সেদিন দেখা হয়েছিলো পর্ব -৪৫

পর্বঃ৪৫(সারপ্রাইজ পর্ব)
গল্পঃ #সেদিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
(গল্প কপি পোস্ট সম্পূর্ণ নিষেধ।)

রাত ১টার সময় বারান্দায় বসে গ্রুপ কলে নতুন প্রোগ্রাম নিয়ে বন্ধুদের সাথে আলোচনা করছে রাইদা। আলোচনা বললে ভুল হবে সকলে বলছে আর রাইদা শুনছে।

‘একটা লাইভ কনসার্টে পারফর্ম করতে হবে। সেখানে আরো নামি-দামি গায়ক এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীরা পারফর্ম করবে। নিশ্চয়ই তোরা বুঝতেই পারছিস প্রেশারটা কত। সকলকে নিজের সেরাটা দিতে হবে।’,ফাহিম কথাগুলো বলে।

‘কারা আসবে তা দেখে আমাদের লাভ নেই। আমরা যাবো নিজেদের পারফরম্যান্স করে চলে আসবো।’,অর্ক বলে।

‘অর্ক ঠিক বলেছে। আমরা যাবো আমাদের পারফরম্যান্স দেখাতে আশেপাশে কারা আছে দেখার বিষয় না।’,অর্কের কথায় সায় দিয়ে পায়েল বলে।

‘পেমেন্টের কথা বল আগে।’,বাপ্পি অর্ককে বলে।

‘তোর কি মনে হয় পেমেন্টের কথা বলি না আমি? সবার আগে পেমেন্টের কথা বলি তারপর বাকি কথা ডিসকাশন করি। নরমালি যত নেই এবার তার দ্বিগুণ চেয়েছি আর ওরা রাজি।’,ফাহিম জবাব দেয়।

‘তাহলে তো সব মিলেই গেলো।কাল থেকে প্র্যাক্টিস শুরু।’,রুহি বলে উঠে।

‘আরে দাঁড়া কথা এখনো বাকি। ওদের ডিমান্ড আছে একটা।’,রুহির কথার মাঝে ফাহিম বলে।

‘আবার কি?’,অর্ক প্রশ্ন করে।

‘গ্রুপ পারফরম্যান্সের আগে রাইয়ের সিংগেল পারফরম্যান্স চায়। রাই যদি সিংগেল পারফরম্যান্স করে তাহলেই ওরা দ্বিগুন টাকা দিবে। ওরা মূলত রাইকে চায়।’,ফাহিম আমতাআমতা করে বলে।

‘অসম্ভব! তুই জানিস না আমরা কেউ সিংগেল পারফরম্যান্স করি না। আর রাই তো জীবনেও করবে না।’,অর্ক প্রতিবাদ করে বলে।

‘আমি রাজি। কনসার্ট কবে?’,নিরবতা ভেঙে রাইদা বলে।

‘এক সপ্তাহ পর। তুই পারবি তো?’,ফাহিম জিজ্ঞেস করে।

‘রাই মনে নেই সেই ঘটনা যে বার তুই একা স্টেজে পারফর্ম করছিলি দর্শকের সারি থেকে কয়েকজন ছেলে দৌড়ে এসে জোর করে তোর সাথে ছবি তুলছিলো।’,অর্ক রাইদাকে বলে।

‘রাই কিছু ভুলে না শুধু ভুলে থাকার অভিনয় করে। কল রাখছি রেস্ট দরকার আমার। কালকে সকাল আটটায় অডিটোরিয়ামে দেখা হবে।’
কথাগুলো বলে গ্রুপ কল থেকে বেরিয়ে যায়।
রাইদা বেরিয়ে যেতে গ্রুপ কলে নিরবতা নেমে আসে।

‘ওর মাথায় নিশ্চয়ই অন্য কিছু চলছে।’,ফাহিম বলে।

‘বড়সড় কিছু চলছে আমার মনে হয় ঘটনার বিস্তার অনেক।’,আনমনে বলে অর্ক।

অর্কের কথা শুনে সকলে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।

ফোন লক করে রাইদা বাহিরে দৃষ্টি ফেলে যেখানে গাড়ির সামনে সায়ন দাঁড়িয়ে আছে। সোডিয়ামের আলোতে দেখা যাচ্ছে এক হাতে সিগারেট অপর হাতে ফোন নিয়ে রাইদাকে বারবার কল দিচ্ছে কিন্তু নাম্বার ব্লক থাকায় কল ঢুকছে না। হতাশ চোখে বারবার রাইদার বারান্দার দিকে তাকাচ্ছে আর সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া উড়াচ্ছে। বারান্দার এক পাশে রাইদা বসা যেখানে পর্দা টাঙানো।বাহির থেকে কেউ রাইদাকে দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু সোডিয়ামের আলোতে রাইদা দেখতে পাচ্ছে সব।

তখন সায়ন বেরিয়ে গেলে রাইদা দরজা লাগিয়ে দেয় রুমের এমনকি মারিয়াকেও ঢুকতে দেয়নি। পরে অবশ্য ঘুমানোর সময় মারিয়াকে ঢুকতে দিয়েছে। সায়ন ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে ততক্ষণে রাইদাদের বাসার মেইম গেটে তালা মারা হয়েছে। সায়ন চাইলে মান্নান রাফায়েতকে কল দিয়ে তালা খুলতে পারতো কিন্তু সে চায়নি এতো রাতে বিরক্ত করতে। বাসায় ফিরে যাওয়ার থেকে তার কাছে মনে হয়েছে এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা শ্রেয়।

‘কেমন লাগছে মিস্টার ইমতিয়াজ সায়ন? সবে তো শুরু পিকচার আবি বাকি হে।’,চোখের চশমাটা খুলে সায়নের দিকে দৃষ্টি রেখে রাইদা বলে।

‘রাই কখনো মাফ করে না। দেওয়া আঘাতের প্রতিটি আঘাত দ্বিগুণ রুপে ফেরত দেয়। এক রাতেই ফ্ল্যাট থেকে রাস্তায় নামিয়েছি এরপর যদি আপনাকে ঘর ছাড়া না করেছি আমিও রাইদা রাফায়েত না। আটটা বছর ধরে ভেতরে সব পুষে রেখেছি আর আপনি ভেবেছেন আপনার আট দিনের প্রেমে আমি সব ভুলে যাবো? আমি ভাবতাম আপনি খুব চতুর লোক কিন্তু এখন দেখছি বড্ড বোকা। রাইদা রাফায়েতের ভালোবাসা দেখেছেন, ঘৃণা দেখেছেন এবার দেখবেন তার প্রতিশোধ নেওয়ার স্টাইল।’

বিরবির করে কথাগুলো বলে চুলের খোঁপা খুলে চুলে হাত বুলাতে থাকে রাইদা।

যতবার সায়নকে দেখে ততবারই তার সেইসব মনে পড়ে। চোখ বন্ধ করেতেই সব ভেসে উঠতে চোখ খুলে দাঁড়িয়ে যায় রাইদা,রাগে তার ইচ্ছে করছে এক্ষুণি গিয়ে সায়নের গলা চে*পে ধরতে।
রুমে এসে পায়চারী করতে থাকে পুরানো কথা ভেবে। বালিশে মাথা এলিয়ে দিয়ে আটবছর আগের দিনগুলোতে ডুব দেয়।

..

আট বছর আগে যখন রাইদা ক্লাস এইটে উঠে রাইদার কান্নাকাটি আর জেদের কারণে তাকে নানার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় মান্নান রাফায়েত। বাচ্চা হারানোর পর রওশন আরাকে কাউন্সিলিং করার পাশাপাশি মান্নান রাফায়েত প্রচুর সময় দিতো যাতে সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।

নানুর বাড়িতে নয় টা মাস খারাপ কাটেনি রাইদার। তবে মাঝে মাঝে খালাদের কটু কথা শুনেছে এমন কি তার পছন্দের ছোট মামাও তাকে অনেক কথা শুনিয়েছে। একমাত্র রাইদা আদর পেয়েছে তার নানা ভাইয়ের কাছ থেকে।

সমস্যাটা শুরু হয় যখন রাইদার নানা স্টোক করে। তার চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে তাকে নিয়ে ভর্তি থাকতো তার ছেলে মেয়েরা। এর ফলে পুরো বাড়ি খালি হয়ে যায়। রাইদা আর তার নানু থাকতো বাড়িতে। সেই সময় ছোট মামা আর ছোট খালার বিয়ে হয়নি। ছোট মামা চাকরির সুবাদে ঢাকা থাকতো আর ছোট খালা,মেজ খালা মিলে হাসপাতালে থেকে তাদের বাবার দেখাশোনা করতো।

নভেম্বর মাস পেরিয়ে চলছে ডিসেম্বর মাস। দুদিন পর স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা সেদিকে রাইদার ভ্রুক্ষেপ নেই। পড়া বাদ দিয়ে উঠানে মেয়েদের ডেকে কুতকুত খেলায় ব্যস্ত সে।

‘এই তুই আউট তুই সর এখন আমি খেলবো।’,রাইদা বলে উঠে।

‘মুই আউট না দাগে পা লাগে নায়।’,মেয়েটা প্রতিবাদ করে বলে।

‘এই না তোর আঙ্গুলের কোনা লাগছে।’

রাইদার কথায় মেয়েটা পাত্তা না দিয়ে খেলতে থাকে। রাইদা হতাশ হয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। রাস্তার দিকে চোখ গেলে তার চোখ আঁটকে যায়। এক ছেলে হাঁটছে আর বিরবির করে কিছু বলছে, দূর থেকে চেহারা স্পষ্ট না তবে বুঝা যাচ্ছে সে কিছু নিয়ে বিরক্ত। ফর্সা ছেলেটার গায়ে সাদা গেঞ্জিটা বেশ মানিয়েছে। রাইদা বুঝার চেষ্টা করে ছেলেটা বেশি ফর্সা নাকি তার গায়ের গেঞ্জি। হুট করে রাইদা নিজের হাত-পায়ের দিকে তাকায়। রোদে দৌড়াদৌড়ি করে তার গায়ের আস্তরণ তামাটে হয়ে গেছে।

মূহুর্তেই অপরিচিত ছেলেটাকে রাইদার হিংসা হয় গায়ের রঙ নিয়ে। রাইদা নখ কামড়ে ছেলেটাকে দেখছিলো তখনই ছেলেটা এদিকে তাকায়। চোখে চোখ পড়ায় লজ্জায় রাইদা ঘুরে দাঁড়ায়। রাইদার খেলার সাথী আউট হলে ওড়না কোমড়ে বেঁধে রাইদা কুতকুত খেলা শুরু করে।

সায়ন রাস্তা থেকে রাইদার কুতকুত খেলা দেখে দাঁড়ায়। এক সময় রাইদার আর তার খেলার সাথীদের মধ্যে কুতকুত খেলা নিয়ে ঝগড়া বেঁধে যায়। ঝগড়ায় জিততে না পেরে খেলার ঘরই রাইদা নষ্ট করে দেয়। রাইদার এহেন কান্ড দূর থেকে দেখে হেঁসে দেয় সায়ন।

মেয়েটাকে সে আরো কয়েকবার রাস্তায় দেখেছে দুষ্টুমি করতে। সায়নের বুঝতে বাকি নেই মেয়েটা যেমন চঞ্চল তেমন দুষ্টু।
সায়ন পা বাড়ায় বাজারের দিকে। রাইদা মন খারাপ করে ঘরে চলে যায়। নানু ঘরে নেই সে কখন আসবে সেটাও অজানা। শেষে বই নিয়ে পড়তে বসে রাইদা।

স্কুলে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। রাইদা যাচ্ছে নাম মাত্র পরীক্ষা দিচ্ছে। মন চাইলে লিখছে না চাইলে বসে বসে আকাশ দেখছে। বাংলা পরীক্ষার দিন এমন করায় কৃষি পড়ায় সেই স্যার এসে ধমকে গেছে। স্যারটা রাইদাকে বেশ স্নেহ করে। স্যারের ধমকে রাইদা পরের পরীক্ষা গুলোতে লিখে।

পরীক্ষা দিয়ে মানুষ জন,গাছপালা দেখতে দেখতে বাসায় ফিরছিলো রাইদা। বসায় ফেরার পথে গ্রামের বাজারটা পেরিয়ে যেতে হয়। এদিক ওদিক তাকিয়ে মানুষ দেখতে দেখতে রাইদার নজর যায় কয়েকজন ছেলের মধ্যে থাকা এক ছেলের দিকে। রাইদার হাঁটার গতি কমে যায় ছেলেটাকে দেখে। মানুষটাকে চেনাচেনা লাগে কিন্তু ঘোলা চোখ জোড়া দেখে মনে করতে পারে না কোথায় দেখেছে। নখ কামড়ে মনে করার চেষ্টা করে আবার তাকায় তখনই ছেলেটার চোখে চোখ পড়ে রাইদার। ভ্রু উঁচিয়ে ছেলেটা তাকায় রাইদাও ভংচি দিয়ে হাঁটতে থাকে।

রাইদার প্রতিক্রিয়াতে সায়ন আবারো হাসে। মাথা চুলকে রাইদার যাওয়ার পানে তাকায়।

সন্ধ্যার পরে নানু বাসায় না থাকায় রেডিওর চ্যানেল ঘুরিয়ে গান বাজে এমন চ্যানেল দিয়ে রাইদা একা একা নাচ করার চেষ্টা করে। নাচতে ভীষণ পছন্দ করে কিন্তু লজ্জায় কাউকে বলে না কে কি ভাববে এটা নিয়ে সেটা ভেবে।

জানালার পাশে শব্দ হলে নাচ বন্ধ করে রাইদা গিয়ে টর্চ মারে কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। বিরক্ত হয়ে জানালা লাগিয়ে দেয়। জানালার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সায়ন আর আরেকটা ছেলে। সে বাজার থেকে বাড়িতে ফিরছিলো তখনই মন চায় রাইদাকে দেখতে তাই এসেছিলো কিন্তু শুকনো পাতার শব্দ পেয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখে ছেলেটা রাইদার জানালার উঁকি মেরে দাঁড়িয়ে ছিলো সেটা দেখে সায়ন তার পিঠে লাঠি দিয়ে আঘাত করে।

‘আজকে মাফ করলাম আর করবো না। আর কোনোদিনও এই বাড়ির আশেপাশে তুই কিংবা তোর ছায়া কোনোটাই যাতে না দেখি। শোন সব ছেলেগুলাকে বলে দিবি এই বাড়ি থেকে দূরে থাকতে। কথাগুলো মনে থাকবে?’,ছেলেটার গলার টেনে সায়ন শাসিয়ে কথাগুলো বলে।

‘জে ভাই মনে থাকবে।’,মাথা নিচু করে ছেলেটা বলে।
সায়ন ছেলেটার শার্টের কলার ছেড়ে দিতেই ছেলেটা দৌড়ে পালায়। বন্ধ জানালার দিকে একবার তাকিয়ে সায়ন চলে যায়।

পরের দিন বিকাল বেলা সায়ন তার মা-বোনের সাথে বেরিয়েছে ঘুরতে। সায়ন বের হতে চায়নি মিসেস রিনা তাকে জোর করে সাথে নিয়ে বের হয়েছে।

রাইদার নানু বাড়ির সামনে এসে রিনা দাঁড়িয়ে যায়। দূর থেকে আলেয়া বেগমকে দেখে ডাক দেয়। রিনাকে দেখে আলেয়া বেগম এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। সায়ন তাকিয়ে রাইদার খোঁজ করতে থাকে কিন্তু তাকে দেখতে পায় না।

রিনা আর আলেয়া বেগম কথা বলতে বলতে উঠানে যায়। চেয়ার এনে দিলে রিনা বসে সামনে আলেয়া বসে গল্প শুরু করে দেয়। রিনাকে দেখে পিছনের বাড়ির মহিলারাও চলে আসে গল্প করতে। ছোট মেয়েদের সাথে সায়ন্তিকা খেলায় ব্যস্ত হয়ে যায়। এই ফাঁকে রাইদারকে খুঁজতে খুঁজতে সায়ন চলে যায় বাগানে। সেখানে গিয়ে দেখে রাইদা কাঠবাদাম কুড়াচ্ছে আর গান গাইছে।

‘আমি কি গানের সাথে একটু মিউজিক দিবো?’
অপরিচিত কন্ঠ পেয়ে রাইদা ঘুরে তাকায়।

‘আপনি তো মহা বেয়াদব অনুমতি ছাড়া অন্যের বাগানে চলে আসছেন। বের হন এখনই না হলে নানুকে ডাক দিবো। আপনি কি কাঠ বাদাম নিতে এসেছেন? আমাদের বাগানের বাদাম দিবো না।’

রাইদার এমন কথায় সায়ন ঠোঁট কামড়ে হাসে।

‘কোন ক্লাসে পড় তুমি? তোমাকে দেখে মনে হয় লেখাপড়া করো না সারাদিন কুতকুত খেলো।’,রাইদার দিকে তাকিয়ে বিরুপ মন্তব্য করে সায়ন।

‘এক্সকিউজ মি আমি ক্লাস এইটে পরীক্ষা দিচ্ছি এবার নাইনে উঠবো। অনেক বড় হয়ে গেছি আমি। আমাকে বাচ্চা মেয়ে ভেবে ভুল করবেন না যথেষ্ট বড় আমি।’

‘দেখতেই পাচ্ছি এতো বড় হয়ে গেছো বিয়ে করে বাচ্চা সামলানোর জন্য উপযুক্ত। আমার কাছে একটা পাত্র আছে বেশ নাম ডাক তার তবে সে বুড়ো হয়ে গেছে। বয়স বেশি না ধরো আশি হবে। তোমার নানুর কাছে সেই সমন্ধ নিয়েই এসেছি আমরা।’

সায়নের কথা শুনে রাইদা আঁতকে উঠে। কুড়ানো বাদাম গুলো ফেলেই উঠানে দৌড় দেয়। সায়ন হাসতে হাসতে রাইদার পিছন পিছন যায়।

‘নানু আমি বুড়া বেটাকে বিয়ে করবো না।’,উঠানে গিয়ে রাইদা বলে।

রাইদার এমন আজগুবি কথা শুনে আলেয়া বেগম চোখ বড়বড় করে তাকায়। রিনা রাইদার কথা শুনে হাসি দেয়।

‘এইটা রওশনের মেয়ে? মেয়েটা মা শা আল্লাহ মায়ের মতো সুন্দর হয়েছে আর মনে হয় মায়ের মতোই চঞ্চল।’,আলেয়া বেগমকে বলে রিনা।

জিভে কামড় দিয়ে রাইদা বুঝে যায় সে ভুল সময়ে ভুল কথা বলে ফেলেছে। দৌড়ে পুকুর পাড়ে চলে যায়। গাছে হেলান দিয়ে সায়ন সব দেখছে আর রাইদাকে পর্যবেক্ষণ করছে। মেয়েটাকে কেনো জানি তার ভালো লাগছে। মেয়েটার কথা,দুষ্টুমি,রাগী কন্ঠ এসব তাকে টানছে। পুকুরের সাইডে বসে রাইদা বকাবকি করে সায়নের গুষ্টি উদ্ধার করছে।

‘তোমার নাম কি?’

সায়নের কন্ঠ পেয়ে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় রাইদা।

‘এভাবে তাকালে ভয় পাবো তো। একটু সুন্দর করে তাকাও।’,সায়ন আবারো বলে।

‘আমি এভাবে তাকাই আপনার সমস্যা? ‘

‘আমার কোনো সমস্যা নেই তবে তুমি একটু সুন্দর করে তাকালে মিষ্টি করে কথা বললে সেখানেই মরে যাবো।’

‘ছবির ডায়লগ দিয়ে লাভ নাই। যত্তসব কই থেকে যে আসে।’,বিরক্তি নিয়ে বলে রাইদা।

‘তোমার নামটা তো বললা না আমার নামটা না হয় শুনো।’

‘আমি মোটেও আপনার নাম শুনতে ইচ্ছুক নই। সরুন ঘরে যাবো।’
সায়ন সরে দাঁড়ালে রাইদা ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

‘তুমি কথা বললে রিনরিন একটা শব্দ কানে বাজে হয়তো এটা তোমার ঝাঝালো কন্ঠের দোষ। তোমার নাম তো জানি না তাই আমি তেমায় রি ডাকবো।’
সায়নের কথা শুনে রাইদা আবারো ফিরে আসে।

‘আপনার মাথায় সমস্যা? রি কারো নাম হয় নাকি? আমার নাম রাইদা সবাই ভালোবেসে রাই ডাকে। আপনার দেওয়া নাম একদম ফালতু।’, সায়নের সামনে দাঁড়িয়ে রাইদা কোমড়ে হাত রেখে বলে।

‘আমি না হয় রি ডাকলাম। তুমি সাঁতার পারো?’

‘না কিন্তু কেনো?’

‘এখন যদি আমি তোমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করি তার বদলে তুমি আামকে আমার পছন্দের নাম ধরে ডাকার অনুমতি দিবা সাথে আমি ডাক দিলে সাড়া দিবা। বলো রাজি তুমি?’,সায়ন রাইদার দিকে সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলে।

‘আমার বয়েই গেছে আপনার কথা শুনতে।’, কথাটা বলে রাইদা ঘুরতে নিলে পা পিছনে পুকুরে পড়ে যায়। সায়নের সাথে ঝগড়া করতে এসে পুকুরের কিনারে দাঁড়িয়েছে সেটা সে খেয়ালই করেনি।

পুকুরটা বেশ বড় আর গভীর। রাইদা পানিতে পড়তেই হাত উঁচিয়ে তাকে উঠাতে বলে।

‘তুমি আমার শর্তে রাজি? একবার শুধু হ্যা বলো না হয় মাথা নাড়াও।’

সায়নের কথার কোনো জবাব দেয় না রাইদা। সায়ন যখন দেখে সকলে দৌড়ে এদিকে আসছে সাথে সাথে সে পানিতে ঝাপ দেয়। পানিতে নেমে দু’হাতে রাইদাকে আগলে নেয়। সায়নকে পেয়ে বাঁচতে সায়নের গলা জড়িয়ে ধরে রাইদা। হাঁপাতে হাঁপাতে সায়নের গলার কাছে মুখ নিয়ে নিঃশ্বাস নিতে থাকে রাইদা।

‘আরেকটু হলে মরেই যেতাম।’,রাইদা বলে।

‘আমি থাকতে তোমাকে কিছু হতে দিবো না। এখন থেকে তুমি আমার।’

সায়নের অদ্ভুত কথায় রাইদা চোখ তুলে তাকায়। রাইদাকে পাড়ে তুলে দিয়েছে সায়ন তারপরও রাইদা সায়নের দিকে তাকিয়ে আছে। আলেয়া বেগম এসে রাইদাকে ঘরে নিয়ে যায়। পুকুর থেকে উঠে সায়ন সিঁড়িতে বসে আর নিজের গলায় হাত রাখে যেখানে রাইদা হাত রেখেছিলো। কেনো জানি রাইদার স্পর্শ সায়নের ভালো লাগে। রিনা এসে আলেয়ার দেওয়া গামছা দিয়ে সায়নের মাথা মুছে দেয় এরপর তারা বাড়ি ফিরে যায়।

সেদিনের ঘটনার পর রাইদা ধরেই নেয় ছেলেটার মাথায় সমস্যা আছে তাই সে বিষয়টা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে। এরপর অবশ্য সায়নকে দেখলে পালাতো। চেষ্টা করতো সায়নের সামনে না আসার।

আর দুটো পরীক্ষা বাকি রাইদার এরপর সে কি করবে কিছুই ভাবেনি। তবে কেনো জানি সে আর নানুবাড়ি থাকতে চাইছে না। আজকাল তার নিজেকে অসহায় লাগে। মান্নান রাফায়েতকে কল দিয়ে কয়েকদিন বলেছে তাকে বাসায় ফেরত নিতে কিন্তু মান্নান রাফায়েত তাকে সবসময় ব্যস্ততা দেখাচ্ছে।

এক সকালে ঘুম থেকে উঠে মান্নান রাফায়েতকে কল দেয় কিন্তু সে কল রিসিভ করে না। সারাদিন পেরিয়ে রাত নেমে এলে মান্নান রাফায়েত কল ব্যাক করে।

‘বাবা আমি এখানে থাকবো আমাকে প্লিজ নিয়ে যাও। আমার এখানে ভালো লাগছে না।’,রাইদা কান্নারত অবস্থায় বলে।

‘কি হয়েছে মা? হঠাৎ কাঁদছো কেনো? কেউ কিছু বলেছে?’,মান্নান রাফায়েত জিজ্ঞেস করে।

‘আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও প্লিজ। তুমি আমাকে না নিলে আমি একাই চলে আসবো।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে আমি তোমার মামাকে বলবো তোমাকে নিয়ে আসতে। এখন কান্না থামাও। তুমি না লক্ষী মেয়ে এভাবে কান্না করলে আমার তো খারাপ লাগে।’

‘আমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে মামাকে বলো জলদি আসতে।’

‘ঠিক আছে বলবো। কল রাখছি তোমার মা ডাকছে আমাকে।’
মান্নান রাফায়েত কল কেটে দিলে রাইদা চুপ করে বসে থাকে।

পরের দিন দুপুর বেলা বাসায় কেউ নেই। রাইদার নানু রান্না শেষ করল পিছনের বাড়ির চাপ কল থেকে গিয়েছে পানি আনতে আর রাইদা পুকুরের সিঁড়িতে বসে গোসল করছে। গোসল সেরে তোয়ালে মাথায় পেঁচিয়ে ঘরে যায় ভেজা জামাকাপড় পাল্টাতে। জামা কাপড় পাল্টানোর সময় দরজায় কেউ নক করে। ভরদুপুরে দরজায় কেউ নক করায় রাইদা ভয় পেয়ে যায়। জলদি জামা পাল্টে চিন্তা করতে থাকে কি করবে।

একটা সময় দরজা খুলে কিছুটা ফাঁকা করে উঁকি মেরে রাইদা তাকায়।তার অর্ধেক চেহারা আর চুল দেখা যাচ্ছে। ভরদুপুরে সায়নকে দেখে তার চোখেমুখে আতংক। মাথা থেকে তোয়ালে সরিয়ে বিছানায় রেখেছিলো যার ফলে ভেজা চুল থেকে টপাটপ পানি পরে মাটি ভিজে যাচ্ছে।

সায়ন আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলো রাইদা মাত্র গোসল সেরে এসেছে।

‘কাকে চাই?’,রাইদা প্রশ্ন করে।

‘নানু বাসায় আছে?’, সায়ন পাল্টা প্রশ্ন করে।

‘কেউ নেই যান এখান থেকে।বাসায় কেউ নেই তাই আপনাকে ওয়েলকাম করতে পারছি না।’

কথাটা বলে রাইদা মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দেয়। দরজা লাগিয়ে বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। অনেক ভয় পেয়েছিলো সে।

সায়নের মুখে হাসি ফুটে উঠে।
‘সময় হোক তারপর বলবো কাকে চাই।’,বিরবির করে কথাগুলো বলে দরজার পানে চেয়ে থাকে সায়ন।
পকেটে দু-হাত ঢুকিয়ে সেখান থেকে চলে যায় সে।

কিছুক্ষণ পর সায়নের সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা খুলে উঁকি দেয় রাইদা কাউকে দেখতে না পেয়ে আবারো দরজা লাগিয়ে দেয়।

সকালে রাইদার ঘুম ভাঙে এর্লামের শব্দে। ফোনটা হাতে নিয়ে এলার্ম বন্ধ করে উঠে বসে। রাতের বেলা পুরানো ঘটনা গুলো ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো।

বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নেয়। রেডি হয়ে ব্যাগ নিয়ে বসার ঘরে আসলে দেখে মান্নান রাফায়েত বসে টিভি দেখছে তার পাশেই মারিয়া বসা।

‘বাবা আমি বের হচ্ছি।’,রাইদা বলে।

‘এত জলদি? নাশতা খেয়ে বের হ।’,মান্নান রাফায়েত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে।

‘প্র্যাক্টিস আছে তারপর ক্লাস,ল্যাব আবার ক্লাস সব মিলিয়ে সারাদিন ব্যস্ত আজকে আমি। ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নিবো থাকো আসছি।’
কথাগুলো বলে রাইদা বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

‘মেয়েটারে যেতে কেনো দিলা ঐ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলা না কেনো?’,রওশন আরা মান্নান রাফায়েতকে বলে।

‘সময় হলে মেয়ে নিজেই আমাকে সব বলবে এতো উত্তলা হওয়ার কিছু নেই।’

‘আমি তো আগেই বলছি ছেলে ভালো না। মেয়ে ঐ ছেলের সাথে সংসার করবে না। সংসার করতে চায় না বলেই ফিরে এসেছে।’

কথাগুলো বলতে বলতে রওশন আরা নিজের রুমে যায়। মান্নান রাফায়েত চিন্তায় পড়ে যায় বিষয়টা নিয়ে।

বাসা থেকে নেমে সায়নের গাড়ি দেখতে পায় না রাইদা। সে বুঝে যায় সায়ন হয়তো বাসায় ফিরে গেছে। রিকশা ডেকে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

ভার্সিটিতে এসে সকাল বেলা প্র্যাক্টিস শেষ করে ক্লাস করতে চলে যায় রাইদা এবং তার বন্ধুরা। ক্লাস শেষ করে ল্যাব ক্লাসের আগে সবাই গাছ তলায় এসে বসে বিশ্রাম নিতে।

‘কে কি খাবি বল নিয়ে আসি।’,অর্ক জিজ্ঞেস করে।

‘আমার জন্য মিল্কশেক। ‘,রাইদা বলে।

‘আমার জন্য কোল্ড কফি।’,পায়েল হাত তুলে বলে।

‘আমার জন্য চা।’,রুহি বলে।

‘এই গরমে তুই চা খাবি? এলিয়েন কোথাকার।’,বাপ্পি রুহির দিকে তাকিয়ে বলে।

‘তুই যখন ঠান্ডায় আইসক্রিম খাস আমি কিছু বলছি? তুই নিজে এলিয়েন।’,রুহি বাপ্পির কথায় ফোঁড়ন কেটে বলে।

‘ল্যাব ক্লাসটা করে সবাই লাঞ্চ করতে বের হবো আপাতত যে যা খেতে চায় খাক।’,হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অর্ক বলে।

অর্কের কথা শুনে রুহি মুখ তুলে তাকায়। বাপ্পি আর অর্ক চলে যায় ক্যান্টিনে। ফাহিম পায়েলের কাঁধে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে আর পায়েল ফোনে রুবেলের সাথে বার্তা আদান-প্রদানে ব্যস্ত।

‘আপু এই চিঠিটা আপনাকে দিতে বলেছে ঐ ভাই।’
এক ছেলে রাইদার দিকে একটা চিঠি বাড়িয়ে দিয়ে বলে। রাইদা চোখ জোড়া ছোট ছোট করে তাকালে দেখে দূরে সায়ন দাঁড়িয়ে আছে। হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলে ছেলেটা সেখান থেকে চলে যায়।
রুহি কৌতুহল চোখে রাইদার দিকে তাকালে দেখে রাইদার চোখ মুখে বিরক্তি।
চিঠিটা খুলে রাইদা মনে মনে পড়তে শুরু করে।

“প্রিয় বউ,
প্রথমেই আমার একরাশ ভালোবাসা নাও। তোমাকে ভালোবাসা ছাড়া দেওয়ার মতো আমার কাছে আর কিছুই নেই। তোমার সাথে সংসার করার পর বুঝেছি প্রমিক পুরুষরা কেনো সবসময় তাদের কল্পনার নারীকে নিজের করে চায়। আমি সেই ভাগ্যবান প্রেমিক পুরুষদের মধ্যে একজন যে তার স্বপ্নের রমনীকে নিজের করে পেয়েছে হয়তো কিছু সময়ের জন্য কিন্তু বিশ্বাস করো যতটুকু সময় তুমি আমার সাথে কাটিয়েছো সেই সময়টুকু আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়। আমি জানি আমি তোমার উপযুক্ত না তবুও বলবো আমার মতো তোমায় কেউ ভালোবেসে চাইয়নি কিংবা চাইবে না।
এই অধম প্রেমিককে ভুল বোঝাবুঝি দূর করার একটা সুযোগ দাও না হলে তোমার প্রেম তৃষ্ণায় প্রেমিকটা অকালে প্রাণ হারিয়ে শহীদ হবে।

ইতি,
তোমার একমাত্র বর।”

চিঠিটা পড়ে রাইদা সায়নের দিকে তাকায় অবাক চোখে। রাইদার দিকে তাকিয়ে সায়ন আলতো হেঁসে এগিয়ে আসে।


(চলবে..)

(আজকে সারপ্রাইজ হিসেবে জলদি গল্প দিলাম আর বড় করে পর্ব দিলাম। ধৈর্য্য ধরে সকলকে পড়ার অনুরোধ রইলো। গল্পে যা ঘটছে তার পিছনে অবশ্যই কেনো কারণ আছে সেটা গল্পটা পড়লেই বুঝতে পারবেন। গল্পটা সাধারণ প্রেম কাহিনী হিসেবে লিখছি না কিছু টুইস্ট অবশ্যই আছে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here