অগোচরে তুমি পর্ব -৩৬+৩৭ ও শেষ

#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার

৩৬.

রান্নাঘরের টুকটাক শব্দ ছাড়া পুরো বাড়িই নিঃশব্দ।ফাঁকা বাড়িতে অবশিষ্ট শুধু মেহেনূর আর অর্ক।কলি আর দিহাদ ওদের বাসায় গিয়েছে।সাথে ওহি আর তিন্নিকেও নিয়ে গেছে।মেহেনূর কনসার্টে যাওয়ার আগে ওখান থেকেই ওদেরকে নিয়ে যাবে।এখন মেহেনূর অর্কের জন্য রান্না করা খাবারগুলো গরম করছে।সকালে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের হাতে অর্কের জন্য এই খাবারগুলো রান্না করেছিল ও।এখন আবার গরম করতে হচ্ছে।মেহেনূরের চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট।সবাই ঠিক সময়ে খেয়েছে অথচ এই ছেলে অসুস্থ শরীর নিয়ে এখনো অবধি খাবার খায় নি।মানুষের কষ্টের কি কোনো দাম নেই?সবাইকে কি নিজের মতো ভাবে নাকি!মেহেনূর খাবারগুলো ট্রে-তে নিয়ে তপ্ত একটা নিঃশ্বাস ফেলে পা বাড়ালো অর্কের রুমের দিকে।

অর্কের রুমের বাহিরে ভ্রুকুটি করে দাঁড়িয়ে আছে মেহেনূর।অর্কের রুমের ভেতরে কেমন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।যদিও আওয়াজের ধরনটা খুবই পরিচিত কিন্তু অর্ক রুমে এইসব কি করছে?কয়েক মুহূর্ত অতিক্রম হয়ে যাওয়ার পরেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটে নি।আর এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকাও সম্ভব না।মেহেনূর ইতস্ততভাবে দরজায় নক করতে গেলে বুঝতে পারে দরজাটা খোলাই আছে।ফলে মেহেনূর গলা খাঁকারি দিয়ে দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো।ঘরের ভেতরে ঢুকে এদিক সেদিক চোখ বুলালো।ঘরে কেউ নেই অথচ এখনো সেই শব্দ শোনা যাচ্ছে।মেহেনূরের পাশে থাকা ছোট টেবিলটায় খাবার গুলো রাখলো।শব্দের উৎপত্তি স্থল অনুসন্ধান করে একটু সামনের দিকে এগোলো।পরমুহূর্তেই মেহেনূরের চক্ষু চড়াক গাছ।অর্ক খাটে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে।ডগিরাকে কোলে নিয়ে একনাগাড়ে চুমু দিয়ে যাচ্ছে!মেহেনূর কপাল কুঁচকে বিস্মিত কণ্ঠে ডাকলো,

– ডগিরা!

মেহেনূরের গলার আওয়াজ শোনা মাত্রই অর্ক থেমে যায়।কিন্তু মেহেনূরের দিকে তাকায় নি।ও উল্টো দিক হয়েই নির্বিকার বসে রইলো।ডগিরা অর্কের কোল থেকেই উঁকি দিয়ে মেহেনূরকে একবার দেখলো কিন্তু ওর কাছে গেলো না।তাতে বেশ অবাক হয় মেহেনূর।অর্ক ফের ডগিরাকে চুমু দিচ্ছে আর ডগিরাও গদোগদো হয়ে অর্কের মুখ চেটে দিচ্ছে।আজ ডগিরার জন্যই অর্ক তার কিরণকে খুঁজে পেয়েছে।কাল যদি ডগিরা ওকে আলমারিতে ঢুকতে বাধ্য না করতো তাহলে অর্ক মেহেনূরের ওই বিশাল সাম্রাজ্যের সন্ধান হয়তো কখনই পেত না!আর না কখনো এই চরম সত্যের মুখোমুখি হতো!

পালাক্রমে চলতে থাকা এইসব দেখে মেহেনূর হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষণ।একটা মেয়ে কতক্ষণ ধরে এইখানে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে এই ছেলের কোনো খেয়ালই নেই।একটা বার তাকালোও না অবধি।মেহেনূরের এবার বেশ রাগ হচ্ছে।একটু পর ওকে বেরুতে হবে আর এখন এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের জন্য সময় নষ্ট করছে!মেহেনূর দাঁত কড়মড় করে বাজখাঁই গলায় বললো,

– ডগিরা তোকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না?

মেহেনূরের গলা শুনে চমকে উঠলো অর্ক।ডগিরাকে জড়িয়ে রাখা হাতগুলো আলগা হয়ে আসে।ডগিরা ধীরে পায়ে এগিয়ে গিয়ে মেহেনূরের পায়ের কাছে দাঁড়ায়।ততক্ষণে অর্কও উঠে দাঁড়িয়েছে।মেহেনূরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এক পলক ডগিরাকে দেখে স্থির করে অর্কের দিকে।ধীর কন্ঠে বললো,

– আপনি এখনো খাবার খান নি কেন?

– খিদে নেই।

অর্ক একরোখা জবাব দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।মেহেনূর আশ্চর্য হয়ে তাকালো ওর দিকে।মেহেনূরের রাগ হলেও এইমুহূর্তে ওর রাগ করলে চলবে না।অর্ককে এই খাবারটা খেতে হবে।ডাক্তার বলেছে অর্কের শরীর অনেক দূর্বল।ও ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করে না,বিপি একদম লো।মেহেনূর স্মিত হেসে বললো,

– আপনি বললেই হলো?সেই কাল রাতের বেলায় খেয়ে ছিলেন আর এখন বাজে বিকাল চারটে!এবার তো পেটে পিত্তি পরবে।

– পরুক!তাতে তোমার কি?

– আমার আবার কি হবে?যা হওয়ার সেটা আপনারই হবে।খালি পেটে থাকলে গ্যাস্টিক হবে তারপর গ্যাস্টিক থেকে আলসার হবে।

– হোক!তাতে…..

– তাতে আমার কি!তাই তো?আসলেই আমার কি!ঠিক আছে,আপনাকে খেতে হবে না।

অর্ক বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে।মেহেনূর খাবারের ট্রে নিয়ে চলে যাচ্ছে।অর্ক মনে মনে ভাবছে,“এই রে একটু বেশি বেশি হয়ে গেলো নাকি?”অর্ক শুধু দেখতে চাইছিল ওর এমন ব্যবহারে মেহেনূরের কেমন রিয়েকশন হয়।কালকে রাতের পর আজ এখন মেহেনূরকে দেখছে ও।ভেবেছিল খাবে না বলে জেদ করলে মেহেনূর হয়তো ওকে বকাঝকা করবে।খাওয়ার জন্য জোর করবে,খেতে বলবে!একপর্যায়ে হয়তো নিজের হাতে খাইয়েও দেবে বা দিতে চাইবে!কিন্তু এখন তো হিতে বিপরীত হয়ে গেলো।যদিও অর্ক জানে ওর আশা সেগুড়ে বালি!তাও অন্ধকারে ঢিল ছুড়েছিল,যদি কাজে আসে!কিন্তু এখন কি হবে?খিদেয় তো পেট ছু ছু করছে।তারউপর যে আকাম করে বসে আছে পরে তো চাইলেও কিছু খেতে পারবে না!এখন যদি কিছু না খায় তাহলে নির্ঘাত জ্ঞান হারাবে নয়তো পটল তুলবে!অর্ক আমতা-আমতা করে গলার স্বর উঁচু করে বললো,

– তা কি রান্না হয়েছে শুনি?

মেহেনূরকে আটকানো হলো কথা!মাথায় যা এসেছে তাই জিজ্ঞাস করে ফেলেছে।অর্কের প্রশ্ন শোনে দরজা অবধি গিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো মেহেনূর।ঘাড় ঘুরিয়ে ভ্রুকুটি করে উল্টো প্রশ্ন করলো,

– সেটা জেনে আপনি কি করবেন?
– খিদে পেয়েছে খুব।
– একটু আগেই না বললেন আপনার খিদে নেই?
– তখন খিদে ছিল না তাই বলেছিলাম।তাই বলে এখন আমার খিদে লাগতে পারে না।

মেহেনূর একটা ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ফেলে খাবারগুলো পুনরায় রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।মেহেনূর চলে যেতেই অর্ক রুমের দরজাটা একটু ভিড়িয়ে দিয়ে খাবারগুলো নিয়ে বিছানার উপর বসে।অর্ক নিজের হাতে দিকে অসহায় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ডগিরার দিকে তাকাতেই ডগিরা দৌঁড় দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে।বাইরে এসে অদূরেই মেহেনূরকে দেখতে পেয়ে ঘেউঘেউ করে উঠলো।ডগিরা ঘেউঘেউ করে উঠতেই মেহেনূর পেছন ফিরে তাকাতে তাকাতে ডগিরা আবার ঘরের ভেতর চলে আসে।মেহেনূর বুকের ভেতরটা অজানা ভয়ে মোচড় দিয়ে উঠলো।ফলে মেহেনূরও ডগিরার পেছন পেছন তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকলো।মেহেনূরকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পরলো অর্ক।ডগিরা এইভাবে চিৎকার করে উঠবে আর ওর চিৎকার শোনে মেহেনূরও চলে আসবে বুঝতে পারে নি ও।অর্ক তাড়াতাড়ি ওর হাত দুটো পিছনে লুকিয়ে নেয়।কিন্তু তার আগেই যা দেখার মেহেনূর দেখে নিয়েছে।দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় অর্কের দিকে।

– আপনার হাতে কি হয়েছে?

প্রশ্নটা করে অর্কের দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহেনূর।অজানা কারণেই অর্কের বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে।মেহেনূরকে কি বলবে বুঝতে পারছে না।মেহেনূরকে বলার যতেষ্ট শব্দ অর্কের শব্দ ভান্ডারে মজুদ নেই!মাথা নিচু করে নেয় অর্ক।মেহেনূরের কপাল সংকুচিত হয়ে আসে।অর্কের এইরূপ ব্যবহারের মানেটা মেহেনূরের কাছে অস্পষ্ট।অর্কের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললো,

– আপনার ফোন কোথায়?

অর্ক নিশ্চুপ।কয়েক সেকেন্ড অতিক্রম হয়ে গেছে তবু অর্কের মধ্যে কোনো হেলদোল নেই।সে নির্বিকার চিত্তে বসে আছে।মেহেনূর বিরক্ত হয়ে ধমকে বললো,

– কি হলো কথা বলছেন না কেন?

মেহেনূর ধমক খেয়ে শিউরে উঠলো।অর্ক এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে।মেহেনূরের চোখে মুখে রাগের আভাস।অর্ক আমতা আমতা করে মাথা নিচু রেখেই ক্ষীণ স্বরে বললো,

– টেবিলের উপরে।

মেহেনূর টেবিলের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে ফের অর্কের সামনে এসে বললো,

– পাসওয়ার্ড?

– মিসেস রকস্টার!

অর্ক মিনমিনে স্বরে বললো।মেহেনূর আড়ঁচোখে অর্কের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে পুনরায় ফোনের উপর দৃষ্টি স্থির করে।পাসওয়ার্ড লিখে ফোনটা আনলক করতেই চমকে উঠলো।অর্কের ফোনের ওয়ালপেপারে ওর ছবি দেওয়া!ছবিটায় মেহেনূর হাটু গেড়ে বসে ডগিরার দুগালে হাত রেখে ডগিরার কপালে ওর কপাল ঠেকিয়ে রেখেছে।মেহেনূর অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ছবিটার দিকে।ছবিটা বছর দেড়েক আগের তোলা।কয়েক মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার পর মেহেনূরের হুশ ফিরে।লম্বা একটা শ্বাস টেনে কল লিষ্ট থেকে দিহাদের নাম্বার বের করে দিহাদকে কল দেয়।অপর পাশ থেকে কল রিসিভ করতেই মেহেনূর ধীর কন্ঠে বললো,

– আমি চলে আসার পর হসপিটালে কি হয়েছিল ভাইয়া?

মেহেনূরের গলায় স্বর শুনতে পেয়ে কিঞ্চৎ বিস্মিত হয় দিহাদ।মেহেনূর অর্কের ফোন থেকে কল করবে এটা ওর কল্পনাতীত ছিল।দিহাদকে ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কলি ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাস করলো,

– কে?
– মেহেনূর।

কলি মুচকি হেসে বললো,

– চুপ করে আছিস কেন?বলে দে।মেহেনূরের চোখকে ফাঁকি দেওয়া অর্কের সাধ্যের বাইরে!

কলির কথা মতো দিহাদ গলা খাঁকারি দিয়ে কোমল স্বরে বললো,

– সকালে অর্কের জ্ঞান ফেরার পর হসপিটালে তান্ডব করেছে ও।নিজের উপর রাগে ক্ষোভে সারা কেবিনে ভাংচুর করেছে।তোমার ফোনটাও অর্ক ভেঙে ফেলেছে।অবশ্য নিজের ফোন ভেবে!জানালার কাঁচ দিয়ে হাত কেটেছে।দুই হাতে পাঁচটা সেলাই লেগেছে।সরি মেহেনূর,আসলে অর্ক বারন করেছিল আমরা যাতে তোমাকে এই ব্যাপারে কিছু না বলি।মেহেনূর ওকে ভুল বুঝো না প্লিজ।ও তো জানতো না যে তুমিই কি………

মেহেনূর দিহাদের বাকি কথা না শুনেই ফোনটা কেটে দেয়।দাঁত কড়মড় করে এগিয়ে যায় অর্কের দিকে।শক্ত গলায় বললো,

– হাত দেখি!

অর্ক মাথা নিচু করে বসে আছে।মেহেনূরের কথা কর্ণপাত হওয়া সত্ত্বেও।মেহেনূর রাগে গলায় স্বর উঁচু করে বললো,

– আমার কথা কি শুনতে পান নি?

অর্ক শুকনো একটা ঢোক গিলে চোখ বুজে আস্তে আস্তে হাত দুটো মেহেনূরের সামনে এগিয়ে দেয়।পরক্ষণেই বাম গালে সজোরে চড় পরতেই তড়িৎ বেগে চোখ খুলে অর্ক।কিছু বুঝে উঠার আগেই ফের একই গালে চড় পরলো।ঘটনাটা অর্কের কাছে এক্কেবারে অপ্রত্যাশিত।তবে ও যা করেছে তার জন্য এটা ওর প্রাপ্যই ছিল!

– আপনি কি পাগল?নিজেকে কি মনে করেন?আলেকজান্ডার?

অর্ক একদৃষ্টে মেহেনূরের দিকে তাকিয়ে আছে।তবে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি।মেহেনূরকে এই প্রথম রাগতে দেখল ও।মেহেনূরের নীলাক্ষী চোখে এখন আগ্নেয়গিরি! মসৃণ ঠোঁটে মৃদু কম্পন আর প্রশস্ত ললাটে ভোরের শিশির কণা!রাগলে তো ওকে বেশ লাগে।অর্ককে তাকিয়ে থাকতে দেখে সজ্ঞানে ফিরে মেহেনূর।ও এটা কি করলো?অর্কের গায়ে হাত তুলেছে?পরমুহূর্তেই মেহেনূর রাগ কয়েকগুণ বেড়ে যায়।বেশ করেছে ও!এই ছেলে মার খাওয়ারই যোগ্য!অর্ক বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।অর্ক উঠে দাঁড়াতেই মেহেনূর কিছুটা পিছিয়ে যায়।মেহেনূর কিছু বুঝে উঠার আগেই অর্ক ওর দুটো হাত ধরে ওর গালে রেখে অসহায় গলায় বললো,

– থামলে কেন,মারো আমাকে!আরো মারো।আমি তো মার খাওয়ারই যোগ্য!

মেহেনূর নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,

– আরে কি করছেন?আমার হাত ছাড়ুন।

অর্ক হাত ছেড়ে দিয়ে হুট করেই মেহেনূরকে জাপটে জড়িয়ে ধরলো।মেহেনূর বিস্ময়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় অর্কের দিকে।অর্ক ওর কাঁধে মুখ গুজে আছে।মেহেনূরের কেমন যেন লাগছে।অর্ক ওকে এইভাবে জড়িয়ে ধরবে বুঝতে পারে নি।মেহেনূর নিজেকে অর্কের আলিঙ্গন থেকে ছাড়ানোর জন্য জোর কাটাচ্ছে অর্ক ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাতর স্বরে বললো,

– আ’ম সরি মেহেনূর!সরি ফর এভ্রিথিং!প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।

প্রিয় মানুষকে জড়িয়ে ধরলে যে শান্তি পাওয়া যায়, বিশ্বাস করুন তাবৎ দুনিয়া ঘুরেও আপনি এই শান্তি আর কোথাও খুঁজে পাবেন না।হয়তো প্রিয় মানুষটার সাথে আপনার রাগ চলছে, কিংবা মনমালিন্য কথা কাটাকাটি হচ্ছে, সব কিছু ঝেড়ে ফেলে একবার তাকে জড়িয়ে ধরুন।ব্যাস, দেখবেন এক নিমিষেই সব ঠান্ডা।হতে পারে কোনো কারণে আপনারা দুজনেই কিছুটা মানসিক চাপে আছেন,পারিবারিক কোনো কারণে বা নিজেদের ভুলে অশান্তিতে আছেন,তখন প্রিয় মানুষটাকে জড়িয়ে ধরলে দেখবেন কোনো অশান্তি আর অশান্তি মনে হচ্ছে না।তখন আপনার মনে হবে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবকিছু থমকে যাক।সেকেন্ড, মিনিট ঘন্টার কাটা বন্ধ হয়ে যাক।সব দুঃখ-কষ্ট, অশান্তি, যন্ত্রণা মানুষ ক্ষনিকের জন্য হলেও ভুলে থাকতে পারে আপন মানুষটাকে জড়িয়ে ধরলে।

এইমুহূর্তে অর্কের ক্ষেত্রেও তাই।যেখানে অনেক সংশয় আর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে নিজের প্রিয় মানুষটাকে খুঁজে পেয়েছে,কাছে পেয়েছে সেখানে এই মুহূর্তটাকে তো ধরে রাখতেই চাইবে।যদিও দুজনের মধ্যে অনেকটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে,তার প্রিয় মানুষটা আদৌ তাঁকে গ্রহণ করবে কি না সেটাও ও জানে না।তবু ও খুব তীব্র ভাবে চাইছে এই মুহূর্তটা যাতে এত দ্রুত শেষ না হয়,সময়টা যাতে থমকে দাঁড়ায়!

মেহেনূরের বুক দুরুদুরু করছে।অর্কের আলিঙ্গনে ওর খুব অস্বস্তিও হচ্ছে।যদিও অর্কের ছোঁয়ায় কোনো নোংরামো নেই তবে জীবনের প্রথম ওকে কেউ এতটা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ধরলো।ফলে অস্বস্তিটাও আকাশচুম্বী।মেহেনূর অর্কের মনে অবস্থা বুঝতে পারছে।অর্কের হয়তো ভালো লাগছে কিন্তু ওর তো ভালো লাগছে না।এতটা ঘনিষ্ঠ হওয়ার মতো সম্পর্ক নেই,আগেও ছিল না।মেহেনূর হাত মুঠি করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ক্ষণে ক্ষণেই বুক চিড়ে তপ্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসছে।পরক্ষণেই কান গরম হয়ে আসে।চোখ রাঙিয়ে শক্ত গলায় বললো,

– এইসব করবেন বলেই কি বাসাটা খালি করিয়েছেন?

চলবে………#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার

অন্তিম পর্ব.

বুকে থাকা চাপা যন্ত্রণার মধ্যেও ফিক করে হেসে উঠলো অর্ক।মেহেনূরকে জড়িয়ে রাখা হাতগুলোও আলগা হয়ে আসে।সুযোগ বুঝে মেহেনূরও দূরে সড়ে দাঁড়াতে চাইলে অর্ক আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।মেহেনূর ভ্রুকুটি করে তাকায় অর্কের দিকে।অর্ক ঠোঁটের আগায় হাসি রেখেই বললো,

– তুমি কোন ধাতুয় গড়া!তোমার মস্তিষ্ক এত আগে আগে চলে কেন?

– অসুস্থ বন্ধুকে বাসায় রেখে বাকি দুই বন্ধুর চলে যাওয়া সাথে তিন্নি আর ওহিকেও নিয়ে যাওয়া,আমার ভাইয়া বাসায় আসছে জেনেও ভাবীর হঠাৎ করে তার বাপের বাড়ি যাওয়া এইসবই আমার কাছে সাজানো লেগেছে।তাও আমি তাদের কোনো প্রশ্ন করি নি।কারণ এতে আমার কিছু যাবে আসবে না!

– তাই!
– হুম!ছাড়ুন আমাকে?
– যদি না ছাড়ি তাহলে কি আবার আমার হাড়গোড় ভাঙবে নাকি!

মেহেনূর বিস্মিত হয়ে অর্কের দিকে ফিরে।অর্ক মেহেনূরের কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে মুখ ভার করে ফের বললো,

– ওইদিন আমাকে কি মার’টাই না মারলে!ডাক্তার এক দেখায় সোজা সাত দিনের বেড রেস্ট দিয়ে দিয়েছে!

– আমি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাইছি না।

মেহেনূরের শক্ত গলায় বলা কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই অর্ক মেহেনূরকে ছেড়ে দেয়।মেহেনূর সোজা হয়ে চুল করে করে কপাল সংকুচিত করে জিজ্ঞাস করলো,

– ভয় পেলেন নাকি!

অর্ক মাথা নিচু রেখে মিনমিনে স্বরে বললো,

– তোমাকে বিশ্বাস নেই!খুব শক্ত মন তোমার।

মেহেনূর অর্কের কথার ভঙ্গিমা দেখে ওর অগোচরে মৃদু হাসলো।বিছানায় বসে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,

– খেতে বসুন।

অর্ক কোনো কথা না বলে চুপচাপ বিছানায় আসন পেতে বসলো।নিজের হাতে খাইয়ে দিতে অস্বস্তি হবে বলে মেহেনূর একটা চামচ নিয়েছে।সেটা দেখে অর্কের চোখ চকচক করে উঠলো।উৎকন্ঠিত স্বরে বললো,

– তুমি খাইয়ে দেবে?

মেহেনূর অর্কের কথার কোনো জবাব দেয় নি।ক্ষুদ্র একটা শ্বাস ফেলে প্লেটে খাবার নিতে নিতে উল্টো বললো,

– আমার হাতে খেতেও সমস্যা!

– তোমার হাতে বিষ খেতেও দ্বিতীয়বার ভাববো না!

অপকটে জবাব দিলো অর্ক।মেহেনূর চকিত দৃষ্টিতে তাকায়।পরক্ষণেই মৃদু হেসে বললো,

– সামান্য মার খেতে ভয় করে এখন বিষ খেয়ে ফেলবেন?

– দিয়েই দেখো না!

– আপনাকে পিটিয়ে ছিলাম বলে প্রতিশোধ নিতে চাইছেন নাকি?জেলে পাঠানোর পায়তারা করছেন!চুল দিয়ে চোখ অবধি ঢাকা ছিল,মুখেও মাস্ক ছিল।তাই চিনতে পারি নি যে ওটা আপনিই ছিলেন।নিন হা করুন

মেহেনূরের কথার প্রত্যুত্তরে অর্ক কিছু বলল না।ও জানে মেহেনূর ঠিকই বলছে।ওইদিন ওকে চিনতে পারে নি বলেই ইচ্ছামতো পিটিয়ে আধমরা করেছিল!মেহেনূর মুখে খাবার তোলে দিচ্ছে আর অর্ক বাধ্য ছেলের মতো চুপচাপ খাচ্ছে।শুধু দৃষ্টি স্থির রেখেছে মেহেনূরের দিকে।তবে সেদিকে মেহেনূর সম্পূর্ণ ভ্রুক্ষেপহীন।অর্কের খাওয়া শেষ হলে মেহেনূর স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞাস করলো,

– বাসায় থাকবেন নাকি কোথাও বেরুবেন?

– কোথাও যাবো না।

অর্কের ঝটপট উত্তর।মেহেনূর কিছু না বলে চুপচাপ ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।অর্ক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।মেহেনূরের প্রশ্নের বিপরীতে ওর কি বলা উচিত ছিল বুঝতে পারছে না।ওর জবাব শোনে তো মেহেনূর কিছু বলল না।তাহলে জিজ্ঞাস করলো কেন?কয়েক সেকেন্ড পরেই মেহেনূর আবার অর্কের ঘরে আসে।অর্কের সামনে একটা চাবি রেখে বলল,

– কোথাও গেলে দরজাটা ভালো ভাবে লক করে যাবেন।

অর্ক কিছু বলার আগেই মেহেনূর চাবিটা রেখে প্রস্থান করলো।অর্ক দরজার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।ভাবছে,“ও তো বাড়িতেই থাকবে তাহলে আমাকে কেন দরজা লক করে দিয়ে যেতে বলছে?ও কি তাহলে বাড়িতে থাকবে না?হায় আল্লাহ এটা আমি কি করলাম!” অর্ক ঠোঁট উল্টে থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে বিছানায় আসন করে বসে ভাবছে।বাড়িটা খালি করার জন্য সকালে কলিকে কতমতো বুঝিয়ে রাজি করিয়েছে।ভেবেছিল ওর করা সব ভুলের অবসান ঘটিয়ে নিজের মনে অব্যক্তরূপে থাকা কথাগুলো প্রিয় মানুষটার সামনে বলবে!মেহেনূরের প্রশ্নের কারণ জানতে না চেয়ে হুট করে বলে দিলো ও বাড়িতেই থাকবে।একবার অন্তত জিজ্ঞাস তো করতে পারতো,”কেন?”।নিজের করা বোকামির জন্য নিজের উপরই রাগ হচ্ছে অর্কের।বিরক্তিতে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।চাবিটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে।

______________________

কনসার্ট শেষ করে ফিরতি পথে মেহেনূর।নিজের গাড়ি দিয়ে একাই আসছে।বাকিরা অন্য গাড়ি দিয়ে যাচ্ছে।ফাঁকা রাস্তা তবু খুব সর্তক হয়ে ড্রাইভ করছে মেহেনূর।হাতে থাকা ঘড়িটার দিকে এক পলক তাকায়।বারোটা বাইশ বাজে।কিছুক্ষণ আগ থেকে হুট করেই মাথাটা খুব ব্যাথা করতে শুরু করে।এক হাতে কপালের পশ্চাতে চেপে ধরে অন্য হাতে স্ট্রেয়ারিং সামলাচ্ছে।কিছুদূর এগিয়েই গাড়ি থামিয়ে দিলো।অসহ্য লাগছে,ড্রাইভ করতে ভালো লাগছে না।গাড়ি থেকে নেমে ক্ষুদ্র একটা শ্বাস ফেলে এগোয় অদূরেই থাকা লেকের দিকে।

মেহেনূর বরাবরের মতো আজও লেকের পানিতে পা ডুবিয়ে বসলো।হিম শীতল হাওয়ায় ওর খোলা চুল মৃদু উড়ছে।আঙুলের সাহায্যে কানের পশ্চাতে গুঁজে দিলো একগুচ্ছ চুল।দৃষ্টি স্থির আকাশের দিকে।আজকেও আকাশে পূর্ণিমার সোনালি চাঁদটা জ্বলজ্বল করছে।আজও লেকের স্বচ্ছ পানি চাঁদের আলোয় চিলিক দিয়ে উঠছে বারে বারে।মেহেনূর স্মিত হাসলো।এইমুহূর্তে ডগিরাকে খুব মিস করছে মেহেনূর।ডগিরা থাকলে কালকের মতো আজকেও খুব লাফালাফি করতো।মাথার ব্যাথাটা কমছেই না।চিনচিন করে ব্যাথা করছে।খুব যে বেশি ব্যাথা করছে তেমনটা নয়।মেহেনূর একটু ঝুকে চোখে মুখে লেকের ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে।এতে অবশ্য মাথা ব্যাথা না কমলেও অনেকটাই আরাম পাওয়া যাবে।

– কিরণ?

পরিচিত কন্ঠ কর্ণগোচর হতেই কিঞ্চিৎ চমকে উঠলো মেহেনূর।ওর হাতে থাকা পানিটুকু পড়ে যায়।পরক্ষণেই ওর দৃষ্টি পরলো লেকের স্বচ্ছ পানিতে।ডগিরাকে কোলে নিয়ে অর্ক দাঁড়িয়ে আছে।হাত ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায় মেহেনূর।অর্ক শান্ত স্বরে জিজ্ঞাস করলো,

– বাসায় ফিরবে না?

মেহেনূর ক্ষুদ্র একটা শ্বাস ফেলে অর্কের কাছ থেকে ডগিরাকে কোলে নিয়ে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে আসতে বলল,

– আপাতত বলতে পারছি না।

অর্ক ভ্রুকুটি করে ফের জিজ্ঞাস করলো,

– মানে?

অর্কের প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে মেহেনূর কিছু বলল না।মেহেনূর নিজের মতো ডগিরাকে আদর করতে করতে এগোচ্ছে।অর্ক মেহেনূরের পিছন পিছন হাঁটছে।মেহেনূর অর্কের দিকে তাকাচ্ছেও না।অর্ক হঠাৎ থম মেরে দাঁড়িয়ে পরলো।মাথাটা কেমন জানি করে উঠলো।পর পরেই নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মেহেনূর নির্লিপ্ত হেঁটে যাচ্ছে।অর্ক সেদিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত।পরক্ষণেই দৌঁড়ে গিয়ে মেহেনূরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।মেহেনূর একটু বিস্মিত হয়ে অর্কের দিকে তাকায়।অর্কের চোখে শীতল চাহনি,মুখে মলিনতা।দুজনের চোখাচোখি হয়ে যেতেই মেহেনূর দৃষ্টি সড়িয়ে নেয়।পাশ কাটিয়ে চলে আসার জন্য উদ্যত হতেই অর্ক ধীর কন্ঠে বলল,

– ঠকে যাওয়ার পর মানুষ উপলব্ধি করতে পারে সে ঠিক কতটা ভুল করে ঠকেছে।সত্যটা যতদিনে উদ্ভাসিত হয় ততদিনে জীবন থেকে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়।

মেহেনূরের পা থেমে যায়।কপাল সংকুচিত করে অর্কের দিকে ফিরে দাঁড়ায়।অর্ক শুকনো একটা ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিয়ে ফের বললো,

– তোমায় ভালোবাসি বলেই অন্য কাউকে চাই নি!

মেহেনূর বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে।অর্কের বলা ভালোবাসি কথাটা বার বার ওর কানে বাজছে।নিজের অজান্তেই বুকটা ধুকধুক করছে।যেদিন অর্ক কিরণের সাথে মেহেনূরের তুলনা করে করেছিল,যেদিন অর্ক স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিল ও কিরণের প্রতি দূর্বল। কিন্তু ও কিরণকে ভালোবাসে এটা একবারও বলে নি।মেহেনূর নিজেকে স্বাভাবিক করে অর্কের কথার প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে উল্টো বলল,

– ওইদিন যদি একটাবার আমাকে বলার সুযোগ দিতেন তাহলে আজকে এই দিনটা আসতো না।হয়তো আমার পক্ষে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগতো তবে সবকিছু অন্যরকম হতো।কিন্তু ওইদিন আপনি আমাকে বলার সুযোগটুকুও দেন নি।

– তাই বুঝি সবটা শোনার পরেও চুপ ছিলে?হাসি মুখে আমাকে সন্তুষ্ট করে পাঠিয়ে দিয়েছিলে!

– আজও তা-ই করবো।যেখান থেকে একবার মন উঠে যায়,পরে হাজার চেষ্টা করেও সেদিকে দ্বিতীয়বার মন ফেরানো যায় না।

– প্লিজ এমনটা করো না।যদি এমনটা হয় তবে আমি মরেই যাবো।

– আশ্চর্য এখানে মরার কথা আসছে কোথা থেকে?

– চারিদিকে এত মানুষ,কিন্তু আমার বলতে কেউ নেই।সবার মন খারাপের সঙ্গী আছে,আর আমার মন খারাপের সঙ্গী বলতে কেবল আমি নিজেই।সবার সুখ দুঃখ বোঝার মানুষ পাশে আছে,আমার বলতে শুধুই আমি আছি!আমার নিয়ম করে খোঁজ নেওয়ার মানুষ নেই।আমি ভালো আছি কিনা এই প্রশ্নটা করারো কেউ নেই।এত্তো এত্তো মানুষের ভীড়ে,আমি কেবলই একলা একা।

– বাবা মা বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজন সবাই তো আছে।আর কি লাগে আপনার?

– আমার একটা তুমি লাগবে।আমার তোমাকে লাগবে কিরণ।

অর্ক কথাটা বলতে বলতে মেহেনূরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। অর্কের এমন হুটহাট জড়িয়ে ধরায় মেহেনূরের খুব অস্বস্তি হচ্ছে সাথে চরম পর্যায়ে অবাকও হচ্ছে।শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও।ডগিরা কোল থেকে নেমে গিয়েছিল অনেক্ষণ আগেই।একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে ও।ওর সামনে ঘটা কীর্তিকলাপের বেশি কিছু বোধগম্য না হলেও এটা ঠিকই বুঝতে পারছে অর্ক আর কিরণের মধ্যে নীরব যুদ্ধ চলছে।কেউ আত্মসম্মানবোধ আর এক আকাশ সমান রাগের পাহাড় গড়ে তুলেছে অন্যজন সেই পাহাড় কেটে সমতল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে!কিরণের চোখ ছলছল করছে।মনের অজান্তে নিমিষেই চোখ দুটো ঘোলা হয়ে আসে। যে কোনো সময় নেত্রযুগল থেকে মুক্ত অশ্রুধারা বইতে পারে!হাত দিয়ে যে মুছবে তারও উপায় নেই।অর্কের আলিঙ্গনে আবদ্ধ ওর হাত।চোখের পলক পরতেই এক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পরলো শূন্যে।চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাস টেনে চোখ খুললো কিরণ।পরক্ষণেই ধীর কন্ঠে বলল,

– আমি যেমন মানুষকে শক্ত করে আগলে রাখতে জানি, তেমন আবার আলতো করে দূরে ঠেলে দেয়ার ক্ষমতাও রাখি।আপনি কোন ধরনের আচরণ পাবেন, সেটা পুরোটাই আপনার ওপর নির্ভর করবে!আমি সবাইকেই ভালোবাসি বলে এই না,আমি অবুঝ। মানুষের করা অবহেলা বা অহেতুক করা অন্যায়গুলো আমি বুঝবো না!আমি সবাইকে আপন ভাবি বলে এই না,আমি দূর্বল।আমি সাদামাটা হলেও,যেখানে আমার কদর হয় না,সেখানেই মাটি কামড়ে পড়ে থাকার মতো মেয়ে অনন্ত আমি না।আমি যেমন অন্যদেরকে ভালোবাসি, তেমন নিজেকেও ভালোবাসি।যেখান থেকে একবার সরে আসি,যেখানে আমার সম্মান নেই সেইদিকে আর দ্বিতীয় বার ফিরে তাকাই না।মনই সায় দেয় না।এটা আমার ইগো না বা অহংকার নয়,আমি এমনই!

– কিন্তু তোমাকে যে ফিরতে হবে!কারণ আমি তোমার এমন একজন মানুষ হতে চাই যার কাছে তুমি অবলীলায় সব বলতে পারবে।আমি তোমার সঙ্গী হয়ে তোমার হৃদ কুটিরে দলা পাকিয়ে আসা নিঃসঙ্গতার গল্পগুলো শুনতে চাই।তোমার চোখের শীতল চাহনিতে তোমাকে বুঝতে চাই।বিশ্বাস করো সৃষ্টিকর্তার কাছে তোমাকে পাওয়ার তীব্র আকুতি জানিয়েছি বহুবার।মোনাজাতে শুধু তোমাকেই পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করেছি প্রতিবার।

অর্কের কথা শুনে বিস্ফোরিত চোখে তাকায় মেহেনূর।বুঝতে বাকি নেই কালকে ওর বলা কথাগুলো অর্ক শুনেছে।অর্ক ফিচেল হেসে আবার বললো,

– কাল কিরণের জন্মদিন ছিল।তাই ওকে খুঁজতে বেরিয়ে ছিলাম।যদি কোথাও দেখা পেয়ে যাই।কিন্তু কোথাও তাঁর দেখা পেলাম না।মন খারাপ করে এই লেকের পাড়েই বসে ছিলাম।চাঁদের আলোয় স্পষ্ট ডগিরাকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠি।প্রথমে ভেবেছিলাম এটা হয়তো অন্য কারোর কুকুর।পরক্ষণেই ডগিরার পাশেই তোমার অবয়বে কাউকে বসে থাকতে দেখে এগোলাম সামনের দিকে।তখনই শুনলাম ডগিরাকে বলছো।কিছুক্ষণ পরেই তুমি চলে গেলে।শেষের কথা গুলোই শুধু শুনেছিলাম।তাই বুঝতে পারছিলাম না তোমার এই কথা গুলো বলার কারণ কি।কিন্তু পরে যখন বাসায় ফিরলাম তখন থেকেই মাথায় অনেক গুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো।লেকের ধারে বলা কথাগুলো,কিরণের বার্থডে একই দিনে তোমারও বার্থডে!এটা দেখে আমি কিছু একটা আন্দাজ করতে পারছিলাম।তৎক্ষণাৎ সবার অগোচরে চুপি চুপি তোমার ঘরে চলে আসি।এর কিছুক্ষণ পরেই ওইখানে ডগিরাও চলে আসে।প্রথমে ডগিরাকে অন্য কেউ ভেবে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।তাই তোমার আলমারিতে ঢুকে পরেছিলাম।পরে যখন বুঝতে পারলাম ডগিরা এসেছে তখন আলমারি থেকে বেড়িয়ে আসি।কিন্তু ডগিরা কিছুতেই চুপ করছিল না।বিরক্ত হয়ে ওকে আলমারিতে আটকে দেই।ব্যাস পরে যা করার ডগিরাই করেছে।

মেহেনূর কপাল সংকুচিত করে অর্কের কথা গুলো শুনলো।ডগিরা ওকে ওর সাম্রাজ্যের হুদিশ দিয়েছে বলেই সকালে ওইভাবে ডগিরাকে চুমু খাচ্ছিলো।মেহেনূর কিছু না বলে চলে আসতে নিলে অর্ক মলিন মুখে ক্ষীণ স্বরে ফের বললো,

– অতীতের ভুল মানুষকে যেমন শূন্য করে ঠিক তেমনি কিছু ভুলের জন্য মরার আগ পর্যন্ত আফসোসও হয়!তখন একাকিত্বই হয় জীবনের একমাত্র পরম সঙ্গী!কিন্তু বিশ্বাস করো কিরণ আমি একাকিত্ব নিয়ে মরতে চাই না।

অর্কের কথার জবাবে মেহেনূর শান্ত স্বরে বললো,

– মানুষ এক জীবনে সব কিছু পায় না।কিছু মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি পেয়ে যায় আবার কিছু মানুষ প্রয়োজনটুকুও পায় না।তাই বলে কি সবাই মারা যায় নাকি!বরং তাঁরাও বাঁচতে চায়,জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাঁচতে চায়।পৃথিবীটা খুব সুন্দর।কেউই সুন্দর এই পৃথিবীর ছেড়ে চলে যেতে চায় না।

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে অর্ক।হঠাৎ করেই ফোনে নোটিফিকেশন আসতেই একটু চমকে উঠলো।বুকটা ধুরু ধুরু করছে।কাটা হাতে পকেট থেকে ফোনটা বের করতে একটু কষ্ট হলেও চটজলদি ফোন নিয়ে নোটিফিকেশন চেক করলো।মুহূর্তেই থমকে গেল ওর পুরো পৃথিবী।এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না!তবে কেন এমনটা হলো?একটা মেসেজ নিমিষেই পুরো জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে।হাত ফসকে ফোনটা পড়ে যায়।ফলে কিঞ্চিৎ শব্দে হুশ ফিরলো অর্কের।হকচকিয়ে গিয়ে ঘোলাটে চোখে তাকায় মেহেনূরের দিকে।ফুট দুয়েক দূরেই দাঁড়িয়ে আছে ও।ওর মুখটা ঝাপসা।বেশ কয়েক দিন ধরেই শরীরে অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল অর্ক।টের পেয়েছিল হয়তো বড় কোনো অসুখ বাসা বেঁধেছে ওর শরীরে।ডাক্তারের কাছে যাবে যাবে করে যাওয়া হয় নি।বাংলাদেশেও সেইভাবে সময় সুযোগ করে ডাক্তার দেখানোর সুযোগ পায় নি।কানাডায় আসবে বলে ঠিক করলো এখানে এসেই না হয় একবার একটু ডাক্তার দেখিয়ে নিবে।কিন্তু কাল যখন হঠাৎ করে সেন্স লেস হয়ে গেল তখন ওর টনক নড়ে।ডাক্তার বলে কিছু টেস্ট করতে।টেস্টের রিপোর্টে যা এসেছে তাতেই ওর জীবন থমকে দাঁড়ায়। ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি রোগ ওর ব্রেনে শিকড় গেঁড়ে বসে আছে অনেক আগে থেকেই।ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি ও।এখন হয়তো আর কিছুই করার নেই।

অর্কের শরীরটা ক্রমশ দূর্বল হয়ে আসছে।আচমকায় ফের একবার জড়িয়ে ধরলো মেহেনূরকে।সাথে সাথে চোখ দিয়ে অনর্গল জল গড়িয়ে পরতে লাগলো।মেহেনূর হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।অর্ক অসহায় স্বরে বললো,

– আমিও তো জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্তই বাঁচতে চেয়েছিলাম।বাকি জীবনটা আমি তোমার সাথেই কাটাতে চেয়েছিলাম কিরণ।তোমার পাশে বসে,তোমার চোখে চোখ রেখে দিন বদলাতে চেয়েছিলাম।তোমার হাতে হাত রেখে বহুদূর অব্দি চলতে চেয়েছিলাম।আমিও মরতে চাই না!তবে তোমাকে না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে বাঁচতেও চায় না।অবশ্য আমার চাওয়া না চাওয়ায় কিছু আসে যায় না। সৃষ্টিকর্তাই বোধহয় চান না যে, এ জীবনের আমার চাওয়া গুলো পূর্ণতা পাক!

অর্কের বলা কথাগুলো মেহেনূরের অজানা শঙ্কায় হঠাৎই মেহেনূরের বুকের ভেতরটায় চ্যাৎ করে উঠলো।অর্ক নিজের আলিঙ্গন থেকে মেহেনূরকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।মেহেনূর হতভম্ব হয়ে অর্কের দিকে তাকিয়ে আছে,শুধু চোখ দুটো অস্থির।ও কি বলছে এইসব?মেহেনূর বুঝে উঠতে পারছে না।অর্ক কাতর গলায় বললো,

– তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখার বড্ড শখ।একটু ছুঁতে দিবে আমায়!প্লিজ মানা করো না।

মেহেনূরের প্রত্যুত্তরে আশায় না থেকে অর্ক নিজের হাতের মুঠোয় মেহেনূরের দু’গাল আবদ্ধ করে নেয়।সেদিকে চকিত দৃষ্টিতে তাকায় মেহেনূর।অর্ক মেহেনূরের কপালে গভীর চুম্বন করে।মেহেনূরের মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে।তাকিয়ে থাকা ছাড়া বাকি কিছু যেন ও ভুলেই গেছে।ও কথা বলতে চাইছে কিন্তু কোথাও যেন বাধা পাচ্ছে ওর কন্ঠস্বর।বাগযন্ত্র নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে!বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে মেহেনূর।অর্ক মৃদু হেসে বললো,

– জানতাম না তুমিই আমার রাজ্যের সম্রাজ্ঞী,আমার প্রেয়সী।যদি জানতাম তবে কখনোই যেতে দিতাম না।নিজের মনের অজান্তেই তোমার মোহে অন্ধ হয়ে তোমাকেই কষ্ট দিয়ে ফেলেছিলাম।তোমায় যে বড্ড বেশি ভালোবাসি কিরণ।প্লিজ আর রাগ করে থেকো না।মেনে নাও না আমাদের মিলনটা হয়তো এইভাবেই হওয়ার ছিল!তোমার অগোচরে আমি আর আমার অগোচরে তুমি!

সমাপ্ত 🌺

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here