পুনরায় পর্ব ২

#পুনরায়
#অরিত্রিকা_আহানা
#পর্ব:২
মেহরিন একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। কাল সারারাত থেকে মরার মত ঘুমিয়েছে সে। কখন সকাল হয়েছে, সকাল গড়িয়ে দুপুর কোন হুঁশ ছিলো না তার। দুপুরের দিকে রায়হান গিয়ে না তুললে হয়ত আজকে সারাদিন হয়ত এমনি কেটে যেত। তাকে নিয়ে বাসার কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে রায়হান। একরকম জোর করেই নিয়ে এসেছে ওকে। আসার পর থেকে একটা কথাও বলে নি মেহরিন। ঠায় বসে আছে। রায়হান খেয়াল করলো কিছুক্ষন পর পর মেহরিনের ঠোঁট দুটো কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে। মনে হচ্ছে যেন কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে সে।
মেহরিন কোলের ব্যাগটা খামছে ধরলো। অসহ্য লাগছে তার। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে মাহমুদের মুখটা। নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলো না। দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলো। রায়হান হতবাক হয়ে চেয়ে আছে। মেহরিনের আকস্মিক কান্নার কারণ কি হতে পারে সে বুঝতে পারছে না। নিজেকে সামলে ধীরে ধীরে মেহরিনের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—“কি হয়েছে মেহরিন? কোন সমস্যা? আমাকে বলো।”
—“আমার খুব খারাপ লাগছে রায়হান। আমি একা থাকতে চাই।”
—“ঠিক আছে। লাঞ্চ করে যাই? সকাল থেকেই তো না খেয়ে আছো।”
চোখ মুছে সোজা হয়ে বসলো মেহরিন। খাবার আসার অপেক্ষা করে বসে রইল। রায়হান চুপচাপ তাকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। মেহরিনের আকস্মিক মন খারাপের কারণ কি সেটা ওকে খুঁজে বের করতেই হবে। খাবার আসতেই মেহরিন দ্রুত শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। ব্যাগ নিয়ে বললো,
—“আমি একা যেতে পারবো রায়হান। তুমি বাসায় চলে যাও।”
—“তোমাকে পৌঁছে দিয়ে যাই?”
—“আমি বাসায় যাবো না।”
—“কোথায় যাবে?”
—“কিছুক্ষন একা ঘোরাঘুরি করবো। প্লিজ!”
—“ঠিক আছে।”
রায়হান উঠে দাঁড়ালো। তার খাওয়া শেষ। ওয়ালেট বের করে বিল পে করলো সে। মেহরিন কে উদ্দেশ্য করে বললো,
—“চলো।”
দুজনে একসঙ্গে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো। গাড়ির কাছে এসে রায়হান আলতো করে মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—“ঠিক আছে আমি তাহলে যাচ্ছি। বাট ইউ টেইক কেয়ার…!”

বাসায় কাছের এই পার্কটায় মাঝে মাঝে আসে মেহরিন। কখনো কখনো সঙ্গে রায়হান থাকে কখনো বা একা আসে। পার্কের রাস্তা ধরে একা একা হাঁটছিলো সে। হঠাৎ একটা বলের বাড়ি এসে কপালে লাগলো। প্রচন্ড জোরে লেগেছে। মাথা ঘুরতে শুরু করলো। নিজেকে সামলাতে একটা খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। চারদিকটা মনে হচ্ছে ঘুরপাক খাচ্ছে। মেহরিন কপালে হাত চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে আছে। হঠাৎ একটা নরম তুলতুলে হাত তাকে স্পর্শ করতেই চোখ খুললো সে।
—“আর ইউ ওকে মিস? আই এম সরি!”
মুহূর্তের জন্য বাক্যহারা হয়ে গেলো মেহরিন
ফ্যালফ্যাল করে বাচ্চাটার দিকে চেয়ে রইলো। বাচ্চাটার মুখে স্পষ্ট অনুতাপ। মেহরিন এদিক ওদিক তাকালো। সেদিনের সেই বুড়ো লোকটা ছাড়া আর কেউ নেই। কপালের ব্যথা ভুলে গিয়ে হঠাৎ করেই বাচ্চাটাকে প্রশ্ন করে বসলো সে,
—“উইল ইউ টেল মি ইউর ফাদার’স নেইম? প্লিজ?”
বাচ্চাটা ভ্রু কুঁচকে ফেললো। চোখেমুখে বিস্ময় ভাব। তবে জবাব দিল সে। নিখুঁত উচ্চারণে বলল,
—“মাহমুদ সিদ্দিকি!”
—“ডু ইউ নো বাংলা?”
—“ইয়েস। আই নো দ্যাট!”
মেহরিন হাটুমুড়ে তার পাশে বসলো। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে আব্বাস। সুজানের তুলতুলে গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—“তোমার নাম কি বাবা?”
—“সুজান মাহমুদ।”
চোখে পানি, মুখে হাসি ফুটে উঠলো মেহরিনের।সুজানকে বুকে চেপে ধরলো সে। দুগালে অসংখ্য চুমু খেলো। সুজান বিরক্ত হলো। অপরিচিত একজন মহিলা তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে কেন সে কিছুই বুঝতে পারলো না। ছাড়া পাওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি শুরু করলো। আব্বাস মেহরিনকে বাধা দিয়ে বললো,
—“হোয়াট আর ইউ ডুয়িং? লিভ হিম। আই সেইড লিভ হিম!”
ছেড়ে দিলো মেহরিন। সঙ্গে সঙ্গেই দৌঁড়ে গিয়ে আব্বাসের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো সুজান। তার চোখে রাগ। বাঁ হাত দিয়ে গাল মুছছে। মেহরিন হেসে ফেললো। ছেলেও বাবার মতই রাগী হয়েছে! দুষ্টুমি করে সুজানকে একটা চোখ মারলো সে। সুজান চোখ বড়বড় করে তার দিকে চেয়ে রইলো। চোখে দারূণ ক্ষোভ! আব্বাসকে টানাটানি শুরু করে দিল কেটে পড়ার জন্য। মেহরিন উঠে দাঁড়ালো। হাসিমুখে বললো,
—“আসি?”
সুজান রাগে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। মেহরিন কিন্তু গেলো না। যাওয়ার ভান করে একপাশে লুকিয়ে পড়লো সে। উদ্দেশ্যে মাহমুদের বাসা চিনে নেওয়া। আব্বাস সুজানকে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো। ট্যাক্সি নিয়ে তাদের পিছু করলো মেহরিন।

জুতো খুলে লম্বা হয়ে খাটে শুয়ে পড়লো সুজান। মাহমুদ তার পাশে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,
—“কি ব্যাপার আজকে মনে হয় তাড়াতাড়ি চলে এলে?”
সুজান জবাব দিলো না। মুখ ভার করে বসে রইলো। মাহমুদ ছেলের মতিগতি পর্যবেক্ষণ করে ল্যাপটপ সরিয়ে তার গা ঘেঁষে বসলো।
ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে হাসিখুশি গলায় জিজ্ঞেস করলো,
—“কি ব্যাপার মি.সুজান মাহমুদ? আপনার চান্দি গরম কেন?”
—“একটা আন্টি আমাকে চোখ মেরেছে।”
বোবার মত তার দিকে চেয়ে রইলো মাহমুদ। খানিকবাদে হো হো করে হেসে ফেললো। অনেকদিন বাদে এমন করে হেসেছে সে। হাসির চোটে চোখে পানি চলে এলো তার। সুজান চোখমুখ লাল করে তার দিকে চেয়ে আছে। মাহমুদ হাসি থামিয়ে বললো,
—“আহারে! কি দিনকাল শুরু হলো। আমার বাচ্চা ছেলেটাকে পর্যন্ত আন্টিরা চোখ মারে।”
সুজান কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,
—“ইউ আর জোকিং বাবা!”
মাহমুদ ভালো ছেলেদের মত হাত নাড়িয়ে বললো,
—“নো, আই এম নট!”
সুজান জোর গলায় বললো,
—“ইয়েস! ইউ আর..!”
ধরা খেয়ে আবারো হাসলো মাহমুদ। সুজানের প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা। মেয়েরা এমন কেন? হ্যান্ডসাম ছেলে দেখলেই কেন তাদের অসভ্যতা শুরু হয়ে যায়? স্কুলে একবার তাদের ক্লাসের একটা মেয়ে জোর করে সুজানের গালে চুমু খেয়েছিলো। সুজান অবশ্য চুপ করে থাকে নি। মেয়েটার গালে কষে চড় মেরেছিলো সে। কিন্তু আজকের আন্টিটাকে তো কিছুই করা হয় নি। আবার যদি সুযোগ হয় অবশ্যই তাকে খামচে দেবে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো সুজান। মাহমুদ মুচকি মুচকি হাসছে। বললো,
—“সুজান? বাবা, এত রাগ করতে নেই! আফটার অল ইউ আর হ্যান্ডসাম এনাফ!”
—“বাবা?”
মাহমুদ হাসতে হাসতে বললো,
—“কি বাবা?
—“আমি কিন্তু রেগে আছি।
—“ওকে। আমি আর কিছু বলবো না। কিন্তু একটা প্রশ্ন?”
—“কি?”
—“আন্টি কি তোমাকে আর কিছু বলেছে?”
—“না। আমার গাল টিপে আদর দিয়েছে।”
মাহমুদ ছেলের মনের ভুলটুকু দূর করে দিলো। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
—“এর জন্য মন খারাপ করছো কেন বাবা। আন্টি হয়ত তার ছেলেকে মিস করছিলো তাই তোমাকে আদর করেছে।”
এইবার সুজানকে চিন্তিত দেখালো। বাবা তো ঠিক বলেছে। সুজানতো এইকথা একবারও ভেবে দেখে নি। মন খারাপ হলো তার। মাহমুদ বললো,
—“কি ভাবছো?”
সুজান বাচ্চাসুলভ কৌতূহলী চোখে প্রশ্ন করলো,
—“ঐ আন্টির ছেলের কি হয়েছিলো বাবা?”
—“আমি জানি না। আবার যদি তোমার সাথে দেখা হয় তুমি জিজ্ঞেস করে নিও!”
সুজান কতক্ষণ চুপ করে থেকে, হঠাৎ মৌন কণ্ঠে বলে উঠলো,
—“আমি মাকে অনেক মিস করি বাবা।”
মাহমুদের দৃষ্টি অসহায়। ছেলেকে কোলে নিয়ে বারান্দা এসে দাঁড়ালো সে। শক্ত করে চেপে ধরলো বুকের মাঝে। মা মরা ছেলে তার। কাজের জন্য ঠিকমত সময় দিতে পারে না। বাবা হিসেবে ছেলের প্রতি দায়িত্বগুলোকে এড়িয়ে-ই চলেছে এতকাল যাবত। এনা মারা যাওয়ার পর থেকেই সুজান একা একা বড় হচ্ছে। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
—“মা-ও তোমাকে অনেক মিস করে সুজান। তুমি তো মায়ের কলিজার টুকরো ছিলে! ”

সেদিনের পর থেকে আর সুজানের সাথে দেখা হয় নি মেহরিনের। আজকে অফ ডে। মেহরিন প্রায় সকাল থেকেই পার্কে এসে বসে আছে, যদি কোনভাবে সুজানের দেখা পায়। এবার দেখা হলে বাসার সবার কথা জিজ্ঞেস করে নিবে সে।
অবশেষে আরো ঘন্টাখানেক বাদে বহুল প্রত্যাশিত কালো রংয়ের গাড়িটা পার্কের গেট দিয়ে ঢুকতে দেখা গেলো। পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করে তার ভেতর থেকে সুজানকে কোলে নিয়ে নামলো মাহমুদ। অপ্রত্যাশিত কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সেই মুখটা মুহূর্তেই মেহরিনের বুকের ভেতর বিষন্নতার ঝড়ো হাওয়া হয়ে বইতে শুরু করলো। আশেপাশের সবকিছু উপেক্ষা করে সে পলকহীন ভাবে চেয়ে রইলো মানুষটার দিকে। তার দৃষ্টি ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে আসছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। পায়ের পাতা টলছে। সরে গেলো সে। আড়ালে চলে গেলো।
পার্কের খোলা ময়দানে বাপ ছেলে ক্রিকেট খেলছে। দুজনের পরনেই কালো প্যান্ট আর নীল শার্ট। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একই ড্রেসআপ। এমনকি চুলের কাটিংটা পর্যন্ত সেইম। মেহরিন জলভরা চোখে মুচকি হাসলো। হঠাৎ করেই সুজানের চোখ পড়লো মেহরিনের দিকে। দৌড়ে গিয়ে বাবার কানে কানে কি যেন বললো সে। মাহমুদ মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। মেহরিনের আর এক সেকেন্ডও দেরী করলো না। তীব্রগতিতে পা চালিতে পার্ক থেকে বের হয়ে গেলো।

ছেলেকে মৌনমুখে ফিরে আসতে দেখে মাহমুদ হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো,
—“কি ব্যাপার পাও নি?”
—“না। মনে হয় আমার সাথে রাগ করেছে।”
ছেলেকে কোলে তুলে নিলো মাহমুদ। কাছেই আব্বাস পানির বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাহমুদ পানি বোতল খুলে পানি খাইয়ে দিয়ে নরম গলায় বললো,
—“ঠিক আছে। কোন ব্যাপার না। আবার দেখা হলে সরি বলে নিবে!”
—“বাবা, দাদুভাইয়ের ফোনে এই আন্টিটার ছবি আমি দেখেছি।”
মাহমুদ থমকে গেলো। হঠাৎ করেই বুকের ভেতর উথাল পাথাল শুরু হলো। চিনচিন করে সেই পুরোনো ব্যথাটা আবার মেহরিন নামক শব্দটার উপস্থিতি জানান দিয়ে উঠলো। চোখের কোনে পানি জমা হলো। হাহাকার করে উঠলো বুকের ভেতরটা। তবে কি সুজান মেহরিনের কথা বলছে? মেহরিন এখানে?
পুনরায়! আরো একবার নিজেকে সামলে নিলো সে।হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে নিয়ে বললো,
—“আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে সুজান। চলো বাসায় ফিরে যাই।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here