খসে পড়া নক্ষত্র পর্ব- ০১

#গল্প
#খসে পড়া নক্ষত্র
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

সোহেলী আজ যার কাছে এসেছে সে অন্যান্য খদ্দেরদের মত নয়। একটু অন্য রকম। তিন দিনের কন্ট্রাকে সে এয়ারে করে এই সাহেবের সাথে কক্সবাজারে এসেছে। হোটেল কক্সহলিডে তে উঠেছে। সোহেলীকে রুমে রেখে ঐ সাহেব বেরিয়ে যান। মাঝে মাঝে ওর কপালে এমন খদ্দের জোটে জানোয়ারের মত শরীরটাকে খুবলে খায় আর পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠে। অথচ এই সাহেবটা ওর দিকে এখন পর্যন্ত ভালো করে তাকায়নি। যাইহোক সোহেলীর কাছে আজ মনে হয় জীবনের সব কিছুই ভুল। সংসারের চোরাস্রোতে ওর পা দুখানা আঁটকে গেছে। কেউ ওকে এখান থেকে উদ্ধার করতে পারবে না। প্রবাদ আছে পাপকে ঘৃনা করো পাপিকে নয়। আর যে জেনে শুনে পাপ করে সেতো জ্ঞান পাপী। এই পাপের পথে অর্থ উপার্জন করতে ওর ভালো লাগে না। ও জানে এ পাপের কোনো ক্ষমা নেই। তারপর ও আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করে ও যেন এখান থেকে বের হতে পারে।
যদিও এ লাইনে যারা কাজ করে তারা বলে এখানে ঢোকা সহজ কিন্তু বের হওয়া কঠিন। দরজায় নক করার শব্দে ভাবনার জগৎ থেকে সোহেলী ফিরে আসলো। তাকিয়ে দেখে সাহেব হাতে কিছু খাবারের বক্স নিয়ে ফিরে এসেছে। সোহেলীর দিকে তাকিয়ে বললো,
——-আপনি ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমরা একসাথে ডিনার করবো।
সোহেলী ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে পাতলা লাল রঙের নাইটি পরে রুমে আসলো। ওকে দেখে সেই সাহেব বলে উঠলো,
——আপনি একটু শালীন পোশাক পরে আসুন।
সেহেলী মনে মনে ভাবলো একটু পরেই তো জানোয়ারের মতো ছিঁড়ে কুঁড়ে খাবে। তার আবার শালীন পোশাক। বেশ্যাদের ও আত্মসম্মানবোধ থাকে। অগত্যা সোহেলী ওয়াশরুমে গিয়ে একটা ফতুয়া আর জিন্স পরে আসলো। তারপর দুজনে ডিনার করে হোটেলের বারান্দায় ওর সাহেব বসলো। সেহেলীও আর একটা চেয়ার নিয়ে সাহেবের পাশে একটু ঘনিষ্ট হয়ে বসলো। সাহেব একটু সরে গিয়ে সোহেলীকে বললো,
—–রুমে ফ্লাক্সে কফি বানানো আছে। দুটো মগে ঢেলে আনলে ভালো হয়। কফি খেতে খেতে এই চাঁদনিরাত উপভোগ করা যাবে। তারসাথে ঐ দূরে সমুদ্রের বিশাল ঢেউয়ের সাথে ওর গর্জনও শুনতে পারবেন। আমার সমুদ্র ভীষণ ভালো লাগে। সমুদ্রের কাছে আসলে ওর বিশালতাকে আমি উপভোগ করি। নিজেও আরো উদার হতে শিখি।
সোহেলী ওর এই কর্মে আজ অবধি এরকম কাস্টমার পায়নি। সোহেলীর নিজের সৌন্দর্যের উপর খুব আস্থা আছে। যে একবার ওর সঙ্গ পেয়েছে সে আবার ওকে কল করেছে। সোহেলী বরং এড়িয়ে যেতো। কারণ পরিচিত হয়ে গেলে ওরা রেটটা ঠিক মতো দিতে চায় না। একটু গড়িমসি করে। আসলে এ লাইনে প্রেমভালবাসা বলে কিছু থাকে না। তাই ও নিজের রেটটা ঠিকমতো আদায় করে নেয়। এখানে ও এই সাহেবের কাছে তিনদিনের জন্য পঞ্চাশহাজার টাকা অগ্রিম নিয়েছে। উনিও কোনো ঝামেলা করেননি। সোহেলীর ডিমান্ড অনুযায়ী পুরো টাকাটা একবারেই দিয়ে দিয়েছে।
দুটো মগে কফি নিয়ে এবার সোহেলী সাহেবের সাথে একটু দুরত্ব রেখেই বসলো। সাহেব কফিতে চুমুক দিয়ে বললো,
——সোহেলী নামের অর্থ কি জানেন?
——এতো আমারই সাবজেক্ট। আর এর অর্থ আমি জানবো না তা কি করে হয়? সোহেলী অর্থ নক্ষত্র কিংবা তারা। আমি অবশ্য খসে পড়া মৃত তারা।
—–আপনার সাবজেক্ট মানে বুঝলাম না?
——আমি বাংলায় পাবলিক ভার্সিটিতে অনার্স পড়ি।
—–ভেরী গুড।কোন ভার্সিটি?
—–নামটা বলতে চাইছি না।
—–কিন্তু আপনি এ লাইনে কেন? আপনার সামনে তো অনেক রাস্তা খোলা আছে। আপনি অনার্স পাশ করে টিচিং প্রফেশনে যেতে পারেন। কিংবা কোনো এনজিওতে চাকরি করতে পারেন।
—–এ লাইনে কোনো মেয়ে ইচ্ছে করে আসে না। যাদের কপাল খারাপ তাদেরকে এখানে আসতে হয়। অর্থাৎ কিছু নরপশু বাধ্য করে এ লাইনে কাজ করতে।
——আমি কি শুনতে পারি আপনার জীবনের গল্প?
——আপনার বিরক্ত লাগতে পারে।
——একদম না। আমি কিছু অনলাইন সাহিত্য পেজে লেখালেখি করি। আপনার গল্পটা হয়ত আমার লেখার প্লট হতে পারে?
সোহেলী অগত্যা ওর এই অন্যরকম খদ্দেরকে নিজের জীবনের কাহিনী বলতে শুরু করলো। প্রথমে ও কিছুটা নিরব থেকে কথাগুলো গুছিয়ে নিতে লাগলো। আসলে সোহেলী কোথা থেকে শুরু করবে কোথায় গিয়ে শেষ করবে বুঝতে পারছে না। ওর নিরবতা দেখে সাহেব বললো,
——আপনার সমস্যা থাকলে বলতে হবে না।
——না কোনো সমস্যা নেই। আসলে আমি যে এলাইনে কাজ করি এটা আমার পরিবার জানে না। তারা জানে আমি একটা এনজিও তে চাকরি করি। যাইহোক ঘটনার শুরু চারবছর আগে। আমি নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। আমার মা বাবা সহ ছয় জনের সংসার। সে সময় আমরা মিরপুর বারো নম্বরে থাকতাম। আমার বাবার মিরপুর এগারো নাম্বারে কাপড়ের দোকান ছিলো। অনেক মানুষের কাছে লোন নিয়ে বাবা এই দোকানটা চালু করে। কিন্তু আমাদের কপাল মন্দ। ব্যবসাটা চালু হতে না হতে করোনার সময় শুরু হলো। দোকান পাঠ সব বন্ধ হয়ে গেল। এভাবে ছ,মাস যাওয়ার পর পাওনাদারেরা টাকার জন্য বাসায় ভীড় জমাতে লাগলো। ওদেরই বা কি দোষ। ওদের হাতেও টাকা নেই। বাবা কিছুদিন আজ দিবো কাল দিবো বলে ঘোরাতে লাগলো। আমি তখন কেবল এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। টাকার অভাবে ভর্তি কোচিং করতে পারিনি। গাইড কিনে প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম। আমার ছোটো বোন ক্লাস টেন এ পড়ে। তার ছোটো বোনটা সেভেন এ পড়ে। আর ছোটো ভাইটা তখন ফাইভে পড়তো। ওদের পড়াশোনাও টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে গেল। আব্বা অগত্যা দোকানের মালগুলো পানির দরে বিক্রি করে লোন শোধ করতে লাগলো। এতে কেবল অর্ধেক লোন শোধ হলো। তখনও বাজারে আব্বার দশলক্ষ টাকা লোন বাকি ছিলো। এরমাঝে যারা টাকা পায়নি তারা আব্বুকে একদিন রাস্তায় খুব করে পেটালো। সেদিন রক্তাক্ত হয়ে আব্বু ঘরে ফিরে আসলো। আমি আব্বুর এ অবস্থা দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। কোনো উপায় না দেখে অনলাইনে চাকরির জন্য সিভি ড্রপ করতে লাগলাম। আসলে আমার মাথায় ছিলো না ইন্টারপাশ করে তেমন কোনো ভালো চাকরি পাওয়া যায় না। প্রায় একশত সিভি ড্রপ করার পর একদিন একজায়গা থেকে কল আসলো। আমার তখন মনে হলো আমি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। তারা আমাকে গুলশানে তাদের অফিসে দেখা করতে বললো। আমি নিদিষ্ট দিনে তাদের সাথে সাক্ষাত করলাম। আমাকে তারা তেমন কিছুই জিজ্ঞাসা করেনি। শুধু নামটা জানতে চেয়েছে। আর পড়াশোনা বাদ দিয়ে চাকরি কেন দরকার সেটা জানতে চেয়েছে। আমিও সরল মনে তাদের কাছে আমার পরিবারের কথা শেয়ার করলাম। ওখানে যিনি বস টাইপের ছিলেন উনি আমাকে বললেন, আমি যদি মনোযোগ দিয়ে কাজটা করি তাহলে প্রতিমাসে আমার তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা আয় হবে। আমি সেই খুশীতে কাজটা কি সেটাই ওদের তখন জিজ্ঞাসা করিনি। ওরা আমাকে জানালো কাজের অর্ডার আসলে আমাকে ফোন করবে। যাইহোক বাসায় এসে যখন আব্বু আম্মুকে বললাম চাকরির কথা উনারাও কাজের কথা কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। আসলে অভাব অনটনে আমাদের ভিতর থেকে সেসময় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে গেছে। আমাদের পরিবারের সবাই তখন যে কোনো মুল্যে বাঁচতে চাইছিলাম। আমরা প্রতিদিন তখন একবেলা খাবার খেতাম। ভাতটা জাউ করে লবন দিয়ে রান্না করা হতো। তার সাথে কখনও পিয়াজ ভর্তা কখনও আলু ভর্তা দিয়ে খাওয়া হতো। আমি ফোনের অপেক্ষা করতে লাগলাম। একমাসের মাথায় গুলশানের ঐ অফিসটাতে যাওয়ার জন্য আমাকে কল করে জানানো হলো। আমিও দুরু দুরু বুকে সকাল ন,টায় অফিসে হিয়ে হাজির হলাম। ওরা আমাকে ওয়েটিং রুমে বসতে বললো। একজন পিয়ন এসে আমাকে এককাপ কফি দিয়ে গেল। ঘন্টাখানিক পর একজন খুব স্মার্ট বয় আমাকে বললো আমার কাজের শিডিউল উত্তরাতে। সুতরাং উনার সাথে আমার উত্তরাতে যেতে হবে। আমি কোনদিন উত্তরার ওদিকটায় তখনও যাইনি। একটু ভয় ভয় লাগছিলো। যাইহোক আমি তার পিছু পিছু পাজেরো জীপে উঠে বসলাম। গাড়ি ফ্লাইওভার দিয়ে এগিয়ে চলছে। এমন জায়গায় গাড়িটি এসে থামলো সেটা একটা ফাইভস্টার হোটেল। আমাকে নিয়ে একটা রুমে বসালো। আমি রুমে ঢুকে দেখি আমার বাবার বয়সি একজন পুরুষ মানুষ বসা আছে। যার সাথে এসেছিলাম সে আমাকে রুমে পৌঁছে দিয়ে দরজা লক করে চলে গেল। তারপর যা হবার তাই হলো। এইটুকু বলে সোহেলী ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। কিছুক্ষণ কাঁদার পর বললো, জানেন সেদিন উনার কাছে আমি অনেক কাকুতি মিনতি করেছি। কিন্তু আমার প্রতি উনার একটুও দয়া হয়নি। অবশ্য যাওয়ার সময় আমার যে রেট ছিলো তার থেকে ডাবল রেট দিয়েছে। টাকাগুলো নিতে প্রথম খুব ঘেন্না হচ্ছিলো। কিন্তু জানেন আমি একসাথে অতগুলো টাকা দেখে ক্ষণিক যেন নিজের এতোবড় ক্ষতির কথা ভুলে গেলাম। এরপর কোনোরকমে নিজেকে সামলে টাকাগুলো নিয়ে ঐ রুম থেকে বের হয়ে একটা সিএনজি নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। ওয়াশরুমে গিয়ে সাবান দিয়ে গোসল করে নিজের পাপের দাগ উঠাতে লাগলাম। কিন্তু শরীরে যে কলঙ্কের দাগ একবার লেগে যায় পৃথিবীর কোনো সাবান কিংবা ডিটারজেন্টে সে দাগ মুছে না।
আমি আম্মুর হাতে দশহাজার টাকা তুলে দিলাম। আম্মু টাকাটা হাতে পেয়ে মনের সুখে বাজার করলো। পোলাও রোস্ট গরুর ঝাল মাংস রান্না করলো। কিন্তু একটা খাবারও আমার গলা দিয়ে নামেনি। ছোটো ভাইবোনগুলো তৃপ্তি করে খেয়েছে। আর আমার ভিতরে আমার আমিটা পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য ওদের খাওয়া দেখে একলহমায় কষ্টগুলো যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ওদের তো দোষ নেই। আমার পরিবারের মানুষ জানে এনজিওতে টাকাটা আমাকে অগ্রিম দিয়েছে।
বাকি দশ হাজার টাকা নিজের কাছে রাখলাম। সামনে আমার ভর্তি পরীক্ষা। এর মাঝে পরীক্ষা দিয়ে ভার্সিটিতে চান্স পেলাম। এবং আমার সতীত্ব বিক্রি করা টাকা দিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম।
সোহেলী আবার নিরব হয়ে গেল। রাতের নিরবতায় দূরে পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা যায়। করুন সুরে নাম না জানা একপাখি ডেকে চলেছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here