তোর শহরে রেখেছি পা পর্ব -২৭ ও শেষ

#তোর_শহরে_রেখেছি_পা
#সমাপ্তি_পর্ব
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

আবরার রা আসতেই নাসরিন খান ওদের বরন করে নেয়। যেহেতু কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে না তাই ওদের বাসর ধরার ও কেউ নেই। তবে রিয়াদ ওদের ঘরটা খুবই সুন্দর করে সাজিয়েছে। সব নিয়মকানুন শেষ করে ওরা রুমে আসে। নাদিয়া আরুহিকে একটা লাল রঙের শাড়ি পরিয়েছে। আবরার রুমে ঢুকেই দেখতে পায় আরুহি ওর জন্য অপেক্ষা করছে। আবরার প্রথমে সালাম দিল,,

“আসসালামু আলাইকুম মিসেস!”

আরুহি মুচকি হেসে বলল,,

“ওয়ালাইকুমুস সালাম মিস্টার।”

“চলুন দু রাকাত নফল সালাত আদায় করি আল্লাহর শুকরিয়ার জন্য।”

“আমি ওযু করেছি। আপনি গিয়ে ওযু করে আসুন।”

আবরার ওযু করে আসলে ওরা দুজনে দু রাকাত নফল সালাত পরলো। তারপর আবরার আরুহির মাথায় রাসুলের শেখানো দোয়া পরে ফু দেয় যাতে ওদের বিবাহিত জীবন সুখের হয়। আবরার আরুহির হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বলল,,

“মিস এখানে আপনার মোহরানার টাকা আছে।”

আরুহি মুচকি হেসে প্যাকেট টা নিয়ে আবার ড্রয়ারে রেখে দিল। আরুহি আবরারের সামনে দাড়াতেই আবরার শক্ত করে আরুহিকে জরিয়ে ধরলো। একটু পরে আরুহি অনুভব করলো ওর কাঁধে দু ফোঁটা পানি। আরুহি বুঝতে পারছে না একটা মানুষ কতটা ভালোবাসলে হালাল ভাবে পাওয়ার পর এভাবে জরিয়ে ধরে কান্না করে। আরুহি মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো এরকম জীবন সঙ্গী দেওয়ার জন্য। ওর চোখ দিয়েও সুখে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরল। আরুহি বলল,

“মিস্টার আমি কি এতটাই খারাপ যে আমাকে পাওয়ার পর এভাবে কাঁদছেন!”

তখন আবরার মাথা উঠিয়ে চোখ মুছে বলল,,

“সব কান্না দুঃখের হয়না কিছু কান্না সুখের ও হয়। আমি এই দিনটার জন্য কতো অপেক্ষা করেছি আল্লাহর দরবারে আপনাকে চেয়েছি। আপনাকে দেখে আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না আপনাআপনি খুশিতে পানি চলে এলো ধন্যবাদ মিস আমার জীবনে আসার জন্য।”

“ধন্যবাদ মিস্টার আমাকে এতো ভালোবাসার জন্য। আর আপনাকেও ধন্যবাদ আমার জীবনে আসার জন্য।”

তারপর দুজনে মিলে ঠিক করে তারা বেলকনিতে গিয়ে চন্দ্রবিলাস করবে। ওরা বেলকনিতে রাখা চেয়ারে বসে। আবরারকে বলে উঠলো,,

“আপনাকে নিয়ে আমি একটা ডায়েরি লিখেছি। সেখানে আমার অনুভূতি আছে। সেখানেই আমি কিছু অনুভুতি লিখেছি আপনাকে নিয়ে সেখান থেকে আমার প্রথম অনুভূতি আপনাকে পরে শোনাবো শুনবেন।”

আরুহি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।আবরার ওর ডায়রি টা নিয়ে এলো যে ডায়েরির মলাটে লেখা #তোর_শহরে_রেখেছি_পা! আবরার আরুহির দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো,,

“তুমি আমার শহরে এলে যখন,
মনটা শান্তহলো তখন,
আশেপাশে রঙের মেলা ছিল ,তুমি আমায় দেখে হাসছিলে আমার পৃথিবী থমকে গিয়েছিল
তোমার ঐ মায়াবী শ্যমবর্ন মুখশ্রীতে। সন্ধ্যায় পেলাম আবার দেখা তোমার তুমি বাচ্চাদের সাথে খেলছিলে। হুট করে আইসক্রিম পরলো তোমার মুখে তুমি অভিমানে ঘুরে দাড়ালে। তখন মনটা চাইছিল তোমার অভিমান ভাঙাতে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। উল্টো তোমার সাথে একটু মজা নিলাম আমিও। যেমনটা নিয়েছিলে তুমিও আমার রঙমাখা নিয়ে। পরেরদিন তুমি হুট করেই আবার হাড়িয়ে গেলে। তখন মনটা আবার অশান্ত হয়ে পরলো।”

পুরোটা শোনার পর আরুহি মুচকি হেসে বলল,,

“এখানে তো আমাদের প্রথম দিনের কথা আছে! আপনি অনেক সুন্দর করে কয়েকটা লাইনে পুরোটা দিন কে লিখেছেন। এটা সত্যি আপনি লিখেছেন?

” আপনাকে নিয়ে সব অনুভূতি লেখিকা আজরিনা জ্যামি লিখেছেন। তবে গল্পে আমার লেখার রুপ দিয়েছেন।”

“ওহ আচ্ছা!”

“এখন কি রুমে যাবেন নাকি ! না আরেকটু থাকবেন?”

“আপনার হাতে হাত রেখে চন্দ্রবিলাশ করতে মন্দ লাগছে না। ইচ্ছে করছে এভাবেই সারারাত গল্প করি দুজনে বসে।”

“করুন না মানা করছে কে?”

“আচ্ছা জনাব আপনার কাছে ভালোবাসা মানে কি?

“পৃথিবীতে সবচেয়ে উচ্চারিত আর আলোচিত শব্দ হচ্ছে “ভালোবাসা” ভালোবাসা একেক জনের কাছে একেক রকম,তবে আমার কাছে ভালোবাসা হলো ভালোবাসার প্রিয়জনের হৃদয়ের সাথে মিশে থাকা। কারো অস্তিত্বের উপস্থিতি নিজের মাঝে ধারন করা। প্রত্যেকটা মুহুর্তে তাকে অনুভব করা। ভালোমন্দে সবসময় তার সাথে থাকা। তার সব স্বপ্ন পুরন করার আকাঙ্ক্ষা রাখা। নিজের সবটুকু বিলিয়ে দিয়ে তার মুখে একটুকরো হাসি ফুটিয়ে তোলা। সবথেকে বড় কথা সারাজীবন তাকে ভালো রাখা তার পাশে থাকা।”

“আপনার মুখে এই কথা গুলো শোনার অনুভূতিটা দারুন!”

“আমার টা তো বললাম আপনার টা বলুন? এমনিতেও আপনি কখনো এটা প্রকাশ করেন না। এতদিন না হয় বুঝলাম কারন ছিল কিন্তু আজ তো সেই কারন নেই। ভালোবাসা লুকিয়ে রাখার জিনিস নয় যদি সেটা হালাল হয়।”

আবরারের কথা শুনে আরুহি মুচকি হেসে বলল,,

“সত্যিই ভালোবাসা লুকিয়ে রাখার জিনিস নয়। “ভালোবাসা “অনেক দামী একটা শব্দ,
মনের অজান্তেই আমরা ভালোবেসে ফেলি।ভালোবাসায় কোন কন্ট্রোল থাকেনা, দুটো মন আপনাআপনি একে অপরের সাথে জরিয়ে পড়ে।
যখন এই ভালোবাসা হালাল ভাবে পবিত্র হয়। তখন এর থেকে সুন্দর আর কিছু হয় না। আলহামদুলিল্লাহ আমাদের দুজনের ভালোবাসা হালাল ভাবে পূর্ণতার রুপ পেয়েছে । ”

“কাউকে শেষ অবদি চাওয়া & পাওয়াটাই হচ্ছে পৃথিবীর শেষ্ঠতম ভালোবাসা ! পৃথিবীতে এক মাত্র পবিত্র এবং হালাল ভালোবাসা হলো স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা !”

“নিশ্চয়ই! তবে স্বামী স্ত্রীর সংসার যে শুধুই ভালোবাসার তা নয় বরং শ্রদ্ধা, দায়িত্ববোধ এবং বোঝাপড়ার এক মিশ্রিত বন্ধন। প্রতিটি সম্পর্কেই কিছু দুঃসময় থাকবে, কিছু মনোমালিন্য থাকবে। হাতের পাঁচ আঙ্গুল তো আর সমান নয়। চিন্তাভাবনার ভিন্নতা কোন খারাপ জিনিস নয়, বরং এটাই আল্লাহর সৃষ্টির সৌন্দর্য।”

“জি সেটা তো অবশ্যই! তবে কি জানেন তো নিজের অবস্থানে থেকে শুকরিয়া আদায় করতে জানলে,প্রতিটা মানুষই সুখী!”

“মাঝে মাঝে কোন কারন ছাড়াই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় বা মন অশান্ত হয়ে উঠলে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললে মনে আলাদা প্রশান্তি অনুভব হয়।’

আরুহির কথা শুনে আবরার মুচকি হাসলো আর বলল,

“ধন্যবাদ মিসেস নিশান আবরার আমাকে অর্ধেক দ্বীন অর্জন করতে সাহায্য করার জন্য!”বিবাহ হচ্ছে মুমিন নারী পুরুষের জন্য দ্বীনের অর্ধেক ।

“আপনাকেও ধন্যবাদ আমাকে অর্ধেক দ্বীন অর্জন করতে সাহায্য করার জন্য!”

ওদের মাঝে কিছুক্ষণ নিরবতা চললো তারপর হুট করে আবরার বলল,,

” মিস আপনি কি আমার হুমায়রা হবেন?”

আরুহি মুচকি হেসে বলল,,

“হুমায়রা কিন্তু অনেক অভিমানি ছিল। পারবেন তো সবসময় অভিমান ভাঙাতে!”

“অভিমান টা সবসময় তার প্রিয়তম রাসুলুল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর করতেন। রাসুলুল্লাহ (স) সবসময় সুন্দর করে তার অভিমান ভাঙাতেন। আমিও তেমন ভাবে আপনার অভিমান ভাঙাবো ইনশাআল্লাহ।”

“আম্মাজান আয়েশা (রা) কে জানিনা কেন সবথেকে আমার বেশি ভালো লাগে। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সবথেকে প্রিয় বিবি ছিলেন তিনি কি সুন্দর তাকে হুমায়রা বলে ডাকতেন। কল্পনা করলেও কি সুন্দর আলাদা প্রশান্তি আসে। ”

“আচ্ছা বললেন না তো আমার হুমায়রা হবেন নাকি?”

“হবো! তবে শর্ত আছে!

” কি শর্ত বলুন!

” আমাকে সবসময় অনেক ভালোবাসতে হবে!

একথা শুনে আবরার মুচকি হেসে বলল,,

“আর না বাসলে আপনিও বুঝি গাল ফুলিয়ে বসে থাকবেন হুমায়রার মতো ?

“হুম থাকবোই তো! আমি জানি আপনি আমায় খুব ভালোবাসেন!

‘আমিতো আপনাকে ভালোবাসি সেটা জানেন তা আপনি আমায় ভালোবাসেন না বুঝি?

হুট করে আবরারের মুখে এমন কথা শুনে আরুহি থম মেরে গেলো। আসলে ও ভাবতেই পারেনি ও এমন কথা বলবে। ও কিছু বলছে না দেখে আবরার আবার ও বলল,,

“কি হলো মিস চুপ করে গেলেন কেন এখনো কি সঠিক সময় আসেনি?”

আরুহি মুচকি হেসে বলল,,

“আনা উহিব্বুকা”

বলেই আরুহি দৌড়ে রুমের ভেতরে চলে গেল। আবরার এই কথার মানে বুঝতে পারলো না। ও ভাবতে লাগলো কি হতে পারে। হুট করে ফোনের কথা মাথায় আসতেই ও রুমে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে কথাটা সার্চ দিলো। কথাটার মানে বুঝতে পেরে আবরার হেসে বলল ,,

“ভালোবাসি কথাটাও রহস্য করে বললেন আপনি। আপনি সত্যিই রহস্যময়ী কন্যা। ”

আবরার আরুহির দিকে তাকিয়ে দেখলো ও বিছানায় বসে আছে তা দেখে ও বলল,,

“আমি আপনাকে আমার ভালোবাসার রঙ দিয়ে রাঙাতে চাই আপনি কি অনুমতি দিবেন!”

আরুহি লজ্জা মিশ্রিত মুখে বলল,,

“তবে সে আসুক। তার ভালোবাসার রঙ দিয়ে আমার শহর রাঙিয়ে তুলুক।”

______________________

পরের দিন সকালে আবরার আরুহির ঘুমন্ত মুখশ্রী এর তাকিয়ে আছে। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে মুখের ওপর। আবরার খুব যত্ন সহকারে চুল গুলো সরিয়ে দিল। কিছুক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে থাকার পর আরুহি পিটপিট করে চোখ খুলে আবরার কে দেখতে পেল মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আবরার মুচকি হেসে বলল,,

“মাশাআল্লাহ আমার বউটাকে ঘুমন্ত অবস্থায় ও কি সুন্দর লাগে। তা ঘুম কেমন হলো মেরে রানী?”

আবরার এর কথা শুনে আরুহি লজ্জা পেল। আর বলল,,

“কখন সকাল হয়ে গেছে। আপনি আমাকে ডাকতে পারতেন তো?”

“তোমার ঘুম ভাঙতে ইচ্ছে করছিল না।”

“সকাল সাতটা বেজে গেছে সরুন এখন গোসল করে কাজা সালাত পরতে হবে। আপনি আগে উঠে পরেছেন তাহলে ফ্রেশ হন নি কেন ফ্রেশ হয়ে নামাজ তো পরতে পারতেন?”

“বিয়ের পরের দিনই শাসন করছেন ভালো! তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একসাথে নামাজ পারবো বলে। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন স্বামী স্ত্রী একসাথে নামাজ পড়া সুন্নত। তুমি গোসল করো ততক্ষনে আমি তোমার জামাকাপড় বের করে দিচ্ছি।”

“আমার টাইম লাগবে আপনি বরং আগে গোসল করে আসুন।”

“ওকে আপনি যাস্ট দশ মিনিট অপেক্ষা করো আমি এখনি গোসল করে আসছি।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

কিছুক্ষণ পর আবরার গোসল করে ওযু করে বের হলো। তারপর আরুহি গোসলে ঢুকলো। ও গোসল করে বের হতেই দেখতে পেল আবরার দুটো জায়নামাজ বিছিয়ে রেখেছে। আরুহি মাথায় সুন্দর করে ঢেকে আবরারের সাথে কাজা সালাত আদায় করে নিল।
আবরার আর আরুহি একসাথে নিচে আসলো। নিচে আসতেই নাসরিন খান ওকে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলেন। তখন নাদিয়া গিয়ে আরুহির সাথে দুষ্টুমি করছে। নাসরিন খান আরুহিকে সবার সাথে ড্রাইনিং টেবিলে বসালো কারন খাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। আবরার ও গিয়ে আরুহির পাশে বসলো। তখন হুট করে আরুহি বলল,,

“মা আপনার ছেলে বলছিল আজ আপনার হাতে খাবে।আপনি তাকে যদি একটু খায়িয়ে দিতেন আর কি?”

আরুহির কথায় পুরো পরিবেশটাই যেনো থমকে গেল। আবরার তো পুরো অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো। আবরারের তাকানো দেখে আরুহির খুব হাসি পেল কিন্তু ও হাসলো না। নাসরিন খান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,,

“সত্যি নিশান আমার হাতে খেতে চেয়েছে?”

“হ্যা চেয়েছে তো?”

“নিশান সত্যি তুমি আমার হাতে খেতে চাও।”

আবরার এখন কি বলবে আবরার বুঝতে পারল আরুহি ওদের সম্পর্ক টা সহজ করতে চাইছে। ও নিজেও সহজ হতে চায়। তাই ও আরুহির সাথে তাল মিলিয়ে বলল,,

“আপনার যদি কোন অসুবিধা থাকে তাহলে দরকার নেই।”

আবরারের কথা শুনে আরুহিসহ সবার মুখে হাসি ফুটে উঠল। নাসরিন খান বললেন,,

“না আমার কোন অসুবিধা নেই।”

নাসরিন খান তাড়াতাড়ি করে ছেলের খাবার বেরে মাখিয়ে ছেলের মুখের সামনে ধরলো। আবরার আরুহির দিকে তাকালো আরুহি চোখ দিয়ে ইশারা করলো খেতে। আবরার খাবারটা মুখে দিলো। নাসরিন খান আর আবরারের চোখে পানি চিকচিক করছে। নাসরিন খান হেসে ছেলেকে খাওয়াচ্ছে। আবরার নিজের মায়ের হাতে খেতে পেয়ে খুব খুশি। সবার খাওয়া শেষ হলে নাসরিন খান আরুহিকে বলল,,

“ধন্যবাদ মা! ” আমি জানি তুমি ইচ্ছে করেই এমনটা করলে।

আরুহি মুচকি হেসে বলল,,

“সে নিজে আপনাদের সাথে সহজ হতে চায়। তাই আমি শুধু একটু এগিয়ে দিলাম।”

নাসরিন খান আরুহির মাথায় হাত রেখে বলল,,

“আল্লাহ তোমার সকল চাওয়া পূরণ করুক।”

“আমিন!”

তখন আবরার আরুহিকে ডাকলো। আরুহি আবরারের কাছে গেল। ওরা ওপরে চলে গেল। আবরার কে আজ অনেক খুশি লাগছে।ওপরে গিয়ে আবরার আরুহিকে বলল,,

“এরকমটা করার জন্য ধন্যবাদ!”

“এটা আমার দায়িত্ব! আপনাদের যত তাড়াতাড়ি সম্পর্ক সহজ হবে। তত তাড়াতাড়ি আমাদের সংসারে শান্তি ফিরে আসবে। আর আপনাকেও ধন্যবাদ আমার কথা শুনে মায়ের হাতের খাবার খাওয়ার জন্য!”

“আমি সেই ছোটবেলা থেকেই এই দিনটা চেয়েছিলাম।”

“হুম!”

“এখন একটু রেস্ট নিন। আরেকটু পর আশেপাশের মহিলারা আপনাকে দেখতে আসবে যদিও আমরা অনুষ্ঠান করছি না সেরকম ভাবে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

____________________

বিকেলে আরুহি আর আবরার আরহামদের বাড়িতে গেল। আরহাম বোনকে পেয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। ওদের দুজন কে দেখে মনে হচ্ছে একদিন পর না পুরো এক যুগ পরে দেখলো। আরুহি বলল,,

“কেমন আছো ভাইয়া!”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?”

“এই তো আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”

“আশেপাশে আমরাও কিন্তু আছি!”

আফরিনের কথা শুনে আরুহি মুচকি হেসে বলল,,

“আরে মাই ডিয়ার সুইট ভাবি। কেমন আছো আমার ভাতিজা ভাতিজি কেমন আছে?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি তারাও ভালো আছে। আচ্ছা আমরা কিন্ত এখনো জানিনা পেটে কে কে আছে তুই সবসময় দুজনের কথাই বলিস কেন?”

“আমি জানি আমার ভাইয়ার একটা ছেলে হবে একটা মেয়ে হবে তাই বলি।”

“উনি সব জান্তা!”

আরুহি মুচকি হেসে সবার সাথে কুশল বিনিময় করলো। তখন আফরিন বলল,,

“তোর ভাইয়া আজ নিজের হাতে তোর জন্য সব রান্না করছে।”

“আই নো আমি জানতাম আমার ভাই এরকম কিছু করবে।”

তখন আরহাম বলল,,

“বিয়ের পর তো দেখছি তোর মুডটাই চেন্জ হয়ে গেছে।”

“বিয়ের পর সবাই চেন্জ হয় ওকে। যেমন তুমিও হয়েছিলে।”

“আমি চেন্জ হয় নি যেমন ছিলাম তেমনি আছি। একদম নাদান অবুঝ বালক।”

“তুমি নাদান অবুঝ বালক হলে আমার ভাতিজা ভাতিজি আসছে কোথা থেকে।”

এ কথা শুনে আরহাম আর আফরিন ভিশন লজ্জা পেল। বাকি সবাই হেসে উঠল তখন আরহাম বলল,,

“বিয়ের পর দেখছি তোর লজ্জাসরম একদম নেই। যা ওপরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়।”

আরুহি আবরার কে নিয়ে রুমে চলে গেল। আরহাম রাতে আরুহি কে খায়িয়ে দিল। পরের দিন ওরা চলে গেল।

______________

দেখতে দেখতে কেটে গেল কয়েকমাস এ কয়েকমাসে পাল্টেছে অনেক কিছু। আবরার ওর মা বাবার সাথে সহজ হয়ে গেছে। এটা অবশ্য আরুহি করেছে।আজকাল আবরার ওর মা বাবার কাছে ছোটবেলার মতো বায়না করে।আবরার এর রেফারেন্স নাহিয়ান খান করেছিলেন সেটা ও আরুহিকে বলেছে। আবরার এখন সবার সাথে হাসিখুশি ভাবে থাকে। ওর শহরে মন খারাপের গল্প নেই। আবরার আরুহি ছাদে বসে বাগান বিলাস করছিল। আবরারের বুকের সাথে লেপ্টে আছে আরুহি। দুজনের সম্পর্ক টা অদ্ভুত গতিতে চলছে। ওদের মাঝে এখন অব্দি ঝগড়া হয় নি‌। দুজন দুজনের সাথে সুন্দর ভাবে মানিয়ে নিয়েছে। হুট করে আবরার বলল,,

” তুমি আমার উত্তম স্ত্রী সেটা প্রথম দিনই প্রমান করছিলে তুমি। আমার জীবনের সবথেকে সুন্দর নারী তুমি আমার অর্ধাঙ্গীনী”

“যেমন!”

“উত্তম স্ত্রীই পারে হৃদয় বাগের ফুটন্ত ফুল দিয়ে স্বামীকে সাজাতে এবং ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে স্বামীর সব দুঃখ-বেদনাকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিতে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন-

❝জীবন আনন্দদায়ক,আর সবচেয়ে মধুর আনন্দ হচ্ছে একজন উত্তম স্ত্রীর সাহচর্য।❞
[সহিহ মুসলিম: ১৪৪৭]

একজন নারী তখন সুন্দর যখন সে সৌন্দর্যের কর্মকান্ডের গুণে গুণান্বিত। তুমি আমার জীবন থেকে দুঃখ বেদনাকে সরিয়ে দিয়ে সুখ ভরে দিয়েছো। এখানে নেই কোন কষ্ট। তোমাকে ধন্যবাদ বলে শেষ করতে পারবো না।”

আরুহি মুচকি হেসে বলল,,

“আমি মানেই আপনি আর আপনি মানেই আমি। আপনার দুঃখ কষ্ট মানে আমার দুঃখ কষ্ট। আমি আমার দুঃখ কষ্ট লাঘব করেছি এতে ধন্যবাদের কি আছে।”

আবরার কিছু বলবে তখনি নিচে থেকে চেঁচামেচির শব্দ শোনা গেল। আফরিনের লেবার পেইন উঠেছে। আরহাম বাড়িতেই ছিল। সকলে আফরিন কে হাসপাতালে নিয়ে আসে।এখন সবাই হাসপাতালের করিডরে আছে আজ আফরিনের ডেলিভারি হবে। আরুহি খুব শক্ত করে নিজের ভাইয়ের হাত ধরে আছে। কিছুক্ষণ পর দুটো বাচ্চাকে কাপড়ে মুড়িয়ে আনে নার্স। আরহাম খুশিতে কেঁদে দেয়। সবাই খুব খুশি আরহাম নিজের ছেলেমেয়েদের কানে আজান দিল। আরুহির কথাই হয়েছে আরহাম এর একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হয়েছে। দুটো বাচ্চাই দেখতে মাশাআল্লাহ খুব সুন্দর হয়েছে।আরহাম আফরিন কে গিয়ে খুশিতে জরিয়ে ধরলো। আনোয়ার খান আর নাহিয়ান খান মিস্টি এনে পুরো হাসপাতালে বিলিয়েছে। হুট করে আবরার আরুহির কাছে গিয়ে বলল,,

“মিসেস মামা তো হয়ে গেলাম। এখন যে বাবা হতে ইচ্ছে করছে।”

একথা শুনে আরুহি মুচকি হেসে বলল,,

“সঠিক সময় হোক সব হবে। তখন মামা থেকে প্রমোশন পেয়ে বাবা হয়ে যাবেন।”

আবরার আর কিছু বললো না। মুচকি হেসে আরুহির পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। আরুহি ওর থাকা বাচ্চাটাকে আবরারের কোলে দিল।তখন আবরার বলল,,

“এই না আমি বাচ্চা নেব না যদি পরে যায়।”

“আরে পরবে না এই দেখুন না এভাবে ধরুন। একটা বাচ্চাকে কোলে নিতে পারেন না। আবার বলেন বাবা হবেন।”

“বাবা তো আমি হবোই আর কোলেও নেব। এই দেখো কি সুন্দর করে কোলে নিয়েছি।”

“হুম তা তো দেখতেই পাচ্ছি।”

“এই আপনি একটু নিন না আমার ভয় হচ্ছে যদি পরে যায়। কেমন নড়াচড়া করছে।”

আবরারের অবস্থা দেখে আরুহি হেসে বলল,,

“দিন আমার কাছে দিন। ভাইয়া কে দেখলেন না একাই দুজনকে কোলে নিল। আর আপনি একজন কেই পারছেন না।”

“এবার তো আমাকে কোলে নেওয়া শিখতেই হবে। আরহাম ভাইয়া যখন পারে আমিও পারবো। তুমিই না বলো আমি আরহাম ভাইয়ার মতো।”

“হ্যা তো! ভাইয়া যেমন আমার বেস্ট ভাই । তেমন আপনিও বেস্ট জামাই।”

“সত্যি তাই!”

“হুম তাই। ”

“ভাইয়া ঠিকই বলে বিয়ে করে লজ্জাসরম ভুলে গেছো। সবার সামনে জামাই নিয়ে কথা বলছো।”

“কেউ শুনেনি এই যে আমি আর আপনি সবার থেকে একটু দূরে আছি।”

“এই নাও এখন ওকে ধরো। আমি এখন আরেকজন কে কোলে নেব। আমি কোলে নেওয়া শিখে গেছি।”

“হুম যান।”

_____________________

একবছর পর,,

আবরার হাসপাতালে ছিল। হুট করেই ওর মা ফোন দিয়ে বলল আবরার কে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে আরুহি অজ্ঞান হয়ে গেছে। আবরার কে আর পায় কে সে ছুটে এসেছে তার প্রানপ্রিয় স্ত্রীর কাছে। বাড়িতে গিয়ে দেখে আরুহি শুয়ে আছে। নাসরিন খান আরুহির পাশে বসে আছে‌। আবরার গিয়ে আরুহির কপাল গলা চেক করলো। আর অস্থির হয়ে বলল,,

“কি হয়েছে মা আরুহির। ও অজ্ঞান হলো কিভাবে আর ও ঠিক আছে তো কিছু হয় নি তো ডাক্তার কি বলেছে?”

তখন নাসরিন খান বললেন,,

“নিশান শান্ত হও আরুহি ঠিক আছে তবে তোমার দায়িত্ব বেড়ে গেছে। এখন থেকে বেশি বেশি আরুহির যত্ন করতে হবে। আর,”

“আরুহি যখন ঠিক আছে তাহলে ও অজ্ঞান হয়ে গেলো কিভাবে। আর বেশি যত্ন তো আমি এমনিতেই করি বেশি বেশি করতে হবে কেন?আর কি ,”

নাসরিন খান কিছু বললেন না। মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলেন। তখন আবরার বলল,,

“আরে মা কোথায় যাচ্ছো বলে তো যাও।”

তখন নাসরিন খান বললেন,,

“বাকিটা আরুহি বলবে!

আবরার আরুহিকে বলল,,

“বুজলাম না মা কি বলে গেল!”

তখন আরুহি মুচকি হেসে বলল,,

“মিস্টার আপনার প্রমোশন হয়েছে আপনি বাবা হতে চলেছেন!”

“ও ওওওও ……….. কি!”

আবরার পুরো জমে গেছে। ওর অবস্থা দেখে আরুহি মুচকি হাসলো আর বলল,,

“আপনি ঠিক আছেন তো?”

আবরার আরুহির দিকে তাকালো আর মাথা দিয়ে জিজ্ঞেস করল সত্যি আরুহি মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলো সত্যি। আবরার কে আর পায় কে আবরার আরুহি কে কোলে উঠিয়ে পুরো ঘর ঘুরালো। আর চিৎকার করতে লাগলো,,

“আরুহি তুমি জানো না তুমি আমাকে কি সুখ দিলে। আরুহি আমি আজ ভিশন খুশি। তুমি আমাকে সম্পুর্ন করে দিলে। আই লাভ ইউ মাই লাভলি ওয়াইফি।”

“আরে কি করছেন আমাকে নামান। আমার মাথা কিন্তু ঘুরাচ্ছে।”

“ওহ সরি সরি ! আমি তোমাকে বোঝাতে পারবো না আমি কতো খুশি আজ।”

“আমিও ভিশন খুশি মিস্টার।”

“এখন থেকে তুমি সিঁড়ি দিয়ে নামবে না। আমি তোমাকে কোলে করে সিঁড়ি পার করে দেব। আমি তোমাকে রোজ খায়িয়ে দেব। তোমার টক খেতে মন চাইলে আমাকে বলবে। কোন অসুবিধা হলে আমাকে বলবে। মুড সুইং হলে আমার সাথে ঝগড়া করবে । আমার ওপর রাগ ঝারবে। কোনকিছু দরকার হলে আমাকে বলবে আমি তোমার জন্য সাথে সাথে নিয়ে আসবো‌। তোমার মাথায় তেল দিয়ে দেব তোমার চুল বেঁধে দেব। তোমার অনেক কেয়ার করবো আর খুব ভালোবাসবো তোমাকে আর বেবিকে।

“আরে থামুন থামুন এরকম করলে লোকে আপনাকে বউ পাগল বলবে।”

“বলুক তাতে আমার কি! ভালোবাসা লুকিয়ে রাখার বস্তু নয়। যদি সেটা হালাল হয়। নিজের স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসাও অন্যদের কাছে প্রকাশ করা যায়। খোদ নবীজি (স) বলেছেন:
আমাকে খাদীজার ভালোবাসা দান করা হয়েছে। (তার প্রতি আমার ভালোবাসাটা আল্লাহর হাদিয়া)।
(মুসলিম)
আমি নাহয় ভালোবাসা না বলে দেখিয়ে প্রকাশ করলাম।”

আরুহি কিছু বললো না মুচকি হাসলো। কারন আবরার তখন খুশি হয় তখন ওর মাথা ঠিক থাকে না। যা ইচ্ছে তাই করে। এর প্রমান এর আগেও পেয়েছে। যেদিন ওর সাথে ওর বাবা মায়ের সব ঠিক হয়ে সেদিন সবার সামনেই আবরার ওর গালে চুমু দিয়েছিল। কিযে লজ্জা পেয়েছিল আরুহি‌ তা বলে বোঝানোর মতো না।

আবরার যা বলেছে তাই। প্রতিদিন নিয়ম করে সিঁড়ি দিয়ে আরুহিকে নামায় আবার ওঠায়। নিজের হাতে খায়িয়ে দেয়। আর ও হাসপাতালে গেলে বলে দিয়েছে আরুহি যেন একদম নিচে না নামে। মিস্টিকে পাহাড়ায় রেখেছে। আরুহিও আবরারের অবাধ্য হয় নি। প্রথম প্রথম আরুহি লজ্জা পেলেও পরে অভ্যেস হয়ে গেছে। আবরার এর কেয়ার দেখে মাঝে অবাক হয়ে যায় একটা মানুষ কিভাবে পারে। সারাদিন হাসপাতালে থেকে এসে আরুহির চুল বেঁধে দেয়। গল্প শোনায় এটা করে ওটা করে। দেখতে দেখতে আরুহির ডেলিভারির সময় চলে আসে আরুহির অবস্থা দেখে আবরার ও কেঁদে উঠে। হাসপাতালে আবরার ওর বাবার হাত ধরে ছোট বাচ্চার মতো বসে ছিল। এদিকে আরহাম ও তাই আফরিন এর হাত শক্ত করে চেপে ধরে ছিল। অবশেষে আরুহির কোল আলো করে একটা কন্যা সন্তান আসে। আবরার সবার প্রথমে বাচ্চাটাকে কোলে নেয়। আর কপালে চুমু দেয়। তার কানে আজান দেয়। আরুহির জ্ঞান ফিরে আসলে আবরার গিয়ে আরুহিকে জরিয়ে ধরে। আরুহি নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু দেয়। আবরার আর আরুহির খুশি যেনো আজ আকাশ ছুয়েছে। সন্তানের মাধ্যমে একজন নারী পূর্ণতা লাভ করে।

______________

আবরার আর আরুহি বেলকনিতে বসে আছে। ওদের বাচ্চা রুমে ঘুমাচ্ছে ওদের বাচ্চার বয়স ছয় মাস হলো। আবরার হুট করে বলল,,

“আনা উহিব্বুকা!”

আরুহি মুচকি হেসে বলল,,

“আমিও আপনাকে ভালোবাসি!”

“আনা উহিব্বুকা যখন তুমি বলেছিলে তখন আমি এটার মানে জানতাম না। আমি রুমে এসে তার মানে সার্চ দিয়েছিলাম আর মানে টা ছিল আমি তোমাকে ভালোবাসি। এটা মরোক্কোর ভাষা।”

“আপনিই আমার পূর্ণতা আপনাতেই আমি সম্পূর্ণ।”

আবরার কিছু বললো না। মুচকি হেসে আরুহিকে জরিয়ে নিল পরম যত্নে।

“আগলে রাখুন সেই মানুষটাকে যে কোনো কারন ছাড়াই নিয়মিত নিঃস্বার্থভাবে আপনাকে ভালোবাসে!”

~সমাপ্ত~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here