাদিঁস না প্লিজ !! তোকে চেনেনি ?

— কিভাবে চিনবে ? নিকাব-

— কাউকে ভালবাসলে চোখ দেখেই চেনা যায়। বুঝলি ? আচ্ছা পুষ্প… তুই কেন সায়নভাইয়ের পিছনে এত পাগল ? সে তো গত ছয় বছরে তোর মুখ ও দেখেনি ! কেন তোর এত টান ?

— আমি… আমি জানিনা !! কিচ্ছু জানিনা… নীরা…

— বল

— যে বয়সটাতে এসে মেয়েরা প্রথম প্রেমের… ভালবাসার এই দুনিয়াটাতে পা রাখে… আমি সে সময় কেবলি সায়ন ভাইয়ের সাথে এই দুনিয়ায় পা দিয়েছি। সশরীরে সে না হোক… তার স্মৃতি… তার প্রতি আমার মনের টান…

— এখন সেটা মুছে ফেলা উচিত না ? যখন জানলি সে অন্য কাউকে ভালবাসে ?

— পারছিনা মুছতে !! আর চাইও না। আমি ধৈর্য ধরব। আল্লাহ তাকে আমার জন্য নির্ধারণ করে থাকলে সে আমারই হবে।

— অ্যা !!

— হুম। নীরা… সে একটা হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। যদি সে বিবাহিত হত তবে আমি তাকে আর মনেও আনতাম না। কিন্তু তা তো নয় ! তাই আমি অপেক্ষা করব। যদি আমার তাকদীর অন্য কারুর সাথে থাকে তা আমি সেদিনই মানব যেদিন আমার বিয়ে হবে। ততদিন… অপেক্ষা করতে দোষ কি !

— বোন… তুই কি জানিস যে তুই নিজেকেই বোঝালি এতক্ষন ধরে !! আচ্ছা… অপেক্ষা কর তোর সায়নের জন্য। পরে ছ্যাঁকা খেয়ে বেঁকে গেলে আমায় ডাকিস না কান্না থামাতে।

— আহহা জানু রাগ হচ্ছ কেন ! আম্মা তোর জন্য ইলিশ ভাজা আর মুগের ডাল রান্না করছে তো। খেয়ে যাবি না ?

— উম্মম্ম… হু । জাস্ট ফর খালাম্মা। তোর জন্য না।

— 😙😙😙

💛💛💛💛💛

প্রচণ্ড জ্বরে কাতর সায়ন। রোদে রোদে ঘুরে জ্বর এসে পড়েছিল। সেদিন রাতে মেসে ফিরেই জ্বরে পড়েছে। বন্ধুরা ভয় পেয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করে দিয়েছে। আজই ভাল করে জ্ঞান এল ওর… আর চোখ খুলেই সাইকার মুখ দেখে ভ্রু কুঁচকে চোখ বুজে ফেলল আবার। এ নেকি এখানে কেন !

— জান… আয়াম সো হ্যাপি ! বাপিইইই… দেখ সায়ন চোখ মেলেছে ! এই সায়ন… দেখতে পাচ্ছ ? বল তো আমি কে ?

— তালগাছের শাকচুন্নি।

— কি বললে ?

— নাথিং। তুমি এখানে ?

— ত আর কে থাকবে ! টেনশন দিতে চাইনা তাই তোমার রিলেটিভস কে খবর দেইনি আর। আমিই তো আছি… আর কাকে লাগে বল ! তোমার জন্য বেস্ট নার্স এপয়েন্ট করে দিয়েছে বাপি। বেস্ট ডক্টরস তোমার খেয়াল রাখছে-

— সাইকা এটা জাস্ট একটা নরমাল জ্বর ! এত কাহিনি করতে কে বলেছে !

— সায়ন বাপি আর আমি তো তোমার জন্যই এতকিছু করেছি। অকারনে রাগারাগি করছ কেন ?

— ওহহহ আয়াম সো সরি সাইকা ডিয়ার ! ভুলেই গেছিলাম তোমার সাথে রাগ করা যাবেনা।

— আহ সায়ন !!

— তোমার আম্মু এসেছেন।

— অহ… মাম্মা ! বসবে ওর কাছে ? তাহলে আমি বের হব… একটু কাজ আছে !

— হু… যা।

সাইকা চলে যেতে নাসরিন সায়নের পাশে বসে ওর মাথায় একবার হাত রাখলেন। এরপর বসে রইলেন চুপচাপ। সায়ন অস্বস্তি নিয়ে দেখছে তাঁকে।

— বাবা… তুমি সাইকার উপর রাগ হইও না। একটু ধৈর্য ধর। সাইকা আর ওর বাবা অমনই। আমি তোমার সাথে আছি ।

— আন্টি… আঙ্কেল এমন করলেন কেন ?

— জানো কি বাবা… লোকটা পাষাণ কিন্তু নিজের মেয়েকে জান দিয়ে ভালবাসে। তার এই ভালবাসাই সাইকা কে এরকম বানিয়েছে। সাইকা তোমায় ভালবাসে… আর ওর বাবা যেকোন মূল্যেই হোক মেয়েকে কষ্ট পেতে দেবেনা তাই তোমার উপর চাপ ফেলছে। আমি… তোমার দিক টা বুঝছি। সাইকাকে দেখে ভাল লাগলেও ওর কাজকর্ম…

— বাদ দেন আন্টি। আমি দেখব।

বলল বটে… কিন্তু দেখবে টা কি ? সাইকার জালে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছে ও। কূল পাচ্ছেনা যে তা ধরে এগুবে।

💚💚💚💚💚💚

দুদিন আগে পুষ্পর দাদির শরীর অনেকখানি খারাপ করেছে। হার্ট এটাক করেছে তার। পুষ্পরা থাকে গাজীপুর সদরে। কাছের হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেলে রেফার করায় আজ দুদিন হয় ওরা সকলেই ঢাকায় রয়েছে। ঢাকায় পুষ্পের চাচার বাসাতে উঠেছে তারা।

আজ নীরা এসেছে দাদিকে দেখতে। দাদির শরীর অনেকটা ভাল বোধ হওয়ায় পুষ্প আর নীরা মিলে হাসপাতালে ঘুরতে বেরিয়েছে। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরছে এমন ভঙ্গিতে যেন কোন আত্মীয়কে দেখতে এসেছে। মাঝে মধ্যে থেমে এক দুজন রোগির সাথে কিছু কথাও বলে নিচ্ছে একজন। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে ১৩ তলার মেল ওয়ার্ডে ঢুকল দুজনে… হাসাহাসির মাঝেই আচমকা নিস্তব্ধ হয়ে গেল পুষ্প।

সায়ন বেডে শুয়ে আশেপাশের মানুষ পর্যবেক্ষন করছে। এই সময় দুটো তরুণী মেয়ে ঢুকল ওয়ার্ডে। হয়ত কারো আত্মীয়… ভেবে পাত্তা দিল না ও। কিন্তু দুই বোরখাওয়ালির মাঝে একজনের চোখদুটি… মাথা নামিয়ে দাঁড়াবার ভঙ্গিটা খুব পরিচিত একজন কে মনে করিয়ে দিচ্ছে কেন !!

অপলক পুষ্পের দিকে তাকিয়ে আছে সায়ন। আর ওদিকে পুষ্পের চোখ ভরে কান্না আসছে। নিশ্চয়ই কিছু করেছে সাইকা ডাইনিটা। নইলে অসুস্থ হবে কিকরে ! ওমা… সায়ন ওকেই ডাকছে নাকি !

— এইযে… মিস, একটু শুনবেন ?

পুষ্প দু একবার নীরার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে সায়নের বেডের কাছে গেল।

— আমাকে ডাকলেন ?

— জি। আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো ! এত চেনা চেনা লাগছে!

— আমি… আপনার গার্লফ্রেন্ডকে হস্পিটালে নিয়ে গিয়েছিলাম।

— ও আপনিই সেই ! কেন নিলেন… মরলে হাড় জুড়াত আমার !

— নাউজুবিল্লাহ ! কারো জন্য বদদুয়া করবেন না সে যতই খারাপ হোক।

— ও খুব খারাপ একটা মেয়ে-

— আপনিও এমন কিছু ভাল লোক নন।

— জি !

কথা শেষ হবার আগেই পুষ্প পগাড়পার হয়ে গেছে। ভয়ঙ্কর লজ্জায় বারান্দায় কোনে গিয়ে বসে রইল। পায়ে জোর পাচ্ছেনা। মুখ ফস্কে এ কি করল ও !! বকে দিল সায়ন কে !! সায়ন চিনে ফেলবে না তো !! কি হবে !!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here