ইচ্ছেমতি পর্ব -০৮+৯

#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_৮
#শামছুন্নাহার

বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে একটু আগেই। এইতো আধঘণ্টা হবে বোধহয়। সূর্য ডুবে অন্ধকার ছেয়েছে সবটাতে। ভীষণ গরম পড়েছে। এই মূহুর্তে একটু ঘুরে এলে ভালো লাগতো। দূরে কোথাও না,এইতো সামনের সরু রাস্তার পাশটায়। যেই ভাবনা সেই কাজ। মিলিকে নিয়ে বের হয়েছে মৃদূল, সাথে নিবে ওয়াসিফকে।এমনটা মৃদুল প্রায় করে। বাড়িতে আসলে ঈশা,ইলমা বা তার বন্ধু নাহিদকে নিয়ে ঘুরে আসে।

ওয়াসিফ ভেবেছিল মিহি হয়তো ওদের সাথে যাচ্ছে। কিন্তু এসে দেখে ওরা দুজন। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো তার। দাঁত কিড়মিড়িয়ে মনে মনে বলে–“বলি আমি কি তোমাদের দুজনের সাথে গিয়ে ডান্স করবো?” মুখে হাসি টেনে বললো- ” আর কেউ যাবে না?”
—“হ্যা মিহি তো আমাদের সাথে যেতে পারে। আমি কি ওকে ডাকবো? ” মৃদুলের দিকে তাকিয়ে মিলি উৎকৃষ্ট কন্ঠে শুধালো।
—“এটা বলার কি আছে? ওহ হু ওরে ডাকতেই ভুলে গেছি। ওয়েট, তোমরা দাড়াও আমি ওকে ডেকে নিয়ে আসছি।”
বলেই মৃদূল গেইট থেকে দৌড়ে ঘরে গেলো। মিহি তখন ফরিনা বেগমের সাথে গল্প করছিল। মৃদুল এসে মিহিকে শুধালো –” মিহি, তোমার আপু তোমায় ডাকছে একটু এদিকে এসো তো!”
প্রতিউত্তরে মিহি কিছু বললো না। শুধু ফরিনা বেগমকে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে দুলাভাইয়ের পিছন পিছন হাটা শুরু করলো।

বাহিরে বের হয়ে মিহি একটু অবাক হল বটে। কারন তার বোন মিলির সাথে ওয়াসিফ। সে এখানে কি করছে? লোকটা আবার আপুকে উল্টা পাল্টা কিছু বলে দেয়নি তো? বললেই কি! আমি তো আর তার প্রেমের প্রস্তাবে রাজি হইনি,ভাবলো মিহি। কোনো ভণিতা ছাড়াই প্রশ্ন করলো–” আমাকে ডেকেছিলে?”
—“হ্যা চল।” মিলির ছোট্ট উত্তর।
—” কোথায়? ”
—” এইতো সামনে কোথাও। তোর ভাইয়া ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে কারেন্ট চলে গেলে আমরা যে রাস্তায় হাটতে বের হতাম তোর মনে নেই? বিষয়টা এরকমই।অবাক হওয়ার কিছু নেই,চল।”মিলির কন্ঠে নির্লিপ্ততা।
প্রতিউত্তরে মিহি মিলির খুব কাছে এসে ওয়াসিফকে ইশারা করে মিলির কানে ফিসফিসিয়ে বলে—“এই লোকটাও কি যাচ্ছে আমাদের সাথে? তাহলে কিন্তু আমি যাবো না।”
—“চুপ কর। চল তো।”

ওয়াসিফ যথেষ্ট সুদর্শন একজন যুবক। সুঠাম,সুগঠিত শরীর। মায়াবী-ফর্শা স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ত্বক। গায়ের গঠন অনেকটা মৃদুলের মতো। যথেষ্ট স্মার্ট আর মুখে খুঁচা খুঁচা চাপ দাঁড়ি স্পষ্ট। যেকোনো মেয়েই পছন্দ করবে তাকে। দুহাত পকেটে রেখে দাড়িয়ে আছে চুপচাপ। যেন একবারে কিছুই বুঝে না। এ্যাহ ঢং! মিহি মনেমনে ইচ্ছেমতো কথা শুনাচ্ছে ওয়াসিফকে। গায়ে টিশার্ট আর টাওজার। সবসময় এসবই পড়ে। এতেই সুন্দর লাগে তাকে। তবে মিলির বৌভাতের দিন একটু ভিন্ন দেখা গিয়েছিল লোকটাকে। কালো জিন্স-সাদা শার্ট তার উপর কালো কোর্ট, কালো শো একদম হিরো হিরো লাগছিল। যাইহোক আমার কি? হু! ভাবতে ভাবতে দু পা এগুতেই মিহি হঠাৎ থেমে গেল। মৃদুল জিজ্ঞেস করলো–” কি হল মিহি,থামলে যে?
—” ভাইয়া ঈশা? ঈশা যাবে না?”
দূর ঈশা কি সবজায়গায় যেতে হবে?কত সুন্দর মৃদুল ভাই আর ভাবী হাত ধরে সামনে হাটতেছিল। পিছনে আমরা দুজন। ঈশা গেলে তো মিহি ঈশার সাথে হাটবে,আমি কি চেয়ে চেয়ে দেখবো মৃদুল ভাই আর ভাবী যে হাত ধরে হাটতেছে নাকি তাদেরকে পাহারা দিতে আসছি? উফফ বিরক্তিকর। ওয়াসিফ মনেমনে আওড়ালো। মৃদুল কিছু বলার আগেই ওয়াসিফ বললো–” Actually ঈশার সামনে পরিক্ষা তো তাই ও আমাদের সাথে যাচ্ছে না।”
—“আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন ঈশা যেতে চায় কি না? ” ভ্রু কুঁচকে মিহির প্রশ্ন।
—” হ্যা,জি জি-জ্ঞেস করছিলাম। চলুন এবার যাওয়া যাক।”
কি সুন্দর বানিয়ে মিথ্যা কথা। ঈশাকে নিতে চাচ্ছেনা এটাতো আর মিহিকে বলা যায় না। তাই ঈশা যে সেদিন বলেছিলো ওর সামনে পরিক্ষা সেটা দিয়ে আপাদত কাজ চালিয়ে নেওয়া গেলো। বাহ ওয়াসিফ বাহ! তুই তো প্রেমকে সার্থক করার জন্য মিথ্যে বলাও শুধু করে দিলি! বাহ কেয়া বাত হে! ওয়াসিফ নিজেই নিজের প্রশংসা করছে আর আনমনে মুচকি হাসছে।

সামনে মস্তবড় পুকুর। পানিতে টইটুম্বুর করছে। শা শা বাতাসে সাগরের ঢেউয়ের মতো ঢেউ বইছে সেখানেও। পুকুরটা এতটাই বিশাল দেখতে কোনো দীঘীর মতো দেখা যাচ্ছে। আবছা আলোতে দেখা যাচ্ছে ক্ষানিকটা দূরে একটা টং এর দোকান। মৃদুল বলেছে ওই দোকানের চায়ের নাকি স্বাদই অন্যরকম। তবে আর কি! এরকম পরিবেশের সাথে এক কাপ চা হলে ব্যাপারটা জমবে। আসলেই টং এর দোকানের চায়ে আলাদা এক প্রশান্তি কাজ করে।

হাটতে হাটতে ওরা দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মিলি ও মিহি একটু দূরে। মিলি প্রথমে আসতে চায়নি। শত হোক নতুন বউ বলে কথা। মৃদুল বললো ওর নাকি পরিচিত দোকান তাই আর মানা করেনি। চা খাওয়ার পর্ব শেষ করে তারা চারজন ফের বাড়ির পথে রওনা দিলো। সামনে মৃদুল আর মিলি। পুরোটা পথ যেভাবে হাত ধরা এখনও তাই। পিছনে ওয়াসিফ ও মিহি। নিশ্চুপ দুজন। অবশ্য ওয়াসিফ অনেক কথা বলেছে,বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু মিহি কোনো রেসপন্স করছে না বলে এখন চুপচাপ হাটছে আর আড়চোখে মিহিকে পরখ করছে।

মাঝপথে আসার পর মৃদুলের আবদার কন্ঠ–“এই ওয়াসিফ তুই না সুন্দর গান গাইতে পাড়িস? একটা গান গা না ভাই!”
ওয়াসিফ দুষ্টুহাসি হেসে মিহির কানে কানে বলে-
-” গাইবো নাকি বেয়াইন।”
মিহির বিরক্তিমাখা কন্ঠ –“নির্লজ্জ, বেহায়া একটা।”
—” ভাইয়া গান গাইতে পারেন?” মিলি বললো।
—“হ্যা,ওয়াসিফ অনেক সুন্দর গান গায়। কিরে সুর ধর!” মৃদুল বললো।
গলার আওয়াজ বাড়িয়ে ওয়াসিফ বললো–“কার গান গাইবো ব্রো? জেমস গুরুর নাকি অন্য কারো?
—“একটা হলেই হলো আপনি গান তো!” মিলি শুধালো।

ওয়াসিফ সুর ধরে। গান গায় আনমনে। গানের মধ্যে হঠাৎ মিহির হাত ধরায় মিহি অনেকটা অবাক হয়। রাগান্বিত লুক নিয়ে তাকিয়ে থাকে আর হাত ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। “অন্ধকারে আবছা আলো”এমন পরিবেশের সাথে গানের সুর এ যেন মনোমুগ্ধকর। ওয়াসিফের মন ও সুর গেয়ে ওঠে……

ভাল্লাগে হাঁটতে তোর হাত ধরে
ভাবনা তোর আসছে দিন রাত ধরে
এলোমেলো মনটাকে কি করে কে আর রাখে
…কেন আমি এত করে তোকে চাই…..
পারবো না আমি ছাড়তে তোকে
পারবো না ছেড়ে বাঁচতে তোকে
হয়ে যাক একদিন……

লাস্ট লাইনটা ওয়াসিফ মিহির দিকে তাকিয়ে চোখটিপে বললো। সে তার গানের মাধ্যমে মিহিকে তার মধ্যকার সব অনুভূতি বোঝাতে চায়। মিহি বোঝেনা এমনটা নয়। সে রিলেশনশিপে যেতে চাচ্ছে না এটাই ওয়াসিফকে বুঝাতে চাচ্ছে। কিন্তু ওয়াসিফ চায় মিহি তার সাথে কথা বলুক,সঙ্গী হোক ভালো-মন্দ দুইটার’ই।আচমকা মৃদুলের কন্ঠ শুনে ওয়াসিফ মিহির হাত ছেড়ে দেয়। মৃদুল পিছনে তাকিয়ে বলে–“কিরে থামলি ক্যান?আরেকটা গা তো।”
—” ভাই কি গাইবো মাথায় তো কিছু আসতেছে না।”
মিহির কানে ফিসফিসিয়ে বলে–“সামনে এমন সুন্দরী বেয়াইন থাকলে মাথা কি আর ঠিক থাকে?”
মিহির কর্কশ কন্ঠ –“অসভ্য,ফাজিল একটা।”
ওয়াসিফ আগের ন্যায় বলে–“ধন্যবাদ ইচ্ছেমতি।”
মৃদুল ফের বলে–” কিরে বল?”
ওয়াসিফ ফের সুর ধরে……

রাতের সব তারা আছে দিনের গভীরে
বুকের মাঝে মন যেখানে,রাখবো তোকে সেখানে।
তুই কি আমার হবি রে?….

মন বাড়িয়ে, আছি দাঁড়িয়ে
তোর হৃদয়ে গেছি হারিয়ে
তুই জীবন মরন সবই রে……
তুই কি আমার হবি রে?…


বাড়িতে আসতে আসতে প্রায় সাড়ে নয়’টা বেজে গেছে। ঈশা তখনও পড়ছে। ফরিনা বেগম তার বোনের সাথে গল্প করছেন। ঐশি ঘুমিয়েছে একটু আগে। তাই মা ও খালার সাথে সেও বসে আছে। ওয়াসিফ এসে ঈশাকে বুঝিয়ে গেছে যেন মিহি কিছু বললে সে এটাই বলে তার পরিক্ষা ছিলো তাই সে যায়নি। ঈশা প্রথমে রাগ করলেও পরে ঠিক হয়ে যায়। সবাই ফ্রেশ হয়ে এসে ফরিনা ও ফরিদা বেগমের গল্পের আসরে আড্ডা জমায়। আড্ডা শেষে রাতের খাবার খেয়ে সবাই যার যার রুমে ঘুমানোর জন্য চলে যায়।

মিহি শুয়ে শুয়ে নিউজফিড দেখছে। হঠাৎ দেখলো নতুন দুইটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসছে। একটা মেয়ের আরেকটা ছেলের। মেয়েটাকে না চিনলেও ছেলেটাকে চিনতে ভুল হয়নি তার। আইডি নাম ” Wasif Chowdhury”–মিহি ওয়াসিফের প্রোফাইলে ঢুকে তার আপলোড করা পোস্টগুলো দেখতেছে এমন সময় নোটিফিকেশন আসলো মেসেজ রিকোয়েস্টের। সিন করতেই দেখলো ওয়াসিফ মেসেজ পাঠিয়েছে।
“Ami jani tumi ekbar holew amar profile a ghure asbe tai profile ta Unlocked kore dilam😊” পরপর আরেকটা মেসেজ আসলো__
“ki korcho.. amr pic dekhtecho tai na?”
ওয়াসিফের মেসেজে মিহি চমকালো খুব। তবে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট বা মেসেজ রিকুয়েস্ট কোনোটাই এক্সেপ্ট করেনি। মোবাইলটা বালিশের পাশে রেখে ঘুমে বিভোর হল মিহি।

এদিকে ওয়াসিফ প্রতিনিয়ত মিহির কথা ভাবছে। দেয়ালে বালিশ রেখে হেলান দিয়ে ফোন চাপছিল। মনটা খারাপ হল তার। মিহি রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করেনি তাই। পরে ভাবলো মিহি হয়তো ঘুমিয়ে গেছে,সকালে দেখলে নিশ্চয়ই করবে। মৃদুল ভাইকে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার। তার জন্যই আজকের সন্ধ্যাটা উপভোগ করেছি। মেয়েদের হাত এত নরম হয়? যাইহোক ওর হাত ধরেছি,একসাথে হেটেছি এটাই অনেক। স্মিত হাসলো ওয়াসিফ। তারপর গিটার নিয়ে গত রাতের মতো বারান্দায় চলে গেল মনের খোরাক, আবেক,ভালবাসা,দুঃখ সবকিছু আকাশকে জানান দিবে বলে।

চোখ দুটো এক হতেই ওপাশ থেকে গিটারের সুর কানে আসছে মিহির। চোখ খুলেই তড়িঘড়ি করে ওড়নাটা নিয়ে বারান্দায় চলে আসে সে। কারন মিহি জানে এই সুর কোথা থেকে আসছে। নিশ্চয়ই এখন গান গাইবে সে। কন্ঠটা মাশাআল্লাহ। তার প্রেমে না পড়লেও গানের প্রেমে পড়াই যায়। দেয়াল ঠেশে দাঁড়িয়ে ভাবছে আর হাসছে মিহি। শব্দহীন,মায়ায় পড়া এক অমায়িক হাসি। কান খাড়া করে দেয় পাশের বারান্দা থেকে গানের সুর শুনবে বলে। ওয়াসিফ গাইতে শুরু করে_______

কতটা হাত বাড়িয়ে দিলে তোমার মন ধরা যায়
কতটা পথ পাড়ি দিলে তোমার প্রেম ছোঁয়া যায়(২)
পাবো কি পাবোনা জানি না
তোমাকে তো বুঝিনা….(২)

তবু তোমার প্রেমে আমি পড়েছি
বেঁচে থেকেও যেন মরেছি
তোমার নামে বাজি ধরেছি, ধরেছি।(২)

চলবে …..#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_৯
#শামছুন্নাহার

ফজরের আজান পড়েছে সেই অনেকক্ষণ আগে।অন্ধকার কেটে ধরণীর বুকে ছেয়েছে আলো ফোটার আবির্ভাব।

নামাজের পর মিহির আজ আর ঘুম হল না। ঠিক ঘুম হয়নি তা নয় বরং ইচ্ছে করেই আর শুয়নি সে। ঈশার রুমের উত্তর দিকের জানালার পাশে দাড়িয়ে আছে মিহি। দৃষ্টি তার সামনের দিকে। রুম থেকে স্পষ্ট দেখা যায় ঈশাদের বাড়ির সামনের ঐ মাটির পথটা। যার দু পাশে লাগানো আছে তালগাছ ও সুপারি গাছ। হঠাৎ দরজা খুলার শব্দ কানে আসতেই পিছনে ফিরে তাকালো মিহি। গুটিগুটি পায়ে চোরের মতো করে রুমে প্রবেশ করছে ঈশা। মিহি ক্ষানিকটা অবাক হল। ভ্রু-যুগলের মাঝ বরাবর ভাঁজ পরল তার, চোখ পিটপিট করে তো তাকিয়ে আছেই। দেখতে থাকলো ঈশার কর্মকাণ্ড। ঈশা ধীরেধীরে এক পা, দু পা করে এগিয়ে গেল তার পড়ার টেবিলের দিকে। কি যেন একটা বই হাতে নিল তা স্পষ্ট দেখতে পেল না মিহি। বইটা হাতে নিয়ে যেই না বারান্দায় পা রাখবে সে মূহুর্তে মিহি ডাকলো -“ঈশা?”
থমকালো ঈশা। ক্ষানিকটা ভয় পেল যেন। পিছন ঘুরে তাকাতেই মিহিকে দেখে সস্তির একটা নিঃশেষ ছাড়লো সে। ঈশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই মিহি বললো-“কি হয়েছে ঈশা? ঠিক আছ তুমি? এভাবে হাটতেছো কেন পায়ে ব্যথা পেলে বুঝি?”
-“আরে থামো! একসাথে এত প্রশ্ন করলে কোনটার উত্তর দেই বলো তো?”
মিহির কাছে যেতে যেতে ফের প্রশ্ন করে-” তুমি আজকে ঘুমাওনি? ”
-” নাহ,আমি তো সকালে ঘুমাই না। তুমি থাকো না, একলা রুমে কি করব তাই শুয়ে থাকি। তখন চোখ লেগে যায়। বাড়িতে হলে এখন আমিও তোমার মতোই পড়তে বসতাম। তা বললে না যে এভাবে চোরের মতো আসার কারন?”
চোরের কথা শুনে ঈশা যেন লজ্জা পেল। পরক্ষনেই খিলখিলিয়ে হাসলো মেয়েটা। বললো-” আমি ভেবেছি তুমি ঘুমিয়ে আছ। তোমার যেন ঘুম না ভাঙ্গে ,ডিস্টার্ব না হয় তাই এভাবে আসা। যেটাকে তুমি চোর বলে সম্বোধন করলা।”
শেষের কথাটা ঈশা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো। মিহি ভাবলো চোর শব্দটা উল্লেখ করা বোধহয় তার উচিত হয়নি। ঈশাকে অসস্তিতে পড়তে দেখে মিহি বিষয়টা ঘুরাতে বললো-” এখন কি পড়তে বসবা?”
-“তুমি যেহেতু ঘুমাওনি তাহলে আড্ডা দেওয়া যাক?”
-“তোমার না সামনে এক্সাম?
-“এক্সাম এক্সাম এক্সাম উফফফ! আমার আর ভাল্লাগেনা এসব পড়ালেখা। বাদ দেও তো চল খাটে বসি।”
খাটে যেতে যেতে ফের বলে–“জানো মিহি আপু! আমার না বেগম রোকেয়াকে আচ্ছামত বকতে ইচ্ছে করে। মাঝেমধ্যে তো গালিই দিয়ে ফেলি। কি দরকার ছিল ওনার! ঘরের মধ্যে থাকতাম কত ভালোই না ছিল বলো? পর্দাও হত,গুনাহও কম হতো! সেটাই ঠিক ছিলোনা বলো?”
-” মোটেও না ঈশা। মেয়েদের facilities দরকার ছিলো। আগে আমরা ফ্রেন্ডরাও অনেক কিছু বলতাম বেগম রোকেয়াকে। এখন মনে হয় তিনি যা করেছেন আমাদের ভালোই হয়েছে। পড়ালেখা না জানলে, মূর্খ থাকলে কারো কাছে দাম পাওয়া যায়না। পুরুষরা মনে করে আমরা অবজ্ঞা। দেশের হাল অবস্থা দেখেছো? নারীরা এতটা এগিয়েও ধর্ষিত হচ্ছে কত মা বোন। কোন বিচার পাচ্ছো? পর্দার কথা বললে না? যদি পর্দা কর এটা তোমার মনোবলের উপর। তোমার ইচ্ছে থাকলে লেখাপড়ার পাশাপাশিও তা করতে পারো।ওটার পাশাপাশি এটাও দরকার আমাদের। বুজলে?”

এরপর মিহি বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে ঈশাকে বুজালো।ঈশা বুজলো এবং মেনে নিল তার কথা গুলো। মিহি মৃদু হাসলো আর মনে মনে ভাবলো-‘মেয়েটা বড় হচ্ছে ঠিকই কিন্তু স্বভাব আচরণ একদম বাচ্চাদের মতোই।’ কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় অতিক্রম হল দুজনের। হঠাৎ কেউ দরজায় নক করতেই ঈশা দৌড়ে গিয়ে একটা বই হতে নিয়ে ফের আগের জায়গায় বসে পড়লো। তার এমন কান্ডে মিহি শব্দ করে হেসে দিল।এদিকে ঈশা হাপিয়ে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। দরজায় আবারো কড়া নাড়তেই বালিশের পাশে মেলে রাখা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিল মিহি। গলা উঁচিয়ে উচ্চস্বরে ঈশা শুধালো-” কে? দরজা খুলা আছে। ভিতরে এসো।”

বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা আর কেউ না। ঈশার খালাতো ভাই ওয়াসিফ চৌধুরী। ঈশার কন্ঠ শুনে আর এক মূহুর্তও অপেক্ষা করেনি বাহিরে। দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করল ওয়াসিফ। কিন্তু ভিতরে গিয়ে থমকে গেল সে। মিহি যে সজাগ থাকবে তা আশা করেনি ওয়াসিফ। ভেবেছিল অন্যদিনের মতো হয়তো আজকেও ঘুমিয়ে আছে। ঈশার সাথে কথা শেরে যাওয়ার সময় বোধহয় ঘুমন্ত মুখখানা দেখে যেতে পারবে। কিন্তু তা আর হল কই! মিহির দিকে তাকিয়ে ফিচেল হেসে শুধালো -” goo good morning.
good morning tubli”
ওয়াসিফকে দেখে মিহি তার ঘুমটা আরেকটু টেনে ধরলো। ঈশা শুধালো -“গুড মর্নিং ভাইয়া।কিছু বলবে?”
-” হ্যা একটু কথা ছিল। কলেজ যাবি না আজকে?”
-” হুম যাবো।”
-” যাওয়ার আগে আমার রুমে একবার আসিস তো!কথা আছে।”
-“আচ্ছা। ”
ঈশার উত্তর শুনার আগেই ওয়াসিফ রুম থেকে বের হয়ে গেল। তারপর ওরা দুজন নাস্তা করতে চলে গেল।
নাস্তা শেষে ঈশার প্রিয় ফুলের বাগানটা একবার ঘুরিয়ে দেখালো মিহিকে।

বারোটা বেজে পঁচিশ মিনিট। সবে শাওয়ার শেষ করে বের হল মিহি। হাতে তার ভেজা কাপরগুলো। উদ্দেশ্য ছাদে যাবে। দু পা এগুতেই দুলাভাই মৃদুলের সাথে দেখা। মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে চলে যেতেই মৃদূল পিছু ডাকলো।
-” মিহি একটু দাড়াও।”
-” জ্বী ভাইয়া? কিছু বলবেন?”
-“তোমার আপু তোমাকে একবার দেখা করতে বলেছে।”
-” কাপরগুলো ছাদে দিয়ে আসি?”
-” আর্জেন্ট বলেছে। আচ্ছা দেখা করিও। আমার একটু কাজ আছে আমি যাই।”
-” জ্বী আচ্ছা। ”

রুম থেকে বের হতেই ওয়াসিফ মিহি ও মৃদুলকে দেখতে পেল। এসেই মিহির বলা”কাপরগুলো ছাদে দিয়ে আসি?” শুনতে পায়। কি ভেবে যেন ঠোঁট কামড়ে হাসলো সে। পিছু নিল মিহির।

ছাদের পূর্বপাশে টানানো রশিতে কাপর মেলে দিচ্ছে মিহি। রৌদের তেজি আলো সরাসরি চোখে,মুখে পরছে তার। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে যাচ্ছে। ভেজা চুল থেকে তোয়ালেটা ছাড়িয়ে দুএকবার ঝেড়ে নিল সে।তোয়ালেটা ফের রশিতে মেলে ঘুরাতেই দেখতে পেল পশ্চিমপাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটা। মিহির প্রিয় কৃষ্ণচূড়া ফুল। লাল রক্তে দণ্ডিত সবুজের মাঠ। দেড়ি না করে দ্রুত ছুটে গেল সেখানে। পূর্বপাশটায় তেজি রোদ থাকলেও পশ্চিমপাশটায় রোদ নেই। কৃষ্ণচূড়া গাছের জন্য ছায়াতল হয়ে আছে এদিকটা। ফুলপ্রেমী মিহি এক তোড়া কৃষ্ণচূড়া ফুল ছোঁয়ে দেখল। হাতে স্পর্শ করতেই মনে যেন এক প্রশান্তি শুরু করলো তার। মেজাজ, মন হয়ে গেল ফুরফুরে। ভাবনায় পড়ে বলতে শুরু করল-

হতে পারো তুমি নৃত্য পাগল ছন্দে উত্তাল
কৃষ্ণচূড়ার ডগায় নাচো।
আমি কিন্তু কবিতা,শিরোনামহীন বসন্তের অভিযাত্রী
কোকিলের পলকে হারিয়ে যাওয়া মৃদু অভিবাসী।
প্রিয় কৃষ্ণচূড়া ফুল!

ছাদের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াসিফ। প্রশস্ত বুকে দু হাত আড়াআড়িভাবে রাখা। নির্নিমেষ দৃষ্টি মিহির দিকেই নিবদ্ধ। কৃষ্ণচূড়া ফুল কেউর এত পছন্দ হতে পারে? ভাবলো ওয়াসিফ। সে অবশ্য জানে মিহি যে ফুলপ্রেমী। সব ফুলই নাকি তার পছন্দ। তবে প্রিয় ফুল কৃষ্ণচূড়া আর কাঠগোলাপ। সকালে ঈশার সাথে মিহি যখন বাগানে হাটতেছিল ওয়াসিফ তখন রুম থেকে তাদের পর্যবেক্ষণ করছিল। তারপর কলেজ যাওয়ার আগে ওয়াসিফের সাথে দেখা হওয়ায় তখন ঈশা বলেছিলো মিহির পছন্দের ব্যাপারে। সেখান থেকেই ওয়াসিফের জানা। অদ্ভুত পছন্দ মিহির যা ওয়াসিফের বুজে আসে না।

মিহির বলা কবিতাটি স্পষ্ট শুনতে পায় ওয়াসিফ। ধীরেধীরে এগিয়ে আসে সে। মিহি এতটাই মগ্ন ছিল যে পেছনে কেউ আসার আওয়াজ তার কর্ণকুহরে প্রবেশই করলো না। ওয়াসিফ শীতল কন্ঠে শুধালো-
-“আমার দেখা মানুষগুলোর গোলাপ পছন্দ হয়। বিশেষ করে মেয়েদের। গোলাপ ফুল তো ফুলের রাণী। কিন্তু কৃষ্ণচূড়া ফুল কেউর এত পছন্দ হতে পারে?”
-“আমার কাছে গোলাপ নয়,কৃষ্ণচূড়া’ই সকল ফুলের রাণী।”

আনমনেই মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলেছে মিহি। পরমূহুর্তেই পুরুষালী কন্ঠ শুনে চমকে উঠে সে।চটজলদি পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে ওয়াসিফ দাঁড়িয়ে। ঠিক ওর পিছনেই। মিহি একপলক সেদিকে তাকিয়েই চোখ আবার ফিরিয়ে নেয়। একটা ফুল ছিঁড়ে তাতে হাত বোলায় সে। ওয়াসিফ একগাল হেসে মিহির সামনাসামনি রেলিংয়ে ঠেশ দিয়ে দাঁড়ায়। তার কিছু বলার আগেই মিহি ক্রুদ্ধ নয়নে তাকিয়ে বললো-“এখানে কি চাই?”
-“তোমাকে!”
বিস্মিত কন্ঠে মিহি শুধালো-“মানে?”
-” কিছুনা।”
-“পাগলামি কেন করতেছেন?”
-“ভালবাসাতে তো পাগলামি থাকবেই।”
এত সহজ সরল উত্তরটা যেন পছন্দ হল না মিহির। ঈষৎ রেগে বললো-“এটা ভালবাসা নয় মি.। কেন বুজতে চান না? এটা জাস্ট একটা fascination। মোহ। আজ বাদে কাল যখন চলে যাবো আপনার এই fascination কেটে যাবে। আর fascination কেটে গেলে আপনার এই পাগলামিও কেটে যাবে।”
-” It’s not fascination ok? it’s real and i love you… শুনছো তুমি? আমি তোমাকেই ভালবাসি! ”

ক্ষানিকটা রেগে গেল মিহি। বিরক্ত হয়ে বললো-” আবার সেই এক কথা।ধুর!”
বলেই চলে যেতে গেলে ওয়াসিফ মিহির হাতটা ধরে তার পথ আটকায়। মূহুর্তেই হাত ছেড়ে দিয়ে বলে-
–” জীবনে যতদিন বাঁচবো ঠিক ততদিন তোমাকে শুনতেই হবে,আমি তোমাকে ভালবাসি। ভীষণ ভালবাসি ইচ্ছেমতি । ”
-” একটা থাপ্পড় দিব। এই চারদিনে ভালবেসে ফেলেছেন? চারদিনে ভালবাসা হয়?”
থাপ্পড়ের কথা শুনে ওয়াসিফ ঠোঁট কামড়ে হাসলো বললো-“ভালবাসার জন্য কালের প্রয়োজন নেই,এক মূহুর্তেই যথেষ্ট।”

মাত্র ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হল মিহি। গায়ে ওড়না জরিয়ে রুম থেকে বের হতেই ঈশার সাথে দেখা হল তার। গেইট পেরিয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে আসলো ঈশা। কলেজ থেকে সবে ফিরেছে সে। মিহিকে দেখে মুচকিহেসে বললো-” চল, রেডি হও।”
চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বললো-“কোথায় যাবে?”
-” ঘুরতে যাবো।”
-“আমি যাবো না। তোমরা যাও।”
-“আমরা মানে?
-” তোমরা ভাইবোন কি আমারে বোকা পাইছো হুম? আমি জানি আমাদের সাথে তোমার ঐ নির্লজ্জ বেহায়া ভাই ওয়াসিফ চৌধুরীও যাবে।”
-“কে বলছে তোমাকে? বিশ্বাস কর আমি আর তুমি ছাড়া কেউ যাবে না।”
-“দুপুরে তোমার ভাইয়া বলেছিল বিকেলে ঘুরতে যাবে।আমি বলেছিলাম যাবো না। ওনি আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছে যে করেই হোক নিয়ে যাবেই। তবে তুমিই বল এটা কি তার plan এর মধ্যে পরেনা?”
থতমত খেল ঈশা। দুটো শুকনো ঢোক গিলে বললো-
-” এ এসবের কিছুই তো আমি জানি না। রুমে আসো ফ্রেশ হই আর ভাইয়া কি বলেছে বলো তো!”

দুপুরে মিহি চলে আসার সময় ওয়াসিফ ডেকে বললো
-” বিকেলবেলা রেডি থেকো।”
পিছন ফিরে মিহি শুধালো -“কেন?”
-“ঘুরতে যাবো।”
-“আমি,তাও আবার আপনার সাথে? আপনার মতো পাগল আমি?”
-“নাহ, আপনি পাগল নয়! আপনি পাগলি। ওয়াসিফের পাগলি।”
-“ফাজলামো বন্ধ করুন।”
-” আচ্ছা। কিন্তু কি যেন বলছিলে?”
-“কানে শুনতে পাননি বুঝি? আমি আপনার সাথে কোথাও যাচ্ছি না। শুনেছেন? ”
-“তুমি যাবে না তোমার…… নাহ কিছুনা। বিকেল হোক দেখা যাবে তুমি যাও নাকি না। শুধু আমরা দুজন যাচ্ছি না ঢুবলি মানে ঈশাও যাচ্ছে আমাদের সাথে।”
-” ঈশা যাবে যাক,আমার কি!
-“বেশি কথা বলো না। তুমি যাবে মানে যাবেই।”
-“চ্যালেঞ্জ করছেন?”
-“হ্যা চ্যালেঞ্জ কর…(থেমে ফের বলে)যদি মনে কর চ্যালেঞ্জ করছি তবে তাইই!

চলবে…..

(পর্বটা তিনবার করে লিখেছি।বারবার কেটে যাওয়ায় বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম এবং লেখাগুলো ধলাপেকে গেছে। দেরি হয়েছে বলে একটু বড় করে দিলাম।ভুল হলে সংশোধন করে দিবেন।ধন্যবাদ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here