মোহ মেঘের আলাপন পর্ব – ১৬

❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[১৬]

দিনটি বরিবার। গ্রীষ্মের ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ জন জীবন।
তার উপরে সকাল থেকে বিদ্যুৎ নেই।বাসার জেনারেটরেরও সমস্যা দেখা দিয়েছে। এত গরমে সীমা বেগমের প্রেশার হাই হয়ে যাচ্ছে। উনি মাঝে মাঝে আইস ব্যাগ মাথাতে দিয়ে বসে পড়ছেন। এত গরমে গালি দিয়ে ফেলেছেন বেশ কয়েকবার।
দিবে না নাই বা কেন? এত গরম সহ্য হয়?মূলত রাগে দুঃখে মুখে গালি এসে যাচ্ছে। আর গত সপ্তাহ থেকে গরম বেড়েছে সেই সাথে লোডশেডিংয়ের পরিমানও তত বৃদ্ধি পাচ্ছে।এসব অশান্তি গুলো একসাথে। এর মানে হয়! এখন যদি গরমের ঠেলায় উনি মারা যান তবে এই দায় ভার কে নিবে? নিবে বা কেন? এতে তো কারো কিছু যায় আসে না। এসব ভেবে উনি
বাগানে গিয়ে বসলেন। রোদের তাপে ফুল গাছ গুলো কেমন নেতিয়ে আছে। উনি সময় নিয়ে গাছে পানি দিলেন। আগাছা পরিষ্কার করলেন। ততক্ষণে সূর্যের তেজ বেড়ে গেছে। রোদে
শরীর পুড়িয়ে দিচ্ছে। সকালের আবহাওয়াতেও যেনো গরম ঢেলে পড়ছে।উনি বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ করে চলে এসে সোফায়
শরীর এলিয়ে দিলেন। মাথা কেমন জানি করছে। আজকাল মেপে গুনে খাবার খাচ্ছেন তবুও প্রেশার খুব সমস্যা করছে।
এই প্রেশার মৃ’ ত্যু’ ডেকে আনবে নাকি কে জানে? যদিও তা
নিয়ে আর কোনো চিন্তা নেই। দুই ছেলে বড় হয়ে গেছে, মেধা
সঠিক সঙ্গী পেয়েছে। এই আমানের একটা গতি হলে ভালো হতো। ছেলেটার বড্ড বেশি জেদ। কবে যে মাথা ঠান্ডা হবে? ভালো মন্দের তফাৎ বুঝবে। তবে নিজের হাতে গড়া সংসার নিয়ে খুব সুখেই আছেন, ভালো আছেন। এখন মারা গেলেও আফসোস নেই। তবে বড্ড শখ দুই ছেলের বউ দেখার। প্রাণ ভরে তাদের জন্য দোয়া করার। কিন্তু শরীরের যা অবস্থা..!
এসব ভেবে উনি চুপ করে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। গতরাত থেকে উনার মনটা বড্ড উতলা হয়ে আছে। কীসব টেনশন এসে মস্তিষ্কে খোঁচা দিয়ে যাচ্ছে। প্রথম প্রথম পাত্তা না দিলেও এখন মনে হচ্ছে খারাপ কিছু ঘটবে। এতে বাসাটা শান্তি হারিয়ে নিষ্প্রাণ হয়ে যাবে।এসব নানা চিন্তায় মশগুল
সীমা বেগম। তখন মেধা বেজার মুখে এসে পাশে বসল। ওর গালে ব্রণ উঠেছে।ফর্সা গালে লাল টকটক করছে দুটো ব্রণ।
সীমা বেগম দৃষ্টি তুলে মেধার দিকে তাকিয়ে চুপ করে আছে।
বাবা-মা মরা মেয়েটার গতি করতে হবে শীঘ্রই। ওকে নিয়েও আজকাল অনেকের কানাঘুষা হচ্ছে। এইতো গতকালই তো
এক প্রতিবেশী ইঙ্গিতে অনেক কিছুই বললেন। আগুনে আর ঘি পাশাপাশি রাখলে বিপদ বাড়বে তার ইঙ্গিতও দিলেন।এর
জবাবে কিছু বলেন নি তিনি। তবে কতদিন বা চুপ থাকবেন?
এই শুক্রবারেই আদিত্য আর মেধার বিয়ের কাজটা সম্পূর্ণ
করবেন। উনাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তখন মেধা বললো,

-”মামনি কিছু কি হয়েছে? শরীর খারাপ করছে তোমার?”

-”আদিত্য কোথায়?”

-”জানি না, ফোন করে ডাকবো?”

-”ফোন করে বল বাইরে থেকে সকালের নাস্তা আনতে। কেন জানি খুব অস্থির লাগছে আমার।”

-”তুমি রুমে গিয়ে একটু শুয়ে থাকো আমি বলছি।”

-”পন্ডিতি করে তোকে রান্না করতে যেতে হবে না। যা বলছি তাই কর।”

-”হুম।”

ঠিক তখন বিদ্যুৎ এলো। সিলিংয়ের বাতাস শরীরে লাগতেই জুড়িয়ে গেল মন। প্রাণ যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। প্রশান্তিতে চোখজোড়া বুজে এলো।তখন সীমা বেগম উঠে রুমের দিকে যেতে যেতে বললেন মেধাকে পন্ডিতি না করতে।বাসায় কেউ কেউ নেই হিতে বিপরীত হতে পারে।জবাবে মেধা ভদ্রমেয়ের মতো সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালো। তারপর উপরের যেতে পা বাড়াতে বাইকের হর্ণ শুনতে পেলো। দাঁড়িয়ে গেল সেখানেই।
ওইতো আমান এসে গেছে। ওকে দিয়ে নাস্তা আনাতে হবে।
আমান শিষ বাজাতে বাজাতে ঢুকতেই মেধা গিয়ে বলল,

-”ভাইয়া, নাস্তা বাইরে থেকে আনতে বলেছে মামনি।”

-”আম্মু অসুস্থ নাকি?”

-”হুম, প্রোশার বেড়েছে।”

-”তোর বরকে গিয়ে বল কেবল বাইরে থেকে আসলাম।এখন ফ্রেশ হয়ে ঘুমাবো আমি।”

-”না, চলো, আমিও যাবো তোমার সঙ্গে। আমার ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে। তাছাড়া আদিত্য ভাইও বাসায় নেই। উনার বন্ধুর মা মারা গেছে গতরাতে সেখানেই গেছে, ফিরে নি এখনো।”

একথা শুনে আমান প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে মেধার দিকে তাকিয়ে রইলো। তখন মেধা বিশ্বজয় করা হাসি হাসলো। সেটা দেখে আমান তার কপালে একটা ঠুয়া মেরে বললো,”চল সামনে হাঁট।”
মেধা এবার ওর বিরক্তমাখা মুখ দেখে খিলখিল করে হেসে সামনে এগোতে থাকল। দু’জনে বাইকে উঠে গেট পার হতেই আদিত্যের গাড়ির মুখোমুখি হলো। আমান দ্রুত ব্রেক কষলে
আদিত্য মুখ বাড়িয়ে মেধাকে জিজ্ঞাসা করলো,

-”কোথায় যাওয়া হচ্ছে? ”

-”বাইরে, নাস্তা আনতে।”

-”দু’জন যাওয়া লাগবে? তুমি বাসায় চলো আমান যাক।”

-”আমি রাস্তা না চিনালে ভাইয়া যাবে কীভাবে, সে রাস্তাঘাট কিছু চিনে না, কি ভাইয়া ঠিক বলেছি না?”

-”জি ভাবিজান, ঠিক বলেছেন। এজন্য চিরকৃতজ্ঞ আমি।”
(আমান)

আমানের এই জবাবে মেধা পুনরায় হাসতে লাগল। ওর হাসি দেখে দুই ভাইয়ের মুখেও হাসি ফুটলো।তারপর পাশ কাটিয়ে বাইক নিয়ে যেতেই আদিত্য আমানকে বললো, “সাবধানে। ”
আমান ভাইয়ের কথা শুনে মুখভর্তি হাসি নিয়ে জবাবে মাথা ঝাঁকাল। আদিত্য এখন ওর সঙ্গে অল্প সল্প কথা বলে। ইঙ্গিত করে বোঝায় এটা ওটা করার। তাকে আবার সুযোগ দিয়েছে অপকর্ম ছাড়ার।তাই সে এখন নিজেকে শুধরে নিচ্ছে। বাবা মায়ের পা ধরে কেঁদে মাফও চেয়েছে। উনাদের সঙ্গে বহুবার খারাপ ব্যবহার করেছে, কষ্ট দিয়েছে। আর তার এই অমূল পরিবর্তনের যথেষ্ট কারণও আছে। সেই কারণ হচ্ছে মেধার বাবার মৃ’ ত্যু’। রোজোয়ানের মারা যাওয়ার পর গভীরভাবে সে কিছু উপলব্ধি করেছে। ওর মন এবং মস্তিষ্কে একটা কথা গেঁথে গেছে ‘জীবন সুন্দর। মৃত্যু অবধারিত।” আর এই মানব
জীবনে এই দুটো বাক্য চিরন্তন সত্য।ওর এসব ভাবনার ছেদ ঘটলো মেধার কথা শুনে। মেধা আদিত্য বলছে,

-”মামনি অসুস্থ এখন ঘুমাচ্ছে বোধহয়। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন আমরা যাবো আর আসবো।

-”হুম।”

তখন আমান বাইক স্টার্ট করতেই মেধা আদিত্যদের দিকে ফ্রায়িং কিস ছুঁড়ে দিলো। আমান সামনের মিরবে তা দেখে হো হো করে হেসে উঠলো। আদিত্য ঠোঁট কামড়ে এক ভ্রুঁ উচু করে মেধার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমানের সামনে এমন করার মানে হয়? মেয়েটা বড্ড জ্বালাচ্ছে আজকাল।না এরে
আর ছেড়ে রাখা যাবে না। যথা সম্ভব তার শরীরে বৈধ ট্যাগ লাগাতে হবে। আদিত্যকে ভ্রু কুঁচকে দেখে মেধা গেয়ে উঠল,

-”ওগো এভাবে তাকিও না। তোমার ওই প্রখর দৃষ্টিতে আমি বরবাদ হয়ে যাচ্ছি, নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি পুরোটাই….।”

ততক্ষণে আমানের বাইক চলতে শুরু করেছে। তখনো মেধা চেঁচিয়ে বলে যাচ্ছে,

-”তুমি গিয়ে জলদি ফ্রেশ হও প্রিয় আমি আসছিইইইইইইই।”

আর ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আদিত্য উচ্চারণ করলো, “ফাজিল একটা।”

এরপর আদিত্য ওর গাড়ি নিয়ে বাসায় প্রবেশ করলো আর ওরা গেল নাস্তা আনতে। আদিত্য মাকে নিচে না পেয়ে ফ্রেশ হয়ে সীমা বেগমের রুমে গেল, প্রেশার চেক করলো। এখনো হাই প্রেশার দেখে মাথায় পানি ঢালতে সাহায্য করলো। মাথা মুছে হালকা খাবার খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলো। সীমা বেগম শুয়ে আছেন আর আদিত্য উনার মাথা টিপে দিচ্ছেন। বেশ আরামের উনি বন্ধ নয়নজোড়া একবার খুলে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। মন থেকেই দোয়া এলো ছেলের জন্য। আদিত্যের কল পেয়ে জেনারেটর ঠিক করার লোকও এসে গেছে। সময় নিয়ে লোকটা জেনারেটর ঠিক করে টাকা নিয়ে চলে গেল। সীমা বেগমও ঘুমিয়ে পড়েছেন। আদিত্যের কল আসায় সে মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। অফিসের ব্যাপারে কীসব আলোচনা করে কলটা কাটতেই তার ঘড়িতে নজর গেল। ওর যাওয়া প্রায় দেড়ঘন্টা
হতে যাচ্ছে। এত দেরি তো হওয়ার কথা না, তবে? সে আরো
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমানকে কল দিলো। কিন্তু আশ্চর্য জনক ভাবে বার বার ফোন বন্ধ পাচ্ছে। মেধার নাম্বারে কল দিতেই তার ফোন রুমে বেজে উঠলো। জ্যামে পড়েছে ভেবে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। কিন্তু না ঘন্টার কাটা টিক
টিক করে চলতেই থাকলো, সময়ও গড়াতে লাগল। এভাবে চার ঘন্টা পেরিয়ে গেল। আদিত্য এবার উতলা হয়ে উঠলো।
বাসার সদর দরজাটা লক করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
ওরা বেশিরভাগ যে রেস্টুরেন্টের খাবার খায়, সেখানে গিয়ে জানতে পারলো আমান আসে নি। সামনের মোড়ে আমানের এক ফ্রেন্ডের বাবার বিরিয়ানি হাউজ আছে। সেখানে গিয়ে জানলো আমান গতরাতে গিয়ে বিরিয়ানি খেয়েছিল, আজ সকালে আসে নি। এভাবে অনেক জায়গায় খুঁজতে থাকলো আদিত্য। এমনকি আমানদের বন্ধুদের ফোন করেও খোঁজ করলো, তবুও কোনো সন্ধান মিললো না। এভাবে হন্ন হয়ে খুঁজতে খুঁজতে আরো ঘন্টা তিনেক পেরিয়েও গেল। অজানা ভয়ে তার বুক কাঁপছে। সেই সঙ্গে খোঁজ নিয়েছে আশেপাশে কোথাও এক্সিডেন্ট হয়ে কী না। না আজকে এক্সিডেন্টও হয় নি।আদিত্য টেনশনে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে বাসায় ফিরে গেল। বাসায় গিয়ে দেখে বাবা মা খেতে বসেছেন তাই কিছু বললো না সে। তবে সীমা বেগম প্রশ্ন ছুঁড়লো,

-”আদিত্য বানর দু’টো বাসায় নেই, কোথায় গেছে জানো?”

-”হুম, টেনশন করো না ঘুরতে গেছে চলে আসবে।”

-”তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন বাবা? কিছু হয়েছে?”

-”না গরমে, এই শরীর রান্না করলে তুমি?”

-”এখন দুপুর তিনটে বাজে। মেধাকে বললাম তোমাকে ফোন করে সকালের নাস্তা আনতে।কিন্তু তুমি পুরো সকাল পেরিয়ে দুপুরে এলে, তারপর হুট করে কোথায় চলেো গেল। এখনো এলে তাও খালি হাতে। এদিকে মেধা আর আমানটাও নেই। আচ্ছা প্রেশার বেড়েছে বলে কী না খাইয়ে মারার পরিকল্পনা করছো তোমরা, হুম?”

মায়ের এমন কথা শুনে আদিত্য মৃদু হাসলো। প্যাকেট দেখে বুঝতে রইল না খাবার বাইরে থেকে এসেছে। তাহলে বাবাই এনেছে খাবার। আদিত্য আর না দাঁড়িয়ে রুমে গেল। এক বন্ধুর মাধ্যমে পুলিশের সাহায্যে খোঁজ চালালো। সময় ধীর গতিতে এগোতে থাকলো। একটা সময় দিন পেরিয়ে রাতও কেটে গেল। ধীরে ধীরে একথা চারদিকে ছড়িয়ে গেল। নিকট আত্মীয়রা বাসায় এসে নানান যুক্তি দেখাতে লাগলেন। কেউ কেউ মুখের উপর বলেও দিলো,

-”আমান বোধহয় মেধাকে ভালোবাসতো। তাই বিয়ের আগে
মেধাকে নিয়ে পালিয়েছে।”

একথা শোনা মাত্রই সীমা বেগম খৈই হারিয়ে ফেললেন। উনি হতবাক হয়ে গেলেন। সেই সঙ্গে থরথর করে কাঁপতে লাগল পুরো শরীর। উনি নিজের ভারসাম্য ধরে রাখতেও পারলেন না। সেন্স হারিয়ে ঢেলে পড়লেন মেঝেতে।

To be continue……….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here