বসন্ত কন্যা পর্ব – ১+২

#বসন্ত_কন্যা
#পর্ব_১
#লেখিকা : সাদিয়া

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

ব্যাগ হাতে একটা বিশাল বড় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিশা, পুরো নাম বাশরাতুন নিশা। বাড়িটা মূলত ওর মামার বাড়ি তবুও বাড়ির ভিতরে ঢুকতে কেমন এক প্রকার ইতস্ততবোধ কাজ করছে। নিশা একটা ন্যাশনাল ভার্সিটির অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। মধ্যেবিত্ত পরিবারের মেয়ে, বাবা সামান্য একজন স্কুল শিক্ষক। বাবা মা আর ওরা দুই বোন নিয়ে ছোট্ট সুন্দর একটা পরিবার ওদের । ছোট বোনটা এবার নবম শ্রেণীতে পড়ে। খেয়ে পড়ে মোটামুটি ভালোই দিন চলে যায়। তাছাড়াও পড়াশোনার পাশাপাশি নিশা কিছু টিউশনি করে তাতেই তার হাত খরচটা চলে যায়। মাস শেষে হাত খরচের জন্য আর বাবার মুখপেক্ষি হতে হয় না। কিন্তু সমস্যাটা হলো ওর বাড়ি নারায়ণগঞ্জ আর ওর কলেজটা ঢাকার ভিতরে। টিউশনিগুলো করে কলেজের আশেপাশে। খুব ভোরে এসে কলেজ , টিউশনি গুলো করে আবার বাড়ি ফিরতে ঝামেলা হয়ে যায়, আর জ্যামে পড়লে তো কথাই নেই। নিশা একবার ভেবেছিলো দুই তিনটা মেয়ে নিয়ে একটা রুম ভারা করে থাকবে কিন্তু তার বড় মামা বিষয়টা জানতে পেরেই বারন করে দিয়েছে। কলেজের কাছেই নিশার মামাদের বাড়ি, তারা কিছুতেই নিজেদের বাড়ি থিকতে ভাগ্নীর অনত্র থাকা মেনে নিবে না। নিশা খুব ভালো ভাবেই জানে ওর দুই মামী ওকে তেমন সহ্য করতে পারে না। মামারা ভীষণ উচ্চবিত্ত হলেও নিশারা মধ্যবিত্ত কিনা। সব মিলিয়ে নিশা কিছুতেই এ বাড়িতে আসতে চায়নি কিন্তু শেষ পর্যন্ত বড় মামার জেদের কাছে হাড় মেনে এ বাড়িতে আসতেই হলো। দুই মামীর চক্ষুশূল হয়ে কিভাবে দিনের পর দিন এ বাড়ি থেকে পড়াশোনা করবে ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো নিশার। কতক্ষন আর এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায় শেষ পর্যন্ত বাড়ির ভিতরে ঢুকেই গেল।

______________________

এ বাড়িতে এসেছে আজ প্রায় চারদিন। নিশার চোখ শুধু একজনকেই খুঁজছে কিন্তু তার দেখা পাওয়া যে মেলা ভার। অবশ্য দেখা হবেই বা কিভাবে নিশা সেই সকালে বেলা বের হয় তারপর সারাদিন কলেজ টিউশনি করে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। অবশ্য একদিকে ভালোই হয়েছে বাসায় থাকলেই উঠতে বসতে মামীদের খোটা শোনা লাগতো যেটা এখন লাগে না। কিন্তু চোখ জোরা তারা তো আর সেই কথা মানে না, অবাধ্য চোখ জোড়া যে একজনকে দেখার জন্য ভীষণভাবে উদগ্রীব হয়ে আছে। আজ শুক্রবার নিশা অধীর আগ্রহে বসে আছে সেই মানুষটাকে দেখার জন্য।

সকালে উঠে রুমে বসেই পায়চারি করছিল নিশা। এর মধ্যেই মামার পড়লো ডাইনিং – এ খেতে ডাকছে। এ বাড়িতে আসার পর নিশা এখন পর্যন্ত এক বেলাও ডইনিং এ বসে খায়নি। বাড়ির কাজের মেয়েটা মুকুল ওকে প্রতি বেলা রুমেই খাবার দিয়ে যায়। আজ মামা বাড়িতে আছেন বলেই হয়তো ডাইনিং – এ ডেকেছেন। আর তাছাড়া হয়তো ডাইনিং – এ গেলে নিশা তার সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির দেখাও পাবে তাই ফুরফুরে মেজাজে রওনা দিল ডাইনিং – এর উদ্দেশ্যে।

ডাইনিং টেবিলের সামনে গিয়েই থমকে গেল নিশার পা জোড়া। আজ কতদিন পর নিশা এই ব্যক্তির দেখা পেল। এবাড়িতে আসাটা আজ যেন স্বার্থক মনে হচ্ছে নিশার কাছে।এই সেই ব্যক্তি যার জন্য নিশা সেই কিশোরী বয়স থেকে নিজের মনের কোনে অনুভূতিগুলো খুব যত্মে গোপন করে রেখেছে। নিশার প্রথম ভালো লাগা ফয়সাল ইমদাদ , সম্পর্কে নিশার মামাতো ভাই , নিশার বড় মামা সোহেল ইমদাদের বড় ছেলে এবার ঢাকা মেডিকেলের তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছে। এই যুগের ভাষ্য অনুযায়ী বেশ সুদর্শন সে। ফয়সাল অবশ্য নিশাকে ততটা পাত্তা দেয় না, হয়তো সহ্যও করতে পারে না নিশা বিষয়টা বুঝতে পারলেও ওর অবাধ্য মনটা যে বুঝতে চায় না।

নিশাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সোহেল ইমদাদ বলে উঠলেন : কিরে ওভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বসে পড়

– জ্বী মামা বসছি।

– ভর্তি তো হয়েছিস ন্যাশনালে সেটা তো নারায়ণগঞ্জ কোনো কলেজেই পড়তে পারতি, ঢাকায় এসে অন্যের বাড়িতে থেকে পড়াশোনার কি দরকার?

ফয়সালের এই কথাটা যেন নিশার বুকে তীরের মতো আঘাত করলো। ও অবশ্য জানতো ফয়সাল এমন কিছুই বলবে সে সবসময় নিশার সাথে এমন ব্যবহারই করে, তবুও মনের কোনে কেন যেন ফয়সালের জন্য কিছু পজেটিভ চিন্তা ভাবনা উঁকি দিচ্ছিল।

– এগুলো কেমন ধরনের কথা ফয়সাল? আর ভুলে যেও না এটা অন্যের বাড়ি নয় এটা ওর মামার বাড়ি।

– না মামা উনি তো ঠিকই বলেছেন। আসলে কি হয়েছে কি ভাইয়া আমি তো অটো পাশের ব্যাচ , বেশিভাগই এ+ ছিল। সব ভার্সিটিগুলো এ+ চাইছিল। আর আমার পয়েন্ট কম থাকায় প্রথম বারে চান্স আসেনি, দ্বিতীয় বারে ৫ টা কলেজে আবেদন করতে হয়েছে তো তাই এখানে আসতে হলো। না হয় আমার নারায়ণগঞ্জেই ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে ছিল।

– তাই বল আমিও তাই ভাবি। অটো পাশ না দিলে তোর মতো স্টুডেন্ট পাশ করতো কিনা সন্দেহ।

ফয়সালের কথাগুলো যেন নিশাকে কাটার মতো আঘাত করছে। খাবার যেন আর গলা দিয়ে নামছে না, প্রিয় মানুষগুলোর সামান্য আঘাতও যেন হৃদয়টা ক্ষত বিক্ষত করে দেয়। নিশা একদম খারাপ ছাত্রী কোনো কালেই ছিল না, আবার ফয়সালদের মতো ভালোও ছিল না, মোটামোটি ধরনের স্টুডেন্ট ছিল। আর এই বিষয়টা নিয়ে ফয়সাল ওকে কম কথা শোনায়নি এই যেমন আজ শোনালো। নিশা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খেতে শুরু করলো। বাঁচতে হলে খেতে হবে আর তাছাড়া এটা ওর বাড়ি নয় যে রাগ করে না খেলে বাবা , মা ওকে ডাকতে ডাকতে মুখের ফেনা তুলে ফেলবে। এটা ওর মামার বাড়ি এখানে না খেয়ে মরে গেলেও কেউ ফিরেও তাকবে না। একমাত্র বড় মামা ডাকতে পারে, আর ছোট মামা তো বিদেশে। অবশ্য তা নিয়েও পরে মামীরা কথা শোনাতে ছাড়বে না।

___________________

খাওয়া শেষে ছাদে এসে দাঁড়ালো নিশা। এই মন খারাপগুলো একটু ঝেড়ে ফেলার ব্যর্থ প্রয়াস আর কি। এর মধ্যেই ভয়ংকর ঝংকার তুলে বেজে উঠল নিশার ফোনটা। ফোনটা হাতে নিয়েই যেন মুখে হাসি ফুটে উঠল তার । মোবাইলের স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে আয়না নামের একটি নাম, নিশার বেস্ট ফ্রেন্ড। এই মেয়েটা থাকলে আর নিশার আর মন খারাপ করে থাকতে হয় না। অবশ্য নিশার ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটা বন্ধুমহল আছে। তবে তাদের মধ্যে এই মেয়েটার সাথে নিশা একটু বেশিই ক্লোজ। এই মেয়েটার সাথে দেখা হয়েছিল সেই এইচএসসির পর ভার্সিটির এডমিশন কোচিং – এ । এই কয়দিনে মেয়েটা বেশ আপন হয়ে গেছে, একদম নিজের আপন বোনের মতো। এসব ভাবতে ভাবতেই কলটা কেটে গেল। নিশা ভ্রু কুঁচকে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। সেকেন্ড দুই পরই মোবাইলটা আবার ঝংকার তুলে বেজে উঠল। নিশার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল, সে যেন এটার অপেক্ষাতেই ছিল। কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আয়না হুংকার দিয়ে উঠলো –

– মরেছিস ? আমার তোকে এবারের জায়গায় দুই বার কল করতে হবে কেন? নাকি ছুটির দিন পেয়ে আরামের ঘুম দিচ্ছিস?

– আস্তে আস্তে। চিৎকার করছিস কেন? কি হয়েছে?

আয়না কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে উঠলো – ভাইয়া আসছে।

– সে তো ভালো কথা। আমাকে বলছিস কেন?

– ভাইয়া দুই মাসের ছুটিতে আসছে। বাসায় দুই দিন এসে বাড়িটাকে জেলখানা করে দেয় আর এখন দুই মাসের জন্য আসছে। আমাকে এই দুই মাসের জন্য তোর বাড়িতে জায়গা দিবি বোইন? না হয় ভাইয়া এই বার আমার জীবনটা তেজপাতা করে দিবে।

– আমিই থাকি অন্যের বাড়ি বোইন । আর আমার কোনো শখ নেই তোর ঐ ক্যাপ্টেন ভাইয়ের মার খাওয়ার। তুই আমাদের বাড়ি এসে উঠবি তারপর তোর ভাই এসে আমাকে খুন করে ফেলুক এই চিন্তা করছিস নাকি? আমি ভাই এতে নেই। এখনও আমার বিয়ে করে বাচ্চা কাচ্চা ডাউনলোড করা বাকি।

– দাঁড়া তুই তোকে আমার ভাইয়ের সাথেই বিয়েটা দিব ভাবছি।

আঁতকে উঠলো নিশা। অসহায়ের মতো বলে উঠলো – না ভাই তোর ভাইয়ের সাথে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। ওমন একটা মানুষ বিয়ে করার থেকে কচু গাছের সাথে গলায় দড়ি দিয়ে কতক্ষন টানাটানি করবো তাও ভালো।

– আরে তুই তো আমার ভাইকে এখনও দেখিসই নি। আমার ভাই কিন্তু অনেক হ্যান্ডসাম।

– তোর ভাইয়ের হ্যান্ডসাম তুই গুলে গুলে খা। দেখিনি আর তোর ভাইকে দেখার শখও নাই। যা যা শুনেছি তাতে আমার আর্মি বাহিনীর প্রতিই একটা ভয় জন্মে গেছে।

– আমার ভাইটা কিন্তু অনেক ভালো।

– তাহলে ভাই আসার কথা শুনে তুই বাড়ি ছাড়তে চাইছিস কেন?

আয়না আমতা আমতা করে বলল : একটু জায়গা দে না তোর বাড়ি বোইন। না হয় ঐ খাটাশটা বাড়ি আসলে ওর দেওয়া সব রুলস পালন করতে করতেই আমার মরন ঘটবে, আমার আর বিয়ে করা হবে না।

– তাড়াতাড়ি মইরা যা একটা এক চল্লিশা খাই।

– হপ, ফকিন্নী। দোয়া করি আমার ভাইয়ের মতো একটা জামাই পরুক তোর কপালে তখন তুই আমার দুঃখটা হাড়ে হাড়ে টের পাবি।
#বসন্ত_কন্যা
#পর্ব_২
#লেখিকা : সাদিয়া

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

ফোনে কথা বলতে বলতে কখন যে ফয়সালও ছাদে এসেছে খেয়ালই করেনি নিশা। কলটা কেটে পাশ ফিরতেই চমকে উঠলো নিশা। বুকে থু থু দিয়ে ফয়সালকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলো –
– ভাইয়া আপনি এখানে?

– আমাদের ছাদ আমি এসেছি কেন তোর সমস্যা হয়েছে কোনো?

– না সেটা বললাম কখন বলেই নিচে নামার উদ্দেশ্য পা বাড়ালো নিশা।

– নিশা….

থমকে দাঁড়ালো নিশা। কতদিন পর প্রিয় মানুষটার মুখে নিজের নামটা শুনলো । কেমন একটা ভালো লাগা কাজ করছে মনের ভিতরে। বন্ধু বান্ধব সবাই তো ওকে সব সময় নিশা বলেই ডাকে। কই তখন তো এত ভালো লাগা কাজ করে না। তাহলে আজ কেন এত ভালো লাগা কাজ করছে? প্রিয় মানুষটার মুখে নিজের নাম শুনেছে বলে, হবে হয়তো সেটাই।

– মাকে বলবি ছাদে আমার জন্য এক কাপ কফি পাঠিয়ে দিতে বলিস।

– আচ্ছা।

বাড়ির সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় অগত্যা নিশাকেই কফি নিয়ে আসতে হলো ফয়সালকে। ধীর পায়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালো নিশা। ওর দিকে পিছন ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে ফয়সাল। পিছন থেকে ডাক দিতেও কেমন ইতস্তত লাগছে নিশার, ফয়সালও পিছন ফিরে তাকাচ্ছে না। এদিকে কফিটাও ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আর উপায় না পেয়ে একটা গলা খাঁকারি দিল নিশা। নাহ এবারও ফয়সাল পিছন ফিরে তাকাচ্ছে না। আর না পেরে এবার নিশা জোড় গলায় ডেকেই বলল –

– ভাইয়া শুনছেন?

ফয়সাল পিছন ফিরে : হুম

– আপনার কফিটা।

– তুই কফি আনলি যে, মুকুল কি করছে?

– ও কাজে ব্যস্ত।

– আচ্ছা যা নিচে যা।

এই ছিল ঐ সপ্তাহের শেষ কথা এরপর আবার যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আবার। তারপর আর নিশার সাথে ফয়সালের তেমন দেখা হয়নি। মাঝে মাঝে নিশা একটু উঁকি ঝুঁকি মেরে ফয়সালকে দেখার চেষ্টা করেছে। অবাধ্য চোখ জোড়া যেন শুধু তাকে দেখার জন্যই ছটফট করে।

দেখতে দেখতে আবার সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। আজ আবার শুক্রবার তাই সবাই আজ বাড়িতেই আছে। নিশা ড্রইং রুমে সোহেল ইমদাদের সাথে বসে আছে। হঠাৎ কোথা থেকে ফয়সাল এসেই নিশার গালে ঠাসসস করে একটা চড় মেরে বসলো। আকর্ষিক ঘটনায় সবাই মুর্তির রূপ ধারন করেছে। নিশা গালে হাত দিয়ে ফয়সালের দিকে তাকিয়ে আছে , ফয়সাল রক্তচক্ষু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি থেকে কি হয়ে গেল সবটাই যেন নিশার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কথা বলতে যেন ভুলে গেছে । আর এই থাপ্পরটাই বা ওকে কেন মারলো ফয়সাল, কি করেছে ও? চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো। মনের মধ্যে হাজার প্রশ্ন কিন্তু মুখে করার শক্তি পাচ্ছে না। হঠাৎ এমন ব্যবহার কেন করছে ফয়সাল? এতদিন তো শুধু কথা দিয়ে আঘাত করতো এখন গায়ে হাত দিয়েই বসলো। এত অপছন্দ নিশাকে? সোহেল ইমদাদ ছেলের এমন ব্যবহারে যেন তাজ্জব বনে গিয়েছিল। হঠাৎই গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠে বলে উঠলো –

– কি হচ্ছে ফয়সাল? তুমি ওকে মারলে কেন?

বাবার কথার তোয়াক্কা না করে হাতের একটা কাগজ দেখিয়ে নিশাকে বলল – তোর স্বভাব এত খারাপ হয়ে গেছে জানা ছিল না তো, জানলে বাবাকে কিছুতেই তোকে এ বাড়িতে আনতে দিতাম না।

– কি করেছি আমি?

– আবার বলছিস কি করেছিস? এই চিঠি তুই লিখেছিস আমাকে তাই তো, ছিঃ ছিঃ এত অধঃপতন হয়েছে তোর। এখন ছেলেদের প্রেমপত্র দিয়ে বেড়াচ্ছিস।

চিঠির কথা শুনে নিশা যেন তাজ্জব বনে গেল। ও আবার কখন ফয়সালকে চিঠি দিল? সেই কিশোরী বয়স থেকে নিজের মনের মধ্যের অনুভূতিগুলো লুকিয়ে রেখেছে। কাউকে বুঝতে দেয়নি, সাহসের অভাবে কথাটা কখনও মুখ ফুটে বলতে পারেনি। আর আজ ফয়সাল কিনা ওকে প্রেমপত্র লেখার অপরাধে অপরাধী করছে। এতক্ষনে ড্রইং রুমের হট্টগোলে বাড়ির সবাই সমবেত হয়েছে। ফয়সালের কথা শুনে ফারজানা বেগম ( ফয়সালের মা ) রাগে ফোঁস ফোঁস করতে বলল –

– যেমন মা তেমন তার মেয়ে। এদের চরিত্র যেন বাধাই করে রাখার মতো। এই জন্যই এ বাড়িতে এই মেয়েকে আমি রাখতে চাইনি। তখন তো আমার কথা কেউ শুনতে চায়নি। এখন দেখলে তো? কি সাহস মেয়ের, বড় বাড়ি দেখেছে তো, আমার সোনার টুকরা ছেলেকে ফুঁসলিয়ে হাত করতে চাইছে।

এতক্ষন চুপ করে সবটা হজম করলেও এখন নিজের মায়ের সম্পর্কে এমন কথা যেন হজম করতে পারলো না নিশা। নিশার বাবা মায়ের বিয়েটা প্রেম করে। না হয় এত বড় বাড়ির মেয়েকে কি আর সাধারণ স্কুল শিক্ষকের কাছে বিয়ে দেয়। আর নিশার মামী কখনও এ নিয়ে নিশাকে কথা শোনাতে ছাড় দেয় না। তবে একটা আনন্দের বিষয় হতে পারে ওর মা ভালোবেসে এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেকে বিয়ে করেছিল কিন্তু এত বছরের কখনও ওর মাকে কোনো বিষয়ে অভিযোগ করতে দেখেনি। সংসারে কিছুটা অভাব থাকলেও ভালোবাসার অভাব কখনও দেখেনি নিশা যেটা সচরাচর এই ইট পাথরের বড় বড় বিল্ডিংয়ের লোকদের মধ্যে দেখা মেলা ভার। নিজের মায়ের অপমান সহ্য না করতে পেরেই নিশা মুখ খুললো-

– আমাকে যা বলার বলো। আমার মাকে নিয়ে একটা কথাও বলবে না মামী।

– একশো বার বলবো, কি করবি তুই? নিজেদের চরিত্রের ঐ তো শ্রী আর আমরা বললেই দোষ। ভুলে যাস না তুই এখনও আমার বাড়িতে দাঁড়ানো। আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আবার আমার মুখের উপর কথা বলছিস। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব বাড়ি থেকে।

– বাড়িটা তোমার বা তোমার ছেলের নয় ফারজানা। বাড়িটা আমার, আমার ভাগ্নীকে এই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার কথা বলার তুমি কে?

ফারজানা বেগম আগুন চক্ষে সোহেল ইমদাদের দিকে তাকিয়ে : তুমি এই মেয়েটার জন্য আমাদের কথা শোনাচ্ছো? আগেই জানতাম এই মেয়ে আমার সংসারে একটা ঝামেলা বাঁধিয়ে ছাড়বে। মেয়েটাও হয়েছে মায়ের মতোই কালনাগীনি।

নিশা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফয়সালের হাত থেকে চিঠিটা হাতে নিল। চিঠিটায় একবার চোখ বুলিয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখে ওর ছোট মামার মেয়ে ফারিয়া কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা এবার দশম শ্রেণীতে পড়ছে। নিশার আর বুঝতে বাকি নেই এই মেয়েটাও কিশোরী বয়সে ওর মতোই নিজের কাজিনকে ভালো লাগার মতো এক মহাপাপ করে ফেলেছে। শুধু পার্থক্যটা এই যে নিশা কখনও নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেনি আর ও প্রকাশ করেছে। একবার ফারিয়ার দিকে চোখ বুলিয়ে ফয়সালের দিকে তাকিয়ে বলল –

– আপনি এত বোকা জানা ছিল না ফয়সাল ভাই।

– মানে ( ফয়সাল ভ্রু কুঁচকে )

– আমি হয়তো আপনাদের মতো ভালো স্টুডেন্ট নই ফয়সাল ভাই কিন্তু আমি এখন একজন ভার্সিটি লেভেলের ছাত্রী। আমার হাতের লেখা যে এমন স্কুল পড়ুয়া বাচ্চাদের মতো নয় সেটা আপনার আগেই বোঝা উচিত ছিল। আমি স্টুডেন্ট খারাপ হলেও হাতের লেখাটা বরাবরই ভালো। আপনি আমাকে এভাবে অপমানটা না করলেও পারতেন ফয়সাল ভাই। যদি চাইতেন একটু বাছ বিচার করে বিষয়টা দেখতে পারতেন তাহলে হয়তো আমার সাথে সাথে আমার মায়ের নামেও এত অপমানজনক কথা শুনতে হতো না।

এরপর একটু থেমে ফারজানা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল : তোমার কষ্ট করে আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে হবে না মামী। আমি নিজেই চলে যাব, যেখানে আমার মায়ের কোনো সম্মান নেই সে বাড়িতে আমি থাকবো না।

মনের কোনে তীব্র অভিমান জমেছে নিশার। যে মানুষটার জন্য মনের মনিকোঠায় এত বছর ধরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভূতিগুলো জন্ম দিয়েছিল সেই মানুষটা আজ কিভাবে পারলো এত বাজেভাবে অপমান করতে। থাপ্পরটা তো ড্রইংরুমে বসে না দিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালেও দিতে পারতো। ভালোবেসে না হোক মানবতার খাতিরে। চিঠিটা পেয়ে একবার অন্তত জিজ্ঞেস করতে পারতো যে চিঠিটা ও দিয়েছে কিনা।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here