ইচ্ছেমতি পর্ব -০৬

#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_৬
#শামছুন্নাহার

ঘড়ির কাটায় ঠিক বারোটা। কমিউনিটি সেন্টারের সামনে গাড়ি এসে থামলো। একেএকে সবাই গাড়ি থেকে নামলো শুধু মৃদুল, মিলি ছাড়া। গাড়িতে বসেই মৃদুল ওয়াসিফকে কল দিয়ে জানায় ওরা চলে এসেছে। ওয়াসিফের মা, ঈশার মা,রনির মা( ঈশার ছোট খালা ফিরুজা বেগম)সহ বাকিরা একে একে ভিতরে যাচ্ছে। ঈশা মিলিকে নামালে মৃদুল মিলির হাত ধরে দরজার কাছে আসতেই ওয়াসিফ দু হাত দু’দিকে দিয়ে ওদের আটকায়। মৃদুল আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে–” তোর আবার কি হল?”
—“আব্বে এমনি এমনি ভিতরে আসতে দিব নাকি?”
—“ফাইজলামি বন্ধ কর। ভিতরে ঢুকতে দে,সবাই অলরেডি চলে এসেছে।”
—-“নো। আমিও দাড়িয়ে থাকলাম।’
—” ভাই তোমার সাথে আমাকে রাখো প্লিজ আমি আসছি।” মৃদুলের পিছন থেকে ঈশার আবদার।

ওয়াসিফ এতক্ষণ ঈশাকে খেয়াল করেনি। ভেবেছিল ওরা সবাই ভিতরে চলে এসেছে। চোখ আটকে গেলো ঈশার পাশে থাকা মেয়েটির উপর। ইশশ কি সুন্দর হাসে! লাল লং জামার সাথে নীল স্কার্ট,নীল ওড়না।ওড়না দিয়ে আধ ঘুমটা দেওয়া, ঝুমকো কানের দুল ভীষন সুন্দর লাগছে মিহিকে। বিশেষ করে হাল্কা সাজ যেটা ওয়াসিফের বেশি ভালো লাগে,তাকে কাছে টানে বারংবার। বাকি সব মেয়েগুলো মেকাপ দিয়ে ময়দা সুন্দরি হলেও তার চোখ আটকায় ওই একজনের কাছেই। উফফ তার প্রেয়সীকে কি অপূর্বই না লাগছে। ওয়াসিফ যেন সব ভুলে গেল। ফিরুজা বেগম এসে ওয়াসিফের কাধে হাত রেখে বললো- “কিরে ওদের আসতে দিচ্ছিস না ক্যান?”
ওয়াসিফের ঘোর ভাঙ্গলো খালামনির ডাকে। পিছনে ঈশার একটা দূরসম্পর্কীয় এক চাচাতো বোন লামিয়া বলতেছে ” এই নিন কেঁচি। ওনাদের আসতে দিন।”

লামিয়ার হাতে গোলাপের পাপড়ির এক থালা সাথে একটা কেঁচি। দরজায় যে ফিতা বেধেছে সেটা কাটার জন্য। ওয়াসিফ মৃদুলকে কি যেন ইশারা করতেই মৃদুল হাজার টাকার দুটো নোট পকেট থেকে বের করে দিল।ওয়াসিফ সরে গিয়ে লামিয়ার থেকে থালাটা নিয়ে মৃদুলের সামনে ধরে। মৃদুল, মিলি একসাথে ফিতা কেটে ভিতরে আসে। ঈশা মৃদুলকে নিয়ে স্টেজে বসিয়ে ওদের সাথে কিছু ছবি তোলে মিহির কাছে এসে পাশের চেয়ারে বসে। মৃদুল মিলির হাত এখনো ধরে আছে। সবাই নতুন বউয়ের সাথে দেখা করতে আসে,ছবি তুলে । মৃদুল তাদের সাথে মিলির পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে মিলিদের বাড়ি থেকে লোকজন এসেছে। মিলির মা,চাচি,ভাবি,ফুফু,ফুফা,কাজিনরা সবাই এসেছে। সবাই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ইনজয় করতেছে দিনটাকে। এর একটু পরেই একটা ছেলেকে কে যেন মেরেছে তাকে নিয়ে তুলকালামকান্ড লাগিয়ে দিয়েছে। পরে জানা গেছে ছেলেটাকে ওয়াসিফ মেরেছে। কিন্ত কেন?

পরিস্থিতি ঠিক হওয়ার পরে মিলির বাড়ির লোকজন চলে যাওয়ার জন্য রওনা হল। মিহিও তাদের সাথে চলে যাওয়ার জন্য বের হতেই ওয়াসিফ ঈশাকে কি যেন ইশারা করল ইশা মিলির মায়ের কাছে গিয়ে আবদার করে বসে মিহি মিলির সাথে যেন যায়। মিলির মা রাজি হল না। তাছাড়া মিহিও থাকতে চাচ্ছে না। মিলির মা বললেন –” না মা। মিহি আমাদের সাথেই ফিরবে। আর শুনো তুমি কিন্তু মিলির সাথে যাবে কেমন?
—“সরি আন্টি আমার এক্সাম থাকবে সম্ভবত তাই যেতে পারবো না। প্লিজ আন্টি মাত্র তিন চারটে দিনের ব্যাপার। মিহি আপুকে দিয়ে যান প্লিজ।”আহ্লাদী সুরে ঈশা শুধালো।
—“বোকা মেয়ে মিহি তো থাকতেই চাচ্ছে না সেখানে আমি দেওয়া না দেওয়া আসছে কোত্থেকে? ”
ঈশা মিহির হাত ধরে শুধালো —“এমন কর কেন মিহি আপু এখানে তোমার কি অসুবিধে আমাকে বলো তো? প্লিজ আর কয়েকটা দিন মাত্র তাছাড়া ভাবীর সাথে চলেই যাবা তোমাকে কি সারাজীবনের জন্য রেখে দিব বলো?”
—“না ঈশা এমনভাবে বলো না। এখানে আমি যথেষ্ট আদরে থাকি কিন্তু সামনের মাসে আমার টেস্ট এক্সাম বুঝলে?” ঈশার হাত মিহির হাতের মুঠোয় রেখে মিহি বললো।
—” সামনের মাস? বাপরে আরও অনেক দেড়ি। আমাকে দেখো সামনের সপ্তাহ পরিক্ষা তবুও এনজয় করছি। এইদিনগুলো কি আর আসবে?”
—“ও থাকবে ঈশা! এত অনুরোধ করা লাগবে না।
উপস্থিত সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো পিছনে। ওয়াসিফের মা ফরিনা বেগম ও ঈশার মা ফরিদা বেগম দাঁড়িয়ে আছে। খালামনি বলছে থাকার জন্য? ওয়াসিফ ভাইয়া কি তার মাকেও বলেছে মিহি আপুকে আটকানোর জন্য? নাকি ওনি এই দু’দিনে মিহি আপুকে আপন করে নিয়েছে বলে আর এ কয়েকটা দিন তারাও থাকছে বলে মিহি আপুকে রাখতে চাইছে? কোনটা? যাইহোক এখন এসব ভাবার সময় নাই মিহি আপুকে আাটকানো মেইন উদ্দেশ্য। ঈশা ভাবছে। মিহির কথায় তার ভাবনা কাটলো। মিহি ফরিনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে __
—“না আন্টি প্লিজ জোড় করবেন না থাকবো না আমি।”
—” আরে মেয়ে আমাদের জন্য থাকতে বলেছি নাকি ওই দেখো তুমি চলে যাবে শুনে তোমার বোন চোখের জলে বন্যা করে দিচ্ছে। মিলি বউমা চায় তুমি থাকো আর ওদের সাথেই যাও।” মৃদুলের মা মিলির দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখালো মিলি কাঁদছে। একটু পরে মৃদুল এসে বললো মিহি যাবে না। এত মানুষদের কথায় মিহি একজনের না কে বা শুনে! তাছাড়া মিলির কান্না দেখে অবশেষে পরিক্ষার কথা ভুলে বোনের কাছে থাকতে বাধ্য হল সে। কিন্তু ওয়াসিফ? সে জানতোনা যে মিহিকে এত সহজে আটকানো সম্ভব হবে,এভাবে সবাই ওর না যাওয়ার জন্য এরকম বাধা দিবে। মিহি যাচ্ছে না ফাইনাল। আহ কি শান্তি লাগছে এখন!

মিহি যাচ্ছে না বলে ওদের বাড়ির কেউ দেড়ি করেনি।তারা বেরিয়ে গেছে দশ মিনিট হবে। মিলি মিহিকে জড়িয়ে ধরে আছে সেই কখন থেকে। ছেড়ে দিলেই বুজি পালিয়ে যাবে। বোনের প্রতি বোনের ভালবাসা দেখে সবাই তাকিয়ে দেখছে ওদের। মিহি কাছে থাকলে মিলির নিজেকে একা লাগবে না,কষ্ট হবে না বলে মিহি থাকতে রাজি হয়ে গেলো। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। অনুষ্ঠান শেষে বাড়িতে রওনা দিল সবাই এবং দশ মিনিটের মধ্যে বাসায় ফিরেও আসলো।

সারাদিনের ক্লান্তি যেন ভর করেছে,সবাই ক্লান্ত। ফ্রেশ হয়ে যার যার রুমে সে সে। ঈশা, মিহি একসাথে একরুমে গল্প করছে। সারাদিনে কে কি করছে এসব নিয়ে ঈশা মিহিকে বলতেছে। আজকের ডিনারটা একটু তাড়াতাড়িই করে ফেলেছে সবাই। রুমে গিয়ে নিশ্চয়ই সব ঘুম দিবে,যা গরম ছিল আজকে ক্লান্ত হওয়ারই কথা।

নিস্তব্ধ রাত। কোনো কোলাহল নেই। রাত এগারোটা চল্লিশ বাজে। অন্যদিন এ বাড়িতে এসময় খাওয়া-দাওয়াও হয় না,হলেও বসে আড্ডা দেয় সবাই। ঘুমাতে ঘুমাতে রাত ১২ টা বেজে যায়। আজকে অনুষ্ঠান সাথে প্রচুর গরমে সত্যিই সবাই ভীষন ক্লান্ত।ঘুমে মগ্ন সবাই কিন্তু ঘুম আসছে না মিহির চোখে। ইলমা আপুর হাসবেন্ড আসেনি বলে আজকেও ঈশা ইলমা আপুর সাথে ওনার রুমে ঘুমায়। ঈশা বলেছে ইলমা আপু নাকি একটু ভীতু টাইপের। একলা কখনো কোথাও যায় না,একা ঘুমায় না ভয় করে,এটা নাকি তার ছোটবেলার অভ্যাস। অথচ মিহি একলা থাকতে পছন্দ করে কিন্তু তাকে কখনো একলা থাকতে দেয়নি।সব সময় মিলির সাথে থাকতো সে। এখন থেকে হয়তো একলা এক বিছানায় রাত কাটাবে, কাথা নিয়ে টানাটানি, খুনসুটি ঝগড়া হবে না। মিলি আপু থাকবে শশুড়বাড়ি মিহি থাকবে নিজেদের রুমে কিন্তু একলা।ভীষণ মিস করবে মিলিকে। খাটে গড়াগড়ি করে ভাবছে মিহি। হঠাৎ গিটারের শব্দ কানে আসছে, শুধু তাই নয় কেউ গলা ছেড়ে গান গাইছে। মিহি মোবাইলে দেখে নিল কয়টা বাজে। বারটা বিশ বাজে এখন। কিন্তু এত রাতে কে গান গাইছে, সে কি আমার মতো ঘুমায়নি নাকি? মিহি ভাবছে। শুয়া থেকেই কান খাড়া করল কোনদিক থেকে আওয়াজ আসছে, কোন গান গাইছে বুঝার জন্য। স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে কেউ গাইছে___
পাগল হয়ে আছি তোরই কারন
সাথে করে এনেছি নে এই মন
তোর হাসির ছল,তোর চুলের দল
আমাকে কেড়ে নেয়।
তোর চোখের ঝিল জানি,পেরোনো মুশকিল মানি
তাও এগিয়ে গিয়েছে আমারই দুটো পা

তোকে একার দেখার লুকিয়ে কি মজা
সে তো আমি ছাড়া কেউ জানে না
তোকে চাওয়ারা পাওয়ারা নয় রে সোজা
সে তো আমি ছাড়া কেউ জানে না

থেমে গেল সেই মিষ্টিময় সুর। বারান্দার ওদিকটা থেকে আসছে এই সুর। তবে কি ওয়াসিফ গাইছে? ওনিই তো থাকে পাশের বারান্দার সাইড রুমে। ওনার গানের কন্ঠ এত সুন্দর? কিন্তু থামলেন কেন?মিহি বিছানা ছেড়ে উঠতেই গান গাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো তাই ফের বিছানায় সুয়ে পরলো সে। সবাই ঘুমায় ওনি সজাগ কেন?আমার মতো ওনারও কি চোখে ঘুম নাই তাও আবার কারন ছাড়া? কি ভাবছি আমি, ভেবে মৃদু হাসলো মিহি। পরক্ষনেই আবার সেই সুর ভেসে আসছে । মিহি এবার বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে গ্রিলে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। দেখার চেষ্টা করে সেটা আসলেই ওয়াসিফ কিনা! আবছা কারো ছায়া দেখা যাচ্ছে। বসে আছে একটা গিটার হাতে নিয়ে। এটা ওয়াসিফ ছাড়া কেউই না মিহি একদম সিউর। এবার অন্য একটা গানের সুর তুলছে ওয়াসিফ। মিহি মনযোগ দিয়েছে গান শুনার জন্য। ওয়াসিফ আনমনে গান গাইছে______
ঘুম চলে যায়
তোমার চোখে বেড়াতে
পারিনা তাকে
কোনোভাবে ফেরাতে
আমার এ মন তোমার পাড়ায়
বোকাসোকা হয়ে আড়ালে আবডালে দাড়ায়

তোমাকে ছোঁয়ার নেই তো আমার সাধ্য
দেখতে পাওয়া সেই তো বড় ভাগ্যে

মনটা অবাধ্য হচ্ছে প্রায়শ
কষ্টের বোঝা বেড়েই যাচ্ছে ক্রমশ
ঘুম চলে যায়
তোমার চোখে বেড়াতে
পারিনা তাকে
কোনোভাবে ফেরাতে….

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here