ইচ্ছেমতি পর্ব -০১

#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_১
#শামছুন্নাহার

মিলির গায়ে হলুদ একটুপরেই শুরু হতে যাচ্ছে। মিলির বোন মিহি বলেছে এশার নামাজের পড়েই শুরু করে দিবে, সবাই নামাজ পড়ে রেডি হতে। চারদিক কোলাহলপূর্ণ, মেহমানভর্তি পুরোটা বাড়ি। বিয়ে বাড়ি বলে কথা!

গত দু’দিন হল মিলিকে পাত্রপক্ষ এসে দেখে গেছে, গতকাল খবর পাঠিয়েছে মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে। ছেলে বিদেশি,সিঙ্গাপুর থাকে। বউ খুঁজতে খুঁজতে চার মাস থেকে একমাস চলে গেছে তাই দেরি করতে চায়না ছেলের মামা। বাবা নেই বলে ছেলের মামাই দেখাশুনা করছে সবকিছু। এদিকে মেয়েরও বাবা নেই বলে সবটা সামলাতে হচ্ছে মেয়ের ফুফা। কারন চাচা দুজনের মধ্যে একজন বিদেশে থাকে, কাতার।আরেকজন ঢাকাতে থাকেন পুরো পরিবারসহ।

আজান পড়েছে মসজিদে। কাছেই মসজিদ তাই স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে। সবাই তাদের সাজু- গুজু গুছিয়ে রাখছে, কেউবা সাজতে শুরু করে দিয়েছে। যারা নামাজ পড়বে তারা নামাজের পর রেডি হবে। অন্য মসজিদের আজান অনেক আগেই হয়ে গেছে। মিলি,মিহি নামাজ পড়ে সাজতে বসছে। বউকে সাজাচ্ছে তাদের কাজিন তুলি। পার্লার বলা যায়।

মিলি মিহি দু’বোন। তাদের তিনভাই,দুজন বিদেশে থাকে সৌদিআরবে,একি সাথে। ছোট ভাই সবে ক্লাস টেন এ পড়ে। সামনের বছর ফাইনাল দিবে। মিহি অনার্স ১ম বর্ষ আর মিলি মাত্র ২বর্ষের পরিক্ষা দিলো।রেজাল্ট এখনো দেওয়া হয়নি।

মিলির শশুরবাড়ি থেকে মিলির জন্য গায়েহলুদের সবকিছু পাঠানো হয়েছে। হলুদের শাড়ী,গহনা,মেহেদি সবকিছু। সাজানোর পর যেন তাকে পরী লাগছে। ফর্সা গায়ের রং,লম্বা, দেখতে ভীষন মায়াবী লাগছে। এরমধ্যে সবার সাজা শেষ। স্টেজে নেওয়া হচ্ছে তাকে। ওর শশুরবাড়ি থেকে হলুদছোঁয়ার জন্য কয়েকজন লোক আসার কথা ছিলো বৈকি! সন্ধ্যাবেলায় হঠাৎ মানা করে দিলো।
একে একে সবাই হলুদ ছোঁয়ালো মিলিকে।সবাইকেই বেশ সুন্দর লাগছে। নাচ শুরু হবে এখন। সব কাজিন মিলে আনন্দে কাটাচ্ছে মূহুর্তগুলা। বিয়ের উছিলায় যেন সবাই একসাথে হলো।

মিলির শ্বশুরবাড়ি ওদের বাড়ি থেকে ত্রিশ টাকা গাড়িভাড়া। আসা-যাওয়া ষাট টাকা। কাছেই বলতে গেলে। খন্দকার বংশের ছেলে মৃদুল। দেখতে সুদর্শন, লম্বা। তাদের বাড়িতেও চলছে প্রাণজুড়নো উৎসব,হলুদের অনুষ্ঠান।

রাত একটা বেজে দুই মিনিট। মেহেদী পড়াচ্ছে দুই বাড়ির দুজনকে। মিলিকে তার কাজিন তুলি আর মৃদুলকে তার ছোটবোন ঈশা। এটা নিয়েও সবাই মজা করছে কারন মৃদুলের হাতে মিলির নাম আর মিলির হাতে মৃদুলের নাম লিখে দিয়েছে। বাকিরা বিকেলবেলাই এই কাজ শেষ করে ফেলেছে।

___
পরদিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে সবার। মিলি এখনো ঘুমে কাতর। মিহি উঠে দেরি হয়ে গেলেও ফজর নামাজ পরে নিলো। বাহিরে বের হতেই দেখলো সবার জন্য খিচুড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশ থেকেই ডাক পরলো “মিহি এদিকে আয়,এই চেয়ারটায় বস।” ঘাড়টা হালকা বাকা করে দেখলো তার ফুফাতো বোন রাইসা ডাকছে। মৃদু হাসলো মিহি,পরক্ষনেই এগিয়ে গেলো।বসলো সে। হাতে খিচুড়ির প্লেট ধরিয়ে দিলো মামাতো ভাই নিলয়। একটাই আবদার ” দানা পড়লে আমাকে দিস কেমন?”
নিলয়ের আবদারে সবাই ফিক করে হেসে দিলো। মিহি আওড়ালো ” আমি বুজি খেতে জানি না ভাইয়া?” আরেকদফা হাসলো সবাই। দানা বলতে খিচুড়িতে টুকরো টুকরো ছোট মাংসগুলোকে বুজিয়েছে, যেটা আমরা বিরিয়ানিতে খুঁজি। খাওয়া যখন অর্ধেক শেষ ঘুমু ঘুমু চোখে বেড়িয়ে আসলো মিলি। এসেই অভিমানে প্রশ্ন ছুড়লো ” আমাকে ফেলে সবাই খেয়ে ফেললি? ”
—” তোর বুজি আজ বিয়ে?” প্রশ্ন করলো নিলয় ভাইয়া।তিনি এখান থেকে সবার বড়, দুষ্টু বেশি।
কোমরে দুহাত রেখে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো ” কি মনে হয় তোমার?”
নিলয় কিছু বলতে যাবে তার আগেই চাচাতো বোন রোমানা বলে উঠলো ” আরে রাগ করছিস কেন? তোকে এখন বাচ্চা বাচ্চা লাগছে,একদম আমার মেয়ের মতো তাই বলেছে আরকি। তাছাড়া তুই উঠলি কেন ঘুমা গিয়া যা! আজ রাতে না ও ঘুমাতে পারিস।” বলেই চোখটিপ মারলেন।

রোমানা তার কাজিন, মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। তাছাড়া এক বাচ্চার মা। কি বুজাতে চেয়েছেন তা এখানের সবাই বুজে গেছে কারন যারা বসেছিল সবাই এডাল্ট। তার এমন কথা শুনে যেন অনেকে লজ্জায় নুয়ে যাচ্ছে, কেউবা এখনো হাসছে মিটিমিটি। মিলি এখনো কোমরে হাত দিয়ে ভ্রুযুগল তাকিয়ে আছে।নিলয় গলা খাঁকাড়ি দিয়ে মুচকি হেসে বললো– “তুই খেয়ে নে মিলি,আমার খাওয়া শেষ আমি গেলাম।” বলেই হাটা ধরলো। সাথে এখানে বসে থাকা মিলির মামাতো ভাই নাহিদ, ফুফাতো ভাই সাফি,সামিও চলে গেলো। চলে গেলো না বরং পালালো।

খাওয়া শেষে মিলির গোছলের পালা। তার মা নীলুফা বেগম ইতিমধ্যে বের হয়ে গেছেন কলসি দিয়ে পানি আনার জন্য,সাথে তার দু জা,বোন আর ননদ। নীলুফা বেগমের মাথায় কোলা তাতে হলুদ,ধান,দূর্বাঘাস নেওয়া।হাটতে হাটতে পাশের খণ্ডে নীলিমাদের মেহেদী গাছের নিচে গেলেন। নীলিমা মিহির আরেকটা চাচাতো বোন। গাছের নিচে কি যেন ঢাললেন। তারপর ফিরে এসে পুকুরপাড় থেকে পানি নিয়ে তবেই বাড়িতে আসলেন। মিলিকে হলুদ লাগালো,তারপর একেএকে নিয়ম পালন করে গোছলের কাজ শেষ করলো। এদিকে সব ছেলেমেয়ে পানি আর হলুদ দিয়ে খেলা শুরু। একজন আরেকজনকে জোর করে হলুদ লাগাচ্ছে, দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি, সাথে গানও চলছে। “লীলাবালি” গান। কি এক কান্ড!

অনুষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। লোকজন আসা শুরু হয়ে গেছে। কেউ খাওয়া দাওয়া করছে কেউবা হাটাচলা। মেয়েরা সব সাজায় ব্যস্ত। আর ছেলেরা? সবাইকে খাওয়াচ্ছে। শাহীদারি যাকে বলে।

বরপক্ষ রওনা দিয়েছে। মাত্র ফোন করে জানালো। মেয়েরা সবাই রেডি,গেইট ধরবে বলে হাজারো প্লেন।মিহির চাচাতো বোন রুপালী মাত্র আসলো ঢাকা থেকে,গতকাল মেয়ের পরিক্ষা শেষ হয়েছে। তাই হলুদে থাকতে পারেনি। মিলিকেও সাজানো শেষ,বর আসার অপেক্ষা।

দীর্ঘ একঘণ্টা পর জামাই আসছে। চারদিকে কোলাহল যেন বেড়ে গেলো আগের থেকে বেশি। মেয়েপক্ষের সব কাজিনরা গেলো জামাইকে এগিয়ে আনতে।মিহির মন খারাপ।আজকে তার বোন চলে যাবে,বাড়িতে গল্প করার কেউ থাকবে না,দুইবোন যে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে রাখতো আজকের পর থেকে হয়তো নিরব থাকবে। ওদিকে মিহির মা নীলুফা বেগমের অবস্থা আরো খারাপ। এ নিয়ে দু’বার বেহুশ হলেন তিনি।মিলিকে জানানো হয়নি কারন সে আরো চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিবে।তাই তাকে পাশের ঘরে আলাদা রুমে সাজিয়ে বসে রাখিয়েছে,পাশে মিহি বসে আছে।

মিহি আাজকে একদম নরমাল সেজেছে। লেহেঙ্গা পড়েছে বৈকি!ওড়নাটা গায়ে জরিয়ে ধরার মতো দিয়ে রাখা, সাথে হিজাব আর একটু লিপস্টিক। ব্যাস এতেই তাকে ভীষন সুন্দর লাগছে। বাকিরা এক একজন তুলির কাছে পার্লারের মতো সেজেছে বর্তমানে যাকে বলে ময়দা সুন্দরী হিহি।
“বর এসেছে বর এসেছে…এই তোরা যা গেইট ধরবি না? কিরে মিহি ওরা যাচ্ছে তুই যাবি না?” মিহির ফুফু লতিফা বেগম উচ্চস্বরে বললেন।

—” না ফুপ্পি যাবোনা আমি।ওখানে কত ছেলেরা থাকবে বলো তো আর তাছাড়া এসব আমার ভাল্লাগেনা, ওরা তো গেছে নাকি?এতেই হবে।”

—“আরে তুই একমাত্র শালী তোকে ছাড়া হবে? চল তোকে নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছে।ফের আসতে হল আমার,তাড়াতাড়ি চল”। মিহির মামাতো বোন রিতিকা বললো। তার কথায় ফুপ্পি,মিহি,মিলি ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মিহিকে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেলো সে।

গেইটে দুইপক্ষ তর্কাতর্কি শুরু করে দিয়েছে,ছেলের পক্ষ বলছে শালী ছাড়া কারো হাতে টাকা দিবে না, তাই নিলয় ভাই একপ্রকার বুদ্ধি করে রিতিকাকে পাঠিয়েছে মিহিকে আনার জন্য। মেয়েপক্ষ বলছে বিদেশি জামাই পাঁচ হাজার কমে ছাড়বে না। অবশেষে মিহি যাওয়ায় তার হাতেই টাকা দেওয়া হল মেয়েপক্ষ যা চেয়েছে তাই। আসল কথা হচ্ছে লটারি দিয়েছিল সেখানে লিখা ছিলো “১০ হাজার”। সেটা ছেলেপক্ষ মানতে নারাজ, তাই কমাতে কমাতে ৫ হাজারে আসছে। তবে যিনি এতক্ষণ তর্ক করেছে তার ফোন আসায় সে চলে গেছে কথা বলতে।

চলবে…..
_____________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here