কিশোরী কন্যার প্রেমে পর্ব -১৪+১৫

#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_১৪
.
আলোর তীব্রতায় ঝলমল করছে চারপাশ। আজ নুসরাতের বিয়ে। বিয়ে হচ্ছে কনভেনশন হলে। অর্ঘমা ভেতরে ঢুকেই আশেপাশে একবার ভালো করে দেখে নিল। সে ভেবেছিল লোকসমাগম খুব বেশি হবে। কিন্তু তার ভাবনার থেকে লোকসমাগম এখানে অনেকটাই কম দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। বেশি ভীড় তার কোনো কালেই পছন্দ না। অস্বস্তি হয় প্রচন্ড। অর্ঘমা ওড়না ঠিক করে এগিয়ে গেল স্টেজের দিকে। উদ্দেশ্য নুসরাতের সাথে দেখা করা। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নীরদকেও খুঁজল। কিন্তু ছেলেটা লাপাত্তা। কোথায় গেছে কে জানে! অভ্রকে দেখা যাচ্ছে খাবারের ওখানে দৌড়াদৌড়ি করছে। তার মানে নীরদও সেখানেই আছে। আর যাই হোক নীরদকে ছাড়া অভ্র একা একা কখনো ওখানে দৌড়াদৌড়ি করবে না।

স্টেজের নিচে একপাশে নুসরাতের মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন মিনা বেগম। অর্ঘমা তাকে দেখেও কিছু বলল না। নুসরাতের মাকে সালাম দিয়ে স্টেজে গিয়ে নুসরাতের পাশে বসে পড়ল। অর্ঘমার মায়ের সাথে অর্ঘমার একটা নীরব যুদ্ধ চলছে। সেদিন অভ্র আর বাবার ঝাড়ি খেয়ে মা অর্ঘমার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছেন। অর্ঘমা নিজে থেকে কয়েকবার গিয়েছিল মায়ের সাথে কথা বলতে কিন্তু তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। হঠাৎ মায়ের এমন অবহেলা সহ্য করতে পারছে না অর্ঘমা। এমন কী হয়েছে যে মা তার সাথে কথা বলছে না? মা সারাক্ষণ তাকে এমনভাবে উপেক্ষা করে যাচ্ছে যেন সে অদৃশ্য। অর্ঘমার ভেতরটা কষ্টে শেষ হয়ে যাচ্ছে মায়ের সাথে কথা বলতে না পেরে, সেটা কী মা বুঝতে পারছে না? হয়তো পারছে না। কান্না পেল অর্ঘমার। কিন্তু নিজেকে দমিয়ে রাখল সে। মুখে মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে নুসরাতের সাথে কথা বলতে লাগল। প্রায় আধঘন্টা পর নীরদকে দেখতে পেল। তাও শুধুমাত্র একপলক। ছেলেটা ভীষণ ব্যস্ততায় আছে বুঝা যাচ্ছে। এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছে সমানে। শত হোক একমাত্র বোনের বিয়ে বলে কথা। সবকিছু একদম ঠিকঠাক হওয়া চাই।

নিধি আসেনি অনুষ্ঠানে। নীরদ এবং নুসরাত দু’জনেই বারবার আসতে বলেছিল তাকে, তবুও সে আসেনি। অর্ঘমা বার কয়েক জোরাজোরি করছিল কিন্তু নিধি আসবেই না। কারণ দু’দিন বাদেই আবার পরীক্ষা আছে। নিধির প্রস্তুতি কিছুটা কম থাকায় সে এখন বইয়ের ভেতরে মুখ গুঁজে বসে আছে। সেদিনের পর থেকে মিনা বেগম নিধিকে আর কোনো কাজে ডাকেন না। এমন কি কোনো কথাই বলে না তার সাথে। নিধি বুঝে অর্ঘমার মা তাকে পছন্দ করে না। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে অনেক কিছুই হজম করে নিতে হয়। অর্ঘমাদের পাড়া-প্রতিবেশিরা তাকে দেখতে পেলেই কটু কথা শোনাতে পিছপা হয় না। নিধি প্রথম প্রথম বিস্মিত হতো এদের কথার ধরন শুনে। কিন্তু পরবর্তীতে সে যখন জানতে পারল এসব কথা অর্ঘমার মা নিজেই ছড়িয়েছে তখন তার আর কিছু বলার মতো ভাষা ছিল না। মানুষের মন-মানসিকতা তো সে আর পরিবর্তন করতে পারবে না। যে পর্যন্ত না নিজে কিছু করতে পারছে, সেই পর্যন্ত তাকে এখানেই থাকতে হবে। এসব কথার মাঝেই নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পড়ায় মনোযোগ দেয় নিধি। তার জীবনে সুখ বলতে কিছুই নেই। সুখ তার কাছে মরীচিকার মতো। সুখ শব্দটাই তো তার জীবনের জন্য হাস্যকর।

অর্ঘমা স্টেজ ছেড়ে খাবারের ব্যবস্থা যেদিকে করা হয়েছে সেদিকে গেল। যদি অভ্র বা নীরদকে পাওয়া যায় এই আশায়। স্টেজে বসে থাকতে তার একদমই ভালো লাগছিল না। এত এত আন্টি-আঙ্কেলের দাঁত কেলিয়ে কেলিয়ে পরিচয় দেওয়া দেখে তার ঘুম পাচ্ছিল প্রচন্ড। অবশেষে আর না পেরে নেমেই গেল স্টেজ থেকে। খাবারের সাইডে এসে দেখা গেল অভ্র, নীরদ দু’জনই ব্যস্ত। তাই অর্ঘমা আবারও ফিরে গেল। এবার স্টেজে গিয়ে না বসে চেয়ার নিয়ে স্টেজের পেছন দিকে বসল। এখানে জনমানব তেমন একটা নেই। দু’একজন ছেলেমেয়ে আছে। এরা তার বয়সী কিংবা তার থেকে ছোট হবে। তাই নিশ্চিন্ত মনে বসে মাথা পিলারের সাথে হেলিয়ে রেখে ফোন টিপতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে পাশে কেউ বসায় ফোন থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকাল। নীরদ বসে আছে তার পাশে। মৃদু হাসল সে। চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলল,
-“ব্যস্ততা কমেছে?”
-“হ্যাঁ, একটু কমেছে। তোমার ভাইয়ের কাঁধে কাজ গছিয়ে দিয়ে আমি বিশ্রাম নিতে চলে এসেছি।”
কথাটা বলে দু’জনই হেসে ফেলল। পকেট থেকে টিস্যু বের করে অর্ঘমার দিকে এগিয়ে এলো নীরদ। অর্ঘমা তা দেখে ভড়কে গেল। নীরদ হেসে বলল,
-“ভয় কেন পাচ্ছ? আমি তো জাস্ট তোমার কাজলটা ঠিক করে দিতে চাইছি। লেপ্টে গেছে একপাশে।”
-“ওহ আচ্ছা।”
-“এবার ঠিক করি?”
অর্ঘমা হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। যত্ন করে অর্ঘমার লেপ্টে যাওয়া কাজলটুকু মুছে দিল নীরদ। টিস্যুটা পকেটে ঢুকিয়ে হাতে থাকা কোকের বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“অনেকক্ষণ যাবৎ বসে আছ। এটা খেয়ে গলা ভিজিয়ে নাও। তোমার প্রিয় কোকাকোলা।”
নীরদের বলার ভঙ্গি দেখে অর্ঘমা না হেসে পারল না। কিছু একটা মনে পরতেই নীরদ আশেপাশে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
-“নিধি আসেনি?”
-“না।”
-“কেন?”
-“অনেকবার জোর করেছিলাম। ও আসবেই না। দু’দিন পর আবার পরীক্ষা। ওর প্রস্তুতি ঠিকঠাক মতো নেওয়া হয়নি। এজন্যই বইয়ের ভেতরে মুখ গুঁজে বসে আছে।”
নীরদ বিরক্ত হয়ে বলল,
-“তোমরা এত পড়ো কীভাবে? আমি প্রথমে ভেবেছিলাম তুমি ফাঁকিবাজ ছাত্রী হবে। পরে দেখি তুমি অতিরিক্ত পড়ুয়া। এত পড়লে মাথার স্ক্রু ঢিলা হয়ে যাবে।”
অর্ঘমা খিলখিল করে হেসে বলল,
-“কে কাকে বলে? আপনি তো নিজেই গড মুন এডুকেশন সী।”
-“মানে?”
-“ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যা সাগর।”
এবার বেশ কয়েকজনের হাসির আওয়াজ পাওয়া গেল। চমকে পাশে তাকাল অর্ঘমা আর নীরদ। সেখানে থাকা ছেলেমেয়ে গুলো হাসছে। অর্ঘমা এদের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল নীরদকে দেখে।
-“ছবি তুলেছ একটাও?”
-“না।”
-“তুলবে না?”
-“আপনি তুলে দিলে তুলতে পারি।”
নীরদ হেসে বলল,
-“আসো তুলে দিচ্ছি।”
নীরদ বেশ কয়েকটা ছবি তুলে দিল অর্ঘমার। দু’জনে মিলে একসাথে কয়েকটা সেলফিও তুলল। ওদের ছবি তোলার মাঝেই অভ্র এসে দাঁড়াল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
-“আমাকে ছাড়াই ছবি তোলা হচ্ছে?”
-“একদমই না। তোমার কথাই বলছিলাম আমরা। তাই না অর্ঘমা?”
অর্ঘমা মাথা নাড়িয়ে ‘না’ করল অথচ মুখে ‘হ্যাঁ’ বলল। বলে নিজেই জিহ্ব কামড়ে অন্যদিকে তাকাল। হেসে ফেলল অভ্র আর নীরদ। নীরদ তার এক বন্ধুকে ডেকে এনে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-“আমাদের তিনজনের ছবি তুলে দে।”
অভ্র, অর্ঘমা আর নীরদ দাঁড়িয়ে পোজ দিয়ে বেশ কয়েকটা ছবি তুলল। নীরদের ডাক পরতেই সে অর্ঘমাকে বলে অভ্রকে নিয়ে চলে গেল। অর্ঘমা নিজের জায়গায় বসতেই কানের পিঠে কেউ একটা গোলাপ গুঁজে দিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল,
-“এই লাল গোলাপটি এই সুন্দর মেয়েরই প্রাপ্য।”
অর্ঘমা চমকে পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল নীরদকে। ঠোঁটে চমৎকার হাসি নিয়ে পাঞ্জাবির পকেটে হাত গুঁজে চলে যাচ্ছে ছেলেটা। একটু আগের কথা মনে পড়তেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল গাল দু’টি। লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নিয়ে চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে গোলাপটা ছুঁয়ে দেখল। নীরদের বলা কথাটা বারবার তার কানে বেজে চলেছে। খুশিতে পাগল পাগল লাগছে নিজেকে। নীরদের একটা প্রসংশা বাক্যই তার কাছে অনেক কিছু।
___
পরীক্ষার খাতা হাতে নিয়ে উদাসীন ভঙ্গিতে টেবিলে বসে আছে অর্ঘমা। মুখে তার কালো মেঘের ঘনঘটা। ভীষণ মন খারাপ তার। গত দুইদিন নীরদের কোনো খোঁজখবর নেই। মন খারাপের ব্যাপার এটা না। মন খারাপের কারণ হলো আজ স্কুল থেকে ফেরার সময় নীরদকে রাস্তায় একটা মেয়ের সাথে দেখেছে অর্ঘমা। সাথে অবশ্য নিধিও ছিল কিন্তু সে নীরদকে খেয়াল করেনি। গত দুইদিন তাদের স্কুলে পৌঁছে দিয়েছে অভ্র। আর বাসায় আসার সময় অভ্রর বন্ধু এসেছিল নিতে।

অর্ঘমা নিজ ভাবনায় এতটাই মগ্ন ছিল যে কলিংবেলের শব্দ তার কানে গেল না। নিধি অর্ঘমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না। আগে দরজা খোলা উচিত ভেবে তাড়াতাড়ি ছুটে গেল সে। দরজা খুলে নীরদকে দেখে সালাম দিয়ে ভেতরে আসতে দিল। নীরদ রুমে ঢুকে দেখল অর্ঘমা চুপচাপ পরীক্ষার খাতাগুলো উল্টিয়ে দেখছে। চেয়ার টেনে বসতেই চমকে উঠল অর্ঘমা। নীরদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সালাম দিয়ে পরীক্ষার খাতা এগিয়ে দিল। নিধিও এসে অর্ঘমার পাশে বসল। নিজের পরীক্ষার খাতা বের করে এগিয়ে দিল নীরদের দিকে। দু’জনই বেশ ভালো নাম্বার পেয়েছে। খুশি হলো নীরদ। খাতা পাশে রেখে পড়ানো শুরু করল।

নীরদ আজ খুব অবাক হয়েছে অর্ঘমাকে এত চুপচাপ দেখে। যে মেয়েটা প্রতিদিন পড়ার ফাঁকে ফাঁকে নানান রকম দুষ্টুমি কথাবার্তা বলে, এমন কি নিধি আসার পর থেকেও যার এই স্বভাব বদলায়নি, সেই মেয়ে কিনা আজ একেবারে চুপ। পড়ার বাইরে একটা বাড়তি কথাও আজ অর্ঘমার মুখ থেকে বের হয়নি। নীরদের ভালো লাগল না ব্যাপারটা। পড়ানো শেষ করে নিধিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“এক গ্লাস ঠান্ডা পানি পাওয়া যাবে?”
-“অবশ্যই পাওয়া যাবে ভাইয়া। আপনি বসুন, আমি আনছি।”
নিধি যেতেই নীরদ অর্ঘমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“কী হয়েছে? মন খারাপ কেন আজ?”
-“কিছু হয়নি। এমনি ভালো লাগছে না।”
-“কিছু তো একটা হয়েছে। বলতে না চাইলে জোর করব না।”
তবুও অর্ঘমা চুপ করে রইল। নীরদ বলল,
-“এবার কী চাই?”
প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাল অর্ঘমা। তা বুঝতে পেরে নীরদ বলল,
-“গতবার পরীক্ষার ভালো ফলাফলের জন্য ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিলাম। এবার কী চাও? এবারও ঘুরতে যাবে?”
-“না, কিছু চাই না।”
কিছু বলল না নীরদ। অর্ঘমার কিছু একটা হয়েছে তা সে শতভাগ নিশ্চিত। কিন্তু সেটা কী? তার সাথে এমন কেন করছে মেয়েটা? সে কিছু করেছে বলে তো মনে পড়ছে না। তাহলে কী হতে পারে মেয়েটার মন খারাপের কারণ? বাসায় কিছু হয়েছে? হলে তো অভ্র তাকে বলত। যেহেতু বলেনি তার মানে বাসায় কিছু হয়নি। তাহলে কী স্কুলে কিছু হয়েছে? এটা হতে পারে। গত দুই দিন তো সে যায়নি ওদের নিয়ে আসতে। গিয়েছিল অভ্রর বন্ধু। নীরদ কিছুক্ষণ ভেবে ঠিক করল যাওয়ার সময় নিধিকে জিজ্ঞেস করবে এই ব্যাপারে।
দরজার বাহিরে বের হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নীরদ। নীরদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিধি দরজা লাগাতে পারল না। প্রশ্ন করল,
-“কিছু বলবেন ভাইয়া?”
-“হ্যাঁ, একটু কথা ছিল।”
-“জি, বলুন।”
-“অর্ঘমার কী হয়েছে?”
নিধি অবাক হলো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“কী হবে?”
-“কিছু তো একটা হয়েছে। ও আজ একদমই চুপচাপ ছিল। দেখেই বুঝা গেছে ওর মন খারাপ। জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু কিছু বলল না। আমার সাথে এত ঠান্ডা ভাবে ও কখনোই কথা বলে না। কিন্তু আজ এমন কেন করল সেটাই বুঝতে পারলাম না।”
-“এই ব্যাপারে আমি তো কিছু জানি না ভাইয়া।”
-“স্কুলে কিছু হয়েছে? বা রাস্তায়?”
-“না।”
-“বাসায় কিছু হয়েছে? আন্টি কিছু বলেছেন?”
-“না আন্টি কিছু বলেন নি।”
-“বুঝতে পারছি না কিছু। আচ্ছা তুমি একটু জিজ্ঞেস করে দেখো তো। ও যদি তোমাকে বলে তাহলে আমাকে জানিয়ো। আগামীকাল আমি যাচ্ছি তোমাদের স্কুলে দিতে।”
-“আচ্ছা ভাইয়া, আমি জিজ্ঞেস করব। যদি আমাকে কিছু বলে তাহলে অবশ্যই জানাব।”
-“ঠিক আছে, আমি আসছি। দরজা লাগিয়ে দাও।”

চলবে…#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_১৫
.
অর্ঘমা আর নিধিকে দিতে স্কুলে যাচ্ছে নীরদ। অনেকক্ষণ যাবৎ উশখুশ করছে অর্ঘমার সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু অর্ঘমা কথা বলার মুডে নেই তা বুঝাই যাচ্ছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু তার উত্তর দিচ্ছে। এছাড়া নিজে থেকে কিছুই বলছে না। মনটা খারাপ হয়ে গেল নীরদের। স্কুলের গেইটের সামনে পৌঁছাতেই নিধি অর্ঘমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“তুই ক্লাসে যা। আমার একটা খাতা লাগবে। আমি কিনে নিয়ে আসছি।”
-“একসাথেই যাই।”
-“তুই আগে যা। সিট পাব না পরে। ওই দেখ ক্লাসের সবচেয়ে বড় দলটা আসছে। জলদি গিয়ে সিট দখল কর আগে।”
-“আচ্ছা। তুই তাড়াতাড়ি আসিস।”
-“এখনই আসছি আমি।”
অর্ঘমা ভেতরে ঢুকে যেতেই নীরদ জিজ্ঞেস করল,
-“কিছু বলেছে?”
-“হ্যাঁ, গতকাল রাতে ঘুমানোর সময় অনেক জোরাজোরির পর বলেছে।”
-“কী?”
-“আপনি গতকাল একটা মেয়ের সাথে ছিলেন সম্ভবত। স্কুল থেকে ফেরার পথে আপনাদের দেখেছে অর্ঘমা। এজন্যই মেয়েটার মন খারাপ হয়ে গেছে। ও ভেবেছে মেয়েটা হয়তো আপনার প্রেমিকা বা এই টাইপ কিছু হবে।”
-“আরে নাহ্! ওই মেয়ে তো আপুর ননদ ছিল। আমি স্কুলেই আসছিলাম তোমাদের নিতে। রাস্তায় ওর সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল তাই ভদ্রতার খাতিরে কথা বলছিলাম। এর মাঝে দেখি তোমাদের স্কুল ছুটি হয়ে অনেকটা সময় পারও হয়ে গেছে। অভ্র ভাইয়ের বন্ধু তোমাদের নিয়ে এসেছে ভেবে আমি আর যাইনি। আপুর ননদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে চলে গিয়েছিলাম।”
-“একটা কথা বলি ভাইয়া?”
-“হ্যাঁ, বলো।”
-“ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলার কিছু নেই আপনার কাছে, তাই সরাসরিই বলছি। অর্ঘমার অনুভূতি সম্পর্কে আপনি নিশ্চয়ই অবগত? অবগত না হওয়ার কোনো কারণ আমি দেখছি না। অর্ঘমা কিন্তু নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রাখেনি। ওর অনুভূতি খোলা বইয়ের মতো। নিজের প্রতিটা কথা বা কাজ দ্বারা কিন্তু ও আপনাকে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেছে। আর আপনিও যথেষ্ট বুঝদার মানুষ। এসব আপনার না বুঝার কথা নয়। আপনি বুঝেছেন কিন্তু কিছুই বলেননি। এতেই বুঝা যাচ্ছে আপনি অর্ঘমাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। আর আপনার কথাবার্তায় বুঝা যায় আপনিও অর্ঘমাকে পছন্দ করেন।”
-“হ্যাঁ, আমি অর্ঘমাকে প্রশ্রয় দিয়েছি। কারণ ওকে আমার ভালো লাগে। আমি ওর জন্য কিছু একটা অনুভব করি। এর বেশি কিছু বলতে চাচ্ছি না। আর আমারও মনে হয় না তোমার এর থেকে বেশি কিছু জানার আছে।”
হাসল নিধি। বলল,
-“আর কিছু জানার নেই ভাইয়া। শুধু বলব অর্ঘমা খুব ভালো মেয়ে। ওকে কখনো কষ্ট দিয়েন না। মেয়েটা আপনাকে অনেক ভালোবাসে।”
নীরদ কিছু না বলে শুধু হাসল। নিধি চলে যেতেই নীরদ উলটো ঘুরে বাসার দিকে রওয়ানা হলো। মুখে তার এক চিলতে হাসি। অর্ঘমার মন খারাপের কারণ জেনে তার আরও বেশি হাসি পাচ্ছে। মেয়েটা যে আসলেই একটা বোকা আজ তার আবারও প্রমাণ পেল। নাহলে নিধি যেখানে বুঝে গিয়েছে সে অর্ঘমাকে পছন্দ করে, সেখানে অর্ঘমা নিজেই বুঝল না?

ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে নীরদ তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল। বাসায় গিয়ে পড়তে বসতে হবে তাকে। আজ তার পরীক্ষা আছে। অর্ঘমার হয়তো মনেও নেই তার পরীক্ষার কথা। অভিমানে সব ভুলে গিয়েছে মেয়েটা। আবারও হাসি পেল নীরদের। পাশ দিয়ে দুটো মেয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ব্যাপারটা খেয়াল করে নিজেকে সংযত করল নীরদ। এভাবে একা একা হাসতে দেখলে যে কেউ তাকে পাগল ভাববে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। চুলে আঙুল চালিয়ে দ্রুত বাসার দিকে অগ্রসর হলো। বাসায় গিয়ে নাহয় একটু প্রাণ খুলে হেসে নেওয়া যাবে।
___
অভ্র আজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছে। অফিসের এক স্টাফ হঠাৎ মারা যাওয়ায় আজ তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে। পরে অবশ্য জানা গেছে যিনি মারা গিয়েছেন তিনি আসলে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন। তার বাড়ির লোকেরা জানিয়েছেন, বিগত কয়েকদিন যাবৎ নাকি তার বুকে ব্যথা ছিল। তারা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলেও ভদ্রলোক যাননি। আর আজ তিনি পরলোকগমন করলেন।

অভ্র ফ্রেস হয়ে এসে মায়ের রুমে উঁকি দিল। রুমে কেউ নেই। ভ্রু কুঁচকে অর্ঘমার রুমের সামনে গিয়ে দরজায় দু’বার নক করে দাঁড়িয়ে রইল। আগে অর্ঘমার রুমে ঢোকার সময় অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করত না। নিধি আসার পর থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করে। দরজা খুলতেই সম্মুখে ঘুম ঘুম চোখে দাঁড়িয়ে থাকা নিধিকে দেখে গলা ঝেড়ে নিল। এই অসময়ে অভ্রকে দেখে নিধি চমকে গেল। জুবুথুবু হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“কিছু বলবেন?”
-“মা কোথায়?”
-“আমি তো জানি না। রুমেই থাকার কথা।”
-“রুমে নেই, দেখেছি আমি। অর্ঘমা কোথায়?”
-“ঘুমাচ্ছে।”
-“তুমিও ঘুমাচ্ছিলে নাকি?”
-“হ্যাঁ, ওই একটু চোখ লেগে এসেছিল।”
অভ্র কতক্ষণ ইতস্তত করে বলল,
-“একটা কথা বলার ছিল।”
অবাক হলো নিধি। তাকে কিছু বলার ছিল অভ্রর? সে কী আদৌ ঠিক শুনল? এ বাসায় আসার পর অভ্রর সাথে তার কথা হয়েছে হাতেগোনা দুই থেকে তিনবার। তাও পড়া সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। অর্ঘমাকে যখন পড়া সংক্রান্ত বিষয় জিজ্ঞেস করত তখন তাকেও করত। অবাকতার রেশ টেনে সে বলল,
-“বলুন।”
-“মা অথবা অর্ঘমা থাকলে ওদেরই বলতাম। কিন্তু অর্ঘমা তো ঘুমে। আর মা বাসায় নেই। তাই তেমাকেই বলতে হচ্ছে।”
-“কী?”
-“এক কাপ চা দিতে পারবে? আসলে মাথাটা ঝিমঝিম করছে। এক কাপ চায়ের খুব দরকার।”
-“আমি এখনই বানিয়ে দিচ্ছি।”
বলেই হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটল নিধি। অভ্র গিয়ে বসল সোফার রুমে। হঠাৎ তার মনে হলো নিধিকে চা বানাতে বলা ঠিক হয়নি। এর থেকে দোকানে গিয়ে চা খাওয়া উচিত ছিল। একবার ভাবল এখনই গিয়ে নিধিকে চা বানাতে না করে দিবে। পরক্ষণেই আবার ভাবল, নিজেই চা বানাতে বলে আবার নিজেই না করে দিলে বিষয়টা কেমন দেখাবে? অভ্রর কেন যেন প্রচন্ড অস্বস্তি লাগছিল। অর্ঘমাটা জেগে থাকলে ভালো হতো।

নীরবতা কাটিয়ে সশব্দে ফোন বেজে উঠতেই চমকে উঠল অভ্র। ফোন হাতে নিয়ে দেখল আননোউন নাম্বার। একবার ভাবল ধরবে না। আবার কি মনে করে যেন ধরল। ফোন কানের কাছে আনতেই বুঝতে পারল সে যা ভেবেছিল তাই। এটা রিয়ার নাম্বার। ব্রেকাপের পর থেকে রিয়া প্রতিদিন বিভিন্ন নাম্বার দিয়ে তাকে কল করে। এই পর্যন্ত রিয়ার কতগুলো নাম্বার যে সে ব্লক লিস্টে ফেলেছে তার হিসেব নেই। মেয়েটা এতগুলো নাম্বার পেল কোথায়? বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিতে গিয়েও ওপাশ থেকে রিয়ার আকুতি মিনতি শুনে আর কাটল না। যতই হোক সে রিয়াকে ভালোবাসে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করল,
-“আবার কেন ফোন করেছ? কতবার না বলেছি আমায় ফোন করবে না।”
-“এমন কেন করছ অভ্র? আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি তোমাকে ছাড়া। প্লিজ আমার সাথে এমন করো না।”
-“আমি কী করলাম?”
-“আমরা আবার আগের মতো এক হয়ে যেতে পারি না অভ্র? আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তুমিও তো আমাকে ভালোবাসো। তাহলে বিচ্ছেদ কেন?”
-“কারণ তোমার ভাই।”
-“আমার ভাইয়ের দোষটা কোথায় একটু বলবে? সে তো শুধু অর্ঘমাকে পছন্দ করেছে।”
-“পছন্দ করলে কিছু বলতাম না। কিন্তু সে লিমিট পার করেছে আমার বোনকে হুমকি দিয়ে। বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল দেখেও আমি তেমন কিছু বলিনি। ভদ্রভাবে না করেছিলাম। কিন্তু তোমার ভাই এখানেও ঘাড়ত্যাড়ামি করে হুমকি দিয়ে গেল।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে। মেনে নিলাম আমার ভাই ভুল করেছে। ওর জন্য আমাকে কেন শাস্তি দিচ্ছ তুমি?”
-“এক্সকিউজ মি! কে শাস্তি দিচ্ছে তোমায়? তুমি নিজেই না বলেছিলে তোমার ভাইয়ের সাথে আমার বোনের বিয়ে না দিলে আমার তোমার সাথেও প্রেম করার দরকার নেই?”
-“সরি অভ্র। ভুল হয়ে গেছে আমার। প্লিজ মাফ করে দাও।”
অভ্র ফোনের এপাশে নিশ্চুপ রইল। রিয়ার কান্না তাকে পীড়া দিচ্ছে। ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়?
-“সব পুরুষ মানুষের ক্যারেক্টার ঢিলা হয় না রিয়া। কিছু পুরুষ মানুষ এক নারীতেই আসক্ত থাকে। আমি আমার বোনের জন্য এক নারীতে সন্তুষ্ট থাকা পুরুষই চাই। যে শুধু আমার বোনের প্রতিই আসক্ত থাকবে। এবং আমি নিজের ক্ষেত্রেও গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, যে আমার জীবনসঙ্গী হবে আমি তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকব। তাকে ব্যতীত অন্য কারও দিকে নজর দিব না। এখন সেই মানুষটা তুমিই হও বা অন্য কেউ।”
-“এভাবে বোলো না অভ্র। কষ্ট হয় আমার। আমি ব্যতীত তুমি অন্য কারও কথা ভাবার চিন্তা করলেও আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।”
-“কেঁদো না।”
কথাটা শুনে যেন রিয়ার চোখের পানি আরও দ্বিগুণ হয়ে গেল। অভ্র অসহায়বোধ করতে লাগল। দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে সে। তার কী উচিত হবে রিয়াকে নিজের জীবনে ফিরিয়ে নেয়া? মন কেন যেন সায় দিচ্ছে না। কিছু একটা বাঁধা দিচ্ছে তার মনকে। সেটা কী? রিয়া নিজেই আবারও বলল,
-“ভাইয়া অর্ঘমাকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছে অভ্র। অর্ঘমার জন্য সে ভীষণ পাগলামি করছে। হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেয়েছে একসপ্তাহ হলো। বাসায় গিয়েই নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। কারও সাথে কথা বলছে না। শুধু অর্ঘমা অর্ঘমা করে যাচ্ছে। বারবার বলছে অর্ঘমাকে এনে দিতে।”
অভ্র দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-“যা বলতে চাইছ সাফ সাফ বলো।”
-“আমি বলতে চাইছি ভাইয়ার এসব পাগলামিতেই কী প্রমাণ হচ্ছে না যে ভাইয়া অর্ঘমাকে ভালোবাসে? আর একবার কাউকে ভালোবাসলে তার মন কখনো দ্বিতীয় নারীর প্রতি আসক্ত হয় না অভ্র।”
ফোনের এপাশ থেকে হেসে ফেলল অভ্র। রিয়া কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। অভ্র হাসি থামিয়ে বলল,
-“আর একটু হলেই তোমাকে দ্বিতীয় বারের মতো আমার জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য আমি কনভিন্স হয়ে যেতাম। ভাগ্যিস তুমি তোমার ভাইয়ের হয়ে উকালতি করে আমাকে কনভিন্স হওয়া থেকে আটকালে।”
-“অভ্র!”
-“তুমি আর তোমার ভাই জাহান্নামে যাও। আল্লাহ’র ওয়াস্তে আমার আর আমার বোনের পেছন ছেড়ে দাও।”
-“আপনার চা। কড়া লিকার দিয়ে বানিয়েছি। আশা করি মাথা ঝিমঝিম ছেড়ে যাবে।”
অভ্র চোখ উঠিয়ে সামনে তাকাতেই নিধিকে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
-“টেবিলে রাখো।”
ওপাশ থেকে রিয়া বলল,
-“মেয়েটা কে অভ্র? তোমার জন্য চা নিয়ে এসেছে কেন? আবার তুমিও বলছ চা-টা টেবিলে রাখতে। এটা অর্ঘমা না তা আমি শতভাগ নিশ্চিত। তুমি কেন অন্য মেয়ের হাতের বানানো চা খাবে? কে মেয়েটা?”
-“আমার বউ। হ্যাপি? আর কখনো ফোন দিলে খুন করে ফেলব একেবারে।”
কল কেটে নাম্বার ব্লক করে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেল অভ্র। নিধি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কী থেকে কী হলো কিছুই বুঝল না সে। অভ্রর চেহারার হাল দেখেই মনে হচ্ছিল সে এই মুহূর্তে ভীষণ রেগে আছে। তাই আর তার রুমে যাওয়ার সাহস করল না। অর্ঘমার রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল।

অর্ঘমা এখনো ঘুমাচ্ছে। ঘড়িতে সময় দেখে নিল নিধি। নীরদের আসতে আরও ঘন্টা দুই সময় বাকি। এই ফাঁকে আরেকটু ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হয় না ভেবে অর্ঘমার পাশে শুয়ে পড়ল। ঘুম আগে থেকেই তার চোখে ছিল। তাই শোয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here