কিশোরী কন্যার প্রেমে পর্ব -১০+১১

#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_১০
.
সূর্য অস্ত যাচ্ছে। গাছের নিচে বেঞ্চের উপর বসে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করছে অর্ঘমা। নীরদ গেছে সামনের স্টল থেকে ফুচকা আনতে। তখন অর্ঘমার কানের পিঠে গোলাপ গুঁজে দেওয়ার পর তারা দু’জন অনেকক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল। নীরদের ফোনের শব্দে ঘোর কেটেছিল তাদের। দু’জনেই কিছুটা লজ্জা পেয়েছিল। অস্বস্তিতে ভুগছিল। সেই অস্বস্তি কাটানোর জন্যই নীরদ বলেছিল,
-“ছবি তুলতে পছন্দ কর?”
-“হ্যাঁ।”
-“তাহলে তুমি দাঁড়াও, আমি ছবি তুলে দিচ্ছি।”
-“না, না দরকার নেই।”
-“অবশ্যই দরকার আছে। তুমি দাঁড়াও।”
এরপর নীরদ বেশ অনেকগুলো ছবি তুলে দিয়েছে তার। সেগুলো সব নীরদের ফোনেই রয়েছে।

অর্ঘমা আশেপাশে তাকিয়ে দেখছিল। তারা আসার পর তেমন একটা লোকসমাগম ছিল না জায়গাটায়। কিন্তু এখন লোকের অভাব নেই। এখানে বেশিরভাগই প্রেমিক-প্রেমিকা এসেছে। কেউ একে অপরের হাতে হাত রেখে হাঁটতে ব্যস্ত। কেউ আবার লেকের ধারে বসে প্রেমিকের কাঁধে মাথা রেখে গল্প করতে ব্যস্ত। অথবা কেউ কেউ একে অপরকে খাইয়ে দিতে ব্যস্ত। ভালোই লাগল অর্ঘমার। হালকা হেসে সামনে তাকাল। নীরদকে দেখা যাচ্ছে। যে এখন স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ফুচকা বানানো দেখছে। মাঝে মাঝে তার দিকে তাকিয়ে দেখছে সে ঠিক আছে কিনা।

কিছুক্ষণ বাদেই হাতে দুই প্লেট ফুচকা নিয়ে ফিরে এলো নীরদ। একটা প্লেট অর্ঘমার দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্য প্লেট নিয়ে নিজে অর্ঘমার পাশে বসল। প্রতিটা ফুচকা বেশি করে টক দিয়ে ভিজিয়ে চোখ বন্ধ করে মুখে দিচ্ছে অর্ঘমা। মুখে নিয়েই চোখমুখ কুঁচকে ফেলছে। যেন এর থেকে তৃপ্তি আর কিছুতে নেই। অর্ঘমার চেহারার অভিব্যক্তি দেখে হা করে তাকিয়ে রইল নীরদ। অর্ঘমা ফুচকায় বেশি করে ঝাল দিয়ে নিয়ে আসতে বলেছিল। নীরদও তার কথা মতো বেশি ঝাল দিতে বলেছিল ফুচকাওয়ালাকে। ঝালে অর্ঘমার নাক লাল হয়ে গেছে। ভ্রু কুঁচকে নিজের প্লেট থেকে একটা ফুচকা নিয়ে মুখে দিতেই নীরদের মনে হলো তার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। খুব কষ্টে ফুচকাটা গিলে নিল। বাকি ফুচকাগুলো আর খাওয়ার সাহস হলো না। অথচ এই ফাঁকে অর্ঘমা নিজের পুরো প্লেট সাফ করে ফেলেছে। নীরদের প্লেটে ফুচকা গুলো আগের মতোই আছে দেখে সে বলল,
-“আপনি খাচ্ছেন না কেন?”
-“একটা খেয়েছি। আর খেতে মন চাচ্ছে না।”
-“ফুচকাগুলো তো ভালোই ছিল। তাহলে?”
-“আসলে আমার এসব খাওয়ার অভ্যাস নেই।”
-“ওহ্!”
-“তোমার ঝাল লাগেনি?”
-“ফুচকায় ঝাল না হলে খেয়ে মজা আছে নাকি?”
-“তাহলে এগুলোও তুমি খাও।”
-“আপনি সত্যি আর খাবেন না?”
-“সত্যি করে বলি! আসলে আমি এত ঝাল খাই না। তোমার দেখাদেখি আমি আমারটাও ঝাল দিয়ে বানাতে বলেছিলাম। কিন্তু একটা খেয়ে দেখি অনেক ঝাল হয়েছে। আমি আর খেতে পারব না।”
নীরদের অসহায় চেহারা দেখে হেসে ফেলল অর্ঘমা। খালি প্লেট পাশে নামিয়ে রেখে নীরদের ফুচকার প্লেটটা হাতে নিয়ে খেতে লাগল। নীরদ গালে হাত দিয়ে অর্ঘমার ফুচকা খাওয়া দেখতে লাগল।

ফুচকা খাওয়া শেষ করে বিল দিয়ে উঠে গেল তারা। এবার বাসায় ফেরার পালা। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। রিকশায় ওঠার আগে অর্ঘমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে নীরদ কোথায় যেন গেল। ফিরে এলো কিছুক্ষণের মাঝে। অর্ঘমাকে রিকশায় উঠিয়ে এবারও ওড়নাটা ঠিক করে তার কোলের মাঝে দিল। নিজে পাশে উঠে বসে একটা পানির বোতলের মুখ খুলে এগিয়ে দিল। মৃদু হেসে বোতলটা নিয়ে পানি খেয়ে বোতল ফিরিয়ে দিল। সেই বোতল থেকে নীরদ নিজেও পানি খেল। অর্ঘমা শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখল। এই ছোট ছোট যত্নগুলো অর্ঘমার মনে প্রতিনিয়ত নতুন করে আরো বেশি ভালো লাগার বীজ জন্ম দিচ্ছে।
___
অভ্র বাসায় এসেছে দু’হাত ভরতি মিষ্টি নিয়ে। তার চেহারায় খুশির ঝলক। অভ্রর মা মিনা বেগম ভীষণ অবাক হলেন ছেলের হাতে এত মিষ্টি দেখে।
-“এত মিষ্টি কিসের?”
-“আমার এত এত পরিশ্রম অবশেষে সফল হয়েছে মা।”
মিনা বেগম ছেলের দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাসিমুখে বললেন,
-“তোর চাকরি হয়ে গেছে?”
-“হ্যাঁ, মা। আমার চাকরি হয়ে গেছে। মাসে পয়ত্রিশ হাজার টাকা বেতন। কাজ ঠিকঠাক মতো করলে দু’মাস পর বেতন আরও বাড়াবে।”
-“আলহামদুলিল্লাহ্।”
-“অর্ঘ এখনো ফেরেনি?”
-“না। ও তো নীরদের সাথে বের হলো।”
-“আমি জানি নীরদের সাথে বেরিয়েছে। কিন্তু এখনো এলো না কেন?”
-“জানি না তো। তুই ফোন করে দেখ। আমি মিষ্টিগুলো রেখে আসি।”
অভ্র ফোন বের করে নীরদকে কল করতে গেলেই বাসার বেল বেজে উঠল। অভ্র গিয়ে দরজা খুলে দেখল অর্ঘমা এসেছে। মেয়েটার হাসিখুশি চেহারা দেখেই অভ্রর ভালো লাগল। মনটা ভরে উঠল প্রফুল্লতায়। অর্ঘমার হাতে গোলাপ ফুল দেখে দুষ্টু হেসে বলল,
-“কিরে! প্রপোজ টপোজ করল নাকি? রিলেশন হয়ে গেছে?”
-“ধুর! তুমি যে কিসব বলো না!”
-“না মানে, লাল গোলাপ তো কেউ আর এমনি এমনি দেয় না তাই না?”
-“হয়েছে তোমার ফাজলামো! এমনি কিনে দিয়েছে। লাল জামা পরেছিলাম। লাল গোলাপ হাতে ছবি ভালো আসবে ভেবে কিনে দিয়েছিল।”
-“বুঝলাম।”
-“উদ্ধার করে ফেললে বুঝে। আচ্ছা, তুমি ভাই নাকি অন্য কিছু! অনায়াসে কীভাবে বলো এসব?”
-“আমি তোর ভাইও আবার বন্ধুও। বুঝেছিস! এখন যা ফ্রেস হয়ে আয়। তোকে গরম গরম একটা খবর শোনাব।”
-“কী খবর?”
-“আগে ফ্রেস হয়ে আয়, তারপর বলছি।”
ভাইয়ের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল অর্ঘমা। অভ্র নিজেও দরজা লাগিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল ফ্রেস হতে।

ফ্রেস হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে সোফায় নীরদকে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো অর্ঘমা। পাশেই অভ্র বসে আছে। দু’জনে মিলে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে। অর্ঘমা এগিয়ে যেতেই অভ্র তাকে দেখে হেসে পাশে বসতে বলল। ভাইয়ের কথা মতো অর্ঘমা পাশে এসে বসল।
-“তুমি না বলছিলে আমাকে কিসের গরম গরম খবর শোনাবে!”
-“হ্যাঁ।”
-“কী সেই খবর?”
-“তোর অকর্মা ভাইয়ের চাকরি হয়ে গেছে।”
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল অর্ঘমা। পর পরই খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল ভাইয়ের গলা ধরে। অভ্রও দু’হাতে আগলে নিল বোনকে।
-“সত্যি!”
-“হ্যাঁ, সত্যি। আগামীকাল থেকেই জয়েন করব।”
অর্ঘমা অভ্রর চুল টেনে বলল,
-“মোটেও আমার ভাই অকর্মা নয়। তুমি একদম আমার ভাইকে অকর্মা বলবে না। আমার ভাই বেস্ট। বেস্টের উপরে যদি কিছু থাকে তাহলে সেটা আমার ভাই।”
অভ্র কিছু বলল না। শুধু হেসে অর্ঘমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। নীরদ বসে বসে দুই ভাই-বোনের এই মধুর খুনসুটি দেখছিল। কি সুন্দর, কি মিষ্টি তাদের সম্পর্ক।
___
সকাল থেকে নীরদদের বাসায় হুলস্থূল কাণ্ড চলছে। আজ নুসরাতকে দেখতে আসবে। কম তো বয়স হলো না মেয়েটার। অবশ্য নুসরাতকে আরও অনেক আগে থেকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল। কিন্তু নুসরাত রাজি হচ্ছিল না কোনোভাবেই। অবশেষে এতদিন পর এসে মেয়েটা রাজি হয়েছে।

কলেজে থাকাকালীন এক ছেলের সাথে নুসরাতের সম্পর্ক হয়েছিল। সেই সম্পর্কের মেয়াদ ছিল দীর্ঘ ছয় বছর। ছেলের পরিবার আর নুসরাতের পরিবার থেকে সব জেনেশুনে তাদের বিয়েও ঠিক করা হয়। কিন্তু বিয়ের সপ্তাহখানেক আগে বেঁকে বসে নুসরাতের বয়ফ্রেন্ড। নুসরাত তার বয়ফ্রেন্ডের কাছে জবাবদিহি চাওয়ার পর জানতে পারে ছেলেটা তাকে কখনো ভালোই বাসেনি। সম্পূর্ণটা একটা অভিনয় ছিল শুধুমাত্র সম্পত্তির জন্য। নুসরাত বাড়িওয়ালার মেয়ে হওয়ায় আর তাদের আর্থিক অবস্থা অনেক বেশি স্বচ্ছল হওয়ায় তার বয়ফ্রেন্ড রাজি হয়েছিল বিয়েতে। কারণ অর্ধেক সম্পত্তি তো নুসরাতের নামেই করে দিবে নুসরাতের বাবা। অর্থাৎ সম্পত্তি নুসরাতের হওয়া মানেই তার হওয়া। কিন্তু বিয়ের সপ্তাহখানেক আগে যখন নুসরাতের বাবা সম্পত্তি মেয়ের নামে দিতে চান তখন নুসরাত এই সম্পত্তি নিতে চায় না। মূলত এর জন্যই বিয়েতে অমত করে বসে নুসরাতের বয়ফ্রেন্ড। এরপর থেকেই নুসরাতের বিয়ের শখ মিটে গেছে। তবে বিয়ে ভাঙায় একটা উপকার হয়েছে। একজন ভুল মানুষকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে গিয়ে বেঁচে গেছে। আর নিজের পড়াশোনা শেষ করে একজন সফল ডাক্তার হতে পেরেছে।

প্রাক্তন প্রেমিকের থেকে এত বড় ধোঁকা পাওয়ার পর নুসরাতের মনে হয়েছিল সে আর কাউকে বিশ্বাস করে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে পারবে না। তাই তো বয়স ত্রিশ পার হওয়ার পথে প্রায় তবুও তার মধ্যে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু তার ইচ্ছেকে বদলাতে সক্ষম হয়েছে এক চমৎকার ব্যক্তিত্বের অধিকারী পুরুষ। যদিও বেচারাকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি নুসরাতকে রাজি করানোর জন্য।
ছেলেটার নাম তমাল। সে নিজেও পেশায় একজন ডাক্তার। সেমিনারে কয়েকবার দেখা হয়েছিল নুসরাতের সাথে। ব্যস! তখন থেকেই নুসরাতকে তার মনে ধরেছে। এরপর থেকেই আঠার মতো পেছনে লেগে ছিল নুসরাতকে রাজি করাতে। অবশেষে সে সফল হয়েছে।

নুসরাতকে সাজানোর দায়িত্ব পরল অর্ঘমার উপর। কারণ অর্ঘমা খুব ভালো মেকআপ করতে জানে। নুসরাত নিজে গিয়ে নিয়ে এসেছে অর্ঘমাকে। তাদের দু’জনের মাঝে সম্পর্কটা বেশ ভালো। যদিও হাতেগোনা কয়েকবার দেখা হয়েছে। এতেই তাদের মাঝে বেশ ভালো খাতির হয়ে গেছে।

অর্ঘমা ফ্ল্যাটে ঢুকার সময় নীরদের সাথে তার চোখাচোখি হলো। ট্রাউজার আর টি-শার্ট পরা নীরদকে এই প্রথম এভাবে দেখল সে। চুলগুলো কিছুটা অগোছালো। তবুও কেন যেন ভীষণ চোখে ধরছে ছেলেটাকে। অর্ঘমা বিরবির করে নিজে নিজেই বলল,
-“ছেলেদের এত সুন্দর হওয়া একদমই উচিত নয়। এটা ঘোরতর অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে আপনি কী নিবেন নীরদ ভাই?”

চলবে…#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_১১
.
নুসরাতকে সুন্দর করে সাজিয়ে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে বিদায় নিল অর্ঘমা। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গেলে নীরদ হন্তদন্ত হয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলো। অর্ঘমার সামনে গিয়ে তার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবারও হন্তদন্ত হয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকে গেল। আজ খুবই ব্যস্ত সে। অর্ঘমা ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ ফ্ল্যাটের দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে হাতে থাকা খামের দিকে তাকাল। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে হুট করে এক দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে চার তলায় চলে গেল।

নিজের রুমে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে বিছানায় গিয়ে লাফ দিয়ে বসে যত্ন করে খামটা খুলতে লাগল। খামের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল কতগুলো ছবি দেখা যাচ্ছে। ভ্রু কুঁচকাল অর্ঘমা। কিসের ছবি এগুলো? তাড়াতাড়ি করে ছবিগুলো বের করল। বিস্ময়ে হা হয়ে গেল তার মুখটা। নীরদের সাথে যেদিন ঘুরতে গিয়েছিল, সেদিনের ছবি এগুলো। কিছু কিছু ছবি দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে এগুলো তার অগোচরে তোলা হয়েছে। আবার কিছু ছবিতে সে নিজে থেকেই পোজ দিয়ে তুলেছে। কয়েকটা ছবি নীরদের সাথেও আছে। এগুলো সব নীরদের ফোনে ছিল। নীরদ তাকে প্রিন্ট করে দিয়েছে। ছবিগুলো দেখে খুশিতে অর্ঘমার পাগলপ্রায় অবস্থা।
___
বিকেলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল অর্ঘমা। আজ সে ঘুমায় নি। বারান্দা থেকে গলির মোড় স্পষ্ট দেখা যায়। নীরদের বন্ধুরা প্রতিদিন এই মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয়। মোড়ের বিল্ডিংয়ে নীরদদের আরেক বন্ধু থাকে। তার কাছ থেকে ক্যারাম বোর্ড নিয়ে ক্যারাম খেলে মাঝে মাঝে। আর নয়তো সামনের চায়ের দোকানে গিয়ে চায়ের আসরে বসে আড্ডা জমায়। এটা তাদের প্রতিদিনের রুটিন। ঝড়বৃষ্টি যা-ই হয়ে যাক না কেন এই রুটিন সবসময়ের জন্য বহাল থাকে।

আজও নীরদের বন্ধুদের দেখা যাচ্ছে। নীরদও আছে সাথে। এদের একটা ব্যাপার খুব ভালো লাগে অর্ঘমার। এরা কখনো বাইরে অযথা ঘুরে বেড়ায় না। ভার্সিটি যাবে, পড়াশোনা করবে। সেখান থেকে হয়তো সব বন্ধুরা মিলে মাঠে বসে কিছুক্ষণ আড্ডার আসর জমাবে। তারপর সবাই যার যার বাসায় যাবে। মাঝে মাঝে গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাবে আর নয়তো এই গলির মাথাতেই তাদের আসর জমবে। অতঃপর রাত আটটার মধ্যে সবাই যে যার বাসায় গিয়ে পড়তে বসবে। এসব নীরদই অর্ঘমাকে বলেছে।

অর্ঘমা খেয়াল করল নীরদ তার বারান্দার দিকেই তাকিয়ে আছে। ওখান থেকে অবশ্য অর্ঘমার বারান্দার ভেতরটা খুব একটা স্পষ্ট দেখা যায় না। কিন্তু তবুও নীরদকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভাবল হয়তো নীরদ তাকে খুঁজছে। অর্ঘমা মৃদু হাসল। কিছুক্ষণের মাঝেই তার ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে নীরদের নাম ভেসে উঠেছে। ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো।
-“তুমি কী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছো?”
অবাক হলো অর্ঘমা। মনে মনে এই ছেলের চোখের পাওয়ারের প্রশংসা না করে পারল না।
-“হ্যাঁ, কেন?”
-“না, আমার মনে হলো তুমি দাঁড়িয়ে আছো তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
-“ওহ! পড়াতে আসবেন না?”
-“একটু পরে আসব। এখন বন্ধুদের সাথে আছি।”
-“আচ্ছা।”
-“কিছু লাগবে?”
অর্ঘমা মনে মনে বলল, ‘আপনাকে লাগবে।’ কিন্তু মুখে বলল,
-“চিপস লাগবে।”
-“আচ্ছা নিয়ে আসব। এখন ভেতরে গিয়ে পড়া রিভাইস কর। আর তোমার হোয়াটসঅ্যাপে আমি কতগুলো ছবি পাঠিয়েছি হায়ার ম্যাথের। এগুলো সলভ কর বসে বসে। আমি এসে দেখব।”
-“আচ্ছা।”
-“রাখছি তাহলে।”
-“ঠিক আছে।”
কথা শেষ হওয়ার পরও কিছুক্ষণ কলে রইল দু’জন। একদম চুপচাপ। অর্ঘমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে নীরদের দিকে। নীরদও অর্ঘমার বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে। আসিফ এসে নীরদের মাথায় থাপ্পড় মারতেই কল কেটে দিল নীরদ। হাসল অর্ঘমা। নীরদের বন্ধুরা যে তাকে আর নীরদকে নিয়ে কনফিউজড তা সে জানে। প্রতিদিন বন্ধুরা এর জন্য নীরদের সাথে মজা নেয় তা-ও সে জানে। কিন্তু সবার সামনে দেখায় এমন যে সে কিছুই জানে না।
___
নীরদ এলো হাতে মিষ্টির প্যাকেট আর কিছু চিপস, চকলেট নিয়ে। অভ্র বাসায় নেই, অফিসে গিয়েছে। অর্ঘমা দরজা খুলে নীরদকে দেখে মৃদু হাসল। বিনিময়ে নীরদও হাসল। মিষ্টির প্যাকেটটা অর্ঘমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“আপুর বিয়ের ডেইট ফিক্সড হয়ে গেছে।”
-“আলহামদুলিল্লাহ্।”
-“আন্টি কোথায়?”
-“আম্মু নিজের রুমে শুয়ে আছে। কোমড় ব্যথাটা বেড়েছে আম্মুর।”
-“মেডিসিন নিয়েছেন?”
-“হ্যাঁ।”
-“আচ্ছা, তুমি এটা রেখে আসো। আমি তোমার রুমে যাচ্ছি।”
-“ওকে।”
মিষ্টির প্যাকেট রেখে চিপস আর চকলেট নিয়ে ঘরে এলো অর্ঘমা। বিছানার পাশে ছোট টেবিলের উপর থাকা ঝুড়িতে সেগুলো রাখল। নীরদ চেয়ারে বসে আছে। অর্ঘমা গিয়ে পাশে বসতেই নীরদ বলল,
-“টেস্ট এক্সাম কবে?”
-“সামনের মাসে।”
-“তোমাকে নিয়ে আমার চিন্তা নেই। তোমার তো সিলেবাস শেষ। এখন শুধু রিভাইস করবে।”
-“হ্যাঁ, তবুও আমার চিন্তা হচ্ছে।”
-“চিন্তার কিছু নেই। দেখি বই বের কর।”
অর্ঘমা বইখাতা বের করে বসল। নীরদ প্রথমে কিছু এমসিকিউ জিজ্ঞেস করল। অপশন ছাড়াই সব ক’টা এমসিকিউ এর সঠিক উত্তর দিল অর্ঘমা। এরপর একটা প্যারাগ্রাফ ধরলো। পুরো প্যারাগ্রাফটা সঠিকভাবে বলার পর কিছু অংক করতে দিল। অংক করার ফাঁকে ফাঁকে তাকে সূত্র জিজ্ঞেস করতে লাগল নীরদ।
___
গত দু’দিন যাবৎ নিধি ক্লাসে আসছে না। অর্ঘমা প্রথমে চিন্তিত হলেও হুট করে তার মনে পরল নিধি বলেছিল সামনের সপ্তাহে তার বিয়ে। অর্ঘমা আতঙ্কিত হয়ে তারিখ হিসাব করল। তারিখ হিসাব করে বুঝতে পারল বিয়ে আগামী পরশুদিন। অর্ঘমার মনটা বেজায় খারাপ হলো। তার তো করার কিছুই নেই। নিধির ভাগ্যটা এত খারাপ কেন হলো? মন খারাপ করে সেদিনের সবগুলো ক্লাস শেষ করল অর্ঘমা। বাসায় গিয়ে নিধির সৎ মায়ের নাম্বারে কল করলেও ওপাশ থেকে কেউ রিসিভ করল না।

চিন্তা করেই সেদিনটা পার করল অর্ঘমা। পরদিন স্কুলে গিয়েই নিধিকে দেখতে পেল। খুশিতে ব্যাগ নিচে ফেলেই জড়িয়ে ধরলো তাকে। নিধি প্রথমে কিছু বুঝতে পারল না। পরক্ষণেই কিছু একটা আন্দাজ করে ফিসফিস করে বলল,
-“কী ভেবেছিলি, বুড়োকে বিয়ে করে সংসার করছি?”
মাথা নাড়াল অর্ঘমা। নিধি মলিন হেসে বলল,
-“বুড়োর দ্বিতীয় স্ত্রী ইচ্ছাকৃত ভাবে সিঁড়িতে তেল ঢেলে রেখেছিল। সেই তেলে পা পিছলে বুড়োর কোমড়ের বারোটা বেজে গেছে। সে এখন হসপিটালে। কোমড়ের হাড় নড়ে গেছে। খালা আমাকে বিয়ের জন্য আসতে দিচ্ছিলেন না এতদিন। কিন্তু এখন বিয়ের ডেইট পেছানো হয়েছে।”
-“তেল ইচ্ছাকৃত ভাবে ঢালার কারণ কী তোদের বিয়ে আটকানো ছিল?”
-“হ্যাঁ। বুড়োর দ্বিতীয় স্ত্রীর বয়স বেশি না। তেইশ বছর চলছে মাত্র। সে বিয়েতে রাজি ছিল না। তার বাড়ির লোকজন বুড়োর টাকা পয়সা দেখে জোর করে বিয়ে দিয়েছিল। আমি তো তার থেকেও ছোট। তাই তিনি আমার সাহায্য করেছেন। তিনি চান না তার মতো আমার জীবনটাও নষ্ট হোক।”
-“আপুটা তো তাহলে অনেক ভালো।”
-“হ্যাঁ।”
-“তার মানে আপাতত বিয়েটা কয়েকদিনের জন্য পেছানো গেছে তাই তো!”
-“হ্যাঁ।”
-“বাকিটা পরে দেখা যাবে। এখন আপাতত চিল কর।”
-“আর চিল! সামনের মাসে টেস্ট এক্সাম। পড়াশোনা হয়নি আমার কিছুই।”
-“চিন্তা করিস না। আমি তোকে সব বুঝিয়ে দিব।”
-“তুই আমার একমাত্র ভরসা। তুই কোচিং করে সব আমাকে বুঝিয়ে দিস বলেই তো আমি পারি। নাহলে আমার পড়াশোনা কবেই বন্ধ হয়ে যেত।”
-“আজাইরা কথা বলিস না তো। ক্লাস শুরু হতে আরও বিশ মিনিটের মতো বাকি। চল এতক্ষণে তোকে কেমিস্ট্রি পড়া দেখিয়ে দেই।”
-“আচ্ছা।”
___
নুসরাতের বিয়ের ডেইট পরেছে অর্ঘমার টেস্ট এক্সামের সময়। তার ফিজিক্স এক্সামের দিন নুসরাতের বিয়ে। এরপর দু’দিন বন্ধ। আবার পরীক্ষা দু’দিন পর। তাও হায়ার ম্যাথ এক্সাম। অর্ঘমা মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে মনে মনে নীরদকে বকা দেয়া শুরু করল। অবশ্য ও বেচারারই বা কি দোষ! নীরদ তো আর জানত না নুসরাতের বিয়ের দিন অর্ঘমার পরীক্ষা পড়ে যাবে। নীরদ যখন জানতে পারল তখন তারও মাথায় হাত। মনে মনে চিন্তিত হয়ে পরল সে। মিনমিন করে বলল,
-“তোমার যদি বেশি সমস্যা হয় তাহলে যাওয়ার দরকার নেই। পড়াশোনা সবার আগে। তবে আমার মনে হয় না তোমার সমস্যা হবে। কারণ আমি তোমাকে পড়িয়েছি। তাই আমি জানি তোমার সমস্যা হবে কি হবে না।”
-“দেখা যাক। আমি এখনই জোর দিয়ে কিছু বলতে পারছি না। তবে আমি না গেলেও ভাইয়া আর আম্মু অবশ্যই যাবে।”
নীরদ মিছে হাসার ভান করল।
-“না যেতে পারলে এক হিসেবে ভালোই হবে। বিয়ে বাড়ির আন্টিদের হাত থেকে বেঁচে যাব।”
এবার সত্যি সত্যিই হেসে ফেলল নীরদ। অর্ঘমা নিজেও সেই হাসিতে যোগ দিল।

অর্ঘমার পড়া প্রায় শেষের দিকে। এমন সময় তার মায়ের ফোন বেজে উঠল। অর্ঘমার কাছেই ছিল ফোন। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে নিধির সৎ মায়ের নাম্বার দেখে ভড়কে গেল। নীরদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে অর্ঘমা বলল,
-“নিধির ফোন।”
কল রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে নিধির কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। অর্ঘমা ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“কী হয়েছে নিধি? কাঁদছিস কেন?”
-“অর্ঘ বাঁচা আমাকে প্লিজ!”
-“কী হয়েছে?”
-“খালার ভাইয়ের ছেলে এসেছে। তার দৃষ্টি ভালো লাগছিল না বলে আমি আমার ঘরের ছিটকিনি লাগিয়ে ভেতরে বসে ছিলাম। তোকে তো বলেইছি খালার ভাগ্নের চালচলন ভালো না। চরিত্র দোষও আছে। একটু আগে রান্না করতে গিয়ে খালা আর তার ভাগ্নের কথোপকথন কানে এসেছে আমার। খালার ভাগ্নে খালাকে টাকা দিয়েছে অনেকগুলো। বিনিময়ে বুড়োর সাথে আমার বিয়ের আগ পর্যন্ত সে প্রতি রাতে আমার সাথে থাকতে চায়। মানে বুঝতে পারছিস তুই? আমি আর কিছু শোনার মতো অবস্থায় ছিলাম না রে। দোতলা ছাদের পানির ট্যাংকের পাশে লুকিয়ে আছি আমি। আসার সময় খালার ফোনটা লুকিয়ে নিয়ে এসেছি। ওরা আমাকে খুঁজছে। অর্ঘ প্লিজ কিছু কর। আমি যদি ধরা পড়ে যাই তাহলে আজ সত্যি সত্যি আমি সুইসাইড করব।”
অর্ঘমা নিজেই ভয় পেয়ে গেছে নিধির কথা শুনে। তাকে কাঁপতে দেখে নীরদ তার মাথায় হাত রাখল। অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল অর্ঘমা। ফোনের ওপাশে নিধি কেঁদেকেটে আকুতি মিনতি করে চলেছে সমানে। নিজেকে শান্ত করে অর্ঘমা নিধির উদ্দেশ্যে বলল,
-“তুই ফোন সাইলেন্ট কর এখুনি। আর লুকিয়ে থাক। যা কিছু হয়ে যাক না কেন বের হবি না। আমি ভাইয়ার সাথে আসছি। যত দ্রুত সম্ভব আসছি আমি।”
কল কেটে দিল অর্ঘমা। অভ্রকে ফোন করতে হলো না। অফিস থেকে ফিরে দরজা দিয়ে সবেমাত্র ঢুকছিল অভ্র তখনই অর্ঘমা হন্তদন্ত হয়ে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলো। পেছন পেছন নীরদও এলো। সে এখনো কিছুই জানে না। অর্ঘমা ড্রয়িংরুমে এসেই বলল,
-“ভাইয়া আমাদের এখুনি বের হতে হবে?”
-“পাগল তুই! ছেলেটা মাত্র বাসায় ফিরল অর্ঘ।”
মায়ের কথায় পাত্তা দিল না অর্ঘমা। এখন তার কাছে নিধির সেফটি সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
-“কী হয়েছে অর্ঘ?”
নিধির সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলল অর্ঘমা। মিনা বেগম বললেন,
-“তাহলে আর দেরি করিস না। জলদি বেরিয়ে পড় তোরা। মেয়েটার যেন কোনো বিপদ না হয় এর মাঝে।”
-“আমার মনে হয় সাথে পুলিশ নিয়ে গেলে বেশি ভালো হবে।”
নীরদের কথায় সম্মতি জানিয়ে অভ্র বলল,
-“হ্যাঁ, চলো জলদি।”
অভ্র, নীরদ আর অর্ঘমা বেরিয়ে পরল নিধির বাসার উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে পাশের থানায় কল করে পুলিশকেও ব্যাপারটা জানিয়ে দিল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here