পুনরায় পর্ব ৩

#পুনরায়
#অরিত্রিকা_আহানা
#পর্বঃ৩
সুজান নিজের মত করে খাচ্ছে। মাহমুদ তার পাশে বসে খাবার নাড়াচাড়া করছে।
—“সুজান?”
—“হুম?”
—“ভালো করে মনে করে দেখো তো সেদিন ঐ আন্টি-টা কি তোমাকে কিছু বলেছিলো?”
—“কেন?”
—“এমনি। তুমি বলছো তুমি আন্টির ছবি দাদুর ফোনে দেখেছো, তাই। তিনি কি তোমাকে দাদুর ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করেছে ?”
সুজান তার ছোট্ট হাতখানা দিয়ে কাটাচামচ নাড়াচাড়া করতে করতে কিছুক্ষন ভাবলো। তারপর স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
—“তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিলো।”
—“আমার কথা?”
মাহমুদের চোখেমুখে উত্তেজনা। অধীর হয়ে সুজানের মুখের দিকে চেয়ে আছে সে। সুজান খাওয়া থামিয়ে বললো,
—“তোমার নাম জিজ্ঞেস করেছিলো।”
—“তাই? তুমি বলেছো?”
—“হুম।”
—“আর কিছু জিজ্ঞেস করেছিলো?”
—“হ্যাঁ। আমার নাম জিজ্ঞাসা করেছিলো। আর কিছু মনে নেই।”
—“আচ্ছা ঠিক আছে। খাও!”
পরোক্ষনেই মাহমুদ আবার প্রশ্ন করলো,
—“আন্টিটা দেখতে কেমন?”
—“ভালো না!”
মাহমুদ আর কিছু বললো না। ডান হাতটা সস্নেহে ছেলের মাথায় রেখে বললো,
—“ঠিক আছে তুমি খাও।”
মাহমুদের খাওয়া শেষ। প্লেট নিয়ে সিংকে ভিজিয়ে রাখলো সে। সুজানের খাওয়া তখনো শেষ হয় নি। মাহমুদ কিচেন থেকে বেরিয়ে ডাইনিং এর পাশ দিয়ে হেটে রুমে যাচ্ছিলো। সেই মুহূর্তেই সুজান আবার ডাক দিলো তাকে,
—“বাবা?”
মাহমুদ ফিরে এলো। ছেলের আদুরে মুখখানার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
—“কিছু বলবে? কিছু লাগবে?”
—“আন্টিটা খুব সুন্দর। ফেইরীদের মত!”
মাহমুদ হেসে ফেললো। ছেলের নরম গালটা টেনে দিয়ে বললো,
—“ঠিক আছে। এবার তুমি তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো।”

রায়হান সরুচোখে মেহরিনের দিকে চেয়ে আছে। মেহরিন নির্বিকার। আজকে তাদের বিয়ের শপিং করার কথা। একসপ্তাহ আগে মেহরিনের নিজেই সব প্ল্যান করে রেখেছিলো। কিন্তু এখন বসে বসে কাঁদছে। রায়হান প্রথমে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেও মানিয়ে নিলো। হাটুমুড়ে মেহরিনের সামনে বসলো। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
—“তোমার কি হয়েছে মেহরিন? আমাকে বলবে? সেদিন পার্টিতে যাওয়ার পর থেকেই দেখছি তোমার মুড অফ! কোন সমস্যা? তুমি কি বিয়েটা করতে চাইছো না?”
মেহরিন অসহায় ভাবে ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে। রায়হানের মুখটা তার চেয়েও বেশি অসহায়। দুবাই আসার পর রায়হানের সাথেই প্রথম বন্ধুত্ব হয়েছিলো মেহরিনের। রায়হান বাঙালী। সেই জন্যই বন্ধুত্বটা খুব সহজে হয়ে গেছে। রায়হানের পুরো পরিবারসহ দুবাই থাকে। ওদের পরিবারের সবার সাথেই মেহরিনের খুব ভালো সম্পর্ক । রায়হানের মা মেহরিনকে নিজের ছেলের জন্য পছন্দ করে বিয়ে প্রস্তাব দেন। মেহরিন সরাসরি না বলতে পারলেও এতকাল যাবত এড়িয়ে এসেছিলো। কিন্তু আজ যখন সে সবকিছু ভুলে বিয়েতে মত দিলো তখনই পুরোনো স্মৃতি জ্বলজ্বল করে তার সামনে এসে দাড়ালো।কালবৈশাখীর ঝড় তুলে দিলো বুকের ভেতর। কি করবে সে?
অবশেষে মনকে বোঝালো মেহরিন। মাহমুদ বিবাহিত। তার সংসার আছে। ফুটফুটে সুন্দর দেখতে একটা ছেলে আছে। অতএব মেহরিনের কষ্ট পাওয়া অনুচিত। আলমারি থেকে জামা বের করে রেডি হয়ে নিলো সে। তারপর রায়হানের সাথে শপিং করতে বেরোলো।

সুজানকে নিয়ে শপিং করতে বেরিয়েছে মাহমুদ। সঙ্গে আব্বাস আছে। সুজান খুব খুশি। মাহমুদের একেবারে গা ঘেঁষে হাঁটছে সে। হঠাৎ করেই চেঁচিয়ে উঠলো সে,
—“বাবা ঐ আন্টিটা!”
মাহমুদ ছেলের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকালো। মুহূর্তে হৃদপিন্ডটা বরফে পরিনত হলো। আকাশ পাতাল সমেত ঘুরতে শুরু করলো। মেহরিন! এখানে!.. তার ধারণাই ঠিক। সুজানের সাথে মেহরিনের-ই দেখা হয়েছিলো।
—“সুজান? চলো বাসায় ফিরে যাই।”
—“কেন বাবা? আন্টিকে সরি বলবো না?”
—“পরে বলে দিও। বাবার একটা কাজ মনে পড়ে গেছে। আমাদেরকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।”
—“ঠিক আছে চলো।”
মেহরিন তাদের দেখতে পায় নি। সেই সুযোগে টেনে সুজানকে নিয়ে আড়ালে চলে গেলো মাহমুদ। দ্রুত পেমেন্ট কাউন্টারের দিকে গেলো সে। পেমেন্ট ক্লিয়ার করে বেরোতে যাবে এমন সময় তারই মত সামনে অগ্রসরমান কারো সাথে ধাক্কা খেলো। সরি বলতে গিয়ে, দীর্ঘ সাত বছর পর আশেপাশে সবকিছু ভুলে পুনরায় দুইজোড়া তৃষিত নয় একত্রিত হলো। ঠিকরে পড়লো অভিমান, আক্ষেপ। তবুও আচমকা মুখে হাসির রেখা টেনে নিলো মাহমুদ। যেন সে জানতোই না মেহরিন এখানে আছে। শান্ত স্বাভাবিক ভাবে বললো,
—” তুমি? এখানে? এখানেই সেটেল হয়েছো বুঝি?”
মেহরিন কোন কথা বলতে পারলো না। তার গলার স্বরটাকে কে যেন আটকে রেখেছে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো শুধু। এর মাঝেই তার পাশে এসে দাঁড়ালো রায়হান। মেহরিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—“তোমার এখনো হয় নি? জুয়েলারি কখন নিবে?”
মাহমুদের চেহারার হাসিটা নিভে গেলো। চেহারায় নেমে এলো আকস্মিক অন্ধকার!নিজেকে স্বাভাবিক রাখার যথাসম্ভব চেষ্টা করলো। মেহরিন তখনো নিশ্চুপ। মাহমুদ রায়হানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—“হ্যালো। আমি মাহমুদ। মিস মেহরিনের ফ্রেন্ড!”
রায়হানও হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—“আপনি বাঙ্গালী? পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো।”
তারপর মেহরিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
—“কি ব্যাপার মেহরিন তুমি তো আমাকে বলো নি এখানে তোমার ফ্রেন্ড থাকে।”
—“আসলে আমি ট্রেনিং এ এসেছি। হঠাৎ করেই উনার সাথে দেখা হয়ে গেলো।
—“ও আচ্ছা। কয়দিন আছেন?”
—“বেশিদিন না।”
সুজানের দিকে চোখ পড়লো রায়হানের। ইশারায় জিজ্ঞেস করল,
—“কে?”
—“আমার ছেলে।”
রায়হান সুজানকে কোলে তুলে নিলো। সুজান নামার জন্য ছটফট করলেও বাবার ইশারা পেয়ে শান্ত হয়ে গেলো।রায়হান হেসে উঠে বললো,
—“একেবারে আপনার বাধ্য দেখছি! যাই হোক আপনারা গল্প করুন আমি ওকে নিয়ে ঘুরে আসছি।”

শপিং মল সংলগ্ন রেস্টুরেন্টে বসে আছে দুজনে। মেহরিনের দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। সে জানে তার মোটেও কাঁদা উচিত নয়। তবুও কেন যে কান্না চেপে রাখতে পারছে না। মাহমুদ তার মুখোমুখি চুপচাপ বসে আছে।
—“কাঁদছো কেন মেহরিন?”
মেহরিনের কান্না থামলো না। পূর্বের মতই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। মাহমুদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
—“এতদিনে তো সব ভুলে যাওয়ার কথা। সাত বছর। এনাফ টাইম। নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য।”
—“তুমি পেরেছো?”
মাহমুদ হাসলো। বলল,
—“তুমি নিজের চোখেই তো দেখেছো। পেরেছি কি না? বিয়ে করেছি। ছেলের বাবা হয়েছি।”
—“ওও!”
—“তুমি বিয়ে করো নি?”
বিয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই মেহরিনের ফোঁপানো বেড়ে গেলো। মাহমুদ চিন্তিত মুখে বলল,
—“পাত্র কি রায়হান সাহেব?”
—“হুম!”
মাহমুদ আর কিছু বললো না। মেহরিন তার মুখ থেকে কিছু শোনা অপেক্ষায় চেয়ে রইলো। কেন রইলো সে নিজেও জানে না। মাহমুদ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার চেষ্টা করলো। বলল,
—“তোমার কাছে মি.রায়হানের নাম্বার আছে?”
—“কেন?”
—“ভয় পাচ্ছো? সুজানকে নিয়ে আসতে বলবো।”
—“ভয় পাবো কেন? রায়হান আমার সম্পর্কে সব জেনেই বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।”
—“আমি বুঝতে পেরেছি। তোমাকে তো আমার চেনা আছে। একমাত্র আমি ছাড়া আর কারো কাছেই তুমি সত্যি গোপন করো না। যাইহোক, সেসব বাদ দাও! এখন বলো মি.রায়হান কি উদ্দেশ্যে আমাদের দুজনকে একা কথা বলার সুযোগ দিয়ে গেছে? আমাকে এতটা বিশ্বাস করা কি তার ঠিক হচ্ছে? অবশ্য বিশ্বাস যে পুরোপুরি করে নি তা বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। আমার ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন।”
মাহমুদের মুখে স্মিত হাসি। মেহরিন ঠাট্টায় যোগ দিলো না। তার মুখে গম্ভীরভাব। রায়হানের নাম্বার বের করে ফোন এগিয়ে দিলো। পাঁচমিনিটের ভেতরই সুজানকে নিয়ে হাজির হলো রায়হান। তারপর কোন রকম বাক্যবিনিময় ছাড়াই সুজানকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো মাহমুদ। মেহরিন শুধু নিষ্পলকভাবে চেয়ে রইলো।

রায়হান নির্বাক হয়ে বসে আছে। এইমুহূর্তে তার কি করা উচিৎ সে বুঝতে পারছে না। তারপাশেই বসে আছে মেহরিন। তার দৃষ্টি বাইরের দিকে। রায়হান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
—“সেদিন পার্টিতে তুমি মি.মাহমুদকে দেখেছিলে তাই না? আমাকে বলো নি কেন?”
মেহরিন চেহারার কোন পরিবর্তন হলো না। আগেরমতই বসে রইলো সে। রায়হান অধৈর্য কন্ঠে বলল,
—“আমাকে সত্যিটা বলা উচিৎ ছিলো তোমার।”
—“সরি।”
রায়হান অবাক হলো। মেহরিন সরি বলেছে ঠিকই কিন্তু তার কন্ঠে কোনরূপ অনুশোচনা কিংবা অনুতাপ নেই। যন্ত্রের মতই শব্দটা উচ্চারণ করেছে সে। রায়হান বিক্ষুব্ধ কন্ঠে বললো,
—“সরি?”
—“হুম সরি। আমার ভুল হয়ে গেছে। এরপর থেকে আর এমন হবে না।”
—“তুমি এমন যন্ত্রের কত আচরণ করছো কেন মেহরিন? সহজ হও। আমরা আলোচনা করতে পারি! ”
মেহরিনের চোখে পানি টলমল করছে। যে কোন মুহূর্তেই অশ্রুবর্ষণ শুরু হয়ে যেতে পারে। রায়হান সেদিকে চেয়ে আবারো নিজেকে সামলে নিলো। শান্ত কন্ঠে বলল,
—“ঠিক আছে। এই বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করবো।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here