‘ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ৬২||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
বীণা দেবী: আধভিকের…সৎ মা!
সিয়ারা এবং দিয়ারা দুজনেই চমকে ওঠে নামটা শুনে। দিয়ারা মুখে হাত রেখে চোখটা সামনের দিকে ঘোরাতেই আঁতকে উঠলো।
দিয়ারা: দি!
সিয়ারা মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো। দিয়ারার ডাক শুনে দিয়ারার দিকে তাকিয়ে, দিয়ারা যেদিকে তাকিয়ে আছে সেদিকে তাকাতেই নিজেও আঁতকে উঠলো। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অস্ফুট স্বরে বললো,
সিয়ারা: আভি!
আধভিক সিয়ারার পিছু নেওয়ায় যখন দেখলো সিয়ারা হসপিটালে এসেছে তখনই বুঝেছিল নিজের মায়ের কাছে ওরা যাচ্ছে। কিন্তু এরকম হুরপার করে আসার মানে কি? আধভিক চুপচাপ পিছু নিয়ে কেবিনের বাইরে, দরজাটা হাল্কা খুলে কথাগুলো শুনছিল। অপরাধীর নাম শুনে আধভিক ভারসাম্য হারিয়ে দরজায় হাত দিতেই দরজাটা খুলে যায় আর দিয়ারা সেটা লক্ষ্য করে ফেলে। কিছুক্ষণ শকের মধ্যে থাকলেও ধীরে ধীরে আধভিকের মুখের অভিব্যক্তি বদলাতে শুরু করে যাতে সিয়ারা ভয় পেয়ে যায়। সিয়ারা এগিয়ে এসে আধভিককে ধরতে যাবে তার আগেই আধভিক বেরিয়ে যায় ওখান থেকে।
দিয়ারা: দি! এবার কি হবে? ভিকিদা এভাবে বেরিয়ে গেলো, আমার ভয় করছে দি। ভিকিদাকে ধীরে সুস্থে বলতে হতো তোকে।
সিয়ারা: আমি কীভাবে জানবো ও আমাকে ফলো করে এখানে চলে আসবে? আমাকে, আমাকে যেতে হবে দিয়া। তুই মায়ের কাছে থাক ঠিক আছে? দরকার পরলে দেবকে ডেকে নিস।
দিয়ারা: ঠিক আছে তুই সাবধানে যা।
সিয়ারা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো ওখান থেকে। বাইরে বেড়াতেই দেখলো আধভিক গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে সিয়ারা নিজের গাড়ি নিয়ে আধভিকের পিছু নিলো। আধভিক যে নিজের বাড়িতে যাচ্ছে সেটা সিয়ারা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে।
বাড়িতে,
আভাস বাবু ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে নিউজপেপার পড়ছেন। সিয়ারা অফিসে পৌঁছতেই আভাস বাবু বাড়ি ফিরে আসেন। সেই সময় পর পর একটানা কলিং বেল বাজতে থাকলে আভাস বাবু চমকে ওঠেন। পরিচারিকা দরজা খুলতেই আধভিক ভিতরে এসে আভাস বাবুর দিকে তাকায় আর হাত মুঠো করে নেয়।
আভাস বাবু: কি হয়েছে ভিকি? তোমাকে এমন…
আধভিক উপরে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। নিজেদের বাড়িতে থাকার দরুন আধভিক নিজের রুম লক করলো না, অ্যাপার্টমেন্টে থাকলে হয়তো করতো। এই রুমে আসার সাহস এখন কেউ পাবে না। পরিচারিকা আধভিকের যাওয়ার ধরণ দেখে একটা ঢোঁক গিলে দরজা দিতে যাবে তার আগেই সিয়ারা সেখানে উপস্থিত হলো এবং পরিচারিকা আবারও দরজা খুলে দিলো। সিয়ারা ভিতরে আসতেই দেখলো আভাস বাবু উপরের ঘরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
সিয়ারা: আংকেল? আভি, আভি কোথায়? (হাঁপাতে হাঁপাতে)
আভাস বাবু: ভিকি প্রচণ্ড রেগে নিজের ঘরে গেলো। এখন তাণ্ডব চালাবে, অনেক বছর পর ও’কে এভাবে দেখছি। কি হয়েছে বলো আমায়? ও তো তোমার সাথে ছিলো, কোনো সমস্যা হয়েছে?
সিয়ারা: এখন অত কিছু বলার সময় নেই আংকেল। আমি আগে তাণ্ডব থামানোর ব্যবস্থা করি।
আভাস বাবু: যেও না এখন। এইসময় ওর মাথার ঠিক থাকে না।
আভাস বাবু সিয়ারাকে আটকে কথাটা বলেন। সিয়ারা কোনো কিছু বলবে তার আগেই বিকট একটা আওয়াজ আসে।
সিয়ারা: আমাকেই যেতে হবে আংকেল।
সিয়ারা চলে গেলো উপরে। আভাস বাবু দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে শুরু করলেন। উনি বুঝতে পারছেন না হঠাৎ করে কি হলো? সিয়ারার উপর তো আজ অবধি আধভিক রাগ পর্যন্ত করেনি তাহলে এত রাগ কার উপর? ভেবে পাচ্ছেন না আভাস বাবু।
সিয়ারা এতক্ষণ দ্রুত পায়ে আসলেও আধভিকের ঘরের সামনে গিয়ে ওর পা আটকে যায়। দ্রুত নিশ্বাস নিতে থাকে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। আধভিক ও একহাত কোমরে এবং অপর হাত কপালে ঘসছে নীচের দিকে তাকিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুই হাত কোমরে রেখে উপরের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে নেয় আধভিক। সিয়ারা ঘরের ভিতরে এসে দরজা বন্ধ করতেই আধভিক মাথা উপরে রেখেই শুধু চোখ খুললো। সিয়ারা দরজা বন্ধ করে আধভিকের দিকে তাকাতেই দেখে আধভিক ওর দিকে তাকিয়ে আছে রক্তিম চোখ নিয়ে। সিয়ারার বুকটা ধুক করে ওঠে আধভিকের চাহুনি দেখে। মনটা বলে ওঠে কিছু একটা খারাপ হতে চলেছে, খুব খারাপ।
সিয়ারা এক পা, দু পা করে আধভিকের দিকে এগোয় কিন্তু আধভিকে প্রতিক্রিয়া এক জায়গায় স্থির। সে একভাবে তাকিয়ে আছে সিয়ারার দিকে। সিয়ারা আধভিকের সামনে এসে দাঁড়াতেই আধভিক নিজের চোখের পলক ফেললো একবার। সিয়ারা কিছু বলতে যাবে তার আগেই এক হাত সিয়ারার গালে রেখে বললো,
আধভিক: আমাদেরকে এই সম্পর্কটা শেষ করতে হবে সিয়ারা। আজ, এখন, এখানেই। এখনও সময় আছে সরে আসার। আণ্টি সুস্থ হয়ে উঠেছেন, দিয়ারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে আর এখন তুমি নিজেও সাবলম্বী। সাফল্য অর্জনের শুরু তোমার জীবনে। খুব সুন্দর একটা জীবন তুমি বাঁচতে পারবে এরপর থেকে, যেই জীবনে আমি থাকবো না। আমি নিজেও জানি না আমার এই “মিসটেক” -এর জীবনটা কতক্ষণের। আমার শত্রু এখন তোমার শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব জানার পর, বোঝার পর আমি কিছুতেই তোমার জীবনটা আমার সাথে জড়িয়ে নষ্ট করতে পারবো না। চলে যাও।
আধভিক নিজের কথা শেষ করে সিয়ারার গাল থেকে হাত সরিয়ে পিছনে ফিরে যায়। সিয়ারা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আধভিক সম্পর্ক শেষ করার কথা বললো? এটা সত্যি? সিয়ারা কথাটা ভেবে না বোধক মাথা নাড়িয়ে আধভিককে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
সিয়ারা: আমাদের সম্পর্কটা “মিসটেক” নয় আভি। তোমার জীবনে যদি কোনো বিপদ আসে সেটা আমরা দুজন মিলে একসাথে ফেস করবো। তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছো আভি।
আধভিক: দুইমাস আগে যেই অ্যাকসিডেন্টটা তোমার সাথে হয়েছে সেটা আমার জন্য! দুই বছর আগে তোমাকে আমার থেকে আলাদা করা হয়েছে আমার জন্য!! কেন জানো? এই বিশাল সম্পত্তির জন্য যেটা আমার নামে লেখা আছে।
আধভিক পিছিয়ে গিয়ে দুহাত ছড়িয়ে চিৎকার করে কথাটা বললো। সিয়ারা কিছু বুঝতে পারছে না আধভিক কি বলছে।
আধভিক: উনি চেয়েছিলেন আমি শেষ হয়ে যাই। আমার মা কে আমার থেকে আলাদা করেছেন এইবার ওনার নিশানা তোমার উপর। আমি নিজে থেকে মরলে তবেই গিয়ে সম্পত্তিটা পাবে। এইসব বোঝার পরেও তুমি বলছো আমি ভয় পাবো না? নাহ সিয়ারা। আমার এই জীবনের সাথে আমি তোমাকে জড়াতে পারবো না যেখানে তোমাকে প্রতি মুহুর্ত কষ্ট পেতে হবে, জীবনের ঝুঁকি থাকবে তোমার। তুমি প্লিজ, প্লিজ তুমি চলে যাও!!
সিয়ারা: (আধভিকের দুই বাহু ধরে) আমার ভালোবাসাটা কি তুমি মজা পেয়েছো? যখন চাইবে আমার জীবনে আসবে, আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করবে আর যখন চাইবে চলে যেতে বলবে সম্পর্ক শেষ বলে? মজা মনে হচ্ছে তোমার? ভালোবাসাটা মজার জিনিস নয় আভি! (কন্নামিশ্রিত কণ্ঠে জোর গলায়)
আধভিক: (জোর গলায়) কিন্তু আমার জীবনটা একটা মজা ড্যাম ইট!
সিয়ারা: এইসব তোমার আগে ভাবা উচিত ছিলো। এগুলো তো তুমি আগে থেকে জানতে তাই না? আমি আসার আগে থেকেই এইসব ছিলো আধভিক! এতই যখন ভয় ছিলো তাহলে কেন আমাকে তোমার জীবনে আনলে? কেন এত কাছে টানলে? দূরে থাকতে পারতে!!
আধভিক: (জোরে) সেটাই তো কথা!! তুমি আসার আগে আমি আমার শত্রু ছিলাম। এখন আমি তোমার শত্রু হয়ে উঠেছি। এইটা আমি জানতাম না। আমি ভাবিনি আমি তোমার শত্রু হয়ে উঠবো, তোমার জীবনে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবো। তাই প্লিজ এখান থেকে, আমার জীবন থেকে চলে যাও সিয়ারা! জাস্ট গো আওয়ে!!
সিয়ারা আরও কিছু বলতে গেলে আধভিক সিয়ারার বাহু শক্ত করে ধরে টানতে টানতে দরজার দিকে নিয়ে যায়। সিয়ারা বারবার চেষ্টা করে আধভিককে আটকানোর, ও’কে বোঝানোর কিন্তু কোনো লাভ হয় না। সিয়ারাকে ধাক্কা দিয়ে বার করতেই সিয়ারা টাল সামলাতে না পেরে পরে যায় মেঝেতে। আধভিক বুঝতে পারেনি সে এতো জোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে তাই সিয়ারাকে ধরতে যাওয়ার আগেই সিয়ারা ঘুরে কান্না ভেজা চোখে আধভিকের দিকে তাকায় বসে থেকেই। আধভিক তৎক্ষণাৎ নিজেকে শক্ত করে সিয়ারার মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দেয়। সিয়ারা ডুকরে কেঁদে ওঠে দরজার উপর একটা হাত রেখে মাথা নিচু করে।
অন্যদিকে, আধভিকের মুখ পুরো লাল হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারছে না তাঁর কি করা উচিত। জল এতটা দুর গড়িয়ে গেছে সে টের পর্যন্ত পায়নি। মাথাতেও আসেনি এই বিষয়টা তাঁর। অ্যাসিড? অ্যাসিড অ্যাটাক হলো তাঁর জন্য সিয়ারার উপর? সে ওখানে না থাকলে কি অবস্থা হতো সিয়ারার? ভাবতেই আধভিকের চোখ দিয়ে জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পরে। ভীষণ অসহায় লাগছে নিজেকে আজকে আধভিকের। দরজায় হেলান দিয়ে ধীরে ধীরে বসে পরে সে।
অনেকক্ষণ পর,
সিয়ারা অনুভব করে কেউ ওর হাতে নিজের ঠোঁটের স্পর্শ দিচ্ছে। চোখটা জোর করে খুলতেই দেখে আধভিক বসে আছে ওর হাতটা ধরে। চোখটা একটু ঘুরাতেই টের পায় দরজা খোলা। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে চোখ লেগে গেছিলো সেটাই টের পায়নি সিয়ারা। আস্তে আস্তে উঠে বসতেই আধভিক অপরাধীর মতো সিয়ারার দিকে তাকালে। সিয়ারা নিজের কান্না চেপে আধভিককে বুকে টেনে নেয়। আধভিক ডুকরে কেঁদে উঠলে সিয়ারাও কেঁদে ফেলে।
সিয়ারা: সব ঠিক হয়ে যাবে আভি। আমরা একসাথে সব কিছুকে ফেস করবো। প্লিজ এভাবে দূরে সরিয়ে দিও না আমায়। আমি বাঁচতে পারবো না তোমাকে ছাড়া।
আধভিক কোনো উত্তর দেয় না চুপ করে থাকে। নিজেকে একটু স্বাভাবিক করেই সোজা হয়ে উঠে বসে আধভিক। চোখটা মুছে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আধভিককে উঠে দাঁড়াতে দেখে সিয়ারাও উঠে দাঁড়ায় কিন্তু অনেকক্ষণ পা ভাঁজ করে বসে থাকায় এবং পরে গিয়ে ব্যথা পাওয়ায় পা টান করতে সমস্যা হওয়ায় পরে যেতে নেয়। তবে আধভিক সাথে সাথে ধরে নেয় সিয়ারাকে।
সিয়ারা: কেন এমন করছো আভি? প্লিজ এমন করো না!
আধভিক: আমি আমার জন্য তোমার জীবনটা নষ্ট করতে পারি না। বিশ্বাস করো, ভাবিনি এমন কিছু হবে। যদি জানতাম, তাহলে কখনও তোমাকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতাম না। কখনও না!
সিয়ারা: (নিজেকে শক্ত করে) তার মানে তুমি তোমার সিদ্ধান্তে অনড় থাকবে তাই তো?
আধভিকের নীরবতা সিয়ারার বুকে হাহাকার ছড়িয়ে দেয়। একটা উচ্চ আর্তনাদ করে ওঠে সিয়ারার হৃদয়ে যা কেউ শুনতে পায় না। আধভিকের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিয়ারা বলে,
সিয়ারা: ঠিক আছে। আমি চলে যাচ্ছি। গতবার আমি নিজের ইচ্ছায় যাইনি, আমাকে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। আজও নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছি না। আমার কোনো সাফল্যের দরকার নেই। কিচ্ছু চাই না আমার।
আধভিক: এইটা তুমি নিজের যোগ্যতায় অর্জন করেছো সিয়ারা।
সিয়ারার জানো বুকে এসে লাগছে আধভিকের মুখে ওর পুরো নামটা শুনে। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা তো ও’কে পাগলের মত ভালোবাসতো। কি কি পাগলামিই না করেছে ও’কে পাওয়ার জন্য আর এখন? এতটা বদলে গেলো এক মুহুর্তে? কীভাবে সম্ভব? কি সুন্দর সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলো। একবারও ভাবলো না কতটা কষ্ট হবে সিয়ারার।
সিয়ারা: চাইনা এমন সাফল্য আমার। যে আমার সাফল্যের কারণ সেই যখন থাকবে না তাহলে সাফল্য নিয়ে আমি কি করবো? এই সাফল্য হতে পারে আমার যোগ্যতায় কিন্তু আমি তো কখনও এই জীবন বাঁচার কথা ভাবিনি। সে আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে। সে আমার স্বপ্ন পূরণ করেছে, এই জীবন দিয়েছে আমাকে। এখন যখন সে মাঝ পথে হাত ছেড়ে দিচ্ছে তখন আমার এই সাফল্য, এই জীবন কিচ্ছু চাই না যা প্রতি পদে আমাকে তাঁর কথা মনে করাবে। এটা মনে করাবে যে, কথা দিয়ে সে কথা রাখেনি!
কথাটুকু বলে সিয়ারা এগোতে নিলে আবার আটকে যায় আর তখন আধভিক ধরতে গেলে সিয়ারা হাত সামনে দিয়ে আটকে দেয়। অভিমানের সুরে বলে,
সিয়ারা: যার সাথে সম্পর্ক শেষ করেছেন তাঁকে স্পর্শ করার আর কোনো অধিকার আপনার নেই মিস্টার রায় চৌধুরী!
আধভিক চোখ বন্ধ করে নিলো সিয়ারার কথাটুকু শেষ করতেই। সিয়ারার মতো আধভিকের বুকের ভিতরেও বোধহয় হাহাকার হচ্ছে, আর্তনাদ করছে হৃদয়। আধভিক আর কিছু না বলে নীচে চলে যায় আর সিয়ারা হাঁটুটা একটু ডলে নেয়। তারপর ধীরে ধীরে নীচে নামার জন্য এগিয়ে যায়। তখনই আধভিকের হুংকার শুনতে পায় আর কেঁপে ওঠে সিয়ারা। যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব নীচে চলে যায় সে আর দেখে….
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]
সমীকরণ বদলাতে চলেছে শীঘ্রই। ধরে নিতে পারেন, গল্পের নতুন মোড়!’ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ৬৩||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
আধভিক চোখ বন্ধ করে নিলো সিয়ারা কথাটুকু শেষ করতেই। সিয়ারার মতো আধভিকের বুকের ভিতরেও বোধহয় হাহাকার হচ্ছে, আর্তনাদ করছে হৃদয়। আধভিক আর কিছু না বলে নীচে চলে যায় আর সিয়ারা হাঁটুটা একটু ডলে নেয়। তারপর ধীরে ধীরে নীচে নামার জন্য এগিয়ে যায়। তখনই আধভিকের হুংকার শুনতে পায় আর কেঁপে ওঠে সিয়ারা। যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব নীচে চলে যায় সে আর দেখে… আভাস বাবুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে আধভিক। আভাস বাবু চুপচাপ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।
আধভিক: কি হলো? কথা বলছো না কেন? মাথা নীচু করে নিলে যে বড়ো? কিছুক্ষণ আগে খুব তো আমার রাগের কারণ জানতে চাইছিলে। এখন যখন বুঝতে পারছো তোমার কাছের লোক আমার রাগের কারণ তখন চুপ করে গেলে?
আভাস বাবু: ভিকি প্লিজ, অভ্র বাড়িতে আছে। তুমি শান্ত…
আধভিক: আমি কাওকে ভয় পাই না মিস্টার আভাস রায় চৌধুরী! কাওকে ভয় পাই না আমি। আজ শুধুমাত্র তোমার ভালোবাসার মানুষ, কাছের মানুষের জন্য আমার জীবনটা নরক হয়ে গেছে। প্রথম থেকে আমার জীবন থেকে আমার কাছের মানুষ গুলোকে কেড়ে নিয়েছে এবং এখনও নিতে চাইছে।
সিয়ারা বুঝতে পারলো আধভিক প্রচণ্ড রেগে আছে। সিয়ারা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে ওদের কাছাকাছি এসে সোফার কাছে দাঁড়ালো ঠিকই কিন্তু আধভিককে আটকানোর সাহস পাচ্ছে না। আবার বাবা-ছেলের কথার মাঝে ঢুকতেও চাইছে না সিয়ারা।
আভাস বাবু: আমি এইসব বিষয়ে কিছু জানতাম না ভিকি, যেগুলো সিয়া মার মা বলেছেন।
আধভিক: তা জানবে কীভাবে? তুমি আজ অবধি নিজের কোনো কর্তব্য পালন করতে পেরেছো? প্রথমে একটা অযোগ্য মানুষকে ভালোবেসে আমার মায়ের মত একজন মানুষকে দিনের পর দিন অবহেলা করে কষ্ট দিয়েছো। তারপর ঠাম্মি আর আমার মায়ের অজান্তেই তাঁকে বিয়ে করে, সংসার পেতে নিয়ে একদিন হঠাৎ করে জানাতে চলে এলে। আমার মায়ের কথা না হয় বাদ দিলাম, একবারও ভাবনি ঠাম্মি কতটা কষ্ট পাবে। তারপর যখন আমি তোমার কাছে থাকতে চেয়েছিলাম এতো কিছুর পরেও, তখনও তুমি আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলে। আরে, তুমি তো যোগ্যই নও কোনো কিছুর! না ভালো ছেলে হতে পেরেছো, না ভালো স্বামী আর না ভালো বাবা। কিচ্ছু না!
সিয়ারা: আভি স্টপেড! কি বলছো…
আধভিক: যা বলছি ঠিক বলছি! কে বলেছিলো ওনাকে আমার প্রতি দরদ দেখিয়ে এই বাড়িতে পরে থাকতে? কে বলেছিল এইসব সম্পত্তি আমার নামে করে রাখতে? আমি তো চাইনি এইসব। যে আমাকে একটা মিসটেক বলে পরিচয় দিয়েছে তাঁর থেকে বাবার পরিচয় চাইনি আমি!! কখনও চাইনি। আজ শুধুমাত্র ওনার জন্য আমার জীবনটা নরকে পরিণত হয়েছে।
সিয়ারা: আধভিক প্লিজ! অনেক বলে ফেলেছো। চুপ করো এবার। মানুষটা তোমার বাবা হয়! তোমার পাশে ছিলেন এতদিন। উনি কিছু বলছেন না বলে এভাবে কথা শোনাতে থাকবে তুমি?
আধভিক: ওনার যেমন আমার কথাগুলো বিষের মতো লাগছে? আমার পুরো জীবনটা বিষিয়ে গেছে।
আধভিক দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলে উপরে উঠে গেল। উপরে উঠতেই দেখলো অভ্র অপর পাশে দাঁড়িয়ে আছে রেলিং ধরে। আধভিক অভ্রর দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাতেই অভ্র মাথা নামিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেলো আর আধভিক মাথা নামিয়ে নীচের দিকে তাকালো।
সিয়ারা: আংকেল, আংকেল আপনি বসুন। আমি জানি ওর কথায় আপনার খারাপ লেগেছে। আমাকেও অনেক কিছু শুনিয়েছে। আমাকে বলেছে আমাদের সম্পর্ক নাকি এখানেই শেষ।
আভাস বাবু চমকে উঠে তাকালো সিয়ারার দিকে। আভাস বাবুর প্রতিক্রিয়া দেখে সিয়ারা মাথা নীচু করে সম্মতি জানলে আভাস বাবু বলেন,
আভাস বাবু: এসব কি বলছো তুমি? দাঁড়াও, আমি এক্ষুনি কথা বলছি ওর সাথে।
সিয়ারা: (আভাস বাবুকে আটকে) আংকেল প্লিজ, কিছুক্ষণ আগে ও আপনাকে এতো কথা শুনালো আর আপনি এখন আবার ওর সাথে কথা বলতে যাচ্ছেন?
আভাস বাবু: (কিঞ্চিৎ হেসে) আমাকে যে কথাগুলো বলেছে সেগুলো তো কিছু ভুল বলেনি ও। আমার এসবই প্রাপ্য, তবে তোমাকে ও এসব বলে ঠিক করেনি।
সিয়ারা: তবুও, এখন যাওয়ার দরকার নেই আংকেল। আগে রাগটা ঠাণ্ডা হোক।
আভাস বাবু: আচ্ছা তবে তাই হবে। (কিছুক্ষণ থেমে) জানো তো সিয়া মা, ওর মায়ের সাথে সত্যি আমি অনেক অন্যায় করেছি। নিজের মায়ের সাথেও। আসলে আমি ঠকাতে চাইনি ওর মা কে। আমি রঞ্জিতাকে ভালোবাসতাম মানে অভ্রর মাকে। কিন্তু আমার মা কিছুতেই রাজি ছিল না তাই আমি বলেছিলাম যে আমি বিয়েই করবো না। মা শুনলো না, জোর করে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলো। আমার সব রাগ, ক্ষোভ গিয়ে পড়লো শ্রীতমার উপর। তাই ঠিক করে কথা বলতাম না কখনও তবে যখনই ওর থেকে দূরে যেতাম আমার মনে হতো আমি ভুল করছি। কিন্তু চোখের সামনে ও আসলেই মনে হতো যে হ্যাঁ, ওর কারণেই আমি আমার ভালোবাসাকে পাইনি নিজের করে।
সিয়ারা: “হ্যাঁ”?? এভাবে কেন বললেন আংকেল? আপনাকে কি কে বলতো এমনটা যে, ওর মায়ের জন্য আপনি আপনার ভালোবাসা পাননি?
আভাস বাবু: রঞ্জিতা বলতো। যখনই ওর কাছে যেতাম বেশির ভাগ সময়ই হতাশ হয়ে থাকতাম। কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলতাম যে, শ্রীর সাথে আমি ঠিক করছি না। আর তখনই ও আমাকে বলতে শুরু করতো যে শ্রীর জন্যেই আমরা এক হতে পারিনি। আমার ভালো লাগতো না, চলে আসতাম। কিন্তু ওর কথাগুলো মনে গেঁথে যেতো। এই টানাপোড়েনে একদিন অতিরিক্ত নেশা করে ফেলি আর প্রথম হয়তো শ্রীকে কাছে টেনে নিই।
আভাস বাবু মাথা নীচু করে ফেলেন। সিয়ারা সময় দেয় ওনাকে একটু। আভাস বাবু আবারও বলতে শুরু করেন,
আভাস বাবু: সেই ঘটনাটা আমার হুঁশ থাকতেই হয়েছিলো। তাই হঠাৎ করেই আমি শ্রীর প্রতি একটা টান অনুভব করছিলাম। আমাদের সম্পর্কটা একটু ভালো হচ্ছিলো। নিজের থেকেই একদিন ও’কে “শ্রী” বলে ডেকেছিলাম, সেদিন ওর খুশির ঠিকানা ছিলো না।
আভাস বাবুর ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে কথাটা বলতে গিয়ে। হয়তো শ্রীতমা দেবীর হাসি মুখটা, সেই মুহূর্তটা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে ওনার। নিজেকে আবার স্বাভাবিক করে নিলেন উনি।
আভাস বাবু: আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম আমাকে কি করতে হবে। বুঝে গেছিলাম অতীতকে ভুলে বর্তমানকে মেনে নিয়ে এগোতে হবে আমাকে। একজন নির্দোষ মানুষের সাথে দিনের পর দিন আর অন্যায় করতে পারছিলাম না আমি। তাই রঞ্জিতাকে গিয়ে জানাই যে, আমি আর তাঁর সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবো না। এটুকু বলেই ও’কে বিদায় জানিয়ে চলে এসেছিলাম। সব ঠিক চলছিলো তারপর কিন্তু হঠাৎই সব আবার এলোমেলো হয়ে গেলো।
সিয়ারা: কি হয়েছিলো?
আভাস বাবু: আমার কাছে খবর এলো রঞ্জিতা সুইসাইড অ্যাটেম্পট করেছে। আমি চিন্তিত হয়ে পরি। দেখতে যাই ও’কে। সেটাই হয়তো আমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ালো।
সিয়ারা: কেন?
আভাস বাবু: রঞ্জিতা একপ্রকার বাধ্য করলো ও’কে বিয়ে করতে আমাকে। আমি বিয়ে না করলে ও আত্মহত্যা করতো। আমি আরেকবার পরে গেলাম দোটানায়। মানুষ হয়ে একটা মানুষকে মরতে দিতে পারি না আমি ওভাবে, সেখানে ও আমার ভালোবাসা ছিলো। পুরোপুরি ও’কে ভুলতে পারিনি তখনও। এদিকে বার বার শ্রীর কথা মনে আসছিলো। রঞ্জিতা কে বলেছিলাম, আমি শ্রীকে ভালোবাসতে শুরু করেছি ও’কেই নিজের স্ত্রী মানি। তারপরেও ও আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছিলো। আমি বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে নিজের মা কে, শ্রী কে বিষয়টা জানাবো।
সিয়ারা: কিন্তু পরে নিশ্চয় আপনি আপনার ভালোবাসাকে আপন করে নিয়েছিলেন?
আভাস বাবু চুপ করে গেলেন। একটু সময় নেওয়ার পর সিয়ারাকে জিজ্ঞেস করলেন,
আভাস বাবু: আমাকে বিশ্বাস করবে তুমি?
সিয়ারা: বলুন। বিশ্বাসযোগ্য হলে নিশ্চয় বিশ্বাস করবো।
আভাস বাবু: (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) অভ্র আমার ছেলে নয়।
সিয়ারা চমকে উঠলো একপ্রকার। আভাস বাবু নির্বিকার ভাবে বসে আছেন। সিয়ারা নিজেকে একটু ধাতস্থ করে জিজ্ঞেস করলো,
সিয়ারা: এসব আপনি কি বলছেন আংকেল? অভ্র আপনার ছেলে নয়? এটা ও জানে?
আভাস বাবু: ওর মা ও’কে জানায়নি কখনও। আমি জানিয়ে দিয়েছিলাম যখন যথেষ্ট বড়ো হয়েছিলো, বোঝার ক্ষমতা হয়েছিলো। আমি পারিনি রঞ্জিতাকে আপন করে নিতে আর। ওর সাথে দেখা করাই তো বন্ধ করে দিয়েছিলাম আমি। সেইসময়ই শ্রী কনসিভ করে। আমি থাকতাম না বাড়িতে, কাজের জন্য সবসময় বাইরে বাইরে থাকতাম। শ্রী ফোন করলে ফোন ধরতাম না। আমার মনে আছে দু, তিন মাস আমি না ওকে একটু দেখেছিলাম আর কথা তো দূরে থাক। আসলে, পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম শ্রীর থেকে। ওর সামনে দাঁড়ানোর মত সাহস পাচ্ছিলাম না।
সিয়ারা: কবে জানতে পারলেন আধভিকের ব্যাপারে?
আভাস বাবু: আমি শুটিংয়ের জন্য যেহেতু বাইরে ছিলাম, আমার সাথে শ্রী যোগাযোগ করতে পারছিলো না দেখে মা সুধাংশুকে দিয়ে আমাকে জানায়। খুব খুশি হয়েছিলাম জানো? সব কিছু ভুলে গিয়ে ফিরে এসেছিলাম আমি। শ্রী অবাক হয়ে গেছিলো আমার প্রতিক্রিয়া দেখে। ও ভাবেনি আমি এতটা খুশি হবো। অনেক যত্ন করেছিলাম ও’কে, আগলে রেখেছিলাম খুব ভালো ভাবে। তবে আমি চেয়েছিলাম আমার মেয়ে হোক। (হেসে)
সিয়ারা: তাহলে, তাহলে আধভিক যে বলেছিলো আপনি ও’কে মিসটেকের তকমা দিয়েছিলেন? সেটা কি…??
আভাস বাবু: সত্যি। আমার ছেলে কখনও মিথ্যে বলে না। সব ঠিক চলছিলো। আধভিক হওয়ার পর মাস খানেক পর হঠাৎই আমার কাছে রঞ্জিতার ফোন আসে। আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠেছিলো সেইসময়। ফোনটা তুলিনি প্রথমে, পরেরবার তুলতেই অন্য একজন মেয়ের গলার স্বর পাই।
সিয়ারা: অন্যকেউ? কিন্তু কে?
আভাস বাবু: সে আমাকে বলে যে রঞ্জিতা অ্যাবরশন করাতে চাইছে। আমার মাথায় বাজ ভেঙে পরে। আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। ওর বান্ধবী ছিলো সে এবং সে জানতো না রঞ্জিতার গর্ভের সন্তান আমার নয়। তাই সে আমাকে অনেক রকম কথা শুনিয়ে দেয় আর হুমকি দেয় পুলিশ ডাকবে। আমি ভয় পেয়ে যাই কারণ পুলিশ জানা মানেই শ্রীর জানা। সদ্য নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিয়েছিলাম আমি আর সেই সময় অমনভাবে শ্রীর এইসব জানা মানে ও’কে হারিয়ে ফেলা। তাই আমি আবারও বাধ্য হই ওখানে যেতে এবং ওর সন্তানকে নিজের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে।
সিয়ারা: উনি নিশ্চয় একই ভয় আপনাকে দেখিয়েছিল?
আভাস বাবু: হ্যাঁ। পরবর্তীকালে আমি অভ্রকে জানিয়েছিলাম তাঁর কারণ তখন আর আমার হারানোর মতো কিছু ছিলো না। আমার ভালোবাসার মানুষ, আমার মাকে আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম ততদিনে।
সিয়ারা: আপনি জানাননি কেন তারপরে? আপনি জানালে নিশ্চই বুঝতো সবাই?
আভাস বাবু: চেয়েছিলাম। পারিনি। রঞ্জিতা যে শুধু নিজের সন্তানের পরিচয় চেয়েছিলো তা নয়। ও আমাকে বলেই দিয়েছিলো আমি যদি ওই বাড়িতে কখনও যাই তাহলেই ও পুলিশে যাবে। অর্থাৎ শ্রীকে কিছু জানাতে বারণ করেছিলো। ও জানতো আমি ফোন করে তো জানিয়ে দিতেই পারি তাই একটা নোংরা খেলা খেললো সেই সময়ে।
সিয়ারা: নোংরা খেলা?
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]
আগামী পর্বে আরো কিছু অতীতের ঘটনা সামনে আসবে।