হৃদয় মাঝারে পর্ব -০১

১.
বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে লালমনিরহাট থেকে ঢাকা যাওয়ার উদ্দেশ্যে ট্রেনে উঠে একটা সীটে বসতেই পাশে থাকা ব্যাক্তিকে দেখে আমার আত্না কেঁপে উঠে। যার ভয়ে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছি সেই ব্যাক্তি টি আমার পাশে বসা। আমার পাশে বসা ব্যাক্তিটি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দূষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি তা বুঝতে ফেরে তাড়াতাড়ি সেই সিট ত্যাগ করার জন্য উঠতেই আমার পাশে বসা ব্যাক্তিটি আমার হাত চে’পে ধরে।

‘এখান থেকে এক’পা নড়লে তোর পা ভে’ঙ্গে আমি হাতে ধরিয়ে দিবো। সো চুপচাপ এখানে বস।’

আমি ভয়ে ভয়ে উনার পাশে বসে পড়লাম। উনি একবার আমাকে ভালো করে পরখ করে বলে,

‘বিয়ের আসর ছেড়ে কার টানে ঢাকা যাচ্ছিস?’

আমি চুপচাপ উনার পাশে গাপটি মেরে বসে আছি। আপাতত উনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো ইচ্ছে আমার নেই তাই চুপচাপ বসে আছি।

‘সুন্দর মতো আমার প্রশ্নের উত্তর দে ফারিহা নাহলে খুব খারাপ হবে কিন্তু বলে দিলাম!’

উনার এরকম বজ্রাকন্ঠ শুনে আমি ভয়ে কেদেই দিলাম।

‘এই একদম ন্যা’কা’মি করবি না বলে দিলাম। আর একটা মুখ থেকে আওয়াজ বের হলে থা’প্পড় দিয়ে বাহিরে ছুড়ে মারবো।’

উনার এরকম হুংকার শুনে আমি চুপ করার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

‘আমি বিয়ে করতে চাই না আপনাকে। আমি তো অভি কে ভালোবাসি, ওকে নিয়েই বাঁচতে চাই।’

উনি চুপচাপ আমার কথা শুনে গম্ভীর কন্ঠে বলে,

‘আর কিছু বলবি?’

আমি প্রতিউত্তরে আর কিছু বলিনি। যার মানে দাড়ায় আর কিছু বলার নেই।

‘তুই কি জানিস তুই বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে নিজের বিপদ ডেকে এনেছিস। তুই কি ভেবেছিস তুই এই মুরতাসিম চৌধুরীর হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারবি?’

‘দেখুন আপনি আমার মা-বাবা কে কি যাদু করেছেন আমি জানি না। আমার পিছনে পড়ে থেকে লাভ নেই। নিজের রাস্তা নিজে দেখুন আর আমাকে আমার মতো চলতে দিন।’

মুরতাসিম আমার হাত জোরে চে’পে ধরে বলে,

‘তোমাকে আমার অর্ধাঙ্গিনী বানিয়ে তবেই নিজের পথে চলবো।’

উনার এতো সহজ সরল জবাব টা আমি ঠিক ভাবে হজম করতে পারিনি। তাই মুখটা ঠমঠমে করে বলি,

‘আমার মতো আঁধার’মুখী একটা মেয়ের পিছনে কেনো পড়ে আছেন? আপনি চাইলে আপনার জীবনটা আলোকিত করে একজন সুন্দরী রমনী গুছিয়ে দিবে। আমার মতো অগোছালো, কালো একটা মেয়ের পিছনে কেনো পড়ে আছেন?’

শেষের কথাটা বলার সময় গলাটা থেমে যায়। তারপরও কষ্ট করে বলতে হয়েছে। সত্যিটা তো আর আড়াল করে রাখা যায় না। আমার কথা শুনে মুরতাসিম নিশ্চুপ হয়ে যায়। আমি তাচ্ছিল্য ভরা নয়নে হেসে বলি,

‘এখন কেনো থেমে গেলেন মিস্টার চৌধুরী?’

‘আমি থেমে যাইনি ফারিহা! তোমাকে আমার ভালোলাগে। কার কি’রকম লাগে বুঝি না বুঝতে চাইও না। তাই তো তোমাকে পাওয়ার জন্য এতো দূরে ছুটে এসেছি। আমি হয়তো অতো বড়লোক বাবার ছেলে নয় কিন্তু আমার ওয়াইফ কে চালানোর মতো যোগ্যতা ও সামর্থ্য আমার আছে।’

একদমে কথা গুলো বলে থামে মুরতাসিম। এদিকে ভ্যাঁপসা গরমে আমার নাজেহাল অবস্থা। উনার কথা শুনার অবস্থা আমার নেই।

‘তা অভি বুঝি এরকম একটা মেয়েকে মেনে নিবে!’

উনার কথা শুনে আমি চমকে উনার দিকে তাকায়। চোখে পানি টলমল করছে তারপরও নিজেকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে বলি,

‘অভির কাছে আমি যাচ্ছি না। আমি আমার মতো করে নিজেকে গড়ে তোলার একটা মাধ্যম খোঁজার জন্য শহরে যাচ্ছি।’

আমার কথা শুনে উনি চমকে আমার দিকে তাকান।

‘আর তাছাড়া আপনিই তো একটু আগে আমাকে বললেন আমাকে আপনার ভালো লাগে, কিন্তু ভালোবাসেন না। এই ভালো লাগা’টা বিয়ের পরে উদাও হয়ে যাবে। সবাই চায় তার জীবনে একজন সুন্দরী তনয়া’র আগমণ হোক তাহলে আপনি কেনো তার বিপরীত দিকে অগ্রসর হচ্ছেন?’

মুরতাসিম একদম নিশ্চুপ হয়ে যায়। হয়তো বলার মতো কিছু খুজে পাচ্ছে না। তাই আমি আবারও বলি,

‘আমি নিজেকে গড়ে তুলে দেখাতে চাই সুন্দর চেহারা সবকিছু নয়। একজন কালো মেয়েও পারে সবকিছু করতে।’

‘আমি তোমাকে সাহায্য করব তোমার স্বপ্ন পূরণের জন্য। সুন্দর চেহারা সবকিছু নয় ফারিহা, মানুষের মন টা সুন্দর হলেই তারা প্রকৃত পক্ষে সুন্দর। তোমার গায়ের রং দেখে তোমাকে আমার ভালো লাগে কে বলেছে তোমাকে? আমার তো তোমার মায়া ভরা এই মুখশ্রী দেখে তোমায় ভালো লাগে। ভালোবাসা টা সবকিছু নয় ফারিহা। ভালো লাগা কেও যথেষ্ট গুরত্ব দেওয়া উচিত।’

এরই মধ্যে ট্রেন এসে কমলাপুর রেলস্ট্রেশনে পৌছে। আমি ব্যাস্ত ভঙ্গিতে নিজের ব্যাগপত্র গোছাচ্ছি। উনার কথার কোনো জবাব আমার কাছে নেই। উনার আমাকে ভালো লাগতেই পারে। কিন্তু উনি আরো ভালো একটা মেয়েকে ডিজার্ব করে।

‘এই বিয়ের পোশাকে যে বের হয়েছো সবাই তো তোমাকে দেখে গণ দো’লাই দিবে।’

‘সেটা আমার ব্যাপার।’

বলেই ট্রেন থেকে নেমে পড়ি আমি। আমার পিছন পিছন মুরতাসিম ও নেমে আসে। আমি বুঝি না এই লোকটা আমার পিছনে কেনো পড়ে আছে।

‘কোথায় যাবে এখন?’

‘সেটা আমার ব্যাপার আপনাকে না ভাবলেও হবে।’

‘আমি তোমাকে আগেই বলেছি তুমি এই মুরতাসিম চৌধুরীর কাছ থেকে পালাতে পারবে না। এতক্ষন তোমাকে ভালো ভাবে বুঝিয়েছি তুমি বুঝো নি। এখন তো আমাকে অন্য পদক্ষেপ নিতেই হবে।’

উনার এতো থমথমে কন্ঠস্বর শুনে আমি কিছুটা ঘাবড়ে যাই। যতোই হোক একটা মেয়ে মানুষ অচেনা একটা শহরে এসে একটা ছেলের সাথে কিছুতেই পারবে না। তাই আমি তাড়াতাড়ি হেটে উনাকে অতিক্রম করে অন্য পাশে চলে আসি। এদিকে দুপুর বেলার এই কাঠখোট্টা রোদের জন্য গলা শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিনত হবে বলে। অনেক্ষণ হাটার পর পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি মুরতাসিম কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সস্তির নিশ্বাস ফেলে একটা টং দোকানে গিয়ে ঠান্ডা পানি কিনে একটা বৃক্ষের নিচে বসে পড়ি। পানি খেয়ে বোতলটা ব্যাগে রাখতে গিয়ে মনে হলো আমার পাশে কেউ বসে আছে। অতর্কিত ভাবে পাশে তাকিয়ে দেখি আমার পাশে মুরতাসিম বসে আছে। আমাকে দেখে উনি মুচকি হেসে দাড়িয়ে পড়ে।

‘চলো আমার সাথে, তোমার শশুর বাড়ি যেতে আর মাত্র কিছুক্ষন লাগবে।’

আমি মুরতাসিমের দিকে কঠোর দূষ্টি নিক্ষেপ করে বলি,

‘এই আপনার কি লজ্জা-শরম বলতে কিছু নেই? আপনাকে তো আমি ভালো লোক ভেবেছিলাম কিন্তু আপনি এরকম ছ্যা’চ’ড়া’র মতো আমার পিছনে পড়ে আছেন কেনো?’

আমার কথা শুনে মুরতাসিম আমার দিকে দূঢ় চোখে তাকিয়ে আছে।

‘অনেক হয়েছে তোমার সাহসী ললনা সাঁজার এবার থামো। তোমাকে আমি আমার সহধর্মিণী বানিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম তুমি তো সেটা চাও না। তোমাদের মত মেয়েদের প্রতি ছেলেরা একটু আকৃষ্ট হলেই তোমাদের ডিমান্ড বেড়ে যায়।’

বলেই আমাকে টেনে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে গাড়ির দরজা লক করে নিজেও বসে পড়ে আমার পাশে। আর আমি ছলছল নয়নে তার পানে তাকিয়ে আছি। আমি জানতাম উনারও বদলাতে সময় লাগবে না তবে, এতো তাড়াতাড়ি পাল্টে যাবে ভাবিনি।
.
গাড়িটি একটি বাড়ির সামনে এসে থামে। হয়তো মুরতাসিম দের বাড়ি। মুরতাসিম গাড়ি থেকে নেমে এসে আমাকে নামতে বলে। আমি বাদ্য মেয়ের মত গাড়ি থেকে নেমে তারপাশে দাড়াই। দেখার অনেক আগ্রহ আমার জীবনে কি হবে তারপর!

‘তাড়াতাড়ি আসো, আর তখন কার ব্যবহারের জন্য দুঃখিত আমি। আসলে তখন মাথা কাজ করছিলো না।’

আমি শুধু একের পর এক অবাক হচ্ছি। এই লোকটার কয়টা রুপ দেখতে হবে আর আমাকে!
বাড়ির ভেতরে আসতেই একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। মুখে ঠমঠমে ভাব বিরাজ করছে। কর্কশ কন্ঠে বলে উঠেন,

‘যে মেয়েটা আমাদের মান-সম্মান দুলোয় মিশিয়ে পালিয়ে গিয়েছে তুমি সেই মেয়েকে আবার ঘরে তুলে এনেছো কেনো?’

‘আমি ওকে বিয়ে করবো তাই। আর পালিয়ে যাওয়া টা তো কোনো দোষ না। ওর আমাকে ভালো নাই লাগতে পারে। আস্তে আস্তে তা ঠিক হয়ে যাবে।’

সামনে থাকা মহিলাটি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দূষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

‘আমার এই হিরের টুকরো ছেলেকে এই মেয়েটার ভালো লাগে না! তা মেয়ে নিজের দিকে কখনো তাকিয়ে দেখেছো তো তুমি কেমন দেখতে?’

আমার সামনে থাকা মহিলাটির কথা শুনে আমার কপোল ভেড়ে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। মুরতাসিম প্রতিবাদের সুরে বলে,

‘আমি আমার পছন্দের কথা তোমাকে জানিয়েছি। আজকেই আমি ফারিহাকে বিয়ে করতে চাই। তুমি রাজি থাকো বা না থাকো তাতে আমার কিছু যায় আসে না।’

‘কিন্তু আমি তো আপনাকে বিয়ে করবো না।’

আমার কথা শুনে মুরতাসিমের ব্রু কুচকে গেলে।

‘আমি কি তোমাকে তোমার মতের কথা জিঙ্গেস করেছি?’

উনার এরকম সহজ ভঙ্গিতে করা অপমান শুনে আমি চুপসে যাই।

‘তোমার মা-বাবা কে তো রেখে চলে এসেছো তাদের কি অবস্থা সেটা জানতে চাও না?’

‘মানে! কি বলতে চাইছেন আপনি?’

‘মানেটা খুব সহজ তোমার মা-বাবা এখন আমার কাছে আছে। বিয়েটা করলে তুমি সুখী হবে আর না করলে তোমার পুরো পরিবার কে আমি ধ্বংস করে দিবো।’

মুরতাসিমেরর বলা কথাটি শুনে আমার দুনিয়া থমকে যায়। আমাকে যতো অত্যাচারই করুক না কেনো তারা তো আমার বাবা-মা।

‘ফারিহাদের বাড়ি থেকে এখনও বাবারা আসেনি?’

উনার আম্মু আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে না বলে।

‘আর শুনো ফারিহা তোমাদের বাড়ি থেকে তোমার বোন আসলেই আমাদের বিয়েটা শুরু হবে। বাবা তোমার বোনকে নিয়ে আসছে। তাই বিয়ের প্রিপারেশন নাও।’

বলেই মুরতাসিম উপরে চলে যায়। মধ্যে বয়স্ক মহিলাটি এখনো আমার দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে আছে।

‘তা মেয়ে আমার ছেলেকে কি যাদু করেছো যে তোমার মতো এরকম একটা বি’শ্রী মেয়ের পিছনে ও পড়ে আছে?’

আমি নিচের দিকে তাকিয়ে আছি। কিছু বলার মতো ভাষা আমার কাছে নেই। পাশ থেকে আমার বয়সের একটা মেয়ে বলে উঠে,

‘মা তুমি চুপ করবে? মেয়েটা কিরকম মায়াবি সেটা খেয়াল করেছো! শুনো ফারিহা তুমি আমার সাথে চলো।’

উনার মা মুখ বাকিয়ে চলে যায়।

‘তুমি কিছু মনে করো না ফারিহা মা একটু এরকমই, তুমি আমার সাথে চলো।’

বলেই আমাকে নিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে একটা রুমে এনে বসিয়ে দেয় মেয়েটা।

চলবে……

#হৃদয়_মাঝারে
#হালিমা_চৌধুরী
#সূচনা_পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here