খসে পড়া নক্ষত্র পর্ব- ০২ ও শেষ

#গল্প
#খসে পড়া নক্ষত্র
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী

সোহেলীর দুচোখ দিয়ে বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। ওর সাহেব ওকে অঝোরে কাঁদতে দিলো। কে জানে কত দিনের বিষাদের জল জমানো ছিলো বুকের গহীনে। দূরে সাগরের গর্জন আর চন্দ্রাকোলিত রাতে উত্তাল ঢেউয়ের জলরাশির অভূতপূর্ব দৃশ্য মনকে ভালো করে দেয়। সোহেলীও হয়তো এই কারনে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলো। সাহেব ওর দিকে তাকিয়ে আবারো বললো,
——এরপর কি হলো সোহেলী?
——তারপর ঐ ঘটনার পর কিছুদিন নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আব্বুর লোনের কারণে বাড়িতে টিকে থাকা দায়। লোকজন এসে খারাপ খারাপ কথা বলে। কেউ কেউ বলতো বাপ যখন টাকা দিতে পারে না তখন মেয়ের শরীর বেঁচে লোন শোধ করুক। তাও ওদের লোন শোধ করে দিতে হবে। এর মাঝে গুলশানের ঐ অফিস থেকে আবারও কল আসে। আমি রাজি হইনি। কিন্তু ওই লোক আমায় বলে,
——আপনি চাইলে তো আগের ফর্মে ফিরতে পারবেন না। আমাদের কাছে আপনার সেদিনের ভিডিও ফুটেজ আছে। ওটা ভাইরাল করে দিলে আপনি তো সমাজে মুখ দেখাতে পারবেন না। আপনার বয়স কম। এ লাইনে ভালো ডিমান্ড আছে। আপনি শুধু মাসে তিন থেকে চারটা ভিআইপিকে সময় দিলেই হবে।

অগত্যা ওদের প্রস্তাবে রাজি না হয়ে উপায় ছিলো না। আমি জানি এটা পাপের পথ। কিন্তু আমি এমন এক চোরাবালিতে আটকে গিয়েছি সেখান থেকে কিভাবে বের হবো, আদৌ কোনোদিন বের হতে পারবো কিনা আমি জানি না। তারপর থেকেই এখানে কাজ করি। আব্বুর লোন প্রায় শেষের পথে। দু,লক্ষ টাকা এখনও বাকি আছে। আমার এই টাকায় বাবা মায়ের সংসারের চাকাটা আবারও ঘুরতে শুরু করেছে। ভাইবোনগুলো লেখাপড়া করছে। তবে আমার পৃথিবীটা একদম ছোটো হয়ে গেছে। আমি এরপর থেকে কোনো পারিবারিক গেদারিং এ যাই না। যদি আমায় কেউ চিনে ফেলে। ভার্সিটিতেও আমি বোরখা পরে যাই। সবাই ভাবে আমি কত ধার্মিক। পর্দা করে চলি। এ যেন নিজের সাথে নিজের হিপোক্রেসি। এখন আমার নিজের উপর ঘৃণা হয়। আমি বহুবার আত্মহত্যা করতে চেয়েছি। কিন্তু পারিনি। এমনিতেই পাপের সাগরে ডুবে আছি। তারউপর আত্মহত্যা করে আর মহাপাপী হতে চাই না। বলতে পারেন জীবমৃত লাশ হয়ে বেঁচে আছি। সমস্যা হচ্ছে ইদানিং বাবা মা আমার বিয়ে নিয়ে খুব অস্থির। যদিও বলে দিয়েছি আমি কোনোদিন বিয়ে করবো না। বরং রুহেলীর বিয়েটা যেন ওরা দিয়ে দেয়।
—– তুমি যদি চাও আমি তোমাকে এ পথ থেকে বের হতে সাহায্য করতে পারি?
——শুধু শুধু আমায় স্বপ্ন দেখাবেন না। আমাদের মতো মেয়েদের স্বপ্ন দেখতে নেই। আমি ছাড়তে চাইলেও এই অফিস তো আমায় ছাড়বে না।
——ওটা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও। চেষ্টা করে দেখতে তো দোষ নাই।
সোহেলী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
—— আপনি কেন আমার জন্য এই প্যারাটা নিবেন?
——তারও কারণ আছে। আমারও একটা বিষাদের অতীত আছে। ব্যথার অতলান্তিক সাগরে আমি অবিরাম সাঁতার কাটছি। আমার মাও ছিলেন একজন সেক্স ওয়ার্কার। পতিতা পল্লীতেই আমার জন্ম। আমার বয়স যখন পাঁচ তখন আমার মা আমাকে এতিমখানায় দিয়ে দেয়। ওখান থেকে ডেনমার্কের এক নিঃসন্তান দম্পতি আমাকে তাদের কাছে নিয়ে যায়। মেয়ে হয়ে জন্মালে হয়তো আমাকে ঐ পতিতাপল্লীতেই থাকতে হতো। আমি বড় হয়ে মায়ের খোঁজে একবার ঐ পল্লীতে গিয়েছিলাম। তখন জানলাম আমার মা মারা গেছে। কবরটা দেখতে চাইলাম। ওরা বললো বেশ্যাদের কবর হয় না। তাই পদ্মার জলে ভেলায় করে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এ কথা শুনে বুকের ভিতরটা ব্যথায় মোচড়াতে লাগলো।
আমি ডেনমার্কে এমবিএ কমপ্লিট করেছি। এখন আমার পালক বাবার কোম্পানীর সিইও। আমার পালক পিতা মাতা কেউ আজ বেঁচে নেই। ওদের সমস্ত সম্পত্তি মৃত্যুর আগে আমার নামে উইল করে দিয়েছে। বর্তমানে আমি অঢেল সম্পত্তির মালিক। আমার স্মৃতিতে এখনও স্পষ্ট হয়ে আছে বেদনায় নীল হয়ে থাকা আমার মায়ের মুখ। যদিও বিদেশে প্রচুর স্বাচ্ছন্দে আমি বড় হয়েছি কিন্তু একটা দিনের জন্য আমার মায়ের সেই মুখচ্ছবি আমি ভুলতে পারিনি। আপনি জানেন আমারই সামনে আমার মাকে ঐ কাজ করতে হতো। খদ্দেররা আসলে মা আমাকে রুমের দরজার বাইরে বসিয়ে রাখতো। তারপর কাস্টমার চলে গেলে আমি ঘরে গিয়ে মায়ের যন্ত্রণায় ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাওয়া মুখটা দেখতে পেতাম। তাই যখন আমি এই যন্ত্রণার কারণ বুঝতে শিখেছি তখন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার মায়ের মতো নারীদের এই অন্ধকার জগত থেকে ফিরিয়ে এনে আলোর পথ দেখাবো।
সোহেলীর কাছে মনে হলো এ যেন মানুষ নয় ফেরেস্তা। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। পাখির কিচির মিচির ডাকে এই শহরটা যেন আস্তে আস্তে জেগে উঠছে। সাহেব সোহেলীর দিকে তাকিয়ে বললো,
——-চলেন সূর্যোদয় দেখি।
সোহেলী বোরখাটা পরে সাহেবের সাথে সাগর পাড়ে এসে দাঁড়ালো। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে ও প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলো। আর মনে মনে ভাবতে লাগলো ও কি সত্যি এই পথ থেকে বের হতে পারবে?

এরপর ঢাকায় ফিরে সাহেব টাকার বিনিময়ে সোহেলীকে ঐ অফিস থেকে ছাড়িয়ে আনলো। এবং ওর বাবার লোনগুলো শোধ করলো। সোহেলীকেও বেশ কিছু টাকা দিলো ও যেন স্বাধীন কোনো ব্যবসা করতে পারে। এরমধ্যে সোহেলীর গ্রাজুয়েশন শেষ হলো। না সোহেলী আর এই শহরে থাকেনি। ও টাকা নিয়ে ওদের গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরে চলে যায়। যেখানে ওকে কেউ চিনবে না। ওর কলঙ্কিত অতীতটা কেই ঘাঁটবে না। সেখানে কিছু অসহায় মেয়েদের সাথে নিয়ে বুটিকস এর কাজ শুরু করে। সাহেব ডেনমার্কে ফিরে যাওয়ার আগে দিনাজপুরে সোহেলীর সাথে দেখা করতে আসে।
——কেমন আছো সোহেলী?
——অনেক ভালো আছি। আপনার এই ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারবো না ভাইয়া।
——ভাই বলে যেহেতু ডেকেছো তাহলে তুমি বলেই ডাকো। তুমি ডাকটা অনেক আপন লাগে। যখনি কোনো বিপদে পড়বে তোমার এই পরবাসী ভাইটাকে ডেকো।
—–অবশ্যই ডাকবো। এভাবে আমাদের মতো নারীদের জন্য তুমি আলোকবর্তিকা হয়ে বারবার ফিরে এসো।
——আসি বােন। গুড বাই।
সোহেলীর চোখদুটো আবারও জলে ভরে উঠলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here