#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
অন্তিম পর্ব
ফ্লোরো এন্টিমনিক এসিড। স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরীতে যার ব্যবহার খুবই নগন্য। এর শক্তিমাত্রা – ৩১.৩। ১০০% সালফিউরিক এসিডের তুলনায় এই এসিড এক লাখ কোটি গুণ বেশি শক্তিশালী। টেস্টটিউব এবং বিকারকে মূহুর্তেই গলিয়ে ফেলতে সক্ষম এই এসিড নিয়ে কাজ করার অনুমতি পাওয়া সহজসাধ্য নয়। কেবলমাত্র অতিপ্রয়োজনীয় কার্যে অনুমতি সাপেক্ষে এর ব্যবহার করার সৌভাগ্য অর্জন করা যায়।
অতিশক্তিশালী ফ্লোরো এন্টিমনিক এসিড টেফলন পলিমার গঠিত ছোট্ট ঢাকনা আবৃত পাত্রে রেখে ইভানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে হিংস্রতম লোকটি। ইভানা হাত পা বাঁধা অবস্থায় বসে আছে একটি চেয়ারে। চেতনাহীন শরীরটা নুয়ে পড়তে বাকী শুধু। বাঁধন মুক্ত থাকলে বোধহয় এতক্ষণে ফ্লোরে গড়িয়ে পড়তো।
ঠান্ডা পানির তীব্র ঝাপটায় হুঁশ ফিরে পায় সে। চোখ পিটপিট করে তাকায়। নিজের অবস্থান নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়ে নজর বুলায় আশেপাশে। ধাতস্থ হয়ে সবটা অনুধাবন করতেই বুকের ভেতর তুফানের আভাস পায়। এটা.. এটা তো সেই জায়গা!
লোকটা ইভানার মুখ দেখে মনের ভেতর চলা ঝড় আঁচ করতে পারে। হেসে উঠে আকাশ কাঁপিয়ে। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে ইভানার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলল,
“চিনতে পারছো জায়গাটা? এটাই সেই জায়গা, যেখান থেকে তোমার প্রাণপ্রিয় স্বামী আত্মহত্যা করেছিল। আমাদের অতি পছন্দের মেধাবী সাইন্টিস্ট সরি সরি সিনিয়র সাইনটিস্ট ড. আবরার ফাইয়াজ সুইসাইড করেছিল।”
খানিকটা থেমে নিজের চেহারায় ভালো মানুষের মুখোশ পরে নরম গলায় বলল,
“এটা তো সামনের গল্প। পেছনের গল্পটা শুনবে না খুকি? শুনবে না প্রাণ প্রিয় স্বামীর আত্মহুতির গল্প? জানো তো গল্পটা খুব করুণ। কিন্তু কি আর করা যাবে বলো? এটা শুনতেই তো মরণফাঁদে পা দিয়েছো। তোমার ভালবাসার জোর দেখেছো? একই ভাবে, একই নিয়মে, একই যন্ত্রণায় দুজন ইহলোক ত্যাগ করবে। আমি আমার ঈশ্বর কে বলব, তোমাদের যেন অতিদ্রুত মিল করিয়ে দেয়। বেচারা একা একা কতদিন থাকবে। এমন সুন্দরী বউ থাকতে কি-না এতগুলো দিন ধরে একা কবরে শুয়ে আছে।”
ইভানা কোনো কথার প্রতিত্তোর করল না। কেবল ঘৃণাভরা নেত্রে তাকিয়ে রইল সম্মুখে। লোকটা পুনরায় বলল,
“এবার গল্পটা বলি?”
ইভানা এবারেও মৌন রইল। কিন্তু এই মৌনতা সহ্য হলো না তার। ভয় দেখতে চাইছে সে ইভানার চোখেমুখে, ব্যবহারে। ভয়ে জর্জরিত ইভানার করুণ আকুতি দেখতে চাইছে সে। কিন্তু ইভানা! তার যে বসতি ভয়ের উর্ধ্বে। চোখে কেবল তেজস্বী রূপ! অন্তরে প্রলয়ের সুর! কণ্ঠে বর্জ্য ধ্বনি!
লোকটা হাতের নাগালে থাকা ফ্লোরো এন্টিমনিক এসিড তুলে নিয়ে ইভানার চোখের সামনে নিয়ে বলল,
“এটা কি জানো তো? একজন বিজ্ঞানী হিসেবে এটা কিন্তু তোমার জানা উচিৎ। জেনারেল নলেজ আছে তো? নাকি শুধুমাত্র অন্য কারো আবিষ্কার দিয়ে আকাশ ছুঁতে এসেছো?”
ইভানা পাত্রের বাইরের আবরণ দর্শন করে খানিকটা আঁচ করতে পেরেছে। ভেতরে ভেতরে খানিকটা শিহরিত হলেও তা বাইরে প্রকাশ করল না বিন্দুমাত্রও। বাইরে এখনো পূর্বের ন্যায় অনড়।
“ফ্লোরো এন্টিমনিক এসিড। একবার গায়ে ছোঁয়ালে মাংস গলতে সময় নেবে না। পারবে তো সহ্য করতে, বাঙালি বধু! পতি পরায়ণ নারী! পারবে?”
ইভানা মুচকি হাসল। বলল,
“বাঙালি বধু ঠিক কি কি করতে পারে তা তোর মা আর বউ কে জিজ্ঞেস করে দেখিস।”
লোকটা শক্ত হাতে ইভানার খোলা চুলের গোছা মুঠোবন্দি করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এখনো এত তেজ কিসের? ভয় কেন পাচ্ছিস না? আবরারের করুণ অবস্থা দেখেও কেন ভয় হচ্ছে না? ভয় পাবি তুই, অনেক ভয়। কাকুতি মিনতি করে করজোড়ে বলবি- ছেড়ে দাও আমাকে, আমি বাঁচতে চাই।”
ইভানা ব্যথাটুকু গিলে হো হো করে হেসে উঠল। শক্ত গলায় বলল,
“আবরারের বিচ্ছেদই আমার শক্তি। ওর যন্ত্রণাটুকুই আমার অনুপ্রেরণা।”
লোকটা যেন এবারে আরও হিংস্রতার বশীভূত হলো। নিচে রাখা টেফলনের পাত্র হাতে নিয়ে বলল,
“ফর্মুলা কোথায়?”
ইভানা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“ক্ষমতা থাকলে খুঁজে বের কর।”
এগিয়ে এলো লোকটা। ইভানার মুখোমুখি হয়ে বলল,
“শেষবার বলছি, ফর্মুলা কোথায়?”
ইভানা এবারেও হাসল। বলল,
“আমি মরে গেলেও তুই পাবি না ফর্মুলার খোঁজ।”
লোকটা একহাতে নিজের চুল খামচে ধরল। পরক্ষণেই ইভানার বাম গালে হাতের তালু দ্বারা উচ্চশব্দে আঘাত করে বলল,
“ফর্মুলা আমার চাই। যে করেই হোক। প্রয়োজনে তোর শেষ সম্বল তোর মেয়ের প্রাণের বিনিময়ে। ছোট্ট বাচ্চা তো সে। অবুঝ। দেখতে বাবার মত হয়েছে না?”
ইভানা মুখের ভেতর নোনতা স্বাদ পেল। হয়তো রক্তের। চোখেমুখে পাষবিক হিংস্রতা প্রকাশ পেল তার। মুখ নামিয়ে কাঁধের উপর ঠোঁট মুছে বলল,
“আরাবীর চারপাশে সুরক্ষা বলয় ঘিরে আছে। তোর মত নরকের কীটের সাধ্য নেই তাকে ছোঁয়ার। কাপুরুষের মত একজন নারী কে আঁটকে রেখে বাহাদুরি দেখাচ্ছিস। লজ্জা করছে না?”
ডান গালে আরও একটা আঘাতের পর ইভানার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। চোখেমুখে অন্ধকার নেমে আসতে চাইল। কিন্তু নিজের ভেতরের মনোবল দ্বারা শক্ত থাকতে চাইল প্রাণপণে। হাতের বাঁধনের উপর জোর খাটিয়ে নিভু নিভু চোখ মেলে ক্লান্ত গলায় বলল,
“খোদার কসম করে বলছি তোর ধ্বংস না দেখে আমি মরব না। আল্লাহ যেন আমায় সেই হায়াতটুকু দান করে।”
লোকটা আরও উগ্র আচরণের দিকে এগিয়ে গেল। এসিডের পাত্রের ঢাকনা উন্মোচন করে এগিয়ে এসে কাত করে বলল,
“বল ফর্মুলা কোথায়? কোথায় আছে সেই আবিষ্কার।”
ইভানা চোখ বন্ধ করে শক্ত গলায় বলল,
“বলব না।”
আরও এগিয়ে এলো সে। পাত্র আরও খানিকটা কাত করতেই দু-তিন ফোঁটা তরল গড়িয়ে পড়ল নিচে। মেঝেতে থাকা শুকনো পাতা তাৎক্ষণিক নিজেদের অস্তিত্ব হারালো। ইভানা তবুও ভড়কালো না। অটল রইল নিজের সিদ্ধান্তে।
গাঢ় দাহ্য বৈশিষ্ট্য বিশিষ্ট এসিড যখন ইভানার গা ছুঁই ছুঁই করছে ঠিক তখনই পায়ের সাহায্যে লাথি মেরে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। ফেলতে সক্ষম হলো না সে। পুনরায় এগিয়ে এলো লোকটা। মুখ বরাবর নিয়ে ঢেলে দেওয়ার জন্য উদ্যত হতেই ছাদের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল গোটাকতক বুট পড়া লোক। নিঝুম নির্জন ছাঁদ মূহুর্তেই লোকে লোকারন্য হলো। গম্ভীর ভরাট গলায় কেউ একজন বলল,
“আপনার খেল খতম মিস্টার গৌতম বিশ্বাস!”
হাসি ফুটে উঠল ইভানার ক্লান্ত মুখে। চোখে মুখে দেখা দিল এতদিনের করা পরিশ্রমের সাফল্যের তৃপ্তি। কিন্তু হাসিটুকু পুরো মুখে ছড়িয়ে পড়ার আগেই গলায় ছুড়ির অস্তিত্ব পেল। মাথা চেপে ধরে ছুড়ি ঠেকিয়ে রেখেছে গলায়। পর মূহুর্তেই হালকা জ্বলন অনুভূত হলো ইভানার। হয়তো লেগে গেছে ধারাল ফলার কিছু অংশ।
পুলিশ ফোর্সের সাথে ছাদে এসে উপস্থিত হয়েছে আহনাফ। ইভানার বন্দিদশা দেখে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বলল,
“মিস্টার বিশ্বাস, আপনি ওকে ছেড়ে দিন। আপনার ফর্মুলা চাই তো? আমি এনে দেব। ছেড়ে দিন ওকে।”
বলেই পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। গৌতম বিশ্বাস তখন আরও আঁটসাঁট করে ধরল ইভানা কে। ব্যথাটাও বাড়ল। পেছন থেকে ইমরান ইভানার ব্যথাতুর মুখটা দেখে আহনাফ কে বাঁধা প্রদান করে বলল,
“আপনি কি চাইছেন মিস্টার বিশ্বাস? উনাকে ছাড়ুন। আপনার চাওয়া আমরা পূরণ করব।”
গৌতম বিশ্বাস উন্মাদের ন্যায় আচরণ করল। গলা ছেড়ে ইভানার হাতে ছুরিকাঘাত করে বলল,
“ওর মৃত্যু। ওদের জন্য আমি আমার জীবনে কিচ্ছু করতে পারি নি। আমার ক্যারিয়ারের সাফল্যের সময় এসে তার ভাগীদার হয়ে গেল আবরার। এরপর আবার ও। ওর মৃত্যু চাই আমি! মৃত্যু!”
বলতে বলতে চেয়ার টেনে হাঁটু সমান রেলিঙের কাছটায় নিয়ে গেল। উল্টে ফেলল ধাক্কা দিয়ে । কাত হয়ে নিচে পড়ার আগেই আহনাফ এসে চেয়ার টেনে সোজা করে ধরল। ইমরানসহ পুরো পুলিশ ফোর্স ঘিরে ফেলল গৌতম বিশ্বাস কে।
আহনাফ ব্যস্ত হাতে ইভানা কে বাঁধন মুক্ত করে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল নিজের বাহুডোরে। দুদিন ধরে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা দাবানলে যেন ঝুম বৃষ্টি নামল। শান্তির পরশ পেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল আহনাফ। ইভানা বোকার মত চেয়ে রইল। আহত সে; অথচ কাঁদছে আরেকজন!
দুর্বল হাতে আহনাফের পিঠ চাপড়ে বলল,
“আমি ঠিক আছি মিস্টার সরকার। ছাড়ুন প্লিজ।”
সময় নিল আহনাফ। নিজেকে সামলে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,
“সরি। আমি আসলে…”
ইভানা হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিল। দুর্বলচিত্তে উঠে দাঁড়াল। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি হলো গৌতম বিশ্বাসের। তাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন পালোয়ান ধরনের পুলিশ।
ইভানা ঠান্ডা গলায় বলল,
“কি দোষ ছিল আমার আবরারের?”
গৌতম বিশ্বাস শক্ত চোখে তাকাল ইভানার দিকে। ইভানা পুনরায় বলল,
“কি দোষ ছিল আমার পরিবারের? আমার?”
“আমার উঠন্ত ক্যারিয়ারে আবরার ভাঙন ধরিয়ে দিয়েছিল। যে বাহবা আমার প্রাপ্য ছিল সেটা প্রতিনিয়ত ও লুফে নিচ্ছিল। ও জয়েন করার আগে আমিই ছিলাম সকলের মধ্যমণি। আমি ছাড়া একটা রিসার্চও সম্পন্ন হতো না। কিন্তু ও আসার পর সকলের কাছে আমার প্রায়োরিটি কমে গেল। ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল আমার সুনাম। সিনিয়র সাইনটিস্টদের টেক্কা দিয়ে ও হয়ে গেল সকলের মাথা। এক সময় ক্যান্সারের মত দুরারোগ্য ব্যাধির প্রতিষেধক আবিষ্কার করে ফেলল। আমি তো এটা স্বাভাবিকভাবে ঘটতে দিতে পারি না। ও আমার ক্যারিয়ার ডাউন করেছে। তাই আমি ওর সৃষ্টি আবিষ্কার কেড়ে নিতে চেয়েছি। কতবার ভালোয় ভালোয় বলেছি। কিন্তু নাহ! ও দিল না। তাই তো বাধ্য হয়ে জান নিতে হলো ওর। আঁটকে রেখেছিলাম সারাদিন। যদি ভয়ে দিয়ে দেয়। কিন্তু ওদের ভয়ভীতি নেই। তাই বাধ্য হলাম ছাদ থেকে ফেলে দিতে। চালিয়ে দিলাম আত্মহত্যার নামে। যা আমার না তা দাবি করার কেউ যেন না থাকে। কিন্তু এই মহিলা! তিনবছর পর উদয় হলো। উড়ে এসে জুড়ে বসে দখল করে নিল আবরারের জায়গা। আবার সেই রিসার্চ, সেই আবিষ্কার, সেই আবরার। সহ্য হয় না আমার। সহ্য করতে পারি না। মেরে দেব একে আমি। একেও মেরে দেব। আবরারের কোনো চিহ্ন আমি পৃথিবীতে রাখব না।”
বলেই ইভানার দিকে এগিয়ে আসতে চাইলে ঠাটিয়ে একটা বসিয়ে দিল আহনাফ। কর্কশ কণ্ঠে বলল,
“পারলে ছুঁয়ে দেখা। দেখি কত হেডম!”
ইভানা আহনাফ কে থামিয়ে দিল। থমথমে গলায় বলল,
“আবরারের আবিষ্কারে আপনার হাত ছিল? সাহায্য করেছিলেন আপনি? কোনোভাবে?”
গৌতম বিশ্বাস মাথা নাড়াল। বলল,
“ওটা আবরারের সিক্রেট রিসার্চ ছিল। প্রায় চার বছর ধরে সে একটু একটু করে এগিয়েছে লক্ষ্যের দিকে। আগে ভাবতাম কিচ্ছু করতে পারবে না সে। অহেতুক কাজ করছে। কিন্তু যেদিন সবাইকে কনফিডেন্টলি জানাল সেদিন জানতে পারি। বিশ্বাস করতে চাই নি। কিন্তু ওর কনফিডেন্ট দেখে বাধ্য হই।”
ইভানা কলার চেপে ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,
“তাহলে কোন অধিকারে ওর আবিষ্কার নিজের বলে চালিয়ে দিতে চাইলি তুই? লজ্জা করল না? বিবেকে বাঁধল না? কি করে পারলি বল?”
বলতে বলতে ডেস্পারেট হয়ে উঠল ইভানা। ইমরান তৎক্ষণাৎ থামিয়ে দিল তাকে। টেনে সরিয়ে এনে দাঁড় করালে মেঝেতে বসে পড়ল সে। সময় গড়াতেই হাউমাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করল। এতগুলো বছর ধরে জমিয়ে রাখা কান্না। পুরো পৃথিবী কে জানিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো- আমি পেরেছি হে ধরণী! আমি পেরেছি আমার স্বামীর খুনিকে চিহ্নিত করতে!পেরেছি আমি!
অসময়ে ইভানার ফোন পেয়ে ফাহিমা করিম ধড়ফড়িয়ে উঠেন। তাড়াহুড়ো করে ফোন কানে তুলতেই ইভানা কান্নারত গলায় বলল,
“মা…।
সবটা শুনে ফাহিমা করিম ডুকরে কেঁদে উঠলেন। নিজের সন্তানের মৃত্যুর কারণ জানার পর নিশ্চয়ই কোনো মায়ের স্বাভাবিকতা ধরে রাখা সম্ভব নয়।
সেদিন ইচ্ছে করেই ইভানা সিদ্ধান্ত নেয় প্রেস কনফারেন্স করার। আবরারের আবিষ্কারের কথা পৃথিবী কে জানিয়ে দেওয়ার। তার বিশ্বাস ছিল খুনি আর আড়ালে থাকতে পারবে না। বেরিয়ে আসবে খোলস ছেড়ে। শুধু একটুখানি ঝুঁকি নিতে হবে তাকে। হয়তো একটু বেশিই। তবুও পিছপা হয় নি সে। এগিয়ে গেছে সাহসী বীরের ন্যায়। সমান তালে সঙ্গ দিয়েছে ইমরানও।
কিন্তু পরিকল্পনা মাফিক কার্য সম্পাদন করার আগেই কিডন্যাপ করা হয় ইভানা কে। ফলশ্রুতিতে সহ্য করতে হয় যন্ত্রণা।
অন্যদিকে চতুরতার শীর্ষে থাকা ইমরান গৌতম বিশ্বাসের অতি ভালোমানুষি রুপ ঠিক হজম করতে না পেরে তার উপর চব্বিশ লক্ষ্য রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। যার ফলে জেনে যায় তার কুকীর্তির কথা।
আবরারের মৃত্যুর পর নিষিদ্ধ করা ছাঁদেই রচিত হয় নুতন কিছু ঘটনার সূচনা। বেরিয়ে আসে আত্মহত্যার নামে পেছনে লুকিয়ে থাকা খুন।
কিছুদিনের ভেতর ইমরান নিজের কাজ গুটিয়ে দেশে ফেরার যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করে ফেলে। নিজের রুমে বসে আকাশকুসুম চিন্তায় মত্ত থাকা অবস্থায় ফোন বেজে ওঠে তার। স্কিনে ভাসতে থাকা নাম দেখে মুচকি হেসে বলল,
” রুহী..বলো জান..”
অপর প্রান্ত থেকে এক নারীকণ্ঠ ঝাঁঝাল গলায় বলল,
“জানের মায় রে বাপ। তুমি থাকো তোমার কাজ, তোমার ডিউটি নিয়ে। এদিকে আমি ভেসে যাই সেদিকে নজর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বাপে আমারে বিয়ে দিয়ে দিক অন্য পোলার লগে। তুমি তারপর বেওয়ারিশ লাশের সাথে সংসার কইরো।”
এহেন ঝাঁঝাল কণ্ঠ শুনে ফোনটা দ্রুত সরিয়ে ফেলল কানের কাছ থেকে। নিলে বধির হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।
কিঞ্চিৎ সময় পর মুচকি হেসে বলল,
“আমি আসছি তো, জান আমার। খুব শীগ্রই।”
পরিশিষ্টঃ ইতালি এবং বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় আয়োজন করা হয়েছে এক বিশালাকার এওয়ার্ড শো। তাতে মনোনীত হয়েছে অজস্র গুনীমান্যি লোকজন। তাদের মধ্যে রয়েছে একজোড়া দম্পতি। দম্পতির নাম আবরার- ইভানা ফাইয়াজ। মরণঘাতী রোগ ব্রেস্ট ক্যানসারের প্রতিষেধক আবিষ্কার এবং তা মানব দেহে পরিক্ষা নীরিক্ষার পর তা সাফল্য পাওয়ার পর গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সাথে রটে যায় একজন মেধাবী গবেষক এবং তার সাহসী স্ত্রীর নেওয়া ঝুঁকিসম্পন্ন কার্যক্রমের কথা। বাংলাদেশ সরকার এবং ইতালির পক্ষ থেকে জানানো হয় সাদর অভ্যর্থণা। গোটা বিশ্বে পড়ে যায় জয়জয়কার। যার ফলশ্রুতিতে আজ এই এওয়ার্ড শো’র মূল আকর্ষণ আবরার ইভানা।
পুরস্কারে ভূষিত করার পর ইভানা কে অনুরোধ করা হয় কিছু বলার জন্য। চোখে চশমা, মাথায় আধাপাকা চুলে করা খোঁপা, মাথা সাদা শাড়ির অল্প করে টেনে নেওয়া ঘোমটা। মঞ্চে যেন এক শুভ্র প্রতিমা চোখে মুখে একরাশ মুগ্ধতা, কৃতজ্ঞতা নিয়ে তাকিয়ে আছে। কিয়ৎক্ষণ পর শান্ত গলায় বলল,
“এই সম্মান আমার প্রাপ্য নয়। এর সম্পূর্ণ অধিকার আমার স্বামী আবরার ফাইয়াজের। এটা তারই যুগান্তকারী আবিষ্কারের সম্মান। আমি তো কেবল তার অনুপস্থিতিতে তার দেখানো পথে হেঁটেছি। সাথ দিয়েছি তার স্বপ্ন পূরণে। তার আবিষ্কার ছাড়া আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল না। আমার এত ক্ষমতাই নেই। হয়তো আমি কখনো এত এত গভীরে গিয়ে ভাবতেই পারতাম না। আর না পারতাম এত সাহসীকতার পরিচয় দিতে…..
এহসান এবং মৃত্তিকার সংসার গুছিয়ে দিয়ে পরলোকগমন করেছেন শেলী সরকার। আহনাফ ইভানা কে দেওয়া কথাটা রাখতে পারে নি। পারে নি বিয়ে করতে। না দেখে জন্মানো ভালবাসা হৃদয়ে এতটাই শিকড় গেড়ে বসেছে যে উপড়ে ফেলতে পারে নি। পারে নি আর একটিবার ইভানা কে চাইতে। তাই বেছে নিয়েছে একাকীত্বকেই। তাতেই তার সুখ নিহিত। বাস্তবিকে না হোক কল্পনায় তার একটা সাজানো সংসার। যেখানে ইভানা বিরাজ করে প্রতিনিয়ত..
ছোট্ট আরাবীর আজ আঠারো বছর পূর্ণ হলো। নোভা রিফাতের দু’দুটো সন্তান নিয়ে তাদেরও সুখী সংসার। হেসে খেলে কেটে যায় দিবস রজনী। ফাহিমা করিমও আজ বয়সের ভারে কুঁজো। হাঁটতে চলতে পারে না একা। সাহায্য নিতে হয় অন্য কারো। সব নিয়ে বেশ আছে সকলে। তবুও যেন দিনশেষে এক চিলতে সুখের পাশাপাশি তীক্ষ্ণ একটা ব্যথা, একটা ধারালো সূচের ন্যায় আঘাত এসে ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের একপাশ। তা কেবল একজন মানুষের উপস্থিতির অভাবে।
আরও কিছু বছর অতিক্রম করার পর…
অনেকগুলো দিন পর ইভানা এসেছে চিরপরিচিত জায়গায়। একাকী, নীরবে সময় কাটাতে। জায়গাটা আবরারের চিরনিদ্রায় শায়িত থাকার জায়গা। গোরস্থান। ইভানা আজ সাদা শাড়ি পরে এসেছে। এটাই তো তার গত সাতান্ন বছরের পরিধেয়।
আবরারের বাঁধাইকৃত কবরের একপাশে কুঁচকে যাওয়া চামড়া আবৃত হাতে স্পর্শ করে বলল,
“আট থেকে আশিতে নিয়ে যাব বলে কথা দিয়েছিলাম। আমি আমার কথা রেখেছি আবরার। তুমি খুব স্বার্থপর জানো তো! স্বার্থপরই রয়ে গেলে। শুধরালে না আর। আট বছরের ভালবাসার লোভ দেখিয়ে আশি বছরের ভালবাসা হাসিল করলে। বিয়ের দিন থেকে শুধু নিজেরটাই বুঝে গেলে। আশি তো হলো.. আমায় আর কত অপেক্ষা করাবে বলো তো। কবে পাব তোমার নিমন্ত্রণ? আর যে দেরি সয় না। তোমার ব্ল্যাং চেকের দাবি পূরণ করতে করতে ক্লান্ত আমি। আচ্ছা, তুমি কি আমাকে দেখে হাসছো? ভাবছো কুঁচকে যাওয়া চামড়া নিয়ে এক বুড়ি এসেছে তোমার কাছে প্রেম নিবেদন করতে? হাসবে না একদম বুঝলে! নয়তো আমি আড়ি করে দেব। তখন বুঝবে..”
অনেকটা সময় অতিবাহিত করার পর চলে আসতে গিয়েও পিছু ফিরল ইভানা। নমনীয় গলায় বলল,
“সেদিন ফাল্গুনের কোনো আগুনঝরা দিন ছিল না। গাছে গাছে ছিল না শিমুল পলাশের রক্তিম রূপ। মন জুড়ায় নি কোকিলের কুহুতানে। কিন্তু আমার শ্রবণেন্দ্রিয়ের খুব কাছে এক প্রেমিক পুরুষ কোকিল তার সুরেলা কণ্ঠে ডেকেছিল। ডেকেছিল তার হৃদয়ের অলিন্দদ্বয়ে স্পন্দিত নিগুঢ় প্রেমের সুপ্ত অনূভুতির সুরে। সেই ডাক আমার কর্ণকুহর ভেদ করে পোঁছে গিয়েছিল হৃদয়ের খুব কাছে। সেদিনটা প্রকৃতিতে আগুনঝরা বসন্তের রেশ না থাকলেও আমার হৃদয়ে বসন্ত এসেছিল। প্রকৃতি না সাজলেও সেদিন বসন্ত ছিল।”
হিম শীতল সমীরণ আবরারের কণ্ঠের ন্যায় সুরের ঝংকার তুলে কানের কাছে গুনগুন করে বলল,
“আজও বসন্ত কাঁচাগোল্লা। সেদিন বসন্ত ছিল আজও বসন্ত আছে। আজীবন বসন্ত থাকবে। যতকাল ভালবাসার নামে একটি হৃদয়ও স্পন্দিত হবে ততকাল বসন্ত রবে প্রতিটি প্রেমিকের হৃদয়ে।”
সমাপ্ত..