ইচ্ছেমতি পর্ব -০২

#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_২
#শামছুন্নাহার

ছেলেরা বরপক্ষকে খাওয়ার ব্যবস্থা শুরু করে দিয়েছে। এদিকটা ওরাই সামলাচ্ছে। মিহি চলে গেলো বাকিরা যারা মহিলা,মেয়েরা আসছে তাদের কাছে। ফুপ্পি তাদের শরবত দিলো। প্যান্ডেলে তাদেরকে খেতে ডেকেছেন, পরে কথা বলা যাবে আগে খাওয়া শেষ করে নিক। খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই বউকে দেখতে এসেছে,মিহি পাশেই বসা ছিলো। ঈশাদের পরিবার ছাড়া সে আর কাউকে চিনে না। ঘণ্টাখানেক ব্যবধানে সবাই যেন তার পরিচিত হয়ে গেলো। মিহি খুব মিশুক। অল্পতেই মিশে ফেলতে জানে,ঈশার মতো। ব্যাপারটা ঈশার খালার অনেক পছন্দ হয়েছে, ইতিমধ্যে তিনি এটা বুজে গেছেন মিহি ভীষন ভালো মেয়ে।

অবশেষে বিয়েটা হল। পূর্ণতা পেলো দুটি জীবন, এক হল দুটি মন এক আত্মায়। একজোড়া হালাল হাতের ছোঁয়ায় পূর্ণ হল মৃদুল মিলির অর্ধেক দ্বীন। আজ থেকে দুজনের নতুন জীবন শুরু হল যেন!

বিদায়বেলা
পুরো বাড়িতে কান্নার রুল পরেছে। মিলি তার মা,ফুপ্পি, খালা,কাজিনদের জরিয়ে কান্নায় ব্যস্ত। শেষে আবদার ছুড়লো মিহি যেন তার সাথে যায়। এদিকে ঈশাও মিহিকে নিয়ে যাবেই,কিন্তু মিহি যেতে ইচ্ছুক নয়। সে সবাইকে আগেই বলে রেখেছিল সে যাবে না। পরিশেষে ঈশা ও তার খালামনির জোড়াজোড়িতে আর না করতে পারলো না,ফেঁসে গেলো চরমভাবে। না গিয়ে উপায় আছে? গুরুজন বলে কথা!

লেহেঙ্গা খুলে একটা থ্রি পিছ পড়ে নিলো মিহি। সাথে নিলো আরও দুইটা থ্রি পিছ। ঈশার সাথে বাহিরে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো একপাশে। কেন যেন মনে হচ্ছে কেউ তাকে লক্ষ করছে,পিছু নিচ্ছে। চারদিকে একবার চোখ বোলায় সে। পরে ভাবলো এটা তার মনের ভুল। কিন্তু আসলেও কি মনের ভুল নাকি সত্যিই কেউ তাকে ফলো করছে?

সব নিয়ম শেষ করে বাপের বাড়ি ছেড়ে রওনা ধরলো স্বামীর বাড়ি। কান্না থামানো দায়। সবার চোখেই পানি।আজকাল কেউ কাঁদে মিলির মতো? সাজ নষ্ট হয়ে যাবে বলেওতো কাঁদে না। এই ফিলিংসটা তারাই বুজবে যারা বিবাহিত। কতটা কষ্টের মূহুর্তে এই সময়টা।

গাড়ি চলছে আপন গতিতে। ঠিক চল্লিশ মিনিট পর গাড়ি থামলো খন্দকার বাড়ির গেইটে। সন্ধ্যা তখন সাতটা দশ মিনিট। যাওয়ার সময় বোধহয় জ্যামে পরেছিল তাই দেরি হয়েছে। এখন পুরো রাস্তা ফাঁকা তাই পৌঁছাতে বেশি সময় লাগেনি। একে একে সবাই গাড়ি থেকে নামলো শুধু বউ ছাড়া। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে কয়েকজন মহিলা হাতে ডালা নিয়ে আসছে। সামনে যিনি ডালা হাতে আসছেন তিনি যে মিলির শাশুড়ি এটা চিনতে ভুল হল না মিহির। ঈশা মিহিকে নিয়ে গেলো তার রুমে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। সবাই ক্লান্ত। নিয়মকানুন পালন করে ঘরে উঠালেন নতুন বউকে।

এশারের আজান হচ্ছে একটু দূরের কোনো মসজিদে।সারাদিনের ক্লান্তি আর কান্নায় মিলির এখন মাথা ব্যথা করছে। তার ওপর একের পর এক মানুষ দেখতে আসছে নতুন বউকে। মিলির বিরক্তি লাগছে খুব,অসস্তিও হচ্ছে। মিহি নামাজ পড়ে নিল,গাড়িতে থাকার কারনে মাগরিব নামাজ কাযা হয়ে গিয়েছিল। নামাজ শেষ করে এরপর রুম থেকে বের হল। বোনের পাশে এসে বসলো। একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা এসে বসলো পাশে থাকা চেয়ারটায়। মিলিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলো ” নাম কি মেয়ে?”
–” মিলি, ইফরাত মিলি।”
— ” বাহ মিষ্টি যেমন চেহারা তেমন সুন্দর নাম”।

মৃদু হাসলো মিলি। তারপর কিছুক্ষণ পর মিহিকে দেখিয়ে বললো ” কি হয় তোমার”?
—“বোন”
—” আপন বোন?”
— “জ্বী।”
—“তোমার নাম কি মেয়ে?” মিহির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন…
—” জ্বী? মিহি,পুরো নাম ইফতিয়া আফরিন মিহি।
—” সুন্দর তো,কে রেখেছে গো?”
পিছনে ঈশার খালামনি বললো। একটু থেমে বললো
— ” এটা আমার আম্মা। মিলি তোমার নানিশাশুড়ি।”
দু’বোন মুচকি হাসলো মাত্র। এমন সময় ঈশার আগমন। উচ্চস্বরে আওড়ালো ” আজকে ভাইয়াকে ছাড়ছি না,অনেক কষ্ট করে সাজিয়েছি ঘরটা”।
ঈশার খালামনি ফরিনা বেগম বললো– “কে বলেছে ছাড়তে,এই উছিলায় ভালো করেই ধরবি। হাহাহা। ”

বাসরঘর সাজানো শেষ। তারমানে ঈশা এতক্ষন পাশের রুমে রুম সাজাতে ব্যস্ত ছিলো। মিহি তাকে খুঁজেছিল, সেজন্যই পায়নি। বিশাল বড় বাড়ি খুঁজবেই বা কোথায়? নতুন এসেছে সে। চাইলেই কি এদিক সেদিক ঘুরা যায়? ভাবনায় ছেদ পরলো ঈশার ডাকে —
“মিহি আপু চল আমাদের বাড়িটা ঘুরে দেখবে।”

ঈশা ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার পড়ছে। মিহি বড় তার থেকে এক বছরের। কিন্তু মিহি বলেছে ওকে যেন তুমি বলেই ডাকে। ঈশার হাত ধরে মিহি ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়ি দেখছে। নতুন, বলতে গেলে ৪-৫ বছর হবে বিল্ডিং তুলেছে,দেখেই বুজা যায়। রাত বলে স্পষ্ট নয় সবকিছু। তবে মিহির ভাবনা ঠিক বাড়িটা ৫ বছর আগেই গড়া।এরপর ঈশার বড় বোন ইলমা আপুর বিয়ে হয়েছিল। ঈশা বাড়ির লোকজনসহ সবকিছু বলতেছে মিহির কাছে। ঈশাদের দুই ভাই,দুইবোন। সবচেয়ে বড় ইলমা আপু,মৃদুল ভাই,মিহাদ ভাই তারপর ঈশা। ঈশা সবার ছোট। মিহাদ মিহির সেইম ক্লাস। ইলমা আপুর একটা মেয়ে আছে ৩ বছরের।

কথা বলতে বলতে মিহি ছিলো একটু সামনে,ঈশা পেছনে। সামনে অন্ধকার কিছু দেখা যাচ্ছে, বোধহয় এদিকটায় লাইট অফ। হঠাৎ ঈশার কথা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মিহি – “ওদিকটা অন্ধকার কেন ঈশা?” জিজ্ঞেস করে পিছু ফিরেই দেখে ঈশা নেই। ঈশাকে বারকয়েকবার ডেকে কোনো সাড়া না পেয়ে যেইনা ফিরে যেতে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ আচমকা হাত ধরে কেউ টান দেওয়ায় অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো মিহির। ভয় পেয়ে যেইনা চিল্লাতে যাবে ওমনি কেউ ওর মুখটা সজোড়ে চেপে ধরেছে। কেউ একজন তার সুঠাম দেহের বলিষ্ঠ হাত দিয়ে মিহির মুখটা আটকে দিলো। কথা বলতে পারছে না মিহি। নিরব স্থানে একটাই শব্দ ” উহুম উহুম”। মিহি নিজের হাত দিয়ে সেই আটকে দেওয়া হাতকে নিজের মুখ থেকে সরানোর চেষ্টা করতেই লোকটা মিহির হাত দুটো শক্ত করে পেছন দিকে মুচড়ে ধরেছে। অন্ধকারের মধ্যে কিছু দেখতেও পারছে না মিহি। মোবাইলটাও মিলি আপুর কাছে রেখে এসেছে। কিন্তু এটা ঠিক বুজতে পারছে তার পিছনে থাকা বলিষ্ঠ হাতের অধিকারী নিশ্চিত কোনো পুরুষ মানুষ।

কি করতে চাইছে লোকটা,আমাকেই বা আটকালো কেন? ঈশা? ঈশা গেলো কই? ঈশা কি জানে আমি যে বিপদে পড়েছি? নাকি ইচ্ছে করেই… নাহ তা কেন হবে ঈশা ওরকম মেয়েই না। মনে মনে আওড়ালো মিহি। ভয় যেন ক্রমশ বাড়ছে বৈকি কমছে না। হাত পা ঠাণ্ডা হওয়ার উপক্রম। মিহি কিছু বুজবার উঠার আগেই তাকে একটা রুমের দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরলো লোকটা। মিহি বারবার লোকটার হাত থেকে ছোটবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারছে না ঐ মানবের হাত থেকে।

মিনিট তিনেক পরেই ছাড়া পেলো মিহি। হাতের সাথে মুখের বাঁধনও খুলে দিলো লোকটা। হঠাৎ ছাড়া পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মিহি। বড় করে দম ফেললো দু’বার। আচমকা ঘটনাটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই প্রশ্ন ছুড়লো ” ককককে? কে আপনি? আমাকে এখানে এনেছেন কেন?”
—” আমি। ভয় পেয়েছেন নাকি বেয়াইন?”

বেয়াইন?ঈশার ভাই মিহাদ নাকি?আমি তো তার বেয়াইন। মজা করছে আমার সাথে?ভাবলো মিহি।পরক্ষনেই পাল্টা প্রশ্ন করলো ” কে আমি? মিহাদ ভাইয়া?”
আজকে বিয়েতে মিহি মিহাদকে দেখেছিল। কথা হয়নি বলে কন্ঠটা এখনো অপরিচিত। ঈশা বলেছিলো ভাইয়া তার বন্ধুদের সাথে মেসে থাকে। সেখানে থেকেই পড়ালেখা করে। হলুদের দিন দুপুরবেলা বাড়ি ফিরেছে মিহাদ। তাই কনে দেখার সময় যাওয়া হয়নি।মিহিদের পরিবারসহ কেউই বিয়ের আগে পাত্রের ভাই মিহাদকে দেখেনি।
— “না বেয়াইন মিহাদ নয়,আমি ওয়াসিফ।”
— “ওয়াসিফ? কোন ওয়াসিফ?”
— “মৃদুল ভাইয়ের খালাতো ভাই।”
—“আমাকে এভাবে এখানে ধরে আনার মানে কি?”
—” আপনাকে আমার ভালো লাগে।”
শেষের কথাটা ওয়াসিফ নেশাভরা কন্ঠে আওড়ালো। কথা বলার সাথে সাথেই পকেট থেকে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে ফ্লাশ লাইট অন করে মিহির মুখের সামনে ধরলো। মিহি রেগে গেলো। সামান্য এই একটা কথার জন্য কেউ এমন করে?তাও আবার এই অন্ধকারে? ফাইজলামি করার আর জায়গা পায় না?মনে মনে বলছে মিহি। এমন সময় ঈশা উচ্চস্বরে ডাকলো
–” ভাইয়া খেতে আসো,খালামনি ডাকছে “। মিহি রাগে চলে যেতেই ওয়াসিফ শুধালো- ” আমার উত্তর?”
মিহির স্পষ্ট ছোট উত্তর- “বেয়াদব”।

হনহন করে বেরিয়ে গেলো সে। ওয়াসিফ পকেটে মোবাইল রেখে দুহাত আড়াআড়ি গুজে মিহির দিকে তাকিয়ে তার যাওয়া দেখছে। এদিকে ঈশা বাড়ির মুরুব্বীদের পাশ থেকে নড়ছেই না। একটাই কারন- এই বুজি তার মিহি আপু এসে এত্তগুলো বকা শুনাবে, মুরুব্বীদের সামনে তো আর বকবে না তাই। একটু আগের ঘটনার সাথে সে যে জরিত তা নিশ্চয়ই এতক্ষণে খোলাসা হয়ে গেছে মিহি আপুর কাছে। ভাবনায় ছেদ পড়লো মিহির ডাকে। মনে মনে আওড়ালো “যেখানে বাঘের ভয়,সেখানেই সন্দেহ রয়”!
—- “ঈশা একটু শুনবে? কথা ছিলো”।

মিহির কি কথা তা বেশ বুঝতে পারছে ঈশা। শুকনো ঢুক গিলে আওড়ালো ” পরে শুনি? এখন কাজ করছি তো।”
মিহি কথা বাড়ালো না,আগের মতো বোনের পাশে গিয়ে বসলো। মিলির শাশুড়ি তাকে খাবার দিয়ে গেছেন।সারাদিনের ক্লান্তি শেষে পেটভরে গিলছে যেন!

—চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here