❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[১০]
মানব মন বড়ই অদ্ভুত। কখন কী প্রত্যাশা করে বোঝা দায়।
মেধার ক্ষেতেও ঠিক তাই’ই ঘটেছে। যাকে তার পছন্দই নয়, যার উপস্থিতি বিরক্তের কারণ। যার ভালো-মন্দ কোনো কর্ম ওর সহ্য হয় না। অথচ সময়ের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে ভাবতে
হচ্ছে, চিন্তা করতে হচ্ছে। তার অপরাধী নিবোর্ধ মন ভাবতে বাধ্য করছে। পক্ষান্তরে এটা হওয়ার কথা ছিল না তবুও তা
হচ্ছে। আদিত্যের কারণে সে পুড়ছে, ব্যাকুল হচ্ছে। অজানা আশঙ্কায় ছটফট করছে।এটা ঠিক সে বর্তমানে আদিত্যকে পছন্দ করে না, সহ্য করতে পারে না। তবে সে বিপদে পড়ুক, কষ্ট পাক, এসব কখনোই চায় না। চায়তে পারেও না।আর না চাওয়ার কারণ আদিত্যকে ভালো করেই চিনে, জানে। ছোট থেকে দেখে আসছে ওই ত্যাড়া মানুষটাকে। সে এটাও জানে,
বিগত কয়েক বছর ধরে মনে প্রাণে তাকে ভালোবাসে। সেই
ভালোবাসা আড়াল রাখতে তিক্ত কথার বাণ ছুড়তেও পারে।
পরক্ষণেই কথার খোঁচাতে তার হৃদয়খানা খুঁচিয়ে পরে প্রণয় বাক্য দ্বারা সারিয়েও তুলতে পারে। ওর অভিমানী রুপ দেখে মিটিমিটি হাসতে পারে। গোপনে গোপনে খুব ভালোবাসতে
পারে। তার বুদ্ধিদীপ্ত নেত্রজোজায় ফুটিয়ে তুলতে পারে তার প্রণয়কাঙ্খার গভীরতা। অথচ সে সব জেনে বুঝেও অবুজ।
কারণ সেই অপছন্দের পুরুষটাকে সে ভীষণভাবে জ্বালাতে চায়, পুড়াতে চায়।প্রণয়ের অনলে দগ্ধ করে ছটফটিয়ে মেরে
পুনরায় সারিয়ে তুলতে চায়। সেই সঙ্গে নিতে চায় ওর অসীম ভালোবাসার পরীক্ষা। মাপতে চায় ধৈর্য্যের সীমা-পরিসীমা।
তবেই না শান্তি! যদিও একটা সময় আদিত্যের সব কার্জকর্ম তাকে মুগ্ধ করতো। গোপনে ভীষণ পছন্দ করতো ওই ত্যাড়া মানুষটাকে। নিগূঢ় ভালোলাগায় আষ্টে পিষ্টে লেপ্টে ছিল ওই মানুষটার নাম। কিন্তু কিছু কারণে সে পছন্দের মানুষটা হয়ে
গেছে অপ্রিয় কেউ। এর জন্য আদিত্যই দায়ী। কিছু কারণে কষ্ট পেয়ে মেধা সমস্ত মুগ্ধতাকে বিরক্ত দ্বারা আবৃত করেছে।
সেই সঙ্গে সর্বসম্মুখে এটা বুঝিয়েছে আদিত্য ওর অপছন্দের মানুষ….! তাকে বিয়ে করা তো দূর একদন্ত বসে গল্প করাও যায় না। মূখ্য কথা আদিত্য এসবের যোগ্যই না। অথচ আজ অপছন্দের মানুষটার বিপদের আশঙ্কায় মনটা উতলা হয়ে উঠেছে। কেন জানি চক্ষু লজ্জাও কাজ করছে না। বাসাসুদ্ধ মানুষ কে কী ভাববে তার পরোয়াও করছে না। মস্তিষ্ক শুধু ঘুরছে আদিত্যের সুস্থ কামনা। আজ এই মুহূর্তে মন কোনো
কারণ বারণও শুনছে না। বরং তাকে সায় দিচ্ছে আদিত্যকে কল করে খোঁজ নিতে। একটাবার তার মুখে শুনতে, ‘আমি ঠিক আছি।’
কিন্তু বিবেক যে বলছে অন্য কথা। যেমন গতরাতে ওই রকম একটা ব্যবহার দেখিয়েও ‘সরি’, বলার প্রয়োজন মনে করে নি আদিত্য। মুখ ফুটে বলেও নি তার ভুল হয়েছে। মূখ্য কথা আদিত্যের থেকে সে এমন কিছু আশা করে নি। অথচ…..!!
আপাতত এসব ভাবনা ছেদ ঘটিয়ে সে সরাসরি আদিত্যের নাম্বারের কল দিলো। ওর চিন্তাকে দ্বিগুন বাড়াতে ফোন বন্ধ পেলো। একবার দুইবার করে কল দিতেই থাকলে একের পর পর। কিন্তু প্রতি বারই ব্যর্থ হলো। মেধা একরাশ চিন্তায় ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। রিমি আর সাথী চিন্তা করতে নিষেধ করছে। সূচী তাকে হাঁটতে যেতে জোরাজোরি করেও লাভ হলো না। অবশেষে তারা বাধ্য হয়ে চলেই গেল।শুনিয়ে গেল কিছু খোঁচা মারা কথাও।আপাতত মেধার ধ্যান ফোনেই সীমাবদ্ধ।সে রিমির কথা শুনলেও গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন
করলো না। সে পায়চারি করতে করতেই এখনো কল করেই যাচ্ছে। কিন্তু বার বার ব্যর্থ হয়ে এবার সে দৌড়ে চলে গেল বাসার ভেতরে।রান্নাঘর থেকে সীমা বেগমের হাত টেনে নিয়ে গেল পাশের রুমে। তার চোখের মুখের এ অবস্থা দেখে সীমা বেগম আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
-”মেধা, মা আমার, কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন তুই, কেউ কী কিছু বলেছে?”
-”তোমার ছেলের ফোন ধরছে না।”
-‘কি আশ্চর্য এজন্য তুই কাঁদছিস?”
-”এত কথা জানি না তুমি খোঁজ নাও তার।”
-” আমার ছেলেকে নাকি ভালোবাসিস না বিয়েও করবি না। তবে তার বিরহে এত ব্যাকুল কেন আম্মাজান?”
-”মামনি প্লিজ তোমার ছেলের খোঁজ এনে দাও, আমার মন কু-ডাকছে। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না, শান্তিও পাচ্ছি
না একদন্ত। ”
একথা বলতে বলতেই সে লজ্জা ভুলে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
ওর এহেন ব্যবহারে সীমা বেগমও হতবাক। এই মেয়ের হঠাৎ কী হলো? মেধা তো এমন করার মেয়ে নয়, তবে? এটা ভেবে
উনি না দাঁড়িয়ে ব্যস্ত পায়ে ছুটলেন নিজের ফোনটা খুঁজতে।
তারপর উনিও আদিত্যকে ফোন দিতেই থাকলেন। ফলাফল
শূন্য। এদিকে মেধার কান্নার শব্দ শুনে বাসার সবাই উপস্থিত হলেন রুমে।ধীরে ধীরে সবাই জেনেও গেলেন আদিত্য ফোন ধরছে না। একথা শুনে সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো।
এভাবে সময় গড়িয়ে সন্ধ্যা পেরিয়ে গাঢ় রাত ঘনিয়ে এলো।
এবার সীমা বেগমও ছেলের খোঁজ-খবর না পেয়ে পেশার বাড়িয়ে ফেললেন। আদিত্যের বাবা দারোয়ানকে ফোন করে জানলেন, আদিত্য সকালে বেরিয়েছে এখনো বাসায় ফিরে নি। যদিও তার ফেরার কথা না কারণ সে সিলেট গেছে। ওই মুহূর্তে আদিত্যের বাবা জানালেন আদিত্য সিলেটে যায় নি।
বাসায় নেই, অফিসে নেই, সিলেটও যায় নি আবার ফোনটা বন্ধ। এ খবর শুনে বিয়ে বাড়ির আমেজ মুহূর্তে বদলে গেল।
মেধা রুমে গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে তার হেঁচকি উঠে গেছে। এত কান্নার কারণ সে ও জানে না। শুধু জানে তার ভয় হচ্ছে, হারিয়ে ফেলার ভয়। ওই মানুষটা যেমন আছে, তেমন থাকুক, তবুও চোখের সামনেই থাকুক।
সে আর খোঁচা মেরে কথা বলবে না, রাগ দেখাবে না, তবুও সে ফিরে আসুক।
এসব ভাবনা ওকে আরো ব্যাকুল করে দিলো। সময় গড়িয়ে ঘন্টার পেরোতে থাকল। তবুও কেউ আদিত্যের সন্ধান বের করতে পারল না। তখন এক পড়শী জানালো তার বড় ভাই নাকি কেবল সিলেটের রাস্তা দিয়ে বাসা গেল। সে নাকি বড় রাস্তায় এক্সিডেন্ট হতে দেখছে। একটা প্রাইভেট কারের সঙ্গে ট্রাক এক্সিডেন্ট করেছে। ওই রাস্তা বন্ধ করে দেওয়াতে ঘুরে আসতে হচ্ছে। উনি একথা শুনে আদিত্যের মা আর মেধার কান্না বেড়ে গেল। তারা দু’জনেই গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হলো। আদিত্যের বাবাও উনাদের সঙ্গে পা বাড়াতেই দরজার কাছে মুখোমুখি হলো আদিত্যের। সে কেবল গাড়ি থেকে দরজায় পা রেখেছে। তাকে এই মুহূর্তে এখানে দেখে
সকলেই হতভম্ব। মেধা অশ্রুসিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। সে আদিত্যের পুরো শরীরে চোখ বুলিয়ে অক্ষত অবস্থায় দেখে
আগে শুকরিয়া করলো। তারপর বিনাবাক্যে সেখানে থেকে সরে রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে দিলো। অঝরে কেঁদে মনটাও
শান্ত করার বৃর্থা চেষ্টা চালালো। এই রুম থেকেই অনেকেরই কথা শোনা যাচ্ছে। সীমা বেগম বকছে আদিত্যকে। আদিত্য তার মাকে কিছু বলে বোঝানোর চেষ্টা করছে। বোধহয় ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ সীমা বেগমের গলার স্বর দ্বিগুন বেড়েছে। উনি
দু’একটা মেরেও দিয়েছেন আদিত্যের পিঠে। বড় মামা সুন্দর ভাবে উপদেশ দিয়ে স্থান ত্যাগ করেছে। সবাইকে এত চিন্তা করতে দেখে তখন আদিত্য জানাল, তার সিলেটে যাওয়ার প্রয়োজন হয় নি। এখানে থেকেই কাজ হয়ে গেছে। পরে কী জানি ভেবে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা বাদ দিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। আসরের নামাজ মসজিদে আদায় করার সময় ফোন বন্ধ করেছিলো। পরে আর ফোনের কথা স্মরনে আসে নি তাই বন্ধ পেয়েছে। এই কথা শুনে সবাই স্বাভাবিক হলো, গালগল্পে মজে গেল।ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পূর্বের মতো হয়ে গেল। তবে সীমা বেগম ছেলের সঙ্গে আর একটা বাক্য বিনিময়ও করলেন না। ভীষণ রেগে দ্রুত’ই প্রস্থান করলেন।
প্রথম প্রথম মেধার ব্যাকুলতা দেখে খুশিই হয়েছিলেন। পরে সময় গড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলের কোনো খবর না ভীষণ ভয় পেয়েছেন। ছেলের চিন্তায় অন্তর আত্মা শুকিয়ে গিয়েছিলো উনার। যদি কিছু একটা হতো, তখন? আম্মুকে যেতে দেখে
আদিত্যও আর কথা না বাড়িয়ে সূচির দেখিয়ে দেওয়া রুমে ফ্রেশ হতে গেল। সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই দেখে রিমি আর সাথী ওর বিছানায় বসে আছে। দু’জন মিলে ফিসফিস করে কীসব বলছেও। তাকে দেখে দু’জনেই চট করে দাঁড়িয়ে গেল। অহেতুক হেসে একে অপরের দিকে আদিত্যের হাতে একখানা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে দৌড়ে পালালো। আদিত্য ভ্রু কুঁচকে কাগজ খুলে দেখে সেখানে লেখা, ”রুমে আসুন, কথা আছে।”
কার লেখা তার বুঝতে বাকি নেই। তাই আদিত্য মাথাটা মুছে তোয়ালে বেলকনিতে মেলে দিয়ে রুম থেকে বের হলো। তার উদ্দেশ্য তৃষ্ণা মেটানোর, চোখের তৃষ্ণা, মনের তৃষ্ণা। কয়েক ধাপ এগোতেই ওর দেখা হয়ে গেল সীমা বেগমের সঙ্গে। উনি
আদিত্যকে খেতে বসতে বলে নিজেই খাবার বেড়ে দিয়ে ধপ করে বসলেন আদিত্যের পাশের চেয়ারে। তারপর বললেন,
-”মেয়েটাকে এভাবে না কাঁদালেও পারতে।”
-”কোন মেয়ের কথা বলছো?
-”মেধার কথা বলছি।”
-”আমি ওকে কখন কাঁদালাম? ওর সঙ্গে দেখা তো দূর এখন অবধি কথাও হয় নি।”
-”দেখা, কথা, কোনোটা হয় নি বলেই তো কেদেঁছে। হারানোর ভয়ে লাজ-লজ্জা ভুলে আজ বাসাসুদ্ধ সকলের সামনে শুধু তোমার জন্য কেঁদেছে। মেয়েটা তোমাকে ভালোবাসে বাবা।”
-”দারুন জোক্স বললে তো।”
-”বে’ য়া’ দ’ ব আমি তোর মা। তোর সঙ্গে এই ব্যাপারে জোক্স করবো?”
-”আচ্ছা মানলাম জোক্স করছো না। তবে এটা বিশ্বাস যোগ্য কিছু বললে না। এখন অবধি, মেধা আমার সঙ্গে নরম সুরে কথা তো দূর সুন্দর ভাবে তাকায়ও না। সবসময় রুড বিহেভ করে। ভালো মন্দ যা বলি খ্যাক খ্যাক করে ওঠে। মুখে যখন যা আসে তাই বলে ফেলে। চটলো নাকি ফাটলো কিছুর ধার ধারে না সে। আর তুমি বলছো ভীষণ কেঁদেছে আমার জন্য। এটা বিশ্বাস করার মতো কথা না আম্মু। তাই বিশ্বাস করলাম না আমি। তবে আমি যদি মারা যায়, বোধহয় সেই সবচেয়ে বেশি খুশি হবে।”
আদিত্যের কথা শুনেও সীমা বেগম বেশি কিছু বললেন না।
নিঃশব্দে উঠে গেলেন ছেলের পাশ থেকে। আদিত্য খাওয়া শেষ করে মেধার ঘরের দিকে একবার তাকিয়ে রুমে চলে গেল। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে দশটা। আর রাত দশটা গ্রামে
এখন অনেক রাত। রাত বাড়ছে বিধায় বাসার সকলেই ধীরে ধীরে ঘুমাতে চলে গেছে। আদিত্য কিছু একটা ভেবে রুমের দরজা খোলা রেখে রুম অন্ধকার করে শুয়ে পড়লো। তবে ঘুম আসছে না। যার কারণে এতদূর ছুটে এসেছে তার দেখা পেলো না। মন যে শুধু তাকেই খুঁজছে। বেশ কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে আদিত্য উঠে দাঁড়াল। গ্লাস থেকে পানি খেয়ে বাঁ দিকে ঘুরতে কেউ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তখনই অনুভব করলো বুকে ধারালো ছুড়ি ঠেকানো। আদিত্য অনড়
হয়ে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ রইল। কারণ নড়লেই বুকে খোঁচা খাবে।
মেধা সর্বশক্ত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখেছে। এতেই মনে হচ্ছে তার পৃথিবী সুখে ভরা। আর কথা না বলে সেভাবেই রইল। আগে বুকের তৃষ্ণা অন্তত মিটুক পরে নাহয় বাক্য বিনিময় করবে।
To be continue………..!!