সেদিন বসন্ত ছিল ২ পর্ব – ৭+৮+৯

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুৃমা_রাহা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পর্বঃ০৭

প্রেগ্ন্যাসি কিট হাতে বিরস মুখে বসে আছে নোভা। দু’ঘন্টা সময় যাবত অনসনে বসেছে সে। সম্মুখে দৃশ্যমান দুটো লাল দাগ দেখে মাথা ঘুরে গিয়েছে তার। এত এত সতর্কতা অবলম্বন করার পরও এই পজিটিভ রেজাল্ট সে মেনে নিতে পারছে না। কেন হলো এমন!

“মা আমি এবরশন করাতে চাই। আমাকে হসপিটালে নিয়ে চলো।”

পিনপতন নীরবতাময় কক্ষে বজ্রাঘাতের ন্যায় শোনালো নোভার কণ্ঠ নিঃসৃত উক্ত বাক্যটুকু। ফাহিমা করিম ঠিক ততোটাই কেঁপে উঠলেন, যতটা কেঁপে ওঠে ধরনী প্রবল ভূমিকম্পে।

নোভা তখনো ভাবলেশহীন বসে আছে; যেন এই মূহুর্তে সে কি বলেছে তা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র অবগত নয় সে।

এহেন সময় ঘটনাস্থলে রিফাতের আবির্ভাব ঘটতেই ফাহিমা করিম বাজখাঁই গলায় বললেন,
“তোর বউ পাগল হয়ে গেছে রিফাত। পারলে একে সামলা নইলে পাগলাগারদে রেখে আয়। আমার বাড়িতে কোনো পাগলের জায়গা হবে না।”

রিফাত নোভার দিকে তাকাল। সে নির্বিকার বসে আছে। তার উপস্থিতি টেরই পায় নি এমন একটা ভান। ঘটনার মর্মার্থ বুঝার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো রিফাত । অতঃপর ফাহিমা করিমের পানে তাকিয়ে বলল,
“কি হয়েছে মা?”
ফাহিমা করিম নোভার দিকে অগ্নিশর্মা হয়ে তাকিয়ে বললেন,
“ওকেই জিজ্ঞেস কর। আমি গেলাম। সামলা ওকে। এসব পাগলামি আমি মেনে নিব না বলে দিলাম।”
বলেই গটগট করে হেঁটে কক্ষ পরিত্যাগ করলেন ফাহিমা করিম।

রিফাত নোভার সামনে বসতেই নোভা দুটো লাল ভেসে ওঠা কিট হাতে ধরিয়ে দিল। ঘটনার সারমর্ম বুঝতেই রিফাতের চক্ষুদ্বয় চিকচিক করে উঠল। আনন্দে আত্মহারা হলো। যেমনটা পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চাকে নতুন খেলনা দিলে হয়।

নোভা রিফাতের আহ্লাদী মনটায় বিষন্নতা ঢেলে দিয়ে বলল,
“আমি এবরশন করাতে চাই।”

রিফাত এক মূহুর্তের জন্য থমকে গেল।থমকে গেল চিন্তাশক্তি। পর মূহুর্তেই গম্ভীর গলায় বলল,
“এর কারণ?”
নোভা এবারে আর নির্বিকার থাকতে পারল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। রিফাত নরম হলো একটুখানি। কান্নারত নোভার চিবুকে হাত গলিয়ে নরম গলায় বলল,
“কি হয়েছে পিচ্চি? আমাকে বলো।”
নোভা ঠোঁট বেঁকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ও এলে আমি আরাবীর খেয়াল রাখতে পারব না। ও এলে যদি আমি আরাবী কে কম ভালবাসি? ভাবী কে আমি কি জবাব দেব? যদি আমার জন্য আরাবীর ক্ষতি হয়ে যায়? যদি আমি স্বার্থপর মা হয়ে যাই?”

রিফাত হেসে ফেলল নোভার বাচ্চামি দেখে। নিজেই এখনো বাচ্চা। অথচ এই বাচ্চা নাকি মা হবে! এক বাচ্চা আরেক বাচ্চার জন্ম দেবে!

নোভার মাথার বাদামী রঙা মসৃণ চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
“তুমি শুধু ওকে পৃথিবীতে এনে দাও। তারপর ওর সব দায়িত্ব আমার। তুমি আরাবীর খেয়াল রাখবে, আমি তোমাদের। এটা নিয়ে কেউ এমন নিষ্ঠুরতম কথা বলে?পাগলী বউ আমার।”

নোভা তবুও বাচ্চামিতে মেতে রইল যেন। জেদ দেখিয়ে বলল,
“আমি এতকিছু জানিনা। ওর আসার উপযুক্ত সময় এখন নয়।”

রিফাত রেগে গেল। ভয়ংকর রাগ কৃষ্ণবর্ণ মুখেও ফুটে উঠল। কড়া গলায় বলল,
“কানের নিচে এমন একটা দেব না, সব ভীমরতি বাপ বাপ করে পালাবে। বাচ্চা তোর একার?একা পয়দা করছোস? আরেক বার বলে দেখ কষিয়ে দু’ঘা লাগাব।”

নোভা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“তুমি আমার গায়ে হাত তুলবে?”

রিফাত ফাটা বেলুনের ন্যায় চুপসে গেল। মিনমিনে গলায় বলল,
“গায়ে হাত তুলব কখন বললাম? আমি তো গালে হাত তুলব।”

নোভা বিষন্নতা ঝেড়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। রিফাত মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গলাধঃকরণ করল সেই মুক্তোঝরানো হাসিটুকু।

“আমার এত বছরের পরিশ্রম বৃথা যেতে দিও না ইভানা। আমার অনুপস্থিতিতে আমার সাফল্যের ভাগীদার হয়ে আমার স্বপ্নকে বাস্তবের রূপ দিও।”
গোটা গোটা অক্ষরে লেখা এতটুকু বার্তা। সাথে স্প্যানিশে লেখা কিছু সাংকেতিক সংলাপ।

ল্যাবটবের স্কিনে মনোনিবেশ করেছে ইমরান। তীক্ষ্ণ নজর বুলিয়ে বছর তিনেক আগের লেখা আবরারের শেষ বার্তা থেকে বের করার চেষ্টা করছে নতুন কোনো তথ্য।
সাংকেতিক সংলাপগুলোর দিকে ভ্রু যুগল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“এগুলো কি ইভানা? এগুলো তো রাসায়নিক সংকেত। এগুলো এখানে কি করছে?”

ইভানা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। শূন্যে তাকিয়ে বলল,
“যদি আমি ভুল না হয়ে থাকি, তবে এগুলোই আমার অকাল বৈধব্যের কারণ।”

ইমরান চকিতে তাকাল। এক মূহুর্তও বিলম্ব না করে বলল,
“এগুলো….”
ইভানা মাথা নাড়ালো। রুদ্ধশ্বাস সমরে আর খানিকটা পথ এগিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায় জানিয়ে বলল,
“এগুলোই তার আবিষ্কৃত ফর্মুলা। যা গত ছয়টি বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তুলেছে সে। অথচ যখন সাফল্য এসে তার শিওরে বসবে তখনই তাকে দুনিয়া ছাড়তে হলো। জীবন কি অদ্ভুত না? দিয়েও দেয় না। কেড়ে নিতে বড্ড পটু সে।”

ইমরান স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কষ্টে জর্জরিত একটা নারী অবয়বের দিকে। যিনি কষ্টে হাসতে জানে। কষ্ট চেপে রেখে স্বামীর মৃত্যুর কারণ খুঁজতে অথৈজলে হাতরে বেড়াচ্ছে। অথচ সে জানেই না কত জলে কত মাছ!

ইভানার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পুনরায় ল্যাবটবে মনোনিবেশ করল ইমরান। ক্ষুদে বার্তাটির গভীরতা খোঁজার চেষ্টা করল।
বিরবির করে বলল- যার আবিষ্কার কে বাস্তবে রূপ দেওয়ার এত প্রচেষ্টা, সে কি করে আত্মহত্যা করতে পারে! যে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য নিজের সুখ ভুলে বছরের পর বছর পরিবার ফেলে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে সাধনা করতে পারে, সে কি করে আত্মহত্যা করতে পারে! পারে না। পারে না। পারেই না।

ইভানা কিয়দংশ সময় পর ইমরানের দিকে তাকাল। বিরবির করতে দেখে মৃদুস্বরে বলল,
“আপনার কি মনে হচ্ছে? আবরার সত্যি আত্মহত্যা করতে পারে? এই বার্তাটি কি কিছু বলছে না আপনাকে? যার স্বপ্ন কে বাস্তবে রূপ দেওয়ার এত চিন্তা, সে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যাওয়ার মত কাজ করতে পারে?”

ইমরান মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ সে বিশ্বাস করে আবরার আত্মহত্যা করে নি।
কিঞ্চিৎ সময় পর নিজের ইমোশন গিলে ফেলে প্রফেশনাল ভরাট গলায় বলল,
“আপনি এই বার্তা কবে পেয়েছেন মিসেস ফাইয়াজ?”

ইভানা নড়েচড়ে বসল। গলা ঝেড়ে জড়তা কাটিয়ে বলল,
“এটা এসেছিল আবরার মারা যাওয়ার তিন দিন আগে। কিন্তু তখন আমি ওর কাছে যাওয়ার আনন্দে এতটাই মশগুল ছিলাম যে, এদিকে মনোযোগই দিতে পারি নি। আবার তিনদিন পরে যখন ওর চলে যাওয়ার খবর পেলাম তখন ওকে হারানোর ব্যথায় এতটাই কাতর ছিলাম যে তখনো সুযোগ পাই নি দেখার। দেখলাম সেদিন, যেদিন আমি জানতে পারলাম আমার আরাবী আসার কথা। সেদিন আমি এটাও নিশ্চিত হলাম আমার আবরার স্বেচ্ছায় আমাকে ছেড়ে যায় নি। ওকে জোর করে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। খুন করা হয়েছে আমার আবরার কে।”

ইমরান প্রতিত্তোর করার আগেই ইভানার ফোন বেজে উঠল। স্কিনে রিফাতের নাম দেখে মৃদুহেসে হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে হৃদয় শীতল করা বার্তা পেল। মূহুর্তেই দুঃখ ভারাক্রান্ত মুখে সত্যিকারের মুচকি হাসি দেখতে পেল এই ধরনী। যাতে নেই কোনো ভণিতা, যা মেকি নয়, নিখাঁদ।

কথা শেষ হতেই ইমরান মৃদুস্বরে বলল,
“অনধিকার চর্চা না হলে জানতে পারি, কে ছিল কলে? কি এমন বলল যে আপনার মুখে এতদিনে সত্যিকারের খুশি দেখতে পেলাম! যা এতদিনেও পাই নি একবারের জন্যও।”

ইভানা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,
“রিফাত ভাইয়া ছিল। তিনি বাবা হবেন এবং আমাদের পিচ্চি নোভা মা।”

ইমরান হাহুতাশ করার ভঙ্গিতে বলল,
“অথচ আজ আমার বাপ হওয়ার কথা ছিল।”

ইভানা উক্ত কথার সারাংশ বুঝতে বুঝতে পেরে শব্দ করে হেসে ফেলল। বহু বহুদিন পর।
ইমরান অপলক চেয়ে থেকে বিরবির করে বলল,
“এভাবেই হাসতে থাকুন আজীবন। কারো কুনজর আর না পড়ুক।”

চলবে…#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পর্বঃ০৮

দিবাবসানের প্রাক্কালে ফ্লোরেন্সের আকাশে দেখা যায় লাল, হলুদের সংমিশ্রণে সৃষ্ট কমলাটে আভা। সেই আভা ভেসে ওঠে আর্নোর জলেও। স্বচ্ছ নীল জলটুকু লালচে আভায় ছেয়ে থাকে। পশ্চিম আকাশ হয়ে ওঠে গাঢ় লাল। সূর্য যখন ডুবি ডুবি করে পন্টে ভেকিও সেতুর উপর তখন কপোত-কপোতীর পশরা বসে। শুরু হয় প্রেমী যুগলের মিলনমেলা।
এহেন পরিবেশে সেতুর রেলিংয়ে হেলান দিয়ে ইমরান যখন তরঙ্গের সাহায্যে সুখালাপে মত্ত তখন আকস্মিক চোখ জোড়া স্থির হয় একজোড়া প্রেমিক যুগলের উপর। তৎক্ষণাৎ সুখালাপনের সমাপ্তি ঘটিয়ে দৃষ্টি মেলে তাকায় কয়েকগজ দূরে। আপত্তিকর কিছু দৃশ্য এই দৃষ্টিনন্দন স্থানে বড্ড দৃষ্টিকটু ঠেকে তার। তবুও তাকিয়ে রয় অনিমেষ। নতুন কিছু সত্যি খোঁজার তাগিদে!

সন্ধ্যা নামার কিছু প্রহর পরে ইমরান হানা দেয় ইভানার আলয়ে। কিছু সত্যি জানানোর অভিলাষে। ইভানা তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আবছা রোশনাইয়ে স্মৃতি হাতরাতে ব্যস্ত। ইমরানের উপস্থিতি টের পেয়ে একান্ত ব্যক্তিগত সময়টুকু থেকে কিছু সময় ধার দিল তাকে। স্মৃতির পাতা উল্টে রেখে মনোনিবেশ করল বর্তমান প্রেক্ষাপটে।

মিনিট পাঁচেক সময় ধরে ইমরান থম মেরে বসে আছে সিঙ্গেল সোফার নরম গতিতে। বাম হাতে ধূসর রঙা কোমল কুশনের সাজ কাটা সুতো টানতে টানতে মাথা এদিক ওদিক ঘুরাচ্ছে সে।
ইভানা ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে ইমরানের ভাবগতিক বুঝতে চেষ্টা করল। কিন্তু চোখেমুখে লেপ্টে থাকা জড়তার আড়ালে থাকা সত্যির সন্ধান পেল না সে মোটেও। অবশেষে ধৈর্য্যহারা হয়ে বলল,
” আপনি কি বলবেন কিছু? নইলে আমি উঠলাম। আপনি একা একাই মৌনব্রত পালন করুন।”

ইমরান চোখ বন্ধ করে বড় বড় দম ফেলে সাহস যুগিয়ে নিল। পরিস্থিতি অনুযায়ী নিম্নমুখী গলায় বলল,
“আজ আমি পন্টে ভেকিও ব্রিজে গিয়েছিলাম।”

ইভানা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। দায়সারা ভাবে বলল,
“তাতে কি হয়েছে? আমি তো রোজই যাই।”

ইমরান বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল,
“পুরোটা বলতে দিন।”

ইভানা প্রতিত্তোর করল না। সুযোগ দিল তাকে পুরোটা বলার। আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকা দৃষ্টি সামনের মানুষটাকে সাহস যোগাল পরবর্তী বাক্যগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে উগরে দেওয়ার।

“আমি আজ পেট্রিসিয়া কে দেখেছি ব্রিজে, সঙ্গে ইরেশ।”

ইভানা পুনরায় ভ্রুকুটি করে তাকাল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। মনে মনে আওড়ালো – হাদার বাচ্চা; ওরা ব্রিজে গেছে তাতে তোর কি? তুই কি ওরা কার সাথে কোথায় যাচ্ছে সেটা দেখার জন্য এসেছিস! নিজের কাজ কর না ভাই।

ইমরান পুনরায় বলল,
“ওরা একসাথে ছিল এটা আসলে ফ্যাক্ট নয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে, ওরা আপত্তিকর অবস্থায় ছিল। গভীর চুম্বনে লিপ্ত ছিল দু’জনে। এতটাই মগ্ন যে আমাকে খেয়ালই করে নি। অথচ আমি ছিলাম খুব কাছেই।”

ইভানা থতমত খেয়ে গেল। কি বলবে এখন! এজন্যই তবে ছেলেটা তাকে বলতে ইতঃস্তত বোধ করছিল।
হালকা কেশে গলা ঝেড়ে বলল,
“তাতে কি হয়েছে ইমরান? ওরা যেখানে, যার সাথে ইচ্ছে যেতে পারে। এতে আমাদের কি বলার আছে?”

ইমরান মুচকি হেসে বলল,
“আপনি কি কিছু বুঝতে পারছেন না?”

ইভানা নিঃসংকোচে মাথা নাড়ালো। আসলেই বুঝতে পারছে না সে। এসব জেনে তার কি লাভ!

ইমরান পুনরায় বলল,
“আবরার ভাইয়ের এক্সিডেন্টের দিন, আই মিন শেষবার যখন তাকে সুস্থ অবস্থায় দেখা গিয়েছে সেদিন পেট্রিসিয়া সাথে ছিল। পথেও, ল্যাবেও। অথচ তাকে টোপ দিয়েও আপনি মুখ খুলাতে পারেন নি। বন্ধুত্ব, টাকা কোনোটাই তাকে স্পর্শ করে নি। যদি জেনেই থাকে তবে কেন মুখ খুলল না সে? এর দুটো কারণ থাকতে পারে। নাম্বার ওয়ান – খুনী তার কাছের কেউ এবং সে তার সহযোগী। অর্থাৎ দু’জনেই সমানভাবে জড়িত। নাম্বার টু- সে আসলে কিছু জানেই না। তবে দ্বিতীয়টা কারণটা হওয়ার সম্ভাবনা টেন পারসেন্ট। প্রথম কারণটাই জোরালো।”

ইভানা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল। হৃদয় গভীরে হওয়া রক্তক্ষরণ বাইরে প্রবেশাধিকার পাওয়া থেকে আটকাতে প্রাণপণ চেষ্টা করল।
খানিকটা ভেবে স্থির গলায় বলল,
“পেট্রিসিয়ার কাছের মানুষটা কি ইরেশ হতে পারে?”

ইমরান মাথা নাড়ালো। বাম গালে লেপ্টে থাকা জন্মদাগটায় স্পর্শ করে বলল,
“যা দেখেছি তাতে তো দূরের বলে মনে হলো না।”

ইভানার চোখ জোড়া চিকচিক করে উঠল। একপা একপা করে লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছে সে। জীবন সিঁড়ির ধাপগুলো মনে হচ্ছে একেকটা এভারেস্ট। জয় করতে পারবে তো সে? নাকি হাজার হাজার পর্বতারোহীর ন্যায় মুখ থুবড়ে পড়বে মাঝপথেই !

কিঞ্চিৎ সময় পর ইমরান আক্রোশ ভরা গলায় বলল,
“শালা ইরেশেরই কাজ এটা। ওদের তো জাত খারাপ। শালা পাইক্কাদের পূর্ব বংশই তো নারী লোলুপ। সেই যুগেও ছিল, এখনো আছে। আর কেউ না, ইরেশই মেইন কালপ্রিট। পাকিস্তানি তো। ওরা ইহজন্মেও বাংলাদেশীদের ভালোটা সইতে পারবে না। ওর লাল সুতো আমি টেনে টেনে, মেপে মেপে বের করব। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।”

পরের দিন মধ্যাহ্নের খানিকটা সময় পরে ইভানা নিজ মনে ধাপে ধাপে কাজ আগাচ্ছিল। আবরারের আবিষ্কৃত ফর্মুলা অনুযায়ীই কাজ করছে সে। সঙ্গে সহযোগী হিসেবে রয়েছে ইমরান এবং প্রয়োজনে সাহায্য নিচ্ছে সিনিয়র সাইনটিস্টদের একজন গৌতম বিশ্বাসের। ইমরান আনাড়ি হাতে এটা সেটা কেবল এগিয়ে দিচ্ছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বেশ আনন্দও পাচ্ছে সে। ইভানা তাকে কনিকেল ফ্লাক্স নিতে বললে সে গোলতলী ফ্লাক্স নিয়ে দিচ্ছে। গ্লাস রড বললে প্রিপেট নিয়ে দেয়। ইভানা কাজের মাঝেও মুখ লুকিয়ে হাসে। আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়েছে তরুণ গোয়েন্দা!

সেদিনের শেষেই ইমরান যখন তার জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে পা ফেলল তৎক্ষণাৎ নাক সিটকাল সে। ঘরে অযাচিত কারো প্রবেশাধিকারের আভাস পেল। নাসিকা রন্ধ্র ভেদ করে সরু গন্ধ ভেতর পর্যন্ত পৌঁছে গেল তার। সাবধানে সতর্ক দৃষ্টি মেলে ঘরের এফোড় ওফোড় করতেই টেবিলে এক টুকরো কাগজে নজর পড়ল। কলম দিয়ে চাপা দেয়া আছে শুভ্র রঙা ফিনফিনে কাগজটা। পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতেই ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হয়ে এলো নিজ গতিতে।

সাদা কাগজে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা – অভিনন্দন জনাব গোয়েন্দা।

চলবে….#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পর্বঃ০৯

“ধ্বংসের খেলায় আপনাকে স্বাগত মিস ইভানা।”

বাংলা স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণের উপযুক্ত বিন্যাসে সাজানো ছোট্ট চিরকুটে লেখা বার্তায় কারো অপ্রকাশিত হুমকির আভাস পাচ্ছে ইমরান। পটু হাতে বেশ গুটিয়ে গুটিয়ে লেখা একেকটা শব্দ। হস্তলেখ প্রশংসার দাবিদার। নজর কাড়ে এক দেখাতেই।

নিজের কক্ষে পাওয়া চিরকুট এবং ইভানার ঘরে পাওয়া উক্ত চিরকুটের লেখায় স্পষ্ট সাদৃশ্য দেখতে পেল তিন জোড়া আঁখি। ইমরান, ইভানা এবং মৃত্তিকা।

সন্ধ্যার পর আর্নোর তীরে নিজের একান্ত সময়টুকু কাটানোর পর ঘরে ফিরতেই মৃত্তিকা দেখতে পায় বেসিনের উপর থাকা এই নীলাভ কাগজের টুকরো। তৎক্ষণাৎ ইভানাকে জানালে ইভানা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। এরপর সময়ের প্রয়োজনে জেনে যায় ইমরানও।

কাগজ থেকে নজর সরিয়ে ইমরান মৃত্তিকার দিকে সরাসরি তাকাল। খানিকটা ভড়কে গেলেও নিজেকে সামলে নিল মৃত্তিকা। ইমরান অনূভুতিহীন কিন্তু নমনীয় গলায় বলল,
“আপনিই প্রথম দেখেছেন কাগজটা?”

মৃত্তিকা মাথা নাড়িয়ে স্বগোক্তি করলে ইমরান পুনরায় বলল,
“কাউকে দেখেছেন এদিক থেকে বেরিয়ে যেতে? অচেনা কেউ বা যাকে দেখে সন্দেহজনক মনে নয়।”

মৃত্তিকা কাল বিলম্ব না করে মিহি গলায় বলল,
“সন্দেহজনক ছিল কি-না জানিনা। তবে আমার ফেরার সময় সিঁড়িতে একজন লোকের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল। লোকটা একটু অদ্ভুত টাইপের। আমি প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম অথচ সে দেখেও যেন দেখল না। মুখ লুকিয়ে পালিয়ে গেল। তখন বুঝিনি ব্যাপারটা। এখন তো মনে হচ্ছে সে-ই ছিল। নইলে আমাকে দেখে মুখ লুকালো কেন?”

ইমরান তৎক্ষণাৎ কৌতূহলী গলায় শুধালো,
“আপনি মুখ দেখেছেন? চিনতে পারেন নি?”

মৃত্তিকা ঠোঁট উল্টে ইভানার পানে তাকাল। ইভানা একরাশ আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে তারই মুখশ্রীতে। তাকে আশাহত করে হতাশ গলায় বলল,
“মুখ দেখতে পাই নি।”

কিঞ্চিৎ সময় পর উৎসাহী গলায় বলল,
“কিন্তু আমি তাকে চিনি। খুব পরিচিত বলে মনে হচ্ছিল আমার। শুধু কয়েক সেকেন্ডে এর বেশি বুঝতে পারি নি। তবে অচেনা কেউ নয় সে। কাছের কেউই হবে। যে আমাদের চেনা এবং আবরার স্যারের চেনা। এমন কাউকে খুঁজুন যাকে আমি এবং আবরার স্যার দু’জনেই চিনি। দু’জনের পরিচিত।”

ইভানা দিশার আশায় ইমরানের দিকে তাকাল। ইমরান বাম হাতের শাহাদাৎ আঙুলে থুতনি চুলকাচ্ছে আর গভীর ভাবে কিছু ভাবছে।
কিয়ৎক্ষণ পর গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“ভার্সিটির প্রফেসরদের মধ্যেই কেউ হবে সে এবং তিনি সম্ভবত বাঙালি।”

ইভানা চমকে তাকাল। অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
“বাঙালী! আহনাফ?”

ইমরান মাথা নেড়ে বলল,
“হতেই পারে। আবার নাও হতে পারে। বাঙালী তিনি একা নন। আবার এমনটাও হতে পারে যে, অবাঙালি কেউ একজন বাঙালি সেজে আমাদের ভড়কে দিতে চাইছে। আমাদের পথ ভ্রষ্ট করতে চাইছে।”

ইভানার মাথা ভনভন করতে শুরু করল। সোফায় গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে।

মৃত্তিকা কৌতূহলী গলায় বলল,
“আপনি কি করে বুঝলেন সে বাঙালি?”

ইমরান টি-টেবিলে পড়ে থাকা চিরকুট দুটো তুলে ধরে বলল,
“স্পষ্ট এবং নির্ভেজাল বাংলা লেখা। একজন ইতালিয়ানের পক্ষে এই লেখাটা লেখা প্রায় অসম্ভব।”

মৃত্তিকা ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ ভাবল। অতঃপর বলল,
“আপু, আহনাফ স্যার এটা করতে পারে? তোমার কি মনে হয়?”

ইভানা নিভু নিভু চোখ জোড়া খুলে স্মিথ হেসে বলল,
“আমার আর মনে হওয়ার কোনো ফাঁক নেই রে মাটি। আমি যাকে দেখছি তাকেই মনে হচ্ছে আমার আবরারের খুনি। আমার বৈধব্যদশার কারণ। আমার আরাবীর এতিম হওয়ার কারণ।”

মৃত্তিকা এবার ইমরানের দিকে তাকাল। সুদর্শন গোমড়ামুখো ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মিহি গলায় শুধালো,
“আহনাফ স্যারের উপর নজর রাখার প্রয়োজন হলে আপনি আমাকে বলতে পারেন স্যার।”

ইমরান চকিতে তাকাল। কৌতূহলী গলায় বলল,
“আপনি নজর রাখবেন? কিভাবে?”

মৃত্তিকা মৃদু হেসে বলল,
“তার বাড়িতে গিয়ে।”

ইমরান বুঝতে না পেরে ভ্রুকুটি করে তাকালে ইভানা বলল,
“মাটি আহনাফ সরকারের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী।”

ইমরান সরু চোখে তাকাল। মৃত্তিকা মৃদু হেসে বলল,
“লাগবে?”

ইভানা মাঝখানে ফোঁড়ন কেটে বলল,
“তোর যেতে হবে না কোথাও। এহসান তোর ক্ষতি করে দিতে পারে। আর তোর বাচ্চা? তার যদি ক্ষতি হয়?”

মৃত্তিকা মুচকি হাসল। পেটের উপর আলতো হাতে স্পর্শ করে বলল,
“ও তো তারও সন্তান। পারবে, বাবা হয়ে সন্তানের ক্ষতি করতে? একটুও বুক কাঁপবে না? আর কতদিন দূরে থাকব বলো তো আপু? আমার সংসারে ফিরতে হবে না আমার? সারাজীবন কি এভাবেই কাটবে?”

ইভানা তবুও দোনোমোনো করায় মৃত্তিকা আশ্বস্ত করে বলল,
“আমি নিজের খেয়াল রাখব আপু। স্যারের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে যদি আমি বিন্দু পরিমাণও অবদান রাখতে পারি, তবে নিজেকে ধন্য মনে করব আমি। এইটুকু করার সুযোগ আমাকে দাও আপু।”

ইভানা সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিমরাজি হয়ে বলল,
“ঠিক আছে। তবে তুমি একা যাবে না। আমি দিয়ে আসব তোমাকে। সাথে তোমার উশৃঙ্খল ছোকরাকে শাসিয়ে আসব।”
মৃত্তিকা হেসে ফেলল ইভানার কথা শুনে। ইমরানও অপলক চেয়ে দেখল দায়িত্বশীল ইভানা কে।

“আহনাফের বাড়ি গিয়ে প্রধান কাজ তার পরিবারের সাথে আবরারের সম্পর্কের ভিত খুঁজে বের করা। তার পরিবারের সাথে কিভাবে জড়িয়ে ছিল আবরার। মিসেস সরকার কেন চমকে উঠেছিল সেদিন? আহনাফের সাথেই বা কি সম্পর্ক ছিল? কি আছে তাদের পরিবারের আড়ালে? সবটা জানতে হবে এবং মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট হচ্ছে আহনাফের লেখা। তার হাতের লেখা দেখতে হবে। যদি না লেখাতে পারেন তবে পুরনো লেখা খুঁজে বের করতে হবে। এটা মাথায় রেখো। যদি লেখা মিলে যায়, তবে তো হয়েই গেল। নইলে অন্য পথে এগোতে হবে আমাদের। তবে সাবধান মিস মৃত্তিকা। এসব যেন ঘূনাক্ষরেও কেউ টের না পায়। এমনিতেই আমার পরিচয় ফাঁস হয়ে গেছে। না জানি আর কি অপেক্ষা করছে সামনে। তাই সাবধান। আপনি যেন সন্দেহ তালিকায় না পড়েন।”

গম্ভীর কণ্ঠে ইমরানের বলা কথাগুলো শুনে মৃত্তিকা মাথা নাড়লো। অর্থাৎ সে মনে রাখবে সব। মনে মনে শপথও করে ফেলল, যে করেই হোক আবরারের খুনি কে সে প্রকাশ্যে আনবেই।

পরদিন ল্যাবে নিজের ডেস্কের ড্রয়ার খুলতেই ইভানা একই রঙের, হালকা নীলাভ কাগজের টুকরো দেখতে পেল।
তাতে একই হাতের লেখায় গোটা গোটা অক্ষরে ফুটে আছে কিছু শব্দ –
‘আরাবী। আবরারের শেষ স্মৃতি। কিন্তু কতক্ষণ থাকবে….”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here