#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_১৬
#সুমাইয়া_মনি
আমেরিকার মাটিতে এই প্রথম ইসানা পা রেখেছে। এখানের কালচার বাংলাদেশের তুলনায় অনেকটা পার্থক্য রয়েছে। মেয়েদের ওয়েস্টার্ন ড্রেসআপে দেখা যায়। এয়ারপোর্ট থেকে বের হবার সময় অনেককেই ছোট ছোট পোষাকে দেখা গিয়েছে।
অবশ্য ইসানা নিজেও জিন্সেট প্যান্ট, শার্ট ওপরে কালো রঙের জ্যাকেট পরিধান করেছে। সে-সব মেয়েদের সঙ্গে তা অনেকটাই মিলে যায়। এখানের আবহাওয়া অনেকটা শীতল। সকলের গায়েই জ্যাকেট রয়েছে। তারা ট্যাক্সি করে হোটেলে চলে আসে। বিকেলে মিটিং আছে তাদোর। তাই আপাতত রেস্ট নিচ্ছে তারা। আমেরিকায় এখন প্রায় দুপুর। সবাইকে আলাদা আলাদা রুম দেওয়া হয়েছে। রাদ ও ইসানার রুমটি ছিল একদম মুখোমুখি। ইসানার পাশাপাশি রুম দু’টি ছিল মুরাদ ও লিসার। রাদের অপর পাশে ইমরানের রুম ছিল। যে যার মতো ফ্রেশ হয়ে নেয়। মুরাদ তার বাবা-মাকে ফোন করে জানানোর পর সোহানাকে কল দেয়।
‘পৌঁছে গেছেন?’
‘হ্যাঁ! অনেক আগেই। কি করছো?’
‘কাজে আছি। আপনি?’
‘হেই তুমি করে বলো না আমাকে। এমনিতেই তো আমি তোমার পিচ্চি হবু বর। নাকি এটা বলতেও সময়ের প্রয়োজন।’
‘হুম। লাগবে সময়।’
‘নেও, নেও। আমি তো টেনসনে আছি তোমাকে নিয়ে।’
‘কেন?’
‘বাসর রাতে বলে না বোসো আমার সময় প্রয়োজন। তখন….’
অপর পাশ থেকে কল কাটার টু টু শব্দ ভেসে আসল। কান থেকে ফোন সরিয়ে মুরাদ দেখল সোহানা কল কে’টে দিয়েছে। ফিক করে হেসে দেয়। সোহানার লজ্জার কারণটি সে বুঝতে পারে। একা একা হাসে কতক্ষণ। তবে আর কল দেয় না।
এদিকে লজ্জায় সোহানার হাত-পা জমতে আরম্ভ করেছে মুরাদের কথাগুলো শুনে। সে মারা’ত্মক বিব্রতবোধ করে।
আনমনে হেসে ফেলে সে নিজেও।
.
কিছুক্ষণ পর পরই ইমরান দরজার বাহিরে উঁকি দিয়ে দেখছে ইসানা রুম থেকে বের হয়েছে কি-না। কয়েকবার কল দিয়েছে সঙ্গে মেসেজ পাঠিয়েছে বাহিরে আসার জন্য৷ কিন্তু ইসানার কোনো খবর পাত্তা নেই। পরিশেষে সে চিন্তাভাবনা করে দরজায় করাঘাত করবে। ডেকে জিজ্ঞেস করবে ‘এতবার আসতে বলার পরও কেন আসছে না বাহিরে।’
সাহস জুটিয়েও এগোতে পারছে না। যদি তারা কেউ দেখে ফেলে এই ভয়ে। রিস্ক না নিয়ে সে অপেক্ষা করে।
অপেক্ষা করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। বোরিংনেস এসে জড়ো হয়। ঘুম পাচ্ছে তার। এখন ঘুমালে চলবে না। মিটিংয়ের জন্য রেডি হতে হবে। রাদ সবাইকে আগেভাগে বের হতে বলে। কারণ মিটিংয়ের আগে তারা একটি নতুন ফ্যাক্টরিতে যাবে। সেখানের কাপড় গুলোর ডিজাইন দেখতে। একত্রে মাইক্রোতে উঠার পর ইমরান ইসানাকে টেক্সট করে জিজ্ঞেস করে ‘সমস্যা কী? আসোনি কেন?’ ইসানা ইমরানের টেক্সট পড়ে ওর পানে তাকালে পরে সে ভ্রু উঁচু করে। তবে ইসানা জবাব দেয় না। ফোন সাইলেন্ট করে চুপচাপ বাহিরে তাকিয়ে থাকে। ইমরানের ইশারাসূচক বার্তা রাদের নজর এড়ায়নি। গাড়ির ওপরের অংশে রাখা আয়নাটিতে সব দেখেছে। চোখেমুখে তার ক্ষ্যা’পা’টে ক্রোধ। নিজেকে নরম শান্ত করার চেষ্টা করলেন। তার সহ্য হয়না ইসানার ওপর কেউ আগ্রহ দেখাক। কথাবার্তা বলুক তা তো প্রশ্নই আসে না! দশ মিনিট পর তারা পৌঁছে যায় সেই ফ্যাক্টরিতে। সেখানের ম্যানেজার তাদের সম্মানের সাথে ভেতরে নিয়ে আসে। কাপড়ের ডিজাইন, মানসম্মত দেখে তারা কিছুক্ষণ পর চলে এলো মিটিংয়ের জন্য। গ্রিন কোম্পানির ভেতরে আসার পর তাদের মিটিং রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। রাদ ইসানার পাশে বসেছিল। চুপিসারে ইসানাকে জিজ্ঞেস করে,
‘কাল রাতে যে ফাইলটি দিয়েছিলাম সেটির কাজ সম্পূর্ণ করেছেন?’
‘হ্যাঁ! করেছি।’
‘গুড!’
ইসানার কাল রাতের কথা মনে পড়ে। এগারোটার দিকে রাদ ইসানাকে একটি ফাইলের ডকুমেন্টস তৈরী করতে বলে। ইসানা অর্ধেক রাত জেগে ডকুমেন্টসটি তৈরী করে। যে ইংরেজি গুলো তার বুঝতে অসুবিধা হয়েছে, সেগুলো গুগলের সার্চ করে বের করে সমাধান করেছে। বহু কষ্ট পোহাতে হয়েছে রাতে। সে খুব করে চাইছে তার স্থান যেন লিসার মতো পরিপোক্ত হয়। কয়েক বছর যদি না সে গ্যাপ দিতো, তবে আজ তার এতটা সমস্যায় পড়তে হতো না।
সে দমে থাকবে না। নিজ যোগ্যতায় এগিয়ে যাবে। ভাবনার মধ্যে ব্যাঘাত ঘটে কোম্পানির ম্যানেজারের আগমনে।
সবাই উঠে দাঁড়ায়। রাদ, মুরাদ হ্যান্ডশেক করে আসন গ্রহন করেন। ইসানার কপাল ঘুচে আসে ম্যানেজারকে দেখে। অতিচেনা পরিচিত লোক মনে হচ্ছে তাকে দেখে। কিন্তু সে মনে করতে পারছে না ওনি কে? তাকে কোথায় কখন দেখেছে মনে নেই তার। রাদ ঠোঁটে মাধুর্যময় হাসি ফুটিয়ে তার উদ্দেশ্যে বলল,
‘সো মি.ইভান আহমেদ শুরু করতে পারি প্রেজেন্টেশন?’
বিষ্ণুর চক্র ইয়াং প্রকৃতির ইভান আহমেদ সানগ্লাস চোখ থেকে নামিয়ে মৃদুহেসে জবাব দেয়,
‘অবশ্যই!’
কা’টা যুক্ত তীর তীব্রভাবে ইসানার হার্টে এসে বিঁধল ইভান নামটি শুনে। ইভানের চোখের পানে চেয়ে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো। চিরচেনা পরিচিত লোকটি যে তার প্রাক্তন স্বামী ইভান আহমেদ। যে কি-না তাকে অস্বীকার করে বিবাহর পরদিন বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিল। যার জন্য অপেক্ষা করেছিল কয়েক বছর। ফিরেনি সে, নিরাশ হয়েছে প্রতিটা প্রহর। বুকে পাথর ফেলে ডিভোর্স দিয়েছেন তাকে। ইসানা চমকে উঠলো। ধ্যান ভাঙল তার রাদের ডাকে। সেখানে উপস্থিত সকলের নজর ইসানার ওপর।
‘আপনি ঠিক আছেন?’
ইসানা চোখ পিটপিট করে কম্পিত গলায় বলল,
‘হ..হ্যাঁ!’
‘আপনি প্রেজেন্টেশন দিন।’
ইসানা নিরুত্তর হয়ে বসে থাকে। সে আজ তৃতীয় বারের মতো ভেঙে পড়েছে। বিধাতা কেন তার সঙ্গে এমনটি করছে বার বার। এ কেমন লীলাখেলা তার? সেই ভয়ং’কর অতীত থেকে বেরিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। তবে কেন আবার এরূপ পরিস্থিতির স্বীকার হতে হচ্ছে। গলা ফাটিয়ে কান্না আসছে। কষ্টে নয়, ক্রোধে! এখন তার অতীত নিয়ে আফসোস হয়না। বরঞ্চ রাগ হয়। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নেয়। চটপট সে উঠে দাঁড়ায়। ফাইলটি হাতে নিয়েই হোয়াইট বোর্ডের সামনে দাঁড়ায়। রুমটির পুরো লাইট অফ করে হোয়াইট বোর্ডের লাইন অন করা হয়। সেখানের কম্পিউটারে পুরো প্রজেক্টের ড্যামো তুলে ধরা হয়। ইসানা তার লম্বা জ্যাকেটটা খুলে চেয়ারের ওপর রেখে প্রেজেন্টেশন আরম্ভ করে। সকলে মনোযোগ দিয়ে ইসানার প্রেজেন্টেশন শুনে। টানা ছয় মিনিট ইসানার প্রেজেন্টেশন চলে। রাদ ইসানার প্রেজেন্টেশনে মুগ্ধ হয়। ইসানার কথা বলার কনফিডেন্স ও স্টাইলে মন্ত্রমুগ্ধ হয় ইভান নিজেও। সাত মিনিট বিশ সেকেন্ডে ইসানার প্রেজেন্টেশন শেষ করে। সবাই হাতে তালি দিয়ে সম্বর্ধনা প্রদান করে। তালির মাধ্যমে লাইট জ্বালানো হয়। ইসানা শক্ত ভঙ্গিতে নজর অন্যদিকে সরিয়ে রাখে। ইভান মুচকি হাসি প্রধান করে ইসানার উদ্দেশ্যে বলল,
‘চমৎকার প্রেজেন্টেশন ছিল। মি.রাদ আমি আপনাদের কোম্পানির সঙ্গে ডিল কনফার্ম করলাম।’
রাদ উঠে ইভানকে ‘থ্যাংকস’ জানায়। ইসানার পরিচয় জানতে চাইলে রাদ পি.এ বলে পরিচয় দেয়। ইভান উঠে ইসানার দিকে এগোয়।
‘হ্যালো মিস.ইসানা ইবনাত।’ বলতে বলতে হাত বাড়িয়ে দেয় হ্যান্ডশেক করার জন্য। ইসানা কিয়ৎক্ষণ শক্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
‘হাই! দুঃখিত, হ্যান্ডশেক করতে পারছি না।’
ইভান অপমানিত হয় কিছুটা। হাত সরিয়ে কথা ঘুরিয়ে বলল,
‘আই লাইক ইউর এ্যাটিটিউড!’
‘থ্যাঙ্কিউ!’ বাক্যাটি শেষ করে জ্যাকেট হাতে বেরিয়ে যায় ইসানা। লিফটে উঠে প্রথম নাম্বার বাটনে প্রেস করে। রাদ সহ বাকিটা এতে কিছুটা অবাক হয়। তবে লিসা বিষয়টি সামলে নেয়। লিফট জুড়ে ইসানা একা। স্থির হয়ে দৃষ্টি নত রেখে ফুঁপিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বসে পড়ে। এতক্ষণ নিজেকে পাথর মূর্তির ন্যায় সকলের সামনে তুলে ধরলেও এখন সে নিজেকে আটকে রাখতে পারে না। ভেতরটা তার জ্বরে যাচ্ছে। যে ভয়া’বহ অতীত থেকে সে বাঁচতে চাইছে, সে অতীত তার সামনে বিক্ষিপ্তভাবে দাঁড়িয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে দমে যাচ্ছে সে। কিন্তু তার এই চাপা আর্তনাদ কাউকে দেখাবে না। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। ইভান তাকে চিনতে পারেনি। সে তাকে প্রাক্তন স্ত্রী হিসাবে পরিচয় দিবে না। কিছুতেই নাহ!
.
মিনিট দশের পর ইমরান নিচের ফ্লোরে এসে ইসানাকে চারদিকে খুঁজতে আরম্ভ করে। রিসিপশনে বসা এক তরুণীর কাছে জিজ্ঞেস করে খবরবার্তা মিলে না। ইমরান বাহিরে এসে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। কয়েকবার কলও দেয়। রিং হচ্ছে কিন্তু ফোন তুলছে না।
ল্যাম্পপোস্টের স্বচ্ছ আলোর রশ্মি অনুসরণ করে খালি পায়ে টাইসের সরু পথ দিয়ে এলোমেলো পায়ে হেঁটে চলেছে ইসানা।
আকাশে অর্ধগোলাকার চাঁদের ন্যায় নিজেকে ভীষণ একা মনে হচ্ছেন তার। কান্নাগুলো বুকে দলা পাকিয়ে কিছুক্ষণ পর পর দীর্ঘশ্বাস হয়ে বের হচ্ছে। অচেনা এক পুরুষকে মনের এক কোণায় জায়গা দিয়েছিল। দিনের পর দিন তার জন্য অপেক্ষা করেছিল। শ্বাশুড়ির কটুবাক্য শুনেও আশ্বাস দিয়েছে নিজেকে সে ফিরে আসবে! তার জন্য অপেক্ষা করেছিল চারটা বছর। কিন্তু দিন শেষে তাকে নিরাশ হতে হয়েছে। ডিভোর্সী নারীর তালিকায় নাম লিখছে।
খানির সময় স্থির হয়ে দাঁড়ায় সে। আকাশের পানে তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করে আলতোভাবে চোখ বন্ধ করে নেয়। বিড়বিড় করে বলে,
‘হে আল্লাহ! ধৈর্য্য দেও আমায়। ধৈর্য্য দেও!’
পুনরায় বড়ো নিঃস্বাস টেনে পাশের বেঞ্চে বসল। তখনই ভাইব্রেশনে থাকা ফোনটি বেজে ওঠলো। জ্যাকেটের পকেট থেকে ফোনটি বের করে দেখে রাদ কল দিয়েছে। রিসিভ করে। রাদ উগ্রতার সঙ্গে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
‘কোথায় আপনি? ফোন কেন তুলছেন না?’
ইসানা রাদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
‘হোটেলের এড্রেস সেন্ড করুন। আসছি আমি।’ বলা শেষ করেই ফোন রেখে দেয়। ইমরানের টেক্সট ও কল দেখতে পায়। ইসানা লক করে নেয় ফোন। রাদ কিঞ্চিৎ চিন্তিত হয়। তবুও হোটেলের এড্রেস সেন্ড করে দেয় ইসানার ফোনে।
এড্রেস পেয়ে ইসানা টেক্সি নিয়ে রওয়ানা হয়। এগারোটার দিকে সকলে খেতে আসে হোটেলের এডজাস্ট রেস্টুরেন্টে।
সবাই থাকলেও ইমরান ছিল না সেখানে। রাদ মুরাদকে ইমরানের কথা জিজ্ঞেস করতেই ইসানা জবাব দেয়,
‘আসছে সে। এতক্ষণ বাহিরে ছিল।’
‘কেন?’
‘আমাকে খুঁজেছে।’
রাদ ফের কিছু বলতে নিলেই ইমরান ছুটে আসে। সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
‘স্যরি স্যরি!’
রাদ ক্রোধান্বিত চোখে তাকালে ইমরান নজর সরিয়ে নেয়। রাদ তাদের উপেক্ষা করে হাঁটতে শুরু করে সামনের দিকে। ইমরান হাঁটার সময় ইসানার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
‘তোমার জন্য লেট হলো।’
ইসানা শান্তভাবে ধীরে জবাব দিলো,
‘আমাকে খুঁজতে বলিনি আমি।’
‘বেপরোয়া ভালোবাসা তুমি দেখোনি।’
‘দেখতেও চাই না।’
‘ওকে, সানগ্লাস ব্যবহার করিও।’
‘স্টপ!’
‘পারব না।’
ইসানা বিরক্ত হয়ে থেমে যায়। ইমরানও থামে। বাকিরা সামনে হাঁটছে। নিজেকে স্বাভাবিক করে সরস কণ্ঠে ইসানা বলে,
‘আমার থেকে দূরে থাকুন। ভালো হবে আপনার আমার জন্য।’
‘পারব না।’ মুখ ভার করে বলে ইমরাম হাঁটা ধরলো।
ইসানা ইমরানের হাঁটার গতি দেখছে চেয়ে চেয়ে। প্রেম-ভালোবাসার প্রতি তার কোনো ফিলিংস কাজ করে না।
সে যে ভেতর থেকে অ’র্ধ’মৃ’ত! কীভাবে বোঝাবে তাকে জানা নেই তার।
.
.
.#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_১৭
#সুমাইয়া_মনি
পায়চারী করছে রাদ। উত্তেজিত হয়ে নয়, বরং তীব্র রাগ নিয়ে। কিছুক্ষণ আগে রেহানা আনসারীর সঙ্গে দ্রুত কথা শেষ করে আপাতত পায়চারীতে মগ্ন সে। ইমরানের ওপর সে ক্ষি’প্ত। কখন কোথায় ওঁকে কথার মাধ্যমে হেনস্তা করে বসে নিজেও জানে না। সঙ্গে উত্তম-মধ্যম ফ্রী! গায়ে পড়ে ইসানার সঙ্গে কথা বলছে। অধিকার দেখাচ্ছে। যেটা তার একদম অপছন্দ।
রাদের পায়চারীর এক পর্যায়ে মুরাদের আগমন ঘটে।
ওঁকে ক্রোধান্বিত দেখে কারণ ধরে ফেলে। মেজাজ আরেকটু বিগড়াতে সে বলল,
‘শোন রাদ, ইমরানের সঙ্গে ইসানা আপুকে বেশ মানায়। আর এমনিতেও ইমরান ইসানা আপুর থেকে বড়ো। একদম পারফেক্ট জুটি হবে কী বলিস?’
কা’টা ঘা’য়ে নুনেরছিটে পড়েছে। জ্বলছে বিক্ষিপ্তভাবে। রাদ ফুঁসে তাকিয়ে বলল,
‘ইউ মেড, আই হেইড দিস পার্সোন। স্টপ ইট!’
‘তোর লাগছে কেন? তারও তো একটা ভবিষ্যত আছে তাই না।’
‘তো ইন্টারফেয়ার কে করলো?’
‘তুই করছিস।’
‘সেটআপ!’
‘কখনো স্টপ বলিস, কখনো সেটআপ বলিস। আসলে আমি করবটা কি?’ মেকি রাগ নিয়ে বলল মুরাদ।
‘আপাতত তুই প্লিজ চুপ থাক। আমাকে ভাবতে দে।’
‘ভালোবাসা কীভাবে আপুকে বলবি সেটা?’
রাদ তড়িঘড়ি হ্যাঁ বলে ফেলে। পরক্ষণেই তার মনে হয় সে ভুলে হ্যাঁ বলেছে। মুরাদের পানে তাকাতেই ওঁকে মিটমিটিয়ে হাসতে দেখে। রাদ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেডে দপ করে বসে।
মুরাদ হেসে রাদের পাশাপাশি বসে বলে,
‘ভালোবাসা এমন একটি জিনিস যার উপরে আসে, তীব্রভাবে আসে। তুইও ভালোবাসা নামক রোগে আ’ক্রা’ন্ত। মেনে নে বিষয়টি।’
রাদ নরম ভঙ্গিতে তাকিয়ে সরসা কণ্ঠে বলল,
‘এটা ভালোবাসা?’
‘হুম, ইসানা আপুকে ভালোবেসে ফেলেছিস তুই।’
রাদ নজর সরিয়ে নেয়। মস্তিষ্ক জুড়ে ইসানার সঙ্গে অতিবাহিত সময় গুলো ভাবছে। তার জীবনে প্রথম ভালোবাসা বলতে ইসানাই! সে কখনো ভালোবাসার স্বাদ গ্রহণ করেনি। লাইফে অনেক মেয়েদের কাছ থেকে প্রেমের প্রপোজাল পেয়েও প্রত্যাখ্যান করেছে। কোন গুনে, কোন মায়া মুগ্ধতায় ইসানার ওপর আটকে গেছে বেমালুম!
হৃদমাঝারে বিন্দু বিন্দু ন্যায় বিশাল জায়গা করে নিয়েছে সে। রাদের চৈতন্য ফিরে মুরাদের স্পর্শে। কাঁধে হাত রেখে মুরাদ নরম স্বরে বলে,
‘রাদ শোন।’
‘বল।’
‘সোহানার মতো ইসানা আপুর জীবন না। সে কিন্তু ছোট থেকেই অনেক কষ্ট করেছে।’
রাদ প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকায়। ইসানার সম্পর্কে তার তেমন কোনো ধারণা নেই৷ মুরাদের মুখে ইসানার ক্লেশময় কথা শুনে কিছুটা থমকালো। মুরাদ হাত সরিয়ে সরু নিশ্বাস নেয়। বলে,
‘সোহানা আমাকে সব বলেছে আপুর বিষয়ে। মামার সংসারে বড়ো হয়েছে সে। মামা পছন্দ করতো না। এজন্য নানান কষ্ট পোহাতে হয়েছে। তার অমতে যৌতুক দিয়ে বিয়ে দেয় তার মামা। স্বামী আপুকে অস্বীকার করে পরদিনই পালিয়ে যায় বিদেশে। সেখানেও সুখী হতে পারেন না তিনি। চার বছর শত বেদনা লাঞ্ছনা নিয়ে স্বামীর অপেক্ষায় সে বাড়িতেই রয়ে যায়।
ফিরে না সে। শেষে ডিভোর্স পেপার পাঠান হয়। বিয়ের বন্ধন ছিন্ন করে সোহানার কাছে উঠে। সেখান থেকেই তার জব হয় তোর ফ্যাক্টরিতে। তোর অগ্রীম টাকা গুলো মামাতো বোনের বিয়ে উপলক্ষে দিয়েছে ইসানা আপু।’
রাদের মনে পড়ে সেদিনের কথা। জরিমানার টাকা চাওয়ার পর ইসানা টাকা নেই বলে জানিয়েছিল। এখন রাদ টাকা না থাকার কারণটি বুঝতে পারে। তার প্রতি ভালোবাসাটা যেন তিরতির করে বৃদ্ধি পেলো।
‘তাকে ভালোবেসে আগলে রাখবো। বিন্দুমাত্র কষ্ট তার ধারেকাছেও ঘেঁষতে দিবো না।’
‘খুশি হলাম দোস্ত!’ মুরাদ হেসে বাহবা দিয়ে বলল।
‘সে কি আমায় ভালোবাসবে?’ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল।
‘মন জয় করে নিতে হবে।’
নিরুত্তর থাকে রাদ। মুরাদ রাদকে কিছু আইডিয়া দেয়।
রাদ সেগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে।
_
সকালে এক সঙ্গে সবাই নাস্তা করছে। সবার খাওয়ার গতি দ্রুত হলেও ইসানা আনমনা হয়ে খাচ্ছে। চোখ হালকা লালচে। মুখে উদাসিনী ছাপ! রাদ আড়চোখে ইসানাকে বার বার খেয়াল করছে। মনে প্রশ্ন, কিন্তু জিজ্ঞেস করার ওয়ে খুঁজে পাচ্ছে না। ভিতরটা তার বলছে কিছু একটা হয়েছে তার প্রিয়তমার! রাদ স্যুপের বাটির মধ্যে চামিচটি রেখে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
‘কাল গ্রিন কোম্পানির CEO এর সঙ্গে দ্বিতীয় মিটিং। আজকে তোমরা নতুন শহরটি ঘুরে দেখতে পারো।’
‘ওয়াও! কোথায় যাওয়া যায় বলো তো রাদ?’ খুশি মুখে বলল লিসা।
‘নো আইডিয়া।’ রাদ জবাব দিলো।
‘চলো সবাই একত্রে ঘুরতে যাই।’
‘হোয়াই নট! খাবার খেয়ে রেডি হয়ে নেও সকলে।’ মুরাদ বলল।
‘ওকে।’
যাওয়ার জন্য সকলে সম্মতি জানালেও ইসানা বলে না কিছু। সবার আগেভাগে খাবার অর্ধেক রেখে কামরাতে ফিরে আছে। রাদ প্রচণ্ড অবাক হয়। কালকের দিন থেকেই ইসানার এমন অদ্ভুত আচরণ মানানসই নয়। জিজ্ঞেস করতেও দ্বিধাবোধ কাজ করছে। মুরাদ রাদের চিন্তিত ফেইস দেখে বুঝে নেয় বিষয়টি। হঠাৎ রাদের হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট আসে। সেটি করেছে ইভান। ফোন ওপেন করে ইভানের বার্তাটি পড়ে কপাল কোঁচকায় রাদ। কারণ ইভান ইসানার ফোন নাম্বার চাইছে। রাদ প্রথমে দিতে না চইলেও পরক্ষণে নাম্বার সেন্ড করে। ইভান ‘থ্যাংকস’ বার্তাটি পাঠিয়ে ইসানার নাম্বারে কল দেয়। বেডে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল ইসানা। কাল রাত তার নির্ঘুম কেঁটেছে। পুরো প্রহর কেটেছে যন্ত্রণাদায়ক পুরনো স্মৃতিতে। চোখ জ্বালাপোড়া করছে। মোটা মোটা অশ্রু বর্ষিত হচ্ছে। হঠাৎ বিদঘুটে আওয়াজে ফোনটি বেজে উঠে। ইসানা আলতোভাবে চোখের পানি মুছে ফোন হাতড়িয়ে পীক করে। নাক টেনে সালাম দেয়। ইভান সালামের জবাব দেয়।
‘চিনতে পেরেছেন?’
‘কে?’
‘ইভান! ইভান আহমেদ।’
নাম শুনে হৃদয়ে তীর যেন এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে বেরিয়ে গেল। চোখ জোড়া আলতোভাবে বন্ধ করে নেয়। তারপর স্বাভাবিক হয়ে বলল,
‘চিনতে পেরেছি।’
‘গুড! হাউ আর ইউ।’
বক্ষে শত বেদনা ধামাচাপা দিয়ে ইসানা বলে,
‘আলহামদুলিল্লাহ! আপনি?’
‘ফাইন। কি করছেন?’
‘নাথিং!’
‘আমরা কি মিট করতে পারি?’
ইভানের এমন প্রশ্নে ইসানা অবাক হয় না৷ শান্তভাবে জবাব দেয়,
‘আমি যেহেতু রাদ স্যারের পি.এ। তার পারমিশন ছাড়া বাহিরে বের হওয়া নিষেধ।’
‘ওকে! কথাটা মাথায় রাখলাম।’
‘রাখছি।’
‘ঠিক আছে। টেক ইয়ার বাই!’
ইসানা ফোন রেখে সেভাবেই শুয়ে থাকে। টুপটাপ অশ্রুগুলো বর্ষিত হচ্ছে বিনাশব্দে।
সন্ধ্যার দিকে রাদ, মুরাদ বাহির থেকে হোটেলে ফিরে। তারা মূলত শপিংমলে গিয়েছিল শীতের পোষাক ক্রয়ের জন্য। ইসানা বাহিরে ঘুরতে যায়নি দেখে বাকিদেরও যাওয়া হয় না। এতে লিসা কিছুটা রেগে আছে। বাংলাদেশের তুলনায় আমেরিকায় অনেক শীত। নিজেদের জন্য ও লিসা, ইসানার পোষাক কিনেছে। রাদ লিসার ব্যাগটি মুরাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘তুই লিসাকে দিয়ে দিস।’
‘ইসানা আপুরটাও দে আমি দিয়ে দেই।’
রাদ সরু চোখে তাকায়। মুরাদ সিরিয়াস মুড নিয়ে বলে,
‘তাকিয়ে লাভ নেই। ব্যাগটি দে আমাকে।’ বলতে বলতে লিসা ও ইসানার দরজায় করাঘাত করল। রাদ ব্যাগ পিছন দিকে সরিয়ে রাখে। মুরাদ পিছনে এসে নিতে নিলে এক প্রকার কাড়াকাড়ির অবস্থা সৃষ্টি হয়।
‘মুরাদ ছাড় বলছি।’
‘তুই ছেড়ে দে।’
‘ছাড়!’ বলেই মুরাদ রাদকে জোরেশোরে ধাক্কা দেয়। রাদ পড়ে যেতে নেয় কিন্তু মুরাদের গলার মাফলারটি খপ করে ধরে ফেলে। যার দরুন মুরাদ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাদের ওপরে উপুড় হয়ে পড়ে আর রাদ দুপাশ করে ফ্লোরে চিৎ!
ইতিমধ্যে ইসানা ও লিসা দু’জনেই এক সঙ্গে কামরা থেকে বের হয়। ওদের দু’জনকে এ অবস্থায় দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে। এই দৃশ্যটি ছিল হালুয়া মিশ্রিত সেদিনের নায়ক-নায়িকাদের রোমান্টিক মুহূর্তের মতো। আজও তারা হতবিহ্বল! এ নিয়ে দ্বিতীয় বার হলো তাদের এমন অবস্থায় দেখেছে তারা। রাদ, মুরাদ দু’জনই লজ্জায় মাখোমাখো। তাদের ইজ্জতভ্রষ্ট! সময় বিলম্ব না করে দু’জনে উঠে দাঁড়ায়। লিসা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
‘কী হচ্ছিল?’
‘এই ইডিয়েট আমাকে ধাক্কা দিয়েছে।’ মুরাদকে দেখিয়ে মেকি রাগ নিয়ে বলল।
‘তাহলে মুরাদ কীভাবে পড়লো।’
‘আমার গলার মাফলার টেনে ধরেছিল।’
‘বুঝেছি, বুঝেছি আর বলার প্রয়োজন নেই। ডেকেছো কেন সেটা বলো।’
মুরাদ শপিং ব্যাগটি এগিয়ে দিয়ে অপরটি দিতে দ্রুত এগিয়ে যায় ইসানার দিকে। সেটি ইসানার নিকট এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘শীতের পোষাক আছে ভেতরে।’
ইসানা শুকনো মুখে ‘থ্যাংকস’ বলে ভেতরে চলে এলো। লিসা দু’জনার উদ্দেশ্যে ব্যাঙ্গ করে বলল,
‘তোমাদের দু’জনার বিহেভিয়ার কাঁপলসদের মতো। আমি বলছি না, যে কেউ দেখলেই বলবে। আগে থেকে সাবধানে থেকো। কেউ আবার তোমাদের লেসবিয়ান না বলে বসে।’ মিটমিটিয়ে হেসে লিসা রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়।
দু’জনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে রেগে বলল,
‘ইতর!’
‘বাঁদর!’
‘সব সময় আমার কাজে বাঁ হাত না দিতে পারলে ভালো লাগে না।’
‘না লাগে না। তুই তো আগে টানাটানি শুরু করেছিলি খাদ।’
‘কথা বলিস না আর।’
‘তুই বলিস না।’ দু’জনে গাল ফুলিয়ে একে অপরের রুমে গেলো।
.
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।