হৃদয় মাঝারে পর্ব -০৫

#হৃদয়_মাঝারে[৫]
#হালিমা_চৌধুরী

স্টেজে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই চাঁদনী দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে।

‘আমি জানি তুমি পারবে ফারিহা। শুধু একটা জিনিস মনে রাখবে গানকে তুমি ভালোবেসে গাইতে হবে। বেস্ট অব লাক।’

‘আমি চেষ্টা করবো চাঁদনী।’

বলেই আমি স্টেজে উঠে পড়ি। আমি স্টেজে উঠতেই তূর্য শিকদার এগিয়ে আসেন।

‘তো ফারিহা ভাবি আপনি তৈরি তো?’

‘জ্বী ভাইয়া।’

‘তো শুরু করে দেন আপনার মিষ্টি কন্ঠের গান।’

বলেই তূর্য শিকদার আমার দিকে মাইক্রো ফোন এগিয়ে দেয়। আমি একবার স্টেজের কোনে দাড়িয়ে থাকা মুরতাসিমের দিকে তাকাই। কেমন উদ্গ্রীব দূষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। নিজেকে দাতস্থ করে গান শুরু করার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কেমন অদ্ভূত একটা ফিলিংস হচ্ছে আমার।

..সে প্রজাপতির মতো উড়ে যায়…
তার মতিগতি বাপু বোঝা দায়..
যেন এক প্রদীপেতে ভরা জীন সে
.. খুব নাটকীয় এক সিন সে…

যদি কেউ বিয়ের ফাঁদে পড়তে চাও
তাহলে নির্বিবাদে তার কাছে সে কথা জানাও…

এ কাহিনী… এ জীবনী..
এ কাহিনী জীবনী সে নিজেরই মতো
এ কাহিনী…এ জীবনী
এ কাহিনী জীবনী সে নিজেরই মতো…

প্রজাপতির পাখায় কত স্বপ্ন যাচ্ছে উড়ে
পক্ষীরাজের ঘোড়ায়
আমরা একে একে দুইয়ে [২]

এ কাহিনী… এ জীবনী..
এ কাহিনী জীবনী সে নিজেরই মতো
এ কাহিনী….এ জীবনী
এ কাহিনী জীবনী সে নিজেরই মতো..

হ্যাপি গো লাকি তার ডাকনাম
প্রচুর ধার বাকি সে স্বপ্নের গোলাম
জীবন জুড়ে দেওয়ার মতো সেলোটেপ
দেখো আকাশ পথে মেঘের রথে এলো কে

এ কাহিনী এ জীবনী
..এ কাহিনী জীবনী সে নিজেরই মতো.
এ কাহিনী…. এ জীবনী…
এ কাহিনী জীবনী সে নিজেরই মতো

গান শেষ হওয়ার সাথে সাথে চারপাশ করো তালিতে মেতে উঠেছে। আমি স্টেজ থেকে নামতে নিতেই আমার সামনে বিয়ের কনে এসে দাড়ায়।

‘আমি জাস্ট অবাক হচ্ছি গানটা শুনে! তুমি সত্যিই চমৎকার গেয়েছো। কালকে যখন ভাইয়া আমাকে বলেছে আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে কোনো বড় শিল্পী আসবে না তখন আমার মেজাজ অনেক খারাপ হয়ে গেছে বাট সেটা এখন তুমি ঠিক করে দিয়েছো।’

শিলা শিকদারের চোখ মুখ খুশিতে চকচক করছে। আমার মাঝে অদ্ভূত এক ভালো লাগা কাজ করছে। জীবনে সরাসরি কাউকে আনন্দ দিতে পারবো গান গেয়ে কল্পনার বাহিরে ছিলো। কিন্তু সেটা এখন বাস্তবে পরিনত হয়েছে। আমি নম্র স্বরে উনাকে ধন্যবাদ দিয়ে স্টেজ থেকে নেমে পড়ি। আমাকে নামতে দেখে মুরতাসিম এগিয়ে আসে আমার কাছে।

‘নার্ভাস লেগেছে?’

‘গান কেমন লেগেছে না বলে এগুলো কি বলেন?’

দাত দিয়ে হালকা জিভ কাটলো উনি। যার অর্থ চরম ভুল হয়ে গেছে। আমাদের একসাথে দেখে চাঁদনী ও এগিয়ে আসে। উনি কিছু বলার আগেই চাঁদনী টিপ্পনী কেটে বলে,

‘ভাবিই তুমি তো সেলিব্রেটি হয়ে গেছো। তোমাকে তো টিভিতে দেখাবে। এই অনুষ্ঠান টা তো যেই সেই,মানুষের না। ডিরেক্টর তূর্য শিকদারের একমাত্র বোন অরপে মেকাপ আর্টিস্ট শিলা শিকদারের বিয়ে বলে কথা।’

ধমকে উঠলো মুরতাসিম বোনের কথা শুনে।

‘তখন থেকে ফালতু বকে যাচ্ছিস। ওকে একটু রেস্ট নিতে দে।’

মুরতাসিমেরর কথা শুনে তূর্য শিকদার সায় দিয়ে বলে,

‘মেয়েদের কাজই তো হলো ফ্যাচফ্যাচ করা।’

তূর্য শিকদারের কথা শুনে চাঁদনী ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। মনে হয় তার চোখের আগুনে ভষ্ম করে দিবে। ওদের এতো খুনশুটি দেখে আমি স্মিত হাসি।

‘আমাদের এবার যাওয়া উচিত। আমার খুব মাথা…’

আমার কথার মাঝে তূর্য শিকদার ফোঁড়োন কেটে বলে,

‘নো ভাবি আপনি এভাবে যেতে পারেন না। আপনি এই প্রথম বর এবং একমাত্র ননদ কে নিয়ে এখানে এসেছেন। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হওয়া পর্যন্ত অন্তত আপনাদের থাকতেই হবে। কি বলিস মুরতাসিম?’

উনিও তূর্য শিকদারের কথার সাথে সায় মিলিয়ে বলে,

‘হ্যা একদম ঠিক বলেছিস। বিয়ের পর এই প্রথম বউকে নিয়ে একটু ঘুরতে বের হয়েছি। তোমার মাথা ব্যাথা ঠিক হয়ে যাবে।’

উনাদের কথা শুনে আমি অসহায় ভরা নয়নে সবার দিকে তাকিয়ে আছি।
.
অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে প্রায় সাড়ে ৫ টা বেজে গেছে। আমি চাঁদনী আর উনি বিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠতে নিতেই উনি বলেন,

‘এই ফারিহা, চাঁদ আইসক্রিম খাবে?’

উনার কথা শুনে চাঁদনী লাফিয়ে উঠে। আমিও এক পায়ে দাড়িয়ে রাজি হয়ে গেলাম। উনি পাশের একটা স্টল থেকে দুটো আইসক্রিম নিয়ে আসে। একটা আমাকে আরেকটা চাঁদনী কে দিয়ে উনি গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে পড়ে। আমরা আইসক্রিম খেতে খেতে অন্য পাশে চলে এলাম।

‘আচ্ছাহ ভাবি ভাইয়া আইসক্রিমের কথা বলে নিজের জন্য কিনলো না কেনো?’

আমি ওর কথা শুনে ভাবুক ভঙ্গিতে বলি,

‘তোমার ভাইয়ার হয়তো আইসক্রিম পছন্দ না তাই।’

‘না ওর আইসক্রিম খুব পছন্দের। তুমি বরং গিয়ে ওকে জিঙ্গেস করো আইসক্রিম খাবে কিনা?’

‘আচ্ছাহ চলো।’

চাঁদনী ফোন নিয়ে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে বলে,

‘তুমি যাও না প্লিজ আমার একটা ইম্পরট্যান্ট কল করা লাগবে।’

আমি বাদ্য হয়ে উনার কাছে চলে এলাম। এসে দেখি উনি গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে খুব যত্ন করে সিগারেট মুখে দিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে সিগারেট মুখ থেকে বের করে বলে,

‘চাঁদ কই? আর এখানে কেনো এসেছো ওকে একা রেখে?’

উনার কথা শুনে আমি মিনমিনিয়ে বলি,

‘চাঁদনীই তো বললো আপনার আইসক্রিম পছন্দের তাই তো আমি এসেছি..’

আমার কথা সম্পন্ন শেষ হতে না দিয়ে উনি বলেন,

‘আইসক্রিম তো দুটোই কিনেছি। তুমি কি তোমার এই আধ খাওয়া আইসক্রিম টা আমাকে খাওয়ার জন্য বলছো?’

উনার কথা শুনে আমি কপট রাগ দেখিয়ে বলি,

‘ এই সিগারেট না খেয়ে আমার এই আধ খাওয়া আইসক্রিম খাওয়া অনেক ভালো। আর আমি আমার আইসক্রিম থেকে আপনাকে কেনো ভাগ দেবো? আমি তো এমনি এসেছি…’

আমার কথার মাঝেই আমার হাতে থাকা আইসক্রিম টি তে উনি ঝুকে এসে কামড় বসিয়ে দেয়। উনার এই কান্ড দেখে আমি হতভম্ভ হয়ে যাই। পরক্ষনে উনার মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দেই।

‘এই হাসছো কেনো?’

আমি নিজের হাসিকে নিয়ন্ত্রনে এনে বলি,

‘আপনার মুখে আইসক্রিম লেগে আছে।’

‘তো তুমি শাড়ি পরেছো কেনো ? তোমার ওই শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার মুখের আইসক্রিম মুছে দেও!’

উনার আবদার শুনে আমি আবারো হেসে দেই।

‘আমি পারবো না।’

বলে চলে যেতে নিতেই উনি আমার শাড়ির আঁচল ধরে রাখেন।

‘আশ্চার্য্য তো আপনি বাচ্চাদের মত এমন করছেন কেনো?’

আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে উনি আমার শাড়ি দিয়ে আয়েশ করে মুখ মুচে নেন। আমি মুখ কুচকে বলি,

‘এই আপনি একদম শাড়ির মধ্যে আইসক্রিম লাগাবেন না।’

‘অলরেডি কাজ শেষ আমার সুইটহার্ট।’

বলেই উনি বাঁকা হাসেন। উনি আমার সামনে থেকে সরে গিয়ে বলে,

‘এই চাঁদ আমরা চলে যাচ্ছি তুই যদি যেতে চাস তবে তাড়াতাড়ি সামনে আয়।’

উনার বলার আগেই চাঁদনী এগিয়ে আসে।

‘তোমাদের রোমান্স শেষ না হলে আসবো কিভাবে?’

চাঁদনীর কথা শুনে উনি আমার দিকে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,

‘বাড়িতে তো আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। এখানে রাস্তায় এসে এখন তার প্রেম প্রেম ভাব হচ্ছে বুঝলি চাঁদ।’

উনার কথা শুনে আমি দাতেদাত চেপে বলি,

‘আপনার মত নির্লজ্জ লোক আমি দুজন দেখি নি।’

আমার কথা শুনে চাঁদনী মিটমিট করে হাসছে। ও গিয়ে গাড়ির ভেতরে বসে পড়ে। ওর এই মিটমিট করে হাসার কারনে আমার আরো অসস্থি হচ্ছে। আমি উনার দিকে তাকিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলি,

‘সরুন সামনে থেকে। আপনি আপনি একটা পাগল।’

আমার কথা শুনে উনি হো হো করে হেসে উঠে। উনার হাসি দেখে আমার রাগ আরো বেড়ে গেছে। উনাকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিতেই উনিও সেই পাশে চলে আসে। ফলে উনার মাথার সাথে বাড়ি খেয়ে আমার অবস্থা শেষ।

‘আহ আমার একমাত্র মাথা’টার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন আপনি!’

উনি আমাকে ধমকে বলে,

‘চুপ করো স্টুপিড। মানুষের মাথা আবার একমাত্র হয় নাকি? ‘

‘মানুষের মাথা পাঁচ টা হয় নাকি? মানুষের মাথা একটাই হয়। যাগগে সেসব কথা বাদ দিয়ে আরেকটা বাড়ি দেন নাহলে আমার মাথায় শিং গজাবে।’

উনি আমাকে আবারো ধমকে বলে,

‘তোমাকে আমি চুপ করতে বলেছি কিন্তু! কি সব স্টুপিড এর মত কথা বলছো? আগের যুগের কুসষ্কার কে নিয়ে তুমি এখনো পড়ে আছো? তোমাকে আমি অনেক স্ট্রং একটা মেয়ে মনে করতাম।’

উনার ধমক শুনে আমি চুপসে যাই।

‘এই ভাই তোরা আসবি নাকি?’

চাঁদনীর কথা শুনে আমি গিয়ে গাড়িতে বসে পড়ি।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here