#একই_সুতোয়_বাঁধা
পর্ব-১২
সপ্ত শীখা
পুষ্প সাথে আসা বাক্সটা নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজাটা আটকে দিলো। আছিয়া হাসিমুখে নিজের কাজে গেলেন… কেবল দাদি চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন নাতনির পথে…
বাক্সটা খুলতে ইচ্ছা করছেনা পুষ্পর। সামনে ওটাকে রেখে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে ও। হাত বুলাচ্ছে বাক্সের গায়ে। এবার আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করল। মোড়ক খুলতেই একটা চ্যাপ্টা প্যাকেট বেরুলো। সেটা সরিয়ে ভিতরে উঁকি দিল ও। ভিতরে আরো একটা মাঝারি প্যাকেট, একটা লাল টুকটুকে ছোট বাক্স আছে। আর একটা মিষ্টি চেহারার কমলা খাম।
চ্যাপ্টা প্যাকেট টা খুলল পুষ্প। বড় একটা বাঁধানো ছবি বেরুতেই চোখগুলো বন্ধ করে ফেলল মেয়েটা। কেন যেন এই বদ্ধ ঘরেও খুব লজ্জা লজ্জা করছে ! আচ্ছা… সায়ন কখনো সামনে এসে দাঁড়ালে কি পুষ্প এভাবেই লজ্জা পাবে ? না মুখঝামটা দিয়ে লজ্জাকে তাড়িয়ে দেবে ?
ছবিটা দেখে অজান্তেই মুখে হাসি এসে গেল পুষ্পর। ওর আর সায়নের ছোটবেলার একটা ছবি। এত মায়াবি !! ছবিটা তুলেছিলেন লাইলি বেগম… সায়নের মা। পুষ্প সায়নের বকা খেয়ে বসে বসে প্রচুর কান্না করছিল আর সায়ন ওর সামনে হাঁটু গেড়ে সরি বলতে আসায় পুষ্প বলেছিল, “কান ধরো”। সেই কানে ধরা সায়ন আর তার সাম্নে ক্রন্দনরতা পুষ্পর পুরোনো ছবিটা আজ বাঁধিয়ে পাঠিয়েছে ও।
বহুক্ষন ছবিখানা জড়িয়ে ধরে রইল পুষ্প। চোখের জলে গাল ভেসে যাচ্ছে। কি দরকার ছিল সায়নের… আজ জন্মদিনের দিনেই পুষ্পকে কাঁদিয়ে দেয়ার !
মাঝারি প্যাকেট টায় একটা শোপিস। বড় সুন্দর। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। মেয়েটা দোলনায় বসে আছে আর ছেলেটা দোল দিচ্ছে তাকে। পুরো জিনিস টাই স্মৃতি বয়ে আনল পুষ্পর মনে। ও বড্ড দোলনা চড়তে ভালবাসত। তবে একা। আর সায়নের কাজ ছিল দোলনা দোল দেয়া। বেজার মুখে সায়ন দোলনা ঠেলত আর পুষ্প আরাম করে দোল খেত।
শেষ যে লাল টুকটুকে প্যাকেট টা, সেটি খুলতে ভেতর থেকে চিকন একটা মখমলি বাক্স বেরুলো। দুরুদুরু বুকে খুলল পুষ্প। ভেতরে অপরূপ সুন্দর একটা রুপোলি কারুকাজ করা চেইন আর একটা অসাধারণ লকেট। কি সুন্দর !! পুষ্প তুলে নিয়ে আয়নার সামনে চলে এল। পরে নিলো গলায়। আয়নার মাঝে দেখা যাচ্ছে অপূর্ব একটা দৃশ্য… মিষ্টি এক তরুণি গলায় লকেট পরছে আর ওদিকে চোখের জলে তার গাল ভেসে যাচ্ছে !
চুলগুলো খুলে দিলো পুষ্প। অমনি পিঠ ছাপিয়ে পড়ল চুল… কি যে ভাল দেখাচ্ছে ওকে হারটা পরে !! খুলে বাক্সে ভরে রাখল আবার। সায়ন যদি ওর ভাগ্যে থাকে তবে ও পরিয়ে দিলেই দ্বিতীয়বার এই হার গলায় উঠবে পুষ্পর। নয়ত কখনো নয়।
সব নামিয়ে এবার খামটা খুলল পুষ্প। ভেতরে একটা চিঠি। সায়নের লেখা।
” এই পুষ্পি,
কেমন আছিস তুই ? কতদিন হয় দেখিনা তোকে ! খুব মিস করছি আজকাল তোকে। তাই এই বার্থডে প্রেযেন্ট গুলো পাঠালাম। টিউশনির টাকায় কিনেছি জানিস ?
পুষ্পি… আমি একটা বড় সমস্যায় আছিরে। সারাটা ক্ষন মনে হয়… আজ পুষ্পিটা থাকলে আমার এত ঝামেলা হতই না ! সারাদিন তোকে মনে পড়ে কেন বল তো ! এতদিন তো এত মনে আসতি না তুই ! এই, তোর কি মনে পড়ে আমাকে ? না ভুলেই গেছিস ?
শোন পুষ্পি… আমাদের ছবিটা তোর বেডরুমের দেয়ালে এমনভাবে টাঙ্গাবি যেন বিছানায় শুলেই দেখা যায়। তারপর সারাদিন আমায় দেখবি। 😀 আর শোপিস টা রাখবি পড়ার টেবিলের একপাশে। আর লকেট টা… ওটা তোর ইচ্ছা। জানি তুই এসব গয়না পছন্দ করিস না তাই। নইলে সারাদিন পরতে বলতাম। অবশ্য বললেই বা কি ! আমি কি দেখতাম !
জানি তুই আমাকে অনেক গালি দিচ্ছিস দেখা করতে আসিনা কেন তাই। আসব না আর। আসার মুখ নেই আমার। যে ঝামেলায় জড়িয়েছি যদি আল্লাহ সেটা থেকে পরিত্রাণ দেন তবে বড় কোন কাজের জন্যেই আসব ইনশাল্লাহ…
ভাল থাকিস পুষ্পিরানী ফরফরানি ! এই চিঠির জবাব দিবিনা একদম। আমি দূর্বল হয়ে পড়ব।
সায়ন। ”
–পুষ্প ! ও মা ! তিন ঘন্টা হইল দরজা খুলনা কেন?
— আসি আম্মা।
পুষ্প দ্রুত সবকিছু গুছিয়ে নিজের আলমারি তে তুলে আয়নার সাম্নে গেল। ইশ কি অবস্থা হয়েছে চোখমুখের ! লাল টুকটুকে হয়ে আছে একেবারে ! মুখ ভাল করে পানি দিয়ে ধুয়ে নিয়ে একটু পাউডার দিয়ে রুম থেকে বের হল পুষ্প।
♏️♏️♏️♏️♏️
সায়ন চিত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। গরম লাগছে। শীত আসি আসি করছে তবু গরম চলবেই ! আর মেসে ত গরমের মাত্রাটা ডবল হয়ে যায় যেন। তবে আপাতত গরমটা গায়ে লাগছেনা ওর। ভাবছে গিফট গুলো পেয়ে পুষ্প কি করবে। আজ পাঠাতে বলেছিল গিফট গুলো। এতক্ষনে হয়ত খুলেও ফেলেছে পুষ্প। কি ভাবছে ও ? কাঁদছে না হেসে উঠেছে??
বিকট শব্দে ফোন টা বেজে উঠে পিলে চমকে দিলো সায়নের। বিরক্ত হয়ে তুলে দেখে সাইকার কল এসেছে। ফোন টা আছড়ে বিছানার উপর ফেলে দিলো আবার। এই অসহ্য মেয়েটা কেন সবসময় সুন্দর মুহূর্ত গুলোকে নষ্ট করে !!
— সায়ন ! ফোন রিসিভ করছ না কেন ?
সায়ন চমকে তাকাল। দুই মিনিটে সাইকা দরজায় এসে গেল কি করে !
— তুমি এখানে ! তোমাকে না বলিছি এটা ছেলেদের মেস এখানে আসবেনা এমন হুটহাট !
— আমি বুঝব সেটা… তুমি ফোন ধরনাই কেন ?
— ভাল্লাগছিল না। কোন দরকার ?
— হু… চল বাপি একবার মিট করতে বলেছে।
— বল্লেই মিট করব নাকি ?
— সায়ন ! বাপির সম্পর্কে এইভাবে কথা বল্লে আমি কিন্তু… whatever, উঠে শার্ট পর তাড়াতাড়ি।
সায়ন বিরক্ত মুখে উঠল। সাইকা দরজাতেই দাঁড়িয়ে আছে বেহায়ার মত। সায়ন শর্টসের উপরে প্যান্ট পরে শার্ট হাতে নিতেই সাইকা হুট করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল ওকে।
— বেবি… এত হট ক্যান তুমি ? খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে।
— আহ সাইকা ছাড়ো তো। মেসের ভেতর এসব… কান্ডজ্ঞ্যান নেই তোমার ?
— যার খুশি দেখুক… হু কেয়ারস ? আমার বিএফ কে আমি ধরেছি…
— আমি কিন্তু হাসবেন্ড না। হাসবেন্ড ছাড়া কাউকে এভাবে ধরতে নেই সাইকা।
সাইকা সায়ন কে ছেড়ে দিয়ে হাসতে শুরু করল। চোখ দুটি অবশ্য রাগে জ্বলছে ওর।
— প্রেম ভালবাসাও তো বউ ছাড়া কাউকে করতে নেই… তুমি কেন করেছিলে হুম ? ফতোয়া দিতে এসেছে…
সায়ন মনে মনে বলল, ” ওই একটা হারাম আজকে আমার পুরা জীবন টা হারাম করে ফেলেছে। খাওয়া ঘুম হারাম আজকে আমার অই একটা ভুলের জন্য। আল্লাহ… কত আর ক্ষমা চাইব ? এইবার মুক্তি দাও এর হাত থেকে !”
সাইকা ততক্ষনে টেনে সায়ন কে নিচে নিয়ে গেছে। গাড়িতে বসেছে উঠে। বিশাল গাড়ি। ভেতরে এসি চলছে। কালো কাঁচে ঢাকা। সায়নের বন্দি ভাবটা সবচে প্রবল হয় এদের গাড়িতে আর বাড়িতে। মুক্ত বাতাসের কোন প্রবেশাধিকার নেই।
সাইকা গাড়ির ভেতরে ইচ্ছা করেই সায়ন কে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। সায়ন ছাড়াতে চেয়েও পারছেনা। একদিন যে মেয়ের সামান্য স্পর্শের জন্য বুভুক্ষু হয়ে রইত, আজ তার এই স্পর্শ বিষের মত লাগছে।
কবে যে ছাড়া পাবে সায়ন ]