#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_১০
#শামছুন্নাহার
গ্রামের মনোরম প্রকৃতির সৌন্দর্যময় দৃশ্যরূপের কোনো ব্যাখা হয় না। দুপাশে সবুজের সমারহ ফসলের মাঠ, মাঝখানটায় আঁকাবাঁকা ঐ রাঙ্গা মাটির মেঠো পথ। পথের দু পাশে রয়েছে খেজুরগাছ ও তালগাছের সাড়ি। একটা গাছের ঠিক আট-দশ হাত দূরে আরেকটা গাছ লাগানো। এ যেন বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
ঈশা ও মিহি সেই মেঠো পথ দিয়ে হাটছে। মেঠো পথের দুপাশে রয়েছে সবুজ ঘাস। রাস্তাসমন্বিত দু’ধারে আগাছা ও বাঁশযারে ভরপুর। কয়েক পা এগুলেই আগের ন্যায় সবুজ ফসলের মাঠ। সবে চারাগাছ থেকে (গ্রামের ভাষায় যেটাকে আলি বলা হয়)একটু বড় হয়েছে অর্থাৎ ধান গাছে রুপান্তর হচ্ছে। মাসখানেক আগে বোধহয় মাঠে ফসলগুলো লাগানো হয়েছিল। অনেক জোড়াজোড়ির শেষে মিহিকে ঘর থেকে বের করা গেল। ঈশা সাথে থাকলেও এর সবটা দায়ভার ছিল ফরিনা বেগমের। মিহি যখন কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না ঈশা তখন ওয়াসিফকে ফোন করে জানায়। ওয়াসিফ তার মাকে ফোন করে জানায় যে করেই হোক মিহিকে যেন ঈশার সাথে পাঠায়।
ঘণ্টাক্ষানিক আগের কথা….
–“বিশ্বাস কর,ভাইয়া যাবে না আমাদের সাথে।”(ঈশা)
–” তাহলে আমি কি মিথ্যা বলতেছি?”( মিহি)
–” আরে তোমার সাথে বোধহয় মজা করছে। আসলে তোমাকে তো ওরকম সময় দিতে পারি না। তাই ভাবলাম আজকে একটু বের হব। (তুতলিয়ে)আাাআামি ভাইয়াকে বলেছিলাম আজকে তোমাকে নিয়ে বের হব,ঘুরতে যাব। সেজন্যই বলেছে বোধহয়। “(ঈশা)
–“কখন বলেছো?(মিহি)
–“ইয়ে মানে সকালে। হ্যা,সকালে ভাইয়ার সাথে যখন কথা হয়েছিল। কলেজ যাওয়ার আগে।”(ঈশা)
এমন সময় ফরিনা বেগমের আগমন-” কি হয়েছে রে ঈশা?”
–” দেখোনা মনি,মিহি আপুকে নিয়ে একটু বের হতে চাইছি কিন্তু ওনি যেতেই চাচ্ছে না।”(ঈশা)
ফরিনা বেগম মিহির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন_
–“কিরে মা শরীর খারাপ? যা না একটু ঘুরে আয় ভালো লাগবে।”
–“না আন্টি এমনিই ভাল্লাগতেছেনা।(মনেমনে বলে- আপনার বজ্জাত ছেলের জন্যই যেতে চাইছি না।ওই বজ্জাতের চ্যালেঞ্জ এর কথা বারবার মাথায় ঘুরছে।)(মিহি)
–“সেজন্যই তো বলছি ঘুরে আয় ভালো লাগবে।”(ফরিনা)
ঈশা ফরিনা বেগমকে চোখটিপ মেরে বললো_
— “ওয়াসিফ ভাইয়া কোথায় গেছে মনি?”
ফরিনা বেগম বুঝতে পেরে বললো-“ওয়াসিফ তো সেই অনেক আগেই বের হয়ে গেছে। আমাকে বলে গেল মার্কেটে নাকি যাবে।”
ঈশা মুখটিপে হাসলো। মিহির কানে কানে বললো–“এবারও যদি তোমার বিশ্বাস না হয় তবে উঠুনে বাইকটা আছে কিনা একবার দেখে আসতে পারো।”
কোনো কথা না বলেই মিহি চলে গেল পরিক্ষা করতে।দেখলো সত্যি সত্যিই বাইকটা উঠুনে নেই। তারমানে ওয়াসিফ মার্কেটে গেছে এবং ঈশার সাথে যাওয়া যায়।ভেবেই মুচকি হাসলো মিহি। দ্রুত পায়ে ড্রয়িংরুমে এসে ঈশাকে বললো-“আসরের আজান পড়েছে ঈশা। চল নামাজ পড়ে নেই। তারপর বের হব।”
ঈশা যেন বেশিই খুশি হল। ঠিক তখনই ঈশার মা ফরিদা বেগম বললেন-“থাকনা মেয়েটা যেহেতু যেতে চাইছেনা কেন জোড় করছিস তোরা?”
ফরিনা বেগম ইশারা করে বললো–“তুমি কথা কম বল আপা। মেয়েটা ঘুরে আসুক ভাল্লাগবে।”
মিহি ও ঈশাকে উদ্দেশ্য করে ফের বললো-” যা মা তোরা নামাজ পড়ে বের হয়ে যা। পরে আবার সন্ধ্যা হয়ে যাবে। যা তাড়াতাড়ি কর।”
ইলমা বললো–” যাও মিহি। সন্ধ্যার আগে ফিরলেই হবে। যাও।”
ঈশা,মিহি নামাজ পরে রেডি হয়ে নিল। দেখতে কিছুটা একি রকম তবে ভিন্ন দুটি কালারের দুইটা লম্বা রাউন্ড জামা পড়লো দুজন। বেণী করে নিল কোমরে পরা চুলগুলো। বেরিয়ে পড়লো দুজনে। ঈশাদের বাড়ির সামনের সেই মেঠো পথের একটু হাটলেই দু’দিকে দু রাস্তা। সেদিন রাতের বেলা যে পথে ঐ দীঘীরপাড়ে গিয়েছিল ঠিক তার উল্টো পথে হাটছে তারা।
বর্তমান…
বাড়ি থেকে মিনিট দশেক হাটার পড়েই দেখা হল মিহির নাম দেওয়া বজ্জাত, নির্লজ্জ, বেহায়া ওয়াসিফের সাথে। খয়েরি রং এর একটা টিশার্ট, কালো জিন্স পড়া সুদর্শন যুবক বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সাথে চোখাচোখি হতেই একটা মিষ্টি হাসি বিনিময় করল ওয়াসিফ। কিন্ত মিহি যেন চুপসে গেল ।ক্ষানিকটা রেগেও গেল। ঈশার দিকে রাগান্বিত চাহনিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। মিহির চাহনি দেখে ঈশা কান ধরে বললো–” Sorry আপু।”
–” তোমাকে আমি ভালো মনে করেছিলাম ঈশা। কিন্তু তুমি ঐ বজ্জাতটার মতোই। যেমন ভাই তেমন বোন।”
ঈশা রাগ করল না। কারন সে জানেই ওয়াসিফকে দেখার পর মিহি হাজারটা কথা শুনিয়ে দিবে। মিহি ফের বললো-” চল ঘুরা শেষ। অনেক ঘুরিয়েছ। বাড়ি যাবো এবার।”
অবাক হয়ে ঈশা বললো- “মাত্রই না এলাম?”
–“আর একটা কথা বললে তুমিও চড় খাবে। আমাকে রাগীও না।”
ওয়াসিফ গলার স্বর উঁচু করে বললো- ” হেরে গেছেন বেয়াইন সাহেবা। এখন চলে গেলেও লাভ নেই। চলুন হাটা যাক।”
–“ভাইয়া তোমার বাইক?”(ঈশা)
–” বাইক মৃদূল ভাই নিয়ে যাবে। ভাইকে কল করে বলেছি নিয়ে যাওয়ার জন্য। এ পথেই যাবে বললো।”(ওয়াসিফ)
–” তাহলে ভাইয়ার সাথে আমিও চলে যাবো ঈশা। তুমি থাকো এখানে।”
ওয়াসিফ এগিয়ে এসে বললো–” তোর সাথে এটা কে রে ঈশা?”
ওয়াসিফের কথায় মিহি অবাক হল। কপাল কুঁচকে তাকালো ওয়াসিফের দিকে। ওয়াসিফ মিহির দিকে আঙ্গুল ইশারা করে বললো–“ওয়েট ওয়েট। এই তুমি সেই মেয়েটা না,যার মুখ দিয়ে সারাক্ষণ ব্ল্যাক কফির মতো তিতা তিতা কথা বের হয়?”
প্রচণ্ড রেগে গেল মিহি। অথচ ঈশা… খিলখিলিয়ে হেসে দিল।
–
সোফায় বসে আছে দু বোন। ফরিদা বেগম ও ফরিনা বেগম। গল্পের আসর জমিয়েছে তারা। ফ্লোরে বসে আছে ফরিদা বেগমের মেয়ে ইলমা। তার মেয়ে ঐশি ফ্লোরে খেলছে। মেয়ের খেয়ালের জন্যই মূলত ফ্লোরে বসে আছে ইলমা। একটু আগে বিকেলের নাস্তা দিয়ে গেছে তাদের বাড়ির কাজের মেয়ে জবা। সাথে চা তো আছেই। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফরিদা বেগম বললেন–” মায়ের জন্য ক্যান জানি খারাপ লাগতাছে রে ফরিনা। বললাম তোদের সাথেই যাক,না সে তার গুনধর ছেলের সাথেই যাবে বললো তো বললো একদম চলেই গেল।”
মায়ের কথা মিলিয়ে ইলমা বললো–“একদম ঠিক বলছো আম্মু। নানুর কি কোনো কাজ আছে? সারাদিন একটা রুমে পড়ে থাকবে। তার চেয়ে ভালো ছিলনা এখানে থাকার? আমরাও সময় দিতাম,সেবা করতাম আর তোমাদের দুই মেয়ের সাথেও আড্ডা দিত।”
–“আর বলিস না ইলমা। কত করে যে বুঝালাম মাকে।শুনলো না আমার কথা। যাকগে, যেখানে ভালো লাগে সেখানেই যাক। ভালো থাকলেই হয়।”(ফরিনা)
–“তা ঠিক বলেছিস। ভাই আর ভাবী অবশ্য কম যত্ন করেনা। তাছাড়া আমার ভাইঝি দুইটা আছেনা দাদির কি না খেয়াল রাখে বল?”(ফরিদা)
একটু থেমে ফের বলে–“আচ্ছা নতুন বউয়ের বোনটারে জোড় কইরা পাঠালি ক্যান? যুবতী দুইটা মাইয়া একা একা গেল। যদি কিছু হয়? আমার তো চিন্তা হইতাছেরে ফরিনা। তুই সবসময় বেশিই করছ।”
–“আরে রাখো তো আপা। ওদের দুইজনরে আমি একলা একলা পাঠামু আমি কি পাগল? ওয়াসিফ গেছে ওদের সাথে। তাই চিন্তা করার কোনো কারন নাই।”(ফরিদা)
–“ঈশা কি অবুঝ নাকি আম্মু? যাক ঘুরে আসুক।আমিও তো যাইতাম যদি ঐশি না থাকতো।”(ইলমা)
–“বউমা কই রে ইলমা?”(ফরিনা)
–“ভাবী ঘুমায় খালামনি”(ইলমা)
এমন সময় ফোনের স্কিনে ভেসে উঠলো মিহাদের কল।
–
ওয়াসিফ থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে মিহি ও ঈশা। ওয়াসিফ দূরে তার কারন তার বোন বর্ষা কল দিয়েছে। কথা বলতেছে তাই। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার আরেকটা কারন হল তার বাইকটা মৃদুলের কাছে তোলে দেওয়া।
এদিকে বেচারা মিহি মনেমনে টার্গেট করে রেখেছে যে মৃদুল আসলেই সে মৃদুল ভাইয়ের সাথে চলে যাবে। ঠিক সেসময় কি যেন চোখে পরলো বাইকের কথা ভুলে গিয়ে ঈশাকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বললো–“ঐ যে বাড়িটা ওটা কার বাড়ি ঈশা?”
–“ঐটা নূরজাহান বুড়িমার বাড়ি। বৃদ্ধ মহিলা। কেউ নেই তার। একলা একলাই থাকে ওখানে। অনেক ভালো তিনি।”
–” চল না যাই।”
–“ওখানে গিয়ে কি করবা তুমি? আরে শুনো ঐ,মিহি আপু?”
ঈশার প্রশ্নের আগেই মিহি দিল এক দৌড়। এদিকে ঈশা গলার স্বর উঁচু করে ডাকছে আর তার পেছনে ছুটছে। ওয়াসিফ মৃদূলকে তার বাইকের চাবিটা বুঝিয়ে মাত্রই দাঁড়িয়েছিল। ঈশার কন্ঠ শুনে পিছনে ফিরে দেখে ঈশা দৌড়াচ্ছে কিন্তু মিহিকে দেখা যাচ্ছে না।
দুচালা টিনের একটা ঘর। তার পাশেই ছোট্ট আরেকটা ঘর। ওটা বোধহয় বুড়ির রান্নাঘর। মিহি ঘরটার সামনে এসে থামলো। উচ্চস্বরে শুধালো -“বাড়িতে কেউ আছেন? ”
এক ডাকেই ভিতর থেকে সারা পেল মিহি। চাপা গলা ভাঙ্গা স্বরে কেউ পাল্টা প্রশ্ন করছে–“কে?”
–“আমি মিহি বুড়িমা। বাহিরে আসুন।”
বুড়ির উঠুনে বড়ই গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায় ঈশা।হাপাচ্ছে আর বড় বড় নিঃশেষ নিচ্ছে সে। দৌড়ের ফল।
বাহিরে বের হলেন ৮৫-৯০ বছরের এক বৃদ্ধা মহিলা।পরমূহুর্তেই মিহি তাকে জড়িয়ে ধরলো। শুধালো-“কেমন আছেন বুড়িমা?”
বৃদ্ধা নূরজাহান বোধহয় চমকালো। এমন কান্ড তার সাথে কখনও ঘটেনি। সবাই মুখে মুখে কথা বললেও জরিয়ে ধরেনি কেউ। প্রতিউত্তরে তিনি বলেন-“বেশ ভালা আছি মা। তুমি কেডা? তোমারে তো চিনলাম না।”
–“আমাকে চিনো দাদি?”(ঈশা)
–“আরে ঈশু না? ভালা আছিস?”
–“হু ভালো আছি। ওরে চিনবা না। ও হচ্ছে মৃদূল ভাইয়ের শালী। ”
–” ও আইচ্ছা। তা মা আমার কাছে আইছো ক্যান? শুধুই দেখা করবার লাইগা নাকি অন্য কোনো কারনে?”
–“ঠিক ধরেছেন আপনি। আমি তো আপনাকে চিনতাম’ই না। আমি এসেছি……(মিহি)
–” কও না কি চাও।”(বুড়িমা)
–“আসলে হচ্ছে কি ওই গাছটা। ঐ গাছটা থেকে কয়েকটা ফুল নেই?”(মিহি)
মিহি আঙ্গুলে ইশারা করে তার প্রিয় কাঠগোলাপ ফুলের গাছটা দেখালো। বাড়ির এক কোণে লাগানো গাছটা।নিঃসঙ্কোচ আবদার। চাইলেই কি ফেলা যায়?
বুড়িমা বললো–” নে না। সবগুলাই নিয়ে নে তোরা।এগুলা দিয়া আর আমি করমু ক। তিন বছর আগে নাতিনডা সখ কইরা গাছটা লাগাইছিল। মইরা আমারে একলা কইরা দিল। স্মৃতি রাইক্কা গেল এই গাছটা। নেও মা তোমরা নেও আমার কোনো বাধা নাই। আমার শইলডা(শরীর) ভালা না। আমি একটু শুই।”
বলেই তিনি চলে গেলেন ভিতরে। মিহি গেল সেই ফুল গাছের নিচে। সাথে ঈশাও। ওয়াসিফ আসলো ঠিক তখন। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসলো ঈশাদের কাছে।মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে রইল সামনে থাকা ভালবাসার মানুষগুলোর দিকে।
ওয়াসিফের ধ্যান ভাঙ্গলো মিহির ডাকে। মিহি বললো– “এই যে মি. এগুলা একটু ধরেন তো!”
বলেই মিহি ওয়াসিফের হাতে তার কুড়িয়ে পাওয়া একমুষ্টি কাঠগোলাপ ধরিয়ে দিল। ঈশার দিকে তাকিয়ে বললো–” এসো ঈশা,তোমার বেণীতে একটা কাঠগোলাপ গেঁথে দিই।”
ঈশাকে মিহি এবং মিহিকে ঈশা দুজনে দুজনের বেণীতে ফুল গেঁথে দিল। তারপর দুজন দুজনের কানে গুজে দিল সেই কাঠগোলাপের আরেকটা ফুল। তাদের অজানায় স্মৃতিচারণ হল সেই মূহুর্তের কিছু ছবি। ফ্রেমে বন্দি হল কারো মোবাইলের গ্যালারিতে।
#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_১১
#শামছুন্নাহার
–“ভাইয়া দেখো ওখানে দুইটা শালিক পাখি। একটা তুমি আরেকটা মিহি আপু। হাহাহা। ঠিক বলছিনা?”
ঈশার এমন কথায় থমকালো ওয়াসিফ ও মিহি।দুজনের যেন বিষম লেগেছে,কাশতে কাশতে দুজন দুপাশে চলে গেল। বেচারা ঈশা কিছুই বুঝলনা। সে যেন বোকাবনে গেল। তাকিয়ে রইল বাচ্চাসুলভ চাহনিতে। মিহির দিকে তাকিয়ে দেখল মিহি চোখ,মুখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। ঈশা কিছু বলার আগেই মিহি ঈষৎ রেগে বললো–“তোমার মনে হয় না তুমি একটু বেশিই করছো?”
–“আসলে মুখ ফসকে বলে ফেলেছি। তু তুমি… (ঈশা)
পুরোটা বলার আগেই মিহি ধমকিয়ে বললো_
–” চুপ কর।”(মিহি)
মিহির রাগান্বিত চেহারা দেখে ওয়াসিফ যেন মিহিকে রাগিয়ে দেওয়ার আরেকটা সুযোগ পেল। বললো–” মুখ ফসকে কি বলেছিস তুই,যা বলেছিস একদম ঠিক বলেছিস। ওইখানে পাখি দুটোর মধ্যে একটা আমি আর একটা…… আচ্ছা চল আজকে তোকে ওই রহিম চাচার দোকানের চা খাওয়াবো। (চোখটিপে কি যেন ইশারা করে বললো) এটা কিন্তু তোর ট্রিট। ”
মিহি কথা বাড়ালো না। সে জানে আজকে ওদের দিন।এখানে যেহেতু চলেই এসেছে তাহলে কথাও শুনতে হবে।
ওয়াসিফ, ঈশা, মিহি হাটছে সেই মেঠো পথ ধরে।সামনেই ঈশাদের পাশের বাড়ির রহিম চাচার দোকান।
দোকানে গিয়ে দেখলো রহিম চাচা নেই,বসে আছে তার ছোট ছেলে মাহবুব মিয়া। ওয়াসিফ তিনটা দুধ চায়ের অর্ডার দিয়ে দোকানের সামনে থাকা বেঞ্চটিতে বসলো।মিহি, ঈশা একটু দূরে দাঁড়িয়ে।
চা খাওয়া শেষ করে ওরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।তবে যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিক দিয়ে নয়। তার উল্টো পথে বাড়িতে যাওয়ার আরেকটা রাস্তা নাকি আছে। ওরা সে পথেই হাটছে। ওয়াসিফ রহিম চাচাকে ভালো করেই চিনে। এদিকটায় ওনার হাতের চা ফেমাস বলা যায়। ওয়াসিফ যখন গ্রামে আসে,ঈশাদের বাড়িতে, তখনই ঈশাকে নিয়ে বা মিহাদকে নিয়ে বের হয়ে যেত এই রহিম চাচার চা খাওয়ার জন্য। চাচার কথা জানতে চাওয়ায় মন খারাপ কন্ঠে ঈশা শুধালো –” আর বলো না ভাইয়া,ভালো মানুষদের কষ্ট বোধহয় বেশি থাকে। রহিম চাচার বড় একটা ছেলে আছে। নাম মাসুম মিয়া। জানো’য়ার, অস’ব্য, বদ’মাশ একটা। চাচার যত জ্বালা ওই ছেলেটাকে নিয়ে। খুব কষ্টে আছে চাচা,টেনশন অনেক। দেখোনা দোকানেও বসে না!”
অবাক হয়ে মিহি বললো–” কি করেছে ওনার ছেলে?”
–“আরে ওই জানো’য়ারটা গাঁজা,মদ খায়। মাতাল হয়ে এসে বউকে পিটায়। নেশা করতে করতে লাখ চারেক টাকা ঋন। সব ঋন করেছে ওই চাচার নামে। এখন তিনি যেখানেই যায় সবাই তাকেই ধরে। কারন তার নাম করে মানুষের কাছ থেকে টাকা আনছে। চাচা সেদিন আমাদের বাড়ি গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে একদম কেঁদে দিছিলো। গরিব মানুষটা এত টাকা কিভাবে দিবে বলতো!ভীষণ ভালো মানুষ তারা। কি সুখের পরিবারটা ধ্বংস হয়ে গেল একটা জানো’য়ারের জন্য।”(ঈশা)
–“ওনার ছেলে কি গ্রামে থাকেনা?(ওয়াসিফ)
–“দেখা যায় না সচরাচর। ঋণ এর কারনে সেও পালিয়ে বেড়ায়। আগে তো মাসুম ভাইও ভালো ছিল। হঠাৎ কি হল কে জানে!”(ঈশা)
–
সন্ধ্যা হতে আর কিছুক্ষণ। সূর্য ডোবার আগমুহূর্ত। লাল,কমলা আভায় ছেয়ে গেছে আকাশটা। পরন্ত বিকেলের এ সময়টা গোধূলি লগ্নে সূর্যের ছন্দপতন হয়ে যায়।
মিহিরা দাঁড়িয়েছে পরন্ত বিকেলের সূর্যের ছন্দপতন হয়ে যাওয়া মূহুর্তটা উপভোগ করার জন্য। সবার দৃষ্টি যেখানে সূর্যের দিকে ওয়াসিফের দৃষ্টি তখন মিহির মুখশ্রীতে। এ সময়টা যেন থমকালো। তার দৃষ্টিও যেন প্রখর হল। মিষ্টি হেসে ঈশা তাকলো মিহি ও ওয়াসিফের দিকে। মিহির দৃষ্টি সূর্যতে বিদ্যমান থাকলেও নির্লজ্জ, বেহায়া ওয়াসিফ তাকিয়ে আছে আগের ন্যায়। মিনিট দুয়েক পরে ঈশা গলা খাঁকারি দিয়ে ওয়াসিফকে উদ্দেশ্য করে বললো–“কিরে ভাইয়া,মিহি আপুর প্রেমে ডুবে যাবি তো!”
ঈশার কথায় ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসে ওয়াসিফ। এক গাল হেসে শীতল কন্ঠে বলে–“ডুবেছি তো সেদিনই যেদিন তাকে প্রথম দেখেছিলাম। ”
–“তা তুমি যে ডুবে ডুবে ভালবাসো?মিহি আপু তো তোমাকে ভালবাসে না”
ওয়াসিফ মিহির দিকে তাকিয়ে নেশাভরা কন্ঠে শুধালো
–” ডুবে ডুবে ভালবাসি
তোর মিহি আপু না বাসলেও আমি বাসি!”
মিহি যেন লজ্জা পেল। চোখ নামিয়ে দৃষ্টি রাখলো মাটির উপর। কাউকে ভালবাসলে তার সামনেই তাকে শুনিয়ে সেই মাতাল প্রেমিকের আবেক,ভালবাসা, অনুভব,অনুভূতি প্রকাশ করলে ঐ প্রেমিকাটার একটু অসস্তি হবে এটাই স্বাভাবিক। উৎকণ্ঠিত কন্ঠে ঈশা গানের সুরে শুধালো –” দূরের আকাশ নীল থেকে লাল।
গল্পটা পুরোনো। oh sorry sorry নতুন হবে এটা।”
বলেই খিলখিলিয়ে হাসলো ঈশা। ফের বলে–“oh ho my singer bro! তবে এই পরিবেশের সাথে এই গানটা গাওয়াই যায়। চল দুজনেই গাই?” বলেই ঈশা সুর দিল…
তুমি না ডাকলে আসবো না”
মিষ্টি হেসে ওয়াসিফ সুর মিলিয়ে গায়____
কাছে না এসে ভালবাসবো না!
দূরত্ব কি ভালবাসা বাড়ায়
নাকি চলে যাওয়ার বাহানা বানায়…
দূরের আকাশ নীল থেকে লাল
গল্পটা পুরোনো
ডুবে ডুবে ভালবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি!…
–
সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ হল। পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে রাতের আধার। আকাশের এক ফালি চাঁদের মিষ্টি আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সবটায়।
খন্দকার বাড়ির গেস্ট রুমে আড্ডা জমেছে আজ। লুডু খেলছে ওয়াসিফ, ঈশা, মৃদুল ইলমা। ঈশার পাশে বসে আছে মিহি। অনেক জোড় করার পরেও মিহি খেলেনি।সে ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখেছিল যেখানে লিখা ছিল-
|| লুডু খেলা জায়েজ না ||
হাদিস শরিফে এসেছে__
অর্থ: যে পাশা (বা লুডু) খেলল, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানি করল।
সূত্র : আবু দাউদ হাদীস-৪৯৩৮
অর্থ: নবিজি স: বলেন, যে ব্যক্তি পাশা (বা লুডু) খেললো, সে যেন তার হাত শুকরের মাংস ও রক্তে ডুবালো।
সূত্র: সহীহ মুসলিম হাদিস- ২২৬০
এ পোস্ট দেখার পর মিহি আর কখনও লুডু খেলবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল। সেজন্য সবাই বলার পরও সে খেলেনি। বাকিদেরও মানা করেছিল কিন্তু কেউ তা কানে নিল না।
খেলায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলতেছে। জিতার আগমুহূর্ত। এমন সময় মিলি আসলো রুমে। সবাইকে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে মিহির পাশে এসে বসলো। মিহিকে হাত দিয়ে ইশারা করে ডেকে বললো–“এ্যাই মিহি, এদিকে আয় তো!”
বারান্দায় গিয়ে চোখ রাঙ্গিয়ে মিলি মিহিকে বললো –“এখানে এসে আমাকেই ভুলে গেলি?”
–“ওমা তা কখন বললাম,সকালেই না দেখা হল?”
–“তোরে নিয়া আসছি কি রুমে বসে থাকতে?”
–” মৃদূল ভাইয়া তো তোমার সাথে সারাদিন থাকে সেখানে আমি থাকলে কেমন না?”
–” আস্তে কথা বল। ওরা শুনবে।”
মিহি ফিসফিসিয়ে বলে–“আচ্ছা ”
–” তোর দুলাভাই তোকে দুপুরে আসতে বলেনি?ওই যে দুপুরে বের হইছে মাত্র এখন আসছে। সারাদিন একা ছিলাম।”
–” ইলমা আপু,আন্টিরা না ছিলো? ”
–” আমি তো ঘুমাইছিলাম। আচ্ছা দুপুরে আসলি না ক্যান? ”
দুপুরের কথা কি বলা যায়? মিহি আমতা আমতা করে বললো–” ইয়ে মানে আসলে হইছে কি… আমি গোছল শেরে বের হওয়ার পরেই ভাইয়ার সাথে দেখা। ভাইয়া বলছিল কিন্তু আমি বলেছি কাপড়গুলো ছাদে দিয়ে যাবো। তারপর ছাদে গেলাম,কাপর দিলাম। তোমাদের রুমের সাথে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে না? জানোই তো প্রিয় ফুল। সেখানে একটু দাঁড়িয়ে দেন নিচে আসলাম। তারপর আজান দিল নামাজ পরে একটু ঘুমিয়েছিলাম। তারপর… ঈশাদের সাথে চলে গেছিলাম।”
–“বলে যাবি না?”
–“তুমি না তখন ঘুমাচ্ছিলা।”
সে সময়ে স্বজোরে চিৎকার আসছে। মৃদুল আর ওয়াসিফ জিতেছে সেই ম্যাচে। ইলমা উচ্চস্বরে শুধালো –” দূর! আর খেলবো না। ভাবী ভিতরে আসেন,গানের কলি খেলবো। ”
মিলি মিহিকে হেচঁকা টেনে বললো–“চল।”
ওয়াসিফ ঈশাকে উদ্দেশ্য করে বললো–” আমার রুম থেকে গিটারটা নিয়ে আয় তো!”
ঈশাও তাই করল। ওয়াসিফ গিটার বাজালো,একেএকে সবাই গান গাইলো। মিলি আর মিহি ছাড়া। অবশ্য মিলি পারে না আর এবার শেষ পালা মিহির। সবথেকে আগে শুরু করল তাদের ডাকনাম দেওয়া সিঙ্গার ওয়াসিফ চৌধুরী। ওয়াসিফ গাইলো–
–” পড়েছি প্রেমে প্রথম দেখায়।
রেখো আমায় কাজল রেখায়।(২)
শুধু একবার বলো তুমি যে আমার…..
ওয়াসিফ এটা কেন গাইছে বা কার জন্য গাইছে তা কেউ না বুঝলেও ঈশা,মিহি ঠিকই বুঝেছে। মিহি কাউকে কিছু না বুঝতে দিলেও ঈশা মিটিমিটি হাসছিল।
ইলমা গাইলো রবীন্দ্রনাথ গান —
–“কেন মেঘ আসে,হৃদয় আকাশে
তোমারে দেখিতে দেয় না।
মোহমেঘে,তোমারে দেখিতে দেয়না….
তার গান শুনে ওয়াসিফ বলেছিলো…”চিন্তা কইরো না আনোয়ার ভাই আসবো।”
সবাই হেসে ফেলেছিল ওয়াসিফের কথায়। তারপর গাইলো মৃদুল –“তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো ছেড়ে দিবো না”
ঈশা গাইলো-“লাকী গায়া ইশকে তেরা”
–“আমিও গান পারিনা ভাইয়া।”মৃদুলের দিকে তাকিয়ে আকুতি স্বরে বললো মিহি।
–” মিথ্যে বলছিস কেন মিহি। না গাইলে না কর।”(মিলি)
মিহি মিলির শাড়ীটা ধরে ফিসফিসিয়ে বললো–“তুমি সবজায়গায় আমাকে বাঁশ দাও। চুপ কর প্লিজ। ”
–“একটা গাও না মিহি?”(ইলমা)
–” তারমানে ভালো গায়,একটা তো গাইতেই হবে নাহলে ছাড়বোই না আজকে!”(ওয়াসিফ)
–” গায় কি! ও ভালো নাচও পারে।(মিলি)
মিহি গাইতে চাইছিলনা তার কারন হচ্ছে ওয়াসিফ।কিন্তু শেষে গাইতেই হল তার। সে গাইল__
–“আমাকে আমার মত থাকতে দাও
আমি নিজেকে নিজের মত গুছিয়ে নিয়েছি
যেটা ছিলনা ছিলনা সেটা না পাওয়াই থাক
সব পেলে নষ্ট জীবন!”
–
–“এই খুঁচা মার্কা গান কই শিখছো মেয়ে?”
শীতের কোন প্রানউজ্জ্বল রুপমাধুরী নেই। সে রিক্ত,ধ্যানমুক্ত মহাতাপস।
সকালের নাস্তা শেষে ব্যাডমিন্টন খেলছিল মিহি ও ঈশা। হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন ওয়াসিফ এসে উপরোক্ত কথাটি বলছে। খেলা থামিয়ে তিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে মিহি। ওয়াসিফ মুখ টিপে হাসলো। ঈশার দিকে ফিরে বললো –“ঢুবলি তোর ব্যাট টা এদিকে দে তো! আমি ওর সাথে খেলবো।”
মুচকিহেসে ঈশা এগিয়ে দিতে গেলেই মিহি শুধায় -” না ঈশা, আমি ওনার সাথে খেলবো না।”
–” কেন? এতেও সমস্যা নাকি?”(ওয়াসিফ)
–“নাহ আপনার সাথে পারবো না আমি। হেরে যাবো। তারপর আবার গানের মতো খুটা দিবেন? “(মিহি)
–“আমি কই খুটা দিলাম? তুমি যে এটা খুঁচা দিয়ে গাইছো সেটা কি আমি বুঝি না?”(ওয়াসিফ)
–” আজব এটা খুঁচা দেওয়ার কি আছে,গান তো গান’ই।”(মিহি)
–” তাহলে এত গান থাকতে কেন এটা গাইলে?”
–“ওয়েট,ওয়েট। ভাই এই নাও ব্যাট। খেলো আর ঝগড়া কর। আমার কলেজ আছে সো আমি গেলাম।”
বলেই ঈশা অন্দরমহলে চলে গেল। দুজন তাকিয়ে রইল ঈশার যাওয়ার পানে। ঘাড় সোজা করে মিহি ওয়াসিফের দিকে তাকালো। ঈষৎ রেগে কাঠ কাঠ গলায় বললো–” তখন এটা মাথায় আসছিল তাই এটাই গেয়েছিলাম। আর যদি এর মানেটা আপনি বুঝেই থাকেন তবে প্রশ্ন কেন করছেন ? থাকতে দেন আমাকে আমার মত!”
মিহির রাগ দেখে ওয়াসিফ ফিচেল হাসলো,বললো__
–” ঘাড়ত্যাড়া মিহি।”
–“আমি না। আপনি।”
–” তুমি।”
–“আপনি।”
–” আচ্ছা দুজনেই। ”
পুরো দিনটাই বাকি দিনগুলোর মতো কেটে গেল।বিকেলে যখন ঈশা কলেজ থেকে ফিরলো তখন সবাই ছাদে আড্ডা দিয়েছিল। আগামীদিন মিহিরা চলে যাবে,তারপরের দিন ওয়াসিফ ও তার মা চলে যাবে।সবার যেন মন খারাপ। এ নিয়েই কথা হচ্ছে সেখানে। সেই আড্ডা শেষ হয় সন্ধ্যার অনেকক্ষন পর।
চলবে..
(হাদিসটা দিয়েছি বলে কেউ অন্যকিছু ভাববেন না)
চলবে….
(আজকেরটা বোধহয় কল্পনাকৃত কিছুটা অগোছালোই হয়েছে।বড় হয়ে যাবে বলে অনেক কথা’ই ফুটিয়ে তোলা হয়নি।মাফ করবেন।)