#অতঃপর_প্রণয়
#অরিত্রিকা_আহানা
#পর্ব:২
ভয়ে ভয়ে কলিংবেল চাপলো ইরিন।মায়মুনা বেগম ওকে সুপারির জন্য পাঠিয়েছেন আয়াজের মা সোহেলির কাছে।মনে মনে দোয়া পড়ছে ইরিন,আয়াজ যাতে বাসায় না থাকে।যদিও এই সময় আয়াজ বাসায়ই থাকে তবুও আশাতো করাই যায়?..কথায় আছে,”আশায় বাঁচে ভরসা।”
ইরিনের আশায় পানি ঢেলে দিয়ে দরজা খুললো আয়াজ।একহাত ট্রাউজারের পকেটে অন্য হাত দিয়ে দরজার হ্যান্ডেল ধরে রেখেছে সে।ইরিনকে দেখেই চোখ উল্টে ফেললো।
—“আন্টিকে একটু ডাক দিন তো!”
গতকালের ঘটনার পর থেকেই ভয়ে ভয়ে আছে ইরিন।আয়াজ ওকে ছেড়ে দেবে না।আয়াজ তেতে উঠে বলল,
—“পারবো না।তুই ডাক!”
—“আমি ডাকলে শুনবে না।আপনি ভেতরে গিয়ে ডেকে নিয়ে আসুন আমি অপেক্ষা করছি।”
আয়াজ নড়লো না।ভ্রূ জোড়া কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে ইরিনের দিকে চেয়ে রইলো।ইরিন তাড়া দিয়ে বলল,
—“কি হলো যাচ্ছেন না কেন?”
—-“আমি কি তোর চাকর?..বেয়াদপের মত হুকুম করছিস?”
ইরিন ভেতরে ঢুকলো না, আয়াজকে ভেংচি কেটে দরজায় দাঁড়িয়ে গলা চড়িয়ে সোহেলি বেগমকে ডাক দিলো।ভেতরে ঢুকার সাহস ওর নেই।ও ভালো করেই জানে ভেতরে ঢুকলে আয়াজ ওর বারোটা বাজিয়ে দেবে।আয়াজ ধমক দিয়ে বলল,
—“এই তুই আমাকে ভেঙ্গালি কেন? জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো একদম,অসভ্য,ফাজিল!”
ইরিন তাতে কিছু মনে করলো।নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দরজার বাইরে অবস্থান করছে সে।উদ্দেশ্য আয়াজের হাতের নাগালের বাইরে থাকা।
আয়াজ ওর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে দরজার বাইরে বেরিয়ে এলো।ইরিনের ডান হাতটা চেপে ধরে বলল, “তুই কি ভেবেছিস তুই ভেতরে না ঢুকলে আমি তোকে ছেড়ে দিবো?..তোর কতবড় সাহস তুমি আমার পায়ে ছ্যাপ দেস!কি বিশ্রি গন্ধ!কতদিন ব্রাশ করিস না তুই?..ওয়াক থু!”
আয়াজ শব্দ করে একদলা থুথু ফেললো ইরিনের পায়ের কাছে। ছিটকে সরে গেলো ইরিন।গা গুলিয়ে বমি আসছে তার।
—–” আমাকে ছাড়ুন।..বমি আসছে!”
— ” শুধু শুধু বমি আসবে কেন?..কার সাথে অঘটন ঘটিয়েছিস?”
—“আপনার থুথু দেখে!”, দম বন্ধ করে কথাটা বলল ইরিন।
—“আমার থু থু দেখে মানে?..তোর কি মনে হয় আমি তোর মত ব্রাশ না করে থাকি?..গন্ধ শুঁকে দেখ এলাচির সুঘ্রাণ বাহির হবে, ..বিশ্বাস না হলে খেয়ে দেখতে পারিস!”
“ওয়াক!ওয়াক!” ,ঘৃনায় নাকমুখ কুঁকে ফেললো ইরিন।পেট থেকে বমি চেপে বেরিয়ে আসছে।মনে হচ্ছে যেন নাড়িভুঁড়ি সব বের হয়ে যাবে।
আয়াজ দ্রুত দরজার পাশ থেকে সরে গেলো।
—–” খবরদার! দরজায় বমি করলে তোকে আবার খাওয়াবো!…যা ভেতরে যা।”
ইরিন একছুটে ভেতরে ঢুকে হর-হর করে বেসিন ভর্তি বমি করলো।আয়াজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে।দৃষ্টি সরু,সামান্য একটা ব্যাপারে বমি করার কি আছে ওর মাথায় আসছে না।হস্পিটালে কত কাঁটাছেঁড়া দেখেছে ও!…কই ও তো এমন করে নি?..এই মেয়ে আসলেই ড্রামাবাজ!
মুখভর্তি পানির ঝাপটা দিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়লো ইরিন।
—” আপনি একটা খাটাস!”
—” কি বললি তুই? আমি খাটাস? তুই খাটাস তোর চৌদ্দগুষ্ঠি খাটাস।ফাজিলের ফাজিল!
আয়াজ একটু থেমে আবারও কড়া ধমক দিয়ে বলল,
—“তোর কি মনে হয় আমি তোর ছোট?…এই চোখ নামা!নামা বলছি!”
ইরিন তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে ফেললো।বখাটে-টার সাথে কথা বলাই বেকার, দ্রুত ভেতরে পা বাড়ালো।আয়াজের মা মানুষ হিসেবে খুবই ভালো।সরল সোজা।ইরিনকে যথেষ্ট স্নেহ করেন তিনি।উনাদের বাসার সবাই-ই ভালো।কেবল আয়াজ ছাড়া।বদের হাড্ডি এই ছেলে! ইরিন সোহেলির কাছ থেকে সুপারি নিয়ে বেরোনোর সময় আয়াজ ওর কানের তালা ফাটিয়ে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করলো।
ইরিন বাসায় ঢুকে রাগে সুপারির থালাটা মায়মুনা বেগমের সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।
—- “আর কোনদিন আমাকে তুমি ঐ গুন্ডাটার বাসায় পাঠাবা না!”
—–” কে গুন্ডা?”
—–“তুমি জানো না কে?”
মায়মুনা বেগম সুপারির থালা নিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকে গেলেন।আয়াজের সাথে ইরিনের সাপে-নেউলে সম্পর্ক উনি ভালো করেই জানেন।উনার ধারনা ইরিন ইচ্ছে করে আয়াজের সাথে ঝগড়া করতে যায়।এই মেয়ের ধাঁচ ভালো না।বেয়াড়া জাতের মেয়ে।আয়াজ ঠিক কাজই করে একে টাইট দিয়ে।তিনি একা আর কত সামলাবেন? মেয়ের বাবার তো কোন হুঁশই নেই।আদর দিয়ে দিয়ে বাদর বানিয়েছে।
ইরিন রাগে মাহিনের গালে ঠাটিয়ে চড় বসিয়ে দিলো।ও না থাকাতেই ইরিনকে আয়াজের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
—–” কাজের সময় হাওয়া হয়ে যাস না? কই ছিলি?..আব্বারে বলে তোর পায়ের নালা যদি না ভাঙ্গি আমার নামও ইরিন না।বেয়াদপ একটা,সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় টৈ টৈ!
মাহিন গালে হাত দিয়ে বসে আছে।কাঁদোকাঁদো চেহারা!ইরিন আয়াজ ভাইয়ের ওপর রাগ ওর ওপর ঝেড়েছে!অন্য সময় হলে সে নিজেও দুইএকটা কিল বসিয়ে দিতো ইরিনের পিঠে কিন্তু আজকে লক্ষন ভালো না।ইরিন ক্ষেপে আছে তাই ওকে আর চটালো না সে।
পরেরদিন বারান্দা থেকে কলেজের ড্রেস আনতে গিয়ে ইরিনের মেজাজ বিগড়ে গেলো।কত কষ্ট করে ঘষে ঘষে গতকাল সে ড্রেসটা ধুয়ে দিয়েছিলো।এখন সাদা জামায় ছোপ ছোপ নীল রংয়ের দাগ!কলমের কালি মনে হচ্ছে।
আয়াজ বারান্দায় বসে পড়ছে!সকাল বেলা বারান্দায় বসে কিছু সময় পড়াশোনা করা ওর অভ্যেস!
ইরিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার দিলো।
—” আম্মায়ায়ায়ায়া!”
মায়মুনা বেগম প্রায় ছুটে বারান্দায় এলেন।আয়াজ আগের মতই বসে আছে, যেন শুনতেই পায় নি।ইরিন বলল,
—” আমার জামায় রঙ লাগলো কীভাবে?আমি কালকে দুইঘন্টাযাবত কলেজ ড্রেস ধুয়েছি!”
—“তুই এইজন্য এভাবে চিৎকার করবি?আমি তো ভাবলাম ডাকাত পড়ছে।”
ইরিন কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,”আমি কলেজ যাবো কীভাবে?”
—“ধোয়ার সময় খেয়াল করবি না?…সাদা জামা সময় আলাদা ভেজাবি।রঙ্গিন জামাকাপড়ের সাথে দিলে তো এমন হবেই!”
ইরিন ভালো করেই জানে কাজটা কে করেছে? জামাটা ছুঁড়ে ফেলে বলল,”জ্ঞান দিও না তো।অসহ্য লাগছে।”
বারান্দা থেকে ভেতরে ঢোকার সময় আয়াজের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সে।’এর মানে আমি তোমাকে দেখে নেবো।’
আয়াজ বই বন্ধ করে গুনগুন করলো,
—“শাখে শাখে পাখি ডাকে
কত সোভা চারপাশে
আহা! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে!
পরেরদিন সকালবেলা ইরিন কলেজের জন্য বেরোচ্ছিলো।লিফট এর কাছে আয়াজ দাঁড়িয়ে আছে।হাতে বই।ওর পরনে একটা সাদা টি-শার্ট।টি-শার্টের ওপর কালো নীল চেকশার্ট পরেছে সে!শার্টের সবগুলো বোতামই খোলা, হাতে কালো বেল্টের ঘড়ি,সাথে কালো জিন্স আর পায়ে বেল্টওয়ালা জুতো,কাধে ব্যাগ ঝোলানো।দারুণ স্মার্ট লাগছে।ইরিন মুগ্ধ চোখে একপলক তাকালো।তবে ওর মনে অন্য প্ল্যান চলছে।মনে মনে ধারনা করে নিলো সে নিশ্চই আজকে পরীক্ষা আছে মহাশয়ের।গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
—– “কোথায় যাচ্ছেন আয়াজ ভাইয়া?”
মুড ভালো থাকলে ইরিন আয়াজকে ভাইয়া বলে ডাকে।এইমুহূর্তে আয়াজের পড়ায় ডিস্টার্ব করবে সে। সো এখন তার মুড ভালো।আয়াজ জবাব দিলো না।লিফট এর দরজা খুলে গেছে।চুপচাপ ভেতরে ঢুকে গেলো সে।ইরিন দাঁতমুখ খিঁচে ওকে একটা ভেংচি কাটলো।অবশ্যই সেটা আয়াজের অলক্ষে।তারপর ভেতরে ঢুকলো।
—“এত সকাল সকাল বই নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন আয়াজ ভাইয়া?”
—“বিলাতে যাই!
যাবি?”
—“আপনার কি আজকে পরীক্ষা?”
—“নাতো।আমাদের কলেজে আজকে নাচের প্রতিযোগিতা হচ্ছে আমি নাচতে যাচ্ছি।”
—“আপনি নাচ জানেন?”
—“দেখ ইরিন আমার তো আর তোর মত রঙ তামাসা করে বেড়ালে দিন যাবে না!..আমার সামনে ফাইনাল প্রফ!পড়াশোনা করতে হবে।সো প্লিজ তোর মুখটা বন্ধ রাখ।আমার হাত কিন্তু নিশপিশ করছে।”
—“আমি রং তামাসা করি?”
—“আবার কথা বলে?”
—“আপনি যদি আমার প্রশ্নের উত্তর না দেন তাহলে আমি চুপ করবো না।”
লিফট থেকে বেরোলো দুজন।আয়াজ বেরিয়ে গাড়িতে উঠলো।ইরিন গাড়ির দরজার টোকা দিয়ে বলল,
—“আমাকে লিফট দিতে পারবেন?আসলে আজকে একটু তাড়া আছে।”
—“তুই বকবক করবি না তো?”
—“একদম না।”
—“ওঠ!”
ইরিন সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে গাড়িতে উঠেছে।ওর ইউনিফর্ম এ কালিমা লেপনের শাস্তি আয়াজকে দেবে সে।কিছুদূর যাওয়ার পর মিন মিন করে বলল,
—“আপনার কি সত্যিই মনে হয় আমি রঙ তামাসা করি?”
—” করিস না? তোর সাজগোজ দেখলে তো মনে হয় যেন পড়ালেখা শিখতে যাস না প্রেম করতে যাস!বাই দ্যা ওয়ে তুই যে আমাকে জ্বালাতন করতে গাড়িতে উঠেছিস তা আমি ভালো করেই জানি।সুতরাং এবার তুই মুখ বন্ধ না করলে আমি তোর চুলে সুপারগ্ল্যু লাগিয়ে দেবো।নিজের তো পড়ালেখা নাই,আরেকজনকে ডিস্টার্ব করিস!”
আয়াজ সত্যি সত্যি ব্যাগ থেকে একটা গ্ল্যু-স্টিক বের করলো।সেদিন কলেজ থেকে বাসায় ফেরার সময় ওর জুতো ছিঁড়ে গিয়েছিলো।জুতোর তলা জোড়া লাগানোর জন্যই কলেজের সামনের দোকান থেকে গ্ল্যু-স্টিকটা সে কিনেছিলো। লাগানো শেষে বুদ্ধি করে ব্যাগে রেখে দিয়েছিলো।তা না হলে ইরিনকে এত সহজে দমানো যেত না।ইরিন হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।আয়াজের বিশ্বাস নেই।সত্যি সত্যি যদি লাগিয়ে দেয়।চুপ করে গেলো যে।আয়াজ আবার বইয়ে মনোযোগ দিলো।