তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব -০৩

#তোমার_দ্বিধায়_বাঁচি
#পর্ব_৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________
জিয়ান যতক্ষণে হাসপাতালে পৌঁছাল ততক্ষণে নূর-আমিন আহমেদ এবং বড়ো মেয়ে মিতুর স্বামী শোভন হন্যে হয়ে র-ক্তের সন্ধান করছিলেন।

ফোনে কারও সাথে র-ক্তের জন্যই কথা বলছিলেন নূর-আমিন আহমেদ। জিয়ান এগিয়ে গিয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে শুধাল,

“বাবা, নিতু কোথায়?”

কান থেকে ফোন নামিয়ে রাখলেন তিনি। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন,

“তিন ব্যাগ ও নেগেটিভ র-ক্ত লাগবে জিয়ান। ইমার্জেন্সি!”

জিয়ান আর কথা না বাড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে ওর কাছের দুই বন্ধুকে ফোন করল যাদের র-ক্তে-র গ্রুপ ও নেগেটিভ। ফোন পেয়ে ওরা তৎক্ষণাৎ ছুটে আসে। এখনও আরও এক ব্যাগ র’ক্ত প্রয়োজন। হাসপাতালের এমডি এসে জানাল, তাদের হাসপাতালের একজন ওয়ার্ড বয় রক্ত দিয়েছে। হাফ ছেড়ে বাঁচল নিতুর পরিবার।

নিতুর মা শাড়ির আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদছেন। মিতু তাকে কোনোভাবেই শান্ত করতে পারছে না। শোভন আছে শ্বশুরের সাথে। জিয়ানের মনের ভেতর ভয় এবং আশঙ্কা। এখনও কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি। কিন্তু যখন জানতে চাইবে নিতুর সাথে তার কী হয়েছিল? কেন নিতু এমন একটা ডিসিশন নিয়েছে। তখন সে কী উত্তর দেবে?

জিয়ান আগে বাড়িতে ফোন করে ঘটনাটি জানাল। এরপর গিয়ে দূরে প্যাসেজ ওয়েতে একা বসল। মাথার ভেতর যন্ত্রণা হচ্ছে খুব। নিজের ভুলের জন্য নিতুকে এখন কষ্ট পেতে হচ্ছে। সে দু’হাতে মুখ ঢেকে ঝুঁকে বসে। নিতুকে পাওয়ার জন্য এই কথা লুকানো ছাড়া তার কাছে আর কোনো রাস্তাও ছিল না তখন।

তিন মাস আগের কথা। বন্ধু আসিফের বোনের বার্থডে পার্টিতে গিয়েছিল জিয়ান। সেখানেই নিতুকে সে প্রথম দেখেছিল। লাল রঙের সুন্দর একটা গাউন পরেছিল নিতু। জিয়ানের সবচেয়ে অপছন্দের রঙ ছিল লাল। কিন্তু সেদিন যেন সে লাল রঙেই মুগ্ধ হয়েছিল। তার বারংবার মনে হয়েছিল লাল রঙ ছাড়া নিতুকে ঠিক মানাত না। হাস্যোজ্জ্বল নিতুর প্রেমে সেদিনই সে ডুবেছিল। খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারল নিতু বাবা-মায়ের ভীষণ বাধ্য মেয়ে। কোনো সম্পর্কে না থাকলেও তার পেছনে অনেক ছেলের লাইন রয়েছে। যাদের কেউ কেউ জিয়ানের থেকেও বেটার। সে ভয়ে ছিল। নিতু কি তার ভালোবাসার প্রস্তাব গ্রহণ করবে? সম্ভাবনা ছিল খুবই ক্ষীণ। অন্যদিকে তার ছিল অ-ভি-শ-প্ত এক অধ্যায়। যেই অধ্যায়ের নাম মাহিরা!

“জিয়ান!”

ডাক শুনে অতীতের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে জিয়ান। ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে ওর বাবা-মা এসেছে।

“বেয়াই-বেয়াইন কোথায়?” জিজ্ঞেস করলেন জুবায়ের রহমান।

জিয়ান নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“দুই তলায়।”

“তুই এখানে একা বসে আছিস কেন?”

“তোমরা যাও। আমি আসছি।”

নিতুর সাথে নূর-আমিন আহমেদের কথা হয় দুই ঘণ্টা পর। সে এখন কিছুটা সুস্থ আছে। বাইরে জিয়ান ও নিতুর শ্বশুর, শাশুড়ি দাঁড়িয়ে আছে। দুই পরিবারের কেউই এখনও মুখোমুখি কোনো কথা বলেনি। নূর-আমিন আহমেদ আগে নিতুর থেকে সবটা শুনতে চান। তিনি বসে আছেন এখন মেয়ের শিয়রে।

“মা রে, কেন তুই এই কাজটা করতে গেলি বল তো?” বিমর্ষ হয়ে সুধালেন তিনি।

নিতু অভিমানি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“ঠিকই তো করেছিলাম। কেন আমায় হাসপাতালে এনেছ?”

“কী হয়েছে আমায় খুলে বল মা।”

“কিছু বলার নেই তো। আমি বোঝা হয়ে গেছিলাম তোমাদের কাছে তাই না? এটা তো আমাকে বললেই পারতে। আমি চলে যেতাম অন্য কোথাও।” থেমে থেমে কথাগুলো বলল নিতু।

“এসব তুই কী বলছিস মা? তুই আমাদের কাছে বোঝা হয়ে গেছিলি? তোকে কি আমরা কম ভালোবাসি?”

“হ্যাঁ,হ্যাঁ বোঝাই হয়ে গেছিলাম। তাই তো আপদ দূর করতে খোঁজ-খবর না নিয়েই বিয়ে দিয়ে আমায় দূর করেছ।”

“জিয়ানের সাথে কিছু হয়েছে মা? আমায় বল না!”

“আব্বু তুমি যাও প্লিজ! আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না। আর হ্যাঁ, ঐ মানুষটা যেন আমার সামনে না আসে।”

মিতু ইশারায় তাকে বাইরে চলে যেতে বলে। নূর-আমিন আহমেদ তবুও কিয়ৎক্ষণ বসে থেকে বাইরে চলে গেলেন। মিতু পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“জিয়ানের সাথে কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছে আমায় বলা যাবে?”

নিতু এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বলল,

“আমি বাসায় যাব কবে?”

“কাল।”

বাইরে চেঁচামেচির শব্দ শুনে মিতু দৌঁড়ে বাইরে গেল। নূর-আমিন আহমেদ রেগেমেগে বারবার জিয়ানের দিকে তেড়ে যাচ্ছে। শোভন তাকে আটকে রেখেছে। সম্মুখেই মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে জিয়ান। নূর-আমিন আহমেদ ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন,

“এত বড়ো প্র’তা’র’ণা কেন করলেন আপনারা আমাদের সাথে? বিয়ের ব্যাপারটা কেন আগে জানাননি? তাহলে আজ আমার মেয়ের এই করুণ দশা দেখতে হতো না।”

জুবায়ের রহমান মাথা নত করেই বললেন,

“জিয়ানের সাথে সায় দেওয়া আমাদের উচিত হয়নি ভাই। কিন্তু এখন তো কিছু করার নেই…”

“কেন কিছু করার থাকবে না? নিতু যদি না চায় তাহলে এই সংসার করবে না।”

মমতা বেগম স্বামীকে থামিয়ে বললেন,

“আহা! থামো তো। সংসার ভাঙা কি মুখের কথা? এটা হাসপাতাল। এখানে এসব নিয়ে ঝামেলা কোরো না। নিতুকে নিয়ে আগে বাসায় যাই। তারপর একসাথে বসে এসব নিয়ে কথা বলার বলা যাবে।”

শোভন এবং মিতুও তাতে সায় দিল। জিয়ান মিতুর হাত ধরে অনুরোধ করে বলল,

“নিতুর সাথে একটু কথা বলব আপা!”

“নিতু তোমার সাথে কথা বলবে না।”

“আপা প্লিজ! বেশি সময় নেব না।”

জিয়ানের আকুতি-মিনতি শুনে রাজি হলো মিতু। কেবিনে প্রবেশ করতেই নিতু প্রচণ্ড রেগে যায়।

“আমি বলেছিলাম, উনাকে আমার সামনে না আনতে! কেন এনেছিস তাও?”

মিতু শান্তকণ্ঠে বলল,

“ও কী বলে শোন একটু। মাথাটা ঠাণ্ডা কর।”

“আমার কারও কোনো কথা শোনা লাগবে না। তার সংসার আমি করব না।”

নিতুর রাগ কমছে না দেখে জিয়ান কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। উত্তেজিত নিতু কী থেকে কী করে ফেলবে তার কোনো ঠিক নেই।

রাতে শোভন, জিয়ান আর মমতা বেগম হাসপাতালে রয়ে গেলেন। সারা রাত জেগে থাকায় তন্দ্রা ভাব চলে আসে মমতা বেগমের। তিনি নিতুর পাশের বেডে শুয়ে পড়েন। শোভন ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে বলে,

“চলো চা খেয়ে আসি।”

জিয়ান বলল,

“আপনি যান ভাইয়া। আমি এখানেই থাকি।”

অগত্যা শোভন একাই চলে গেল। চা খেয়ে যখন ফিরে এলো জিয়ান সেখানে নেই। সে কেবিনে একবার উঁকি দিয়ে চমকে গেল। নিতুও নেই! শাশুড়িকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল সে। জিজ্ঞেস করল,

“মা, নিতু কোথায়?”

ভয়ে আঁৎকে উঠলেন মমতা বেগম। জিজ্ঞেস করলেন,

“নিতু কোথায় মানে? এখানেই তো ছিল!”

দুজনে মিলে বাইরে বেরিয়ে আসে। শোভন রিসিপশনে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই একজন রিসিপসনিষ্ট বলল,

“স্যার, একটু আগেই তো তার হাজবেন্ড হাসপাতালের সব বিল পে করে তাকে নিয়ে গেল। আপনারা জানেন না?”

শোভন হা হয়ে যায় এই কথা শুনে। পকেট থেকে ফোন বের করে শ্বশুরকে ফোন করার জন্য। তখনই সে জিয়ানের ম্যাসেজ দেখতে পায়।

“ভাইয়া নিতুকে আমি নিয়ে গেলাম। কোথায় যাচ্ছি সেসব এখন বলব না। কিন্তু নিতুকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। আর একবার ও বাড়িতে চলে গেলে আমার কাছে আসবেও না। তাই এভাবে কাউকে কিছু না বলেই নিয়ে যেতে হলো। আপনারা কেউ চিন্তা করবেন না। আমি ওর খেয়াল রাখব।”

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here