❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[১১]
নারীমন ঠিক পদ্মকোমলের ন্যায় নমনীয়। আর এর নিগূঢ় প্রতীকী প্রণয়। যেটা নারী ছেড়ে দিতে পারে, ছিনিয়ে নিতেও পারে। কখনো বা হাসি মুখে মেনে নিতে পারে আবার মানিয়ে নেওয়া শিখাতেও পারে। তরল পদার্থের ন্যায় নিজের অবস্থা
স্থান ভেদে আকার ধারণেও পটু তারা। এর জলজ্যান্ত প্রমাণ মেধা। এতদিন সে ভালোবেসেছে ধূর্ত অভিনয়ের অন্তরালে।
বিরক্ত ভাবটা ফুটিয়ে গোপনে হৃদয়ের আঙিনায় ফুটিয়েছে প্রণয়কলি। যে প্রণয়কলির নামকরণ করা হয়েছে ‘আদিত্য আরহাম’ নামে। সেই প্রণয়কলির প্রতিটা পাপড়ি সাজিয়েছে রঙিন স্বপ্ন দিয়ে। অথচ এতদিন না বুঝতে দিয়েছে আর না কাউকে ধরা দিয়েছে। ওদিকে সেকেন্ডের কাঁটা অতিবাহিত হয়ে মিনিটের কাঁটাও পেরিয়ে যাচ্ছে। তবুও মেধা অটল হয়ে সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। না আদিত্যকে ছেড়েছে আর না সে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখেছে। ঠিক আদুরে বিড়ালছানার মতো আদিত্যের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যেনো তার পৃথিবী সেখানেই থমকে গেছে। তখন আদিত্যই আগে মুখ খুললো,
-” কাহিনি কি হুম? মাথার মধ্যে কিছু পাকিয়েছো না?’
-”হুশশ! চুপ, শুনতে দাও।”
-”কি শুনতে দিবো?”
-”তোমার হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি।”
-”কেন শুনতে দিবো, হুম?”
-”কেন দিবে না, হুম?”
-”দিবো না কারণ আমার বুকে মাথা রাখার অধিকার আমার বউয়ের আর কারো নয়।”
-”তো আমি কে?”
-”তা আমি কি জানি?”
-”সত্যি জানো না?”
-”উহুম, না তো।”
মেধা আর প্রত্যূত্তর না করে সেভাবেই রইল। আদিত্য ওকে পুনরায় ছাড়াতে গেলে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। ভাব এমন যেনো ছেড়ে দিলেই আদিত্য হারিয়ে যাবে, অথবা তার থেকে কেউ ছিনিয়ে নিবে। তবে আজ কেন জানি কেউ আর অনুভূতি প্রকাশে কার্পণ্য করলো না। খোলা আকাশের ন্যায়
মুক্ত করে দিলো লুকায়িত ভালোবাসা। সব মান অভিমানের
যাত্রা এখানে সমাপ্ত করলো। কারণ এভাবে তো অন্তিমকাল চলতে পারে না। জীবন বহমান। এবার ওদের একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হতো, হয় ছাড়ো, নয় আঁকড়ে ধরো। তারা আঁকড়ে ধরার সিদ্ধান্তই নিয়েছে। তখন আদিত্য মেধাকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে বলল,
-”হঠাৎ এই অধমের প্রতি এত দয়া দেখানোর কারণ? ”
-”ভালোবাসি।”
-”কবে থেকে?”
-”ভালোবাসি।”
-”তা তো বুঝলাম কোন মুহূর্ত থেকে ভালোবাসেন, হুম?”
-”ভালোবাসি।”
-”ভালোবাসার চক্করে মাথা কী পুরোপুরি গেছে?”
-”এতকিছু জানি না, বুঝিও না। শুধু জানি, আপনি শুধুমাত্র আপনিই আমার একান্ত ব্যক্তিগত প্রেমিক পুরুষ। যার মাঝে
আমার সুখ- দুঃখ, হাসি-কান্না,মান- অভিমান এ সমস্ত কিছু লুকায়িত।”
-”এতদিন ভালোবাসার ‘ভ’ উচ্চারণ করাতে পারি নি। অথচ আজ ভালোবাসার কোম্পানি খুলে বসেছে। এ্যাই মেয়ে এই দেখি তাকাও আমার দিকে। এই তুমি প্র্যাঙ্ক ট্র্যাঙ্ক করছো না তো? যদি করে থাকো খুব খারাপ হবে কিন্তু বলে দিচ্ছি। ”
-”উহুম, যা বলছি সত্যি বলছি৷ ”
-”কাল সকালে মত বদলে যাবে না তো?”
-”স্বজ্ঞানে, স্বেচ্ছায়, এই আমিটাকে আপনার কাছে সমর্পণ
করলাম আদিত্য আরহাম। শুধুমাত্র লুকোচুরি বাদ দিয়ে অপরিসীম ভালোবাসা আদায়ের লোভে।”
আদিত্যের বুকে মুখ গুঁজে মেধা অনায়াসে কথাগুলো বলে যাচ্ছে। আজ তার কথায় মাঝে নেই কোনো জড়তা আর না গোপনীয়তা। নিজের পবিত্র ভালোবাসা তুলে ধরছে প্রিয় মানুষটার কাছে। অনেক তো হলো মান অভিমান করে দূরে থাকা। এবার নাহয় দূরত্ব ঘুচিয়ে কাছে আসুক, ভালোবাসুক, প্রণয় সুধা পান করে ছটফটিয়ে মরুক। আদিত্য বার দুয়েক মেধাকে সরাতে গেলেও মেধা সরলো না। বরং আদিত্যের টি শার্ট শক্ত করে খামছে ধরে সেভাবে বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে রইল। মেধার এভাবে আঁকড়ে ধরাতে আদিত্যের মুখে হাসি ফুটালো। তবে ওর জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে হাসি আড়াল করতে সময় নিলো না। ঠোঁটের কোণ থেকে হাসি মিলিয়ে সে মেধার মাথায় চুমু এঁকে বললো,
-”গতরাতে ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম। তবে সেটা করতে গিয়ে ঘোরের মধ্যে চলে যাবো বুঝতে পারি নি, সরি।”
-”হুম।”
-”এখন ছাড়ো, রুমে যাও। কেউ এভাবে দেখলে বদনাম রটে যাবে। আর আমি বেঁচে থাকতে আমার চাঁদের গায়ে কলঙ্ক লাগতে দিতে পারব না।”
-”যেতে পারি এক শর্তে।”
-”তার আগে বলো কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে আমার প্রতি এত সদয় হলে কীভাবে? যা সত্য তাই’ই বলো। মেধা একটা মনে রেখো, সব পরিস্থিতিতে ছল চাতুরী শোভা পায় না।
-”আসলে…! ”
আদিত্য এবার জোর করে নিজেকে ছড়িয়ে নিলো মেধার থেকে। মেধার ফোলা ফোলা লাল চোখে এতক্ষণ আদিত্যর বুকে মুখ লুকিয়ে আড়াল করেছিল। আদিত্য বার বার তার মুখ তুলতে গেলে বাঁধা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিলো। এবার আর শেষ রক্ষা হলো না। আদিত্য নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে। তখন মেধা নত মস্তকে অপরাধীর ন্যায় বলতে শুরু করলো,
-”কয়েকদিন যাবৎ খারাপ খারাপ স্বপ্ন দেখছি। সেই স্বপ্নের সারমর্ম আপনি হারিয়ে যাচ্ছেন, কোথাও চলে যাচ্ছেন। গত রাতে স্বপ্নে দেখছি আমার উপর খুব রাগ করে আপনি বিয়ে করে এনেছেন। আপনার বউ আমার চেয়ে সুন্দরী নয়। এর পরেও আপনি ওকে ভীষণ ভালোবাসছেন, কেয়ার করছেন।
বউ পেয়ে আমার দিকে তাকানোও তো দূর রুম থেকেই বের হচ্ছেন না। যখন স্বপ্নটা দেখি মনে হচ্ছিল বাস্তব। আর এই হারানোর কষ্ট প্রবলভাবে আমার হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়েছে। আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়েও দিয়েছে আপনাকে ছাড়া আমি ভালো থাকবো না, একটুও না, এক চিমটিও না। আজ আবার যখন আপনার খোঁজ পাচ্ছিলাম না নিজেকে পাগল পাগল লাগছিলো আমার। বার বার মনে হচ্ছিল স্বপ্ন বুঝি সত্যি হয়েই গেল। আমি বোধহয় সত্যি সত্যি আপনাকে
হারিয়ে ফেললাম। এই ভয়ই আমার সমস্ত রাগ, অভিমানের
গতি পরিবর্তন করেছে। আদিত্য ভাই আপনাকে আমি চাই, খুব করে চাই।”
-”মেয়ে তুমি ভীষণ চালাক।”
-”আমি আবার কি করলাম?”
-”কিছু না রুমে যাও।”
-”হুম।”
মেধা মন ভার করেই ওর রুমে চলে গেল। আদিত্য ওর কথা বিশ্বাস করলো না বোধহয়। তবে সব সত্যের মাঝে এটা মহা সত্য, সে আদিত্যকে ভালোবাসে। ভীষণ, ভীষণ ভালোবাসে।
যে ভালোবাসার আদি থাকলেও অন্ত নেই। পরদিন সকালে খুশ মেজাজেই মেধা ঘুম থেকে উঠলো। গতরাতে তার সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ, মান অভিমানের, বিসর্জন দিয়েছে। পূর্বের যতসব
রাগ ছিলো সব মাটি চাপা দিয়েছে। সে এখন ফ্রেশ মনে নব্য রুপে শুধু ভালোবেসে যাবে। এসব ভেবে সে ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে।ওয়াশরুমের মিররে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে নিজে নিজেকে জিজ্ঞাসা করলো,
-”নব্যরুপে কাকে যেনো ভালোবাসবি বললি?”
-” তাকে।”
-”তাকে মানে কাকে?”
-”ওই যে আমার ব্যক্তিগত ত্যাড়া পুরুষ টাকে।”
একথা বলে লজ্জায় ডুবুডুবু হয়ে সে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিলো। তারপর ফ্রেশ হয়ে পোশাক বদলে আদিত্যের রুমের বাইরে ঢু মেরে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল।
To be continue……!!