কিশোরী কন্যার প্রেমে পর্ব -১২+১৩

#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_১২
.
নিধির বাসায় পৌঁছেই দৌড়ে ওপরে গেল অর্ঘমা। নিধি নেই পানির ট্যাংকের পাশে। আসার সময় বহুবার নিধিকে কল দিয়েও পায়নি অর্ঘমা। চিন্তায় তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আর কিছু না ভেবে অভ্র আর নীরদকে নিয়ের নিধির বাসায় ঢুকল। দরজা খোলাই ছিল। অর্ঘমাকে দেখে নিধির সৎ মা যেমন অবাক হলেন তেমন রেগেও গেলেন। কারণ অর্ঘমা শেষবার যখন এখানে এসেছিল সেদিন তিনি সাফ সাফ অর্ঘমাকে বারণ করে দিয়েছিলেন সে যেন এখানে আর না আসে। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অর্ঘমা জিজ্ঞেস করল,
-“নিধি কোথায়?”
-“তোকে কেন বলব? তোকে বলছিলাম না তুই আর আমার বাসায় আসবি না! তো আসছিস কেন?”
-“খেতে আসিনি আপনার বাসায়। ভালোভাবে জিজ্ঞেস করছি, বলুন নিধি কোথায়?”
-“ও আছে ওর ঘরে। কিন্তু এখন দেখা করা যাবে না। তুই যা এখন। এত রাতে কারো বাসায় আসাটা কোন ধরনের সভ্যতা?”
অর্ঘমা পেছন ঘুরে নীরদ আর অভ্রর দিকে করুণ চোখে তাকাল। তার চোখ ছলছল করছে। যেন এখনই কেঁদে ফেলবে। অভ্রর ফোনে কল আসায় সে নীরদকে বলে বেরিয়ে গেল। ফিরে এলো মিনিট দুয়েকের মাঝে। সাথে আছে পুলিশ। নিধির মা পুলিশ দেখে চমকালেন, ভড়কালেন। অর্ঘমা বলল,
-“দেখুন স্যার, নিধি আমাকে ওনার ফোন থেকে কল করেছিল। মেয়েটা লুকিয়ে ছিল। এখন ওনার ফোন ওনার হাতে দেখা যাচ্ছে। তার মানে ওনারা নিধিকে খুঁজে পেয়েছে। প্লিজ নিধিকে নিয়ে আসতে বলুন এখানে।”
অভ্র বোনের পেছনে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রাখল। পুলিশকে পুরো ঘটনা জানানো হয়েছে ফোনেই। তাই তিনি সময় ব্যয় না করে কনস্টেবলকে বললেন,
-“পুরো বাসা সার্চ কর।”
-“আরে আরে যাচ্ছেন কোথায় আপনারা?”
নিধির সৎ মায়ের কথায় অফিসার বললেন,
-“আপনার নামে অভিযোগ আছে।”
আঁতকে উঠলেন নিধির সৎ মা। রাগী চোখে তাকালেন অর্ঘমার পানে। নিধির বাবা বাসায় ঢুকে পুলিশ দেখে অবাক হয়ে গেলেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে পুলিশ তাকে নিধির ফোন করে জানানো ব্যাপারটা বললেন। তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল মুহূর্তেই। অভ্র আর নীরদ বুঝতে পারল ভদ্রলোক নিজেও এই ঘটনার সাথে জড়িত।

কনস্টেবল ভেতর থেকে একটা ছেলেকে টেনে নিয়ে আসলেন। অর্ঘমা নিধির কথা তাকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন ভেতরে মহিলা কনস্টেবলের সাথে আছে। দেরি করল না অর্ঘমা। দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। অভ্র আর নীরদ গেল না পেছনে। নিধি কী অবস্থায় আছে কে জানে! এই অবস্থায় ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে না তাদের। তারা দাঁড়িয়ে রইল পুলিশের সাথে।

নিধির ঘরে ঢুকতেই অর্ঘমার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরল। মেয়েটার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে সে নিজেই কেঁপে উঠল। নিধি অর্ঘমাকে দেখেই তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। কনস্টেবল মহিলা অর্ঘমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
-“আপনি কে?”
-“ওর বান্ধবী। ও আমাকেই কল করে জানিয়েছিল এখানের ঘটনা।”
নিধির সারা শরীরে মারের দাগ। ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে গেছে। ক্ষতগুলো দেখেই বুঝা যাচ্ছে এগুলো তাজা। অর্ঘনা নিধির হাত ধরে ওকে বিছানায় বসিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে পানি খুঁজল। নিধিকে পানি খাইয়ে তার পাশে বসে হাত ধরে জিজ্ঞেস করল,
-“কী হয়েছিল সবটা বল আমাকে।”
কান্নার দমকে বারবার কেঁপে উঠছে মেয়েটা। অর্ঘমার পানে তাকাতেই তাকে আশ্বাস দিল অর্ঘমা।
-“ফোন কেটে আমি ছাদেই লুকিয়ে ছিলাম চুপচাপ। ততক্ষণে নিচে আমাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছিল খালা আর তার ভাগ্নে। বিল্ডিংয়ের সবার বাসায় গিয়ে আমার কথা জিজ্ঞেস করেছে। আমি ছাদে আসার সময় চারতলার এক মহিলা আমায় দেখে নিয়েছিলেন। তিনিই ওদের জানিয়েছেন আমার ছাদে আসার কথা। খালা আর তার ভাগ্নে ছাদে এসে আমাকে খুঁজে না পেয়ে দোতলা ছাদে আসে। আর আমাকে পানির ট্যাংকের পাশেই পেয়ে যায়। খালা আমাকে সেখানে দাঁড়িয়েই কতগুলো থাপ্পড় মারেন। তারপর আমার চুলের মুঠি ধরে বাসায় টেনে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক পেটান আমাকে। খালার ভাগ্নেও মেরেছে। আমার শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি ছিল না আর মার খাওয়ার। আমাকে সেই অবস্থাতেই এই ঘরে ফেলে রেখে চলে যায় ওরা। কিছুক্ষণ পরে খালার ভাগ্নে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। বাবাও এসবের সাথে জড়িত অর্ঘ।”
কেঁপে উঠল অর্ঘমা। ওর নিজের চোখ থেকেও পানি গড়িয়ে পরল। মেয়েটার সাথে কী তবে আরও বাজে কিছু ঘটেছে? কণ্ঠনালি কাঁপছে অর্ঘমার। তবুও সে বলল,
-“সে কী তোর সাথে বাজে কিছু…”
আর বলতে পারল না। নিধি জোরে কেঁদে উঠল। অর্ঘমা তাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। একসময় শান্ত হলো নিধি। মাথানিচু করে মিনমিনে গলায় বলল,
-“বেশি কিছু করতে পারে নি। তার আগেই পুলিশ এসে গিয়েছিল। তবুও যেখানে যেখানে ওই লোক আমায় স্পর্শ করেছে মনে হচ্ছে সেখানে সেখানে এসিড ঢেলে জ্বালিয়ে দেই। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে অর্ঘ। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।”
আবারও কেঁদে উঠল নিধি। কাঁদতে কাঁদতে এবার তার অবস্থা প্রায় অচেতনের মতো হয়ে গেল। মুখ থেকে হালকা গোঙানির শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা গেল না আর। অর্ঘমা বুঝলো না কিছুই। ঘাবড়ে গিয়ে মহিলা কনস্টেবলকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি নিধির শ্বাসের গতিবিধি দেখে কপালে হাত ছোঁয়ালেন। আঁতকে উঠে বললেন,
-“শরীর তো প্রচন্ড জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।”
নিধির জামা ঠিকঠাক করে সেভাবেই শুইয়ে রেখে ঘর ছেড়ে বের হলো অর্ঘমা আর মহিলা কনস্টেবল। বাইরের ঘর থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছে। সেখানে গিয়ে মহিলা কনস্টেবল অফিসারকে জানালেন নিধির বলা কথাগুলো।

অর্ঘমা অভ্রর কাছে গিয়ে বলল,
-“নিধিকে নিয়ে হসপিটালে যেতে হবে ভাইয়া। ওর অবস্থা ভালো নয়। সারা শরীরে মারের দাগ আর প্রচন্ড জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।”
-“ঠিক আছে, নিয়ে যাব।”
নীরদ অফিসারের উদ্দেশ্যে বলল,
-“এনাদের কী শাস্তি দিবেন তা আপনি জানেন। তবে দেখবেন শাস্তি যেন কঠিন হয়।”
-“অবশ্যই।”
অর্ঘমা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“নিধি এই বাড়িতে থাকলে ওকে আর বাঁচানো যাবে না ভাইয়া। আমি এই মহিলাকে এক বিন্দুও বিশ্বাস করি না। তাছাড়া এই মহিলা নিধির বিয়ে ঠিক করেছেন এক চরিত্রহীন পঞ্চাশোর্ধ বুড়ো লোকের সাথে। আজ বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বুড়ো কোমড়ে ব্যথা পেয়েছে দেখে বিয়ের তারিখ পেছানো হয়েছে। ওই বুড়োর আবার আরও দুইটা বউ আছে। আমি নিধিকে এখানে রাখতে ভরসা পাচ্ছি না।”
-“নিধিকে আমাদের সাথে আমাদের বাসায় নিয়ে যাব।”
-“মা-বাবা!”
-“তাদের আমি বুঝিয়ে বলব।”
নিধির সৎ মা চিল্লিয়ে উঠলেন ওদের কথা শুনে। মহিলা প্রচন্ড আক্রোশে ফেটে পড়লেন।
-“নিধিকে নিয়ে যাবি মানে! ওকে তোদের সাথে কেন নিবি? তোর ভাইয়ের রক্ষিতা করে রাখার জন্য!”
মহিলার কথা শুনে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল অভ্র, নীরদ আর অর্ঘমা। অভ্র রেগে বলল,
-“মুখ সামলে কথা বলবেন।”
মহিলার সাথে অভ্রর বাকবিতণ্ডতা লেগে গেল। তার কথা হলো তিনি কোনোভাবেই নিধিকে নিয়ে যেতে দিবেন না। তার সাথে সহমত প্রকাশ করছে নিধির বাবা। নীরদ এসব দেখে পুলিশের সাথে কথা বলে ঠিক করল নিধি তাদের সাথেই যাবে। অন্তত পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাদের সাথেই থাকবে মেয়েটা। কথা শেষ করে নীরদ অভ্রকে শান্ত হতে বলল।
-“নিধিকে নিয়ে এসো অর্ঘমা।”
নীরদের কথায় অর্ঘমা বলল,
-“ওকে হাঁটিয়ে নেওয়া যাবে না। সেন্স নেই ওর।”
-“কোলে নিতে হবে?”
-“হ্যাঁ, এছাড়া উপায় নেই।”
-“ঠিক আছে, চলো।”
নীরদ অন্য মেয়েকে কোলে নিবে শুনতেই অর্ঘমার শরীরে কাটা দিয়ে উঠল। রেগে নীরদের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই থতমত খেয়ে গেল নীরদ। এভাবে তাকানোর মানে কী? অর্ঘমা দাঁতে দাঁত চেপে অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“ভাইয়া, তুমি নিধিকে উঠাবে। এসো আমার সাথে।”
অভ্র গিয়ে নিধিকে কোলে তুলে বের হলো। পুলিশ ততক্ষণে বাকিদের নিয়ে চলে গেছে।
___
রাতের খাবার নিয়ে অর্ঘমা ঘরে প্রবেশ করল। নিধি বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। চেহারায় অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। গত তিনদিন কঠিন জ্বরে আক্রান্ত ছিল মেয়েটা। গতকালই হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না বলেই ভর্তি করতে হয়েছিল। এখন একটু সুস্থ আছে বলে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে।

খাবারের প্লেট নিধির সামনে রেখে তাকে ধরে ঠিক করে বসতে সাহায্য করল। অর্ঘমা নিজ হাতে খাবার খাইয়ে দিল নিধিকে। খাবার শেষে যত্ন করে মুখ মুছে দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিল। প্লেট রান্নাঘরে রেখে এসে নিজেও খেয়ে নিল। হাত ধুয়ে রুমে এসে দেখল নিধি চোখ বন্ধ করে কাঁদছে। তার পাশে বসে অর্ঘমা জিজ্ঞেস করল,
-“খারাপ লাগছে?”
-“আমার ভাগ্যটা এমন কেন হলো বলতে পারিস? কী পাপ করেছিলাম আমি?”
-“যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। আমরা তো কিছুই বদলাতে পারব না তাই না! এসব আর ভাবিস না। এখন একটু ঘুমা তো। সপ্তাহখানেক পরে টেস্ট পরীক্ষা। আগামীকাল থেকে পড়তে বসবি। আমি তোদের বাসা থেকে আসার সময় তোর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এসেছি।”
কিছু বলল না নিধি। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। তার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে।
___
নিধিকে বাসায় নিয়ে আসায় কিছুটা নারাজ হয়েছেন অভ্রর মা। এর কারণ হলো তিনি সেদিনের ঘটনা অর্ঘমার কাছ থেকে শোনার পর ভেবেছেন নিধিকে তার সৎ মায়ের ভাগ্নে রেপ করেছে। নিধি ভয় পেয়ে সত্যিটা বলছে না। এর ওপর আবার নিধিকে অভ্রর কোলে দেখে তার মাথা ঘুরে উঠেছেন। তিনি ভয়ে আছেন অভ্রকে নিয়ে। তার এত ভালো ছেলেটা আবার নিধির জালে ফেঁসে না যায়। তার ছেলে অনেক ভালো মেয়ে ডিজার্ভ করে। তাছাড়া নিধির রেপ না হলেও তিনি এই মেয়েকে তেমন একটা পছন্দ করতেন না। একে তো মা নেই। থাকে সৎ মায়ের অত্যাচারে। বাপ তো থেকেও না থাকার মতো। এমন একটা পরিবারের মেয়েকে কীভাবে পছন্দ করবেন তিনি!

চলবে…#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_১৩
.

.
অর্ঘমাদের এক্সাম শুরু হয়ে গেছে। নিধি এখনো অর্ঘমাদের বাসাতেই আছে। গত কয়েকদিন অর্ঘমা আর নীরদ মিলে নিধিকে সব পড়া বুঝিয়ে দিয়েছে। নিধি ভালো ছাত্রী হওয়ায় তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি পড়া বুঝাতে।
ইদানিং অর্ঘমা খেয়াল করছে তার মায়ের ব্যবহার নিধির প্রতি কিছুটা অন্যরকম। আগের মতো আদর করেন না তিনি নিধিকে। কেমন যেন সারাক্ষণ ফরমায়েশ দিতে থাকেন। অথচ অর্ঘমাকে তিনি কখনো একটা কাজের কথা বলেন না। নিধির সাথে আচরণটা এমন করেন যেন সে এই বাড়ির আশ্রিতা। অর্ঘমা আশ্চর্য হয়ে দেখে মায়ের এসব কর্মকাণ্ড।

অর্ঘমার বাবা পারিবারিক ঝামেলা থেকে সবসময় দূরেই থাকেন। যেমন নিধির এই বাসায় থাকা বা না থাকা নিয়ে তার কিছু আসে যায় না। মিনা বেগম এই নিয়ে প্রায় রাতেই তার সাথে ঘ্যানঘ্যান করেন কিন্তু তিনি এসবে কান দেন না। নিধির ব্যাপারে সবই শুনেছেন তিনি। মেয়েটার এই দুঃসময়ে তার পাশে থাকার মতো কেউ নেই। সেখানে নিজের ছেলেমেয়ে নিধিকে সাহায্য করছে তো করুক। এতে ক্ষতি কি! কিন্তু মিনা বেগমের কথায়বার্তায় ও ব্যবহারে তিনি যারপরনাই বিরক্ত। সবসময় এককাঠি উপরে বুঝা যেন এই মহিলার স্বভাব। মিনা বেগমকে এখন হাজার প্রমাণ দেখালেও তিনি বিশ্বাস করবেন না যে নিধির সাথে কিছুই হয়নি। সে ধ/র্ষি/তা নয়। শুধু শুধু কথা বাড়িয়ে মুখ ব্যথা করে লাভ নেই। তাই অর্ঘমার বাবা তার কথা চুপচাপ শুধু শুনে যান কিন্তু কিছু বলেন না।

পরীক্ষা দিয়ে নীরদের সাথে বাসায় ফিরল অর্ঘমা আর নিধি। বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই মিনা বেগম নিধিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“ওয়াশরুমে জামাকাপড় ভিজিয়ে রেখেছি। ওগুলো একটু ধুয়ে ছাদে দিয়ে আয় তো নিধি।”
নিধি কিচ্ছুটি না বলে চুপচাপ রুমে গিয়ে স্কুল ড্রেস বদলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল জামাকাপড় ধোয়ার জন্য। অর্ঘমা প্রায় সাথে সাথেই মায়ের কাছে গিয়ে বলল,
-“বাসায় ওয়াশিংমেশিন থাকতেও নিধিকে দিয়ে জামাকাপড় ধোয়ানোর মানে কী মা?”
-“মানে কী মানে? একটা উটকো ঝামেলা আমার বাসায় থাকছে, খাচ্ছে তো সামান্য কাজ করে দিতে পারবে না? সারাক্ষণ তো শুয়ে-বসে থাকছে আর গাণ্ডেপিণ্ডে গিলছে। একটু কাজ করে সেসব শোধ করুক।”
-“ছিঃ মা! তোমার কাছ থেকে আমি এসব একদমই আশা করিনি। তুমি এভাবে বলতে পারলে নিধিকে? ও কী ইচ্ছে করে এসেছে এখানে? ওর অবস্থাটা বিবেচনা করে আমি ওকে এখানে নিয়ে এসেছি জোর করে।”
-“হ্যাঁ, জানি তো। মূল দোষীটা যে তুই তা কী আর জানতে বাকি আছে আমার? দেখেছিস তো বাবার টাকা। ভেবেছিস বাবার কারিকারি টাকা আছে তাই বাসাটাকে একটা আশ্রম বানিয়ে ফেলি।”
-“মা!”
-“চুপ কর। তোর উপরে আমার এত রাগ উঠছে যা আমি বলে বোঝাতে পারব না। তুই কোন আক্কেলে ওকে বাসায় নিয়ে এসেছিস? বাসায় যে তোর জোয়ান ভাই আছে সে খেয়াল নেই তোর? ওমন একটা পরিবারহীন ধ/র্ষি/তা মেয়েকে যে আমার বাসায় নিয়ে এসেছিস, এখন যদি আমার ছেলেকে ওই মেয়ে ব/শ করে নিজের কাছে নিয়ে যায় তখন? এমন মেয়েকে দিয়ে আমি চার আনা বিশ্বাসও করি না।”
-“নিজের মুখে লাগাম টানো মা। মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছ তুমি। ভাইয়া আসুক আগে। ওকে আমি সব বলব। বাবাকেও বলব। তোমার এই হীন মনমানসিকতার কথাবার্তা শুনে ওরা তোমাকে কতটুকু সাপোর্ট করে আমিও দেখব। তুমি নিজেও তো একটা মেয়ে। তাহলে মেয়ে হয়েও কীভাবে অন্য একটা মেয়েকে এসব বলতে পারো তুমি?”
অর্ঘমার গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ বসিয়ে দিলেন মিনা বেগম। হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে মায়ের দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অর্ঘমা। মায়ের অগ্নি দৃষ্টি যেন ঝ-ল-সে দিতে চাইছে তাকে। যে মা তার গায়ে কখনো একটা ফুলের টোকাও লাগতে দেয়নি সেই মা আজকে তাকে মা/র/ল! তাও সামান্য একটা বিষয় নিয়ে! এটা কী আদৌ তার মা?
___
আজ শুক্রবার। বন্ধের দিন। অভ্র খেয়াল করেছে নিধি বাসার প্রায় সব কাজই করছে। এতদিন ব্যস্ত থাকায় এসব খেয়াল করা হয়নি। নিধিকে বাসার কাজ করতে দেখে যতটা না অবাক হয়েছে তার থেকে বেশি বিস্মিত হয়েছে মিনা বেগমের নিধিকে হুকুম করা দেখে। মিনা বেগম যা যা বলছেন নিধি বিনা বাক্য ব্যয়ে তাই তাই করে যাচ্ছে।
অর্ঘমাকে দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে কোথাও। অফিসে প্রচুর ব্যস্ততা চলছে ইদানিং। বাসায় আসতে আসতে রাত দশটার বেশি বেজে যায়। গত দু’দিন যাবৎ অর্ঘমা তার সাথে কথা বলতে আসেনি। সে নিজে কথা বলতে গেলে দেখা গেছে অর্ঘমা ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই আর কথা বলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। মেয়েটার আবার হুট করে কী হলো কে জানে। নীরদের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছে অর্ঘমা তার সাথেও বাড়তি কোনো কথা বলেনি পড়া সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া। এমনটা অর্ঘমা তখনই করে যখন তার মন বিষণ্ণ থাকে অথবা কারো প্রতি তার খুব অভিমান হয়।

অর্ঘমার রুমে ঢুকে দেখতে পেল অর্ঘমা পড়ার টেবিলে বসে পড়ছে। অভ্র তার পাশে গিয়ে বসল। কিছু বলল না অর্ঘমা। তাকাল পর্যন্ত না। অভ্র তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“কী হয়েছে তোর? ক’দিন ধরে দেখছি আমার সাথে কোনো কথা বলছিস না। যে মেয়ে পরীক্ষার সময় সারারাত জেগে পড়াশোনা করে সেই মেয়ে রাত দশটা বাজতে না বাজতে ঘুমিয়ে পড়ছে। ব্যাপারটা তো স্বাভাবিক না। কোনো সমস্যা হলে বল আমাকে।”
চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থেকে বই বন্ধ করে ভাইয়ের দিকে ঘুরে বসে তাকে জড়িয়ে ধরল অর্ঘমা। অভ্র বোনের মাথায় আদরের সহিত হাত বুলিয়ে দিতে গেলে টের পেল তার বোন কাঁদছে। বিচলিত হলো অভ্রর মন। উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“কী হয়েছে অর্ঘ? কাঁদছিস কেন বোন? ভাইয়াকে বল। ভাইয়া সব ঠিক করে দিব।”
অভ্র অনেক চেষ্টার পর অর্ঘমার কান্না থামাতে সক্ষম হলো। অর্ঘমা ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে এলো। অভ্র তার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল। অল্প পানি খেয়ে অর্ঘমা বলল,
-“ছাদে যাব ভাইয়া।”
ঘড়িতে সময় দেখল অভ্র। সকাল দশটা বাজে। আজকে জুমার নামাজ আছে। অবশ্য নামাজ শুরু হতে এখনো অনেক সময় বাকি। তাই বোনের কথায় সায় দিয়ে তাকে নিয়ে ছাদে গেল।
ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দূর আকাশ পানে তাকিয়ে অর্ঘমা জিজ্ঞেস করল,
-“জন্মের পর থেকে কী এখন পর্যন্ত কখনো আমার গায়ে হাত তোলা হয়েছে ভাইয়া?”
-“না। তোর গায়ে হাত তুলব কেন? তুই তো আমার লক্ষী বোন। আমার পুতুল বোন। তোকে মা/রা/র প্রয়োজন পড়েনি আজ পর্যন্ত।”
-“অথচ গত পরশু মা আমার গায়ে হাত তুলেছে। থা/প্প/ড় মেরেছে আমাকে।”
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাল অভ্র। অর্ঘমা মলিন হেসে বলল,
-“আমিও তোমার মতো ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম যে মা আসলেই আমাকে মেরেছে তখন খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার। এখনো হচ্ছে।”
-“কেন মে/রে/ছে? মানে হয়েছিল কী আসলে?”
অর্ঘমা তার ভাইকে পুরো বিষয়টা খুলে বলল। সবটা শুনে অভ্রর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছে ভ/স্ম করে দেবে সবাইকে। রাগে তার র/ক্ত টগবগ করে ফুটছে। অর্ঘমাকে সাথে নিয়ে নিচে নেমে গেল অভ্র। বাসায় এসে কোনো চেঁ/চা/মে/চি কিছুই করল না। মাথা ঠান্ডা করে নিধিকে ডাকল। নিধি তো আসলই সাথে মিনা বেগমও হন্তদন্ত হয়ে বের হলেন রান্নাঘর থেকে। তার ছেলে আবার নিধিকে কেন ডাকছে? অভ্র নিধির দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তোমাকে এই বাসায় কাজ করার জন্য নিয়ে আসা হয়নি। পরীক্ষা চলছে না? রুমে গিয়ে পড়াশোনা করো। তোমাকে যেন আমি আর কখনো বাসার কোনো কাজ করতে না দেখি। লাগলে বাসায় কাজের মানুষ একটা রেখে নিব। তুমি শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা করবে।”
অর্ঘমার দিকে তাকিয়ে অভ্র বলল,
-“ওকে নিয়ে রুমে যা। পড়াশোনা ছাড়া ওর আর তোর অন্য কোনো কাজ নেই। গিয়ে পড়তে বস দু’জনে। পরীক্ষা ভালো হওয়া চাই।”
অর্ঘমা ভাইয়ের কথামতো নিধিকে নিয়ে রুমে চলে গেল। মিনা বেগম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন অভ্রর দিকে। অভ্র সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে নিজের রুমে চলে গেল। ছেলে যখন একবার বলে দিয়েছে তখন আর নিধিকে কোনো কাজে ডাকা যাবে না বুঝতে পেরে রাগে গজগজ করতে করতে নিজেই রান্নাঘরে ঢুকলেন।

অভ্রকে সন্দেহ করার কোনো মানেই হয় না। অভ্র তেমন ছেলেই নয়। তবুও চিন্তা হচ্ছে মিনা বেগমের। যতই হোক জোয়ান ছেলে বলে কথা। যদি মতিভ্রম হয়ে যায়? এছাড়াও আশেপাশের প্রতিবেশীরা সকলে জেনে গেছে তাদের বাসায় অর্ঘমার অবিবাহিত বান্ধবী থাকছে। তারা এখন বিভিন্ন বা-জে মন্তব্য করছে। অনেকে তো আবার তার কাছ থেকেই নিধির ব্যাপারে জেনে তার মনে সন্দেহ তৈরি করে দিয়েছে। সবাই বলছে নিধিকে বাসা থেকে বের করে দিতে। তা না হলে নিধি নাকি তার ছেলের মাথা নষ্ট করে দিবে। মূলত এজন্যই তার ভয়।
___
বিকেলবেলা অর্ঘমা আর নিধিকে নীরদের সাথে বাইরে পাঠিয়ে দিল অভ্র। মায়ের সাথে তার একান্তে কথা বলা উচিত। বাবাকেও ডেকে নিবে সাথে। বাবা-মাকে ডেকে সোফায় এসে বসল অভ্র। এবার খোলাখুলি ভাবে কথা বলা যাবে। মায়ের এত কিসের সমস্যা তা-ও জানা যাবে।
-“কী হয়েছে?”
বাবার কথায় অভ্র শান্ত গলায় বলল,
-“কী হয়েছে সেটা তো মা বলবে। নিধি, অর্ঘমা দু’জনকেই নীরদের সাথে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছি। এবার মা বলো, সমস্যা কী?”
-“কিসের সমস্যা?”
-“তুমি অর্ঘমার গায়ে হাত তুলেছ কেন? আর নিধির সাথে তোমার এমন জঘন্য আচরণের মানে কী?”
থতমত খেয়ে গেলেন মিনা বেগম। মেয়েটা এভাবে অভ্রকে সব বলে দিবে সেটা কে জানত? মনে মনে কথা গুছিয়ে নিয়ে বললেন,
-“অর্ঘমা বেয়াদবি করেছে তাই মে/রে/ছি। এতটুকু মেয়ে মায়ের সাথে বে/য়া/দ/বি করার সাহস পায় কীভাবে? এই সাহস যাতে দ্বিতীয়বার না দেখায় তাই মে/রে/ছি। শাসন করার অধিকার আমার আছে।”
-“অবশ্যই শাসন করার অধিকার তোমার আছে। কিন্তু অযৌক্তিক কারণে শাসন করার অধিকার তোমার নেই। অর্ঘমা শুধু নিধির হয়ে কথা বলায় তুমি ওকে মে/রে/ছ।”
-“আমাকে একটু খুলে বলবি, আসলে হয়েছে কী?”
বাবার প্রশ্ন শুনে অভ্র তার দিকে তাকাল। অর্ঘমার বলা সব কথা তাকে বলল। সব শুনে বেজায় রেগে গেলেন তিনি। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তাকে ধ/ম/কে উঠলেন। অভ্র থামাল তাকে। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
-“অর্ঘমা নিধিকে বাড়িতে নিয়ে আসায় তো আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আর আমার মেয়ে আমার টাকা উড়াচ্ছে। এতে তোমার সমস্যাটা কোথায়? কোন সাহসে ওর গায়ে হাত তুলেছ তুমি?”
-“বেশ করেছি মে/রে/ছি। আরও মা/র/ব লাগলে। নিধিকে আমি আমার বাসায় দেখতে চাই না। ধ/র্ষি/তা একটা মেয়েকে বাসায় রেখে কত কথা শুনতে হচ্ছে আমাকে তা জানো তুমি?”
-“মা! কথাবার্তা বলার আগে ভেবে চিন্তে বলবে। তোমাকে বারবার বলেছি নিধির কোনো ক্ষ/তি হয়নি সেদিন। তবুও বারবার মেয়েটাকে তুমি ধ/র্ষি/তা বলছ কেন?”
-“তোরা বললেই আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? আমি তোদের চেয়ে অভিজ্ঞ মানুষ। আমি ওকে দেখেই বুঝতে পেরেছি ওর সাথে কী কী হয়েছে।”
-“তুমি অভিজ্ঞ মানুষ হতে পারো, কিন্তু ডাক্তার নও। নিধির শরীর খারাপ থাকায় সেদিন ওকে হসপিটালে ভর্তি করেছিলাম। ডাক্তার তখনই চেকাপ করে জানিয়েছিলেন ওর শারীরিক কোনো ক্ষ/তি হয়নি।”
মিনা বেগম নিজের মনে গড়া আরও কিছু অযৌক্তিক কথা বলতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু তাতে বাধ সাধলেন অভ্রর বাবা। স্ত্রীকে ধমকে চুপ করিয়ে দিলেন। শাসিয়ে বললেন,
-“নিধির যতদিন মন চাইবে থাকবে এখানে। ওকে কোনো প্রকার কটু কথা তুমি শোনাবে না বা ওকে দিয়ে কোনো কাজ তুমি করাবে না। আর না অর্ঘমাকে এই নিয়ে কিছু বলবে। যদি শুনেছি এমন কিছু তুমি করেছ তাহলে তোমার একদিন কি আমার একদিন। কথাটা মাথায় রেখো। টাকা তোমার যাচ্ছে না। টাকা গেলে আমার যাচ্ছে। আমার যখন সমস্যা হচ্ছে না তখন তোমারও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here