কিশোরী কন্যার প্রেমে পর্ব -০৮+৯

#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৮
.
অভ্র অফিসের ওয়েটিং রুমে বসে ছিল। আজ তার ইন্টারভিউ আছে এখানে। এমন সময় তার ফোনে কল এলো। রিয়ার নম্বর দেখে প্রথমে রিসিভ করতে না চাইলেও পর পর চারবার কল আসায় রিসিভ করতে বাধ্য হলো। কল রিসিভ করে কানের সামনে ফোন ধরার আগেই ওপাশ থেকে চিৎকার করে উঠল রিয়া। কপালে ভাজ পরল অভ্রর।
-“কী হয়েছে? অসভ্যের মতো চিৎকার করছো কেন?”
-“চিৎকার করব না তো কি তোমায় মাথায় তুলে নাচব! অভ্র তোমার সাহস কী করে হলো আমার ভাইয়ের গায়ে হাত তোলার?”
-“মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার! উল্টো পাল্টা কিছু খেয়েছো? না খেলে আবোল তাবোল বকছো কেন?”
-“আমি আবোল তাবোল বকছি! তুমি আমার ভাইকে পেটাও নি? তাও আবার এতটাই জঘন্য ভাবে পিটিয়েছ যে ভাইয়াকে হসপিটালে ভর্তি করতে হয়েছে। সারা শরীরে মারের দাগ। একটা হাত আর একটা পা ভেঙে গেছে। ডাক্তার বলেছে মাস দুই-তিনেক লাগবে সুস্থ হতে। তুমি এটা কীভাবে করতে পারলে অভ্র?”
-“যে তোমার ভাইকে মেরেছে তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আজকেই আমি মসজিদে একশো টাকা দান করব। আমার খুব আফসোস ছিল তোমার ভাইকে দু’চার ঘা লাগাতে পারিনি বলে। তবে এখন তোমার কথা শুনে আমার সব আফসোস কর্পূরের মতো উবে গেছে।”
-“মানে সত্যি সত্যি তুমি কিছু কর নি?”
-“না। আমার ইচ্ছে ছিল তোমার ভাইকে পেটাবো। আমি তো মনে মনে প্ল্যানও বানাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই কেউ শুভ কাজ সেরে ফেলেছে।”
-“অভ্র!”
-“শুকরিয়া আদায় কর। যে তোমার ভাইকে মেরেছে সে শুধু তোমার ভাইয়ের হাত-পা ভেঙেছে। আমি হলে ওর কলিজাটাই বের করে ফেলতাম। মেরে লাশ পাঠিয়ে দিতাম তোমাদের বাড়িতে। কিন্তু আপাতত তা আর সম্ভব না। একটা আফসোস গেল ঠিকই কিন্তু আরেকটা আফসোস নতুন করে জন্মাল।”
রিয়া অভ্রর কথা শুনে তার উপর চেঁচামেচি করতে লাগল। অভ্র ফোনের লাইনটা কেটে দিয়ে রিয়ার নম্বরটা ব্লক করে দিল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে বসতেই ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক পরল তার। ফোন সাইলেন্ট করে ভেতরের দিকে অগ্রসর হলো।
___
অর্ঘমার যদিও সামনের মাস থেকে স্কুল বাসে যাতায়াত করার কথা ছিল। কিন্তু সে স্কুল বাসে যেতে চাচ্ছিল না বলে অভ্র আর নীরদকেই অর্ঘমাকে দিয়ে আসা ও নিয়ে আসার দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। যেদিন অভ্র ফ্রি থাকে সেদিন অভ্র যায়। আবার যেদিন অভ্র বিজি থাকে সেদিন নীরদ যায়।

গতকাল অর্ঘমার ক্লাস টেস্টের রেজাল্ট দিয়েছে। সে ভালো রেজাল্ট করেছে। নীরদ গত একসপ্তাহ পড়াতে আসেনি। তার পরীক্ষা চলছে ভার্সিটিতে। ফোনে অবশ্য নীরদ তাকে প্রতিদিন পড়া দিয়ে দিত। অর্ঘমাও সেই পড়া বাধ্য মেয়ের মতো কমপ্লিট করে রাখত। আজ নীরদের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। নীরদ বলেছিল আজ আসবে পড়াতে। তাই অর্ঘমা খুশি মনে বইখাতা নিয়ে বসে আছে নীরদের অপেক্ষায়।
___
কলিংবেল চেপে দাঁড়িয়ে রইল নীরদ। কিছুক্ষণ পর অর্ঘমার মা এসে দরজা খুলে দিলেন। হাসিমুখে তাকে সালাম দিল নীরদ। তিনিও পাল্টা হেসে সালামের জবাব দিলেন। নীরদকে ভেতরে যেতে বলে তিনি রান্নাঘরে চলে গেলেন।

অর্ঘমার রুমে ঢুকেই দাঁড়িয়ে পরল নীরদ। পড়ার টেবিলের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে অর্ঘমা। নীরদ ঘড়িতে সময় দেখে নিল। এই সময়টা অর্ঘমা ঘুমিয়েই কাটায় বেশিরভাগ। নীরদ আসলে অর্ঘমার মা অর্ঘমাকে জাগিয়ে দেন। আজ অর্ঘমা জেগে ছিল বলে তার মা আর রুমে আসেনি। কিন্তু তিনি তো আর বুঝতে পারেননি যে তার মেয়ে নীরদের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেছে।

নীরদ এগিয়ে এসে অর্ঘমার নাম ধরে ডাকল। সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না অর্ঘমার। নীরদ একবার দরজার দিকে তাকিয়ে জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। কাঁপা কাঁপা হাতে অর্ঘমার মাথায় হাত রেখে তাকে ডাকতে লাগল। কিছুক্ষণ পর পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাল অর্ঘমা। নীরদকে চোখের সামনে দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। কখন যে তার চোখ লেগে এসেছিল বুঝতেই পারেনি। নীরদ তাকে ফ্রেস হয়ে আসতে বলে চেয়ার টেনে বসল।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে অর্ঘমা দেখল নীরদ তার টেস্ট খাতাগুলো দেখছে। বারান্দায় গিয়ে মুখ মুছে রুমে এসে চেয়ার টেনে টেবিলে বসতেই নীরদ বলল,
-“বাহ! সবগুলো সাবজেক্টেই তো বেশ ভালো নাম্বার পেয়েছো।”
-“মোটামুটি ভালো।”
-“এটা মোটামুটি না। অনেক ভালো নাম্বার। তুমি যদি এভাবেই পড়াশোনা কর তাহলে আরও ভালো নাম্বার পাবে পরবর্তী পরীক্ষায়।”
-“দেখা যাক।”
-“এত ভালো মার্কসের জন্য তোমার একটা ট্রিট পাওনা রইল আমার কাছে। বলো কী চাও?”
অর্ঘমা দুষ্টুমির স্বরে বলল,
-“যা চাই তাই পাবো?”
নীরদ কিছুটা বিব্রত হলো। অর্ঘমার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল সে মজা করছে। তাই সে নিজেও অর্ঘমার দুষ্টুমিতে সায় দিয়ে বলল,
-“হ্যাঁ, বলেই দেখো।”
-“আপনাকে চাই।”
কথাটা বিরবির করে বলল অর্ঘমা। নীরদ শুনতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“কিছু বললে?”
-“নাহ! কিছু বলিনি।”
-“তো বলো, কী চাও?”
-“আগামীকাল আপনি আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবেন। ভাইয়াকে বলেছিলাম নিয়ে যেতে। কিন্তু ভাইয়ার নাকি সময় নেই।”
-“হ্যাঁ, ভাইয়ার সাথে কথা হয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহ ভাইয়া খুব ব্যস্ত থাকবে। অনেকগুলো অফিসে তার ইন্টারভিউ রয়েছে।”
-“অতএব আপনি নিয়ে যাবেন আমাকে। যদি ফ্রি থাকেন তাহলে।”
-“ফ্রি আছি আমি। ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে তারপর জানাবো। যদি ভাইয়া রাজি হন তোমায় আমার সাথে ছাড়তে তাহলে।”
-“আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি ভাইয়া রাজি হবে।”
-“দেখা যাক।”
-“ওকে।”
-“এখন বইখাতা বের কর।”
অর্ঘমা বইখাতা বের করে পড়তে বসল। নীরদ তাকে পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছে। অর্ঘমা মন দিয়ে তা দেখছে। নীরদ তাকে একটা অংক করতে দিয়ে বসে রইল। অর্ঘমা মনোযোগ দিয়ে অংক করছে। নীরদ গালে হাত দিয়ে অর্ঘমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই বাচ্চা মেয়েটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেও তার কেন জানি খুব ভালো লাগে।
___
ক্লাসে ঢুকেই অর্ঘমা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। নিধিকে সারা ক্লাসরুমের কোথাও দেখতে পেল না। ব্যাগ রেখে অর্ঘমা ক্লাসের একজনকে উদ্দেশ্য করে নিধির কথা জিজ্ঞেস করতেই সে জানালো নিধি এসেছে। কিন্তু ক্লাসে ব্যাগ রেখেই বেরিয়ে গেছে। অর্ঘমা অবাক হলেও কিছু বলল না। নিধির ব্যাগ খুঁজে বের করে তার পাশে নিজের ব্যাগ রেখে বের হলো নিধিকে খুঁজতে। কিন্তু সিঁড়ির কাছে আসতেই ক্লাসের ঘন্টা বেজে উঠল। নিধিকে আর খুঁজতে যাওয়া হলো না অর্ঘমার। সে ক্লাস ক্যাপ্টেন। তাকে তো ক্লাসে আগেই থাকতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি ক্লাসে ঢুকে গেল। টিচার ক্লাসে ঢুকার কিছুক্ষণ পর নিধিকে দেখা গেল। ক্লাসরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে টিচারের পারমিশন নিয়ে ভেতরে ঢুকল সে। অর্ঘমার কাছে নিধিকে ঠিক লাগল না।

টিফিন টাইমে নিধিকে ধরে বসল অর্ঘমা। পর পর চারটা ক্লাসে একটুও কথা বলার সুযোগ পায়নি তারা। অর্ঘমা বারবার ঘড়ি দেখছিল শুধু নিধির সাথে কথা বলার জন্য। মাঠের এক কোণায় গিয়ে বসল দুই বান্ধবী। অর্ঘমার হাতে খাবারের ব্যাগ। আজও নীরদ তাকে দিয়ে যাওয়ার সময় অনেক কিছু কিনে দিয়ে গেছে। ব্যাগটা একপাশে নামিয়ে রেখে অর্ঘমা নিধির দিকে ঘুরে বসে ওর হাত ধরে বলল,
-“এবার বলতো কী হয়েছে?”
-“কই কী হয়েছে?”
-“মিথ্যে বলবি না একদম। তোর চোখমুখের বিষণ্ণ ভাবই বলে দিচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। তোর সৎ মা আবার কিছু বলেছে তোকে?”
অর্ঘমার চোখ গেল নিধির গলার দিকে। গলার পাশ থেকে জামাটা একটু সরিয়ে দেখতেই আঁতকে উঠল সে। কালশিটে দাগ বসে আছে। অর্ঘমা তড়িঘড়ি করে নিধির জামার হাতা উঠিয়ে দেখল, হাতে পোড়া দাগ। কপালের ফোলা ভাবটা সে আগেই বুঝতে পেরেছিল। তাই সরাসরি সৎ মায়ের কথা জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু এখন সবটাই তার কাছে পরিষ্কার। নিধির দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকাতেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল নিধি। অর্ঘমা কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পেল না। নিঃশব্দে জড়িয়ে ধরলো বান্ধবীকে।
___
নিধি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। নিধি ক্লাস সিক্সে থাকাকালীন তার মা কঠিন জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। মারা যেত না যদি সঠিক চিকিৎসা দেওয়া হত তাকে। কিন্তু নিধির বাবা লোকটা বরাবরই নিধি এবং তার মায়ের প্রতি উদাসীন ছিলেন। নিধির মা অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। নিধির বাবা বরাবরের মতোই বলতেন এসব নাকি নিধির মায়ের কাজ না করার ধান্দা। টানা দুটো মাস বিনা চিকিৎসায় ঘরে পড়ে থেকে স্বামীর গালমন্দ শুনেছেন নিধির মা।

নিধি টুকটাক কাজ করতে পারত। পড়াশোনা করার কারণে তার মা তাকে খুব একটা কাজ করতে দিত না। তাই তেমন ভাবে কিছুই পারত না নিধি। কিন্তু মা অসুস্থ হওয়ায় অপরিপক্ক হাতে টুকটুক করে প্রায় সব কাজই করতে লাগল। আস্তে আস্তে মোটামুটি সবই শিখে গেল সে। নিধির মায়ের খারাপ লাগলেও তিনি কিছু করতে পারতেন না।

নিধির মায়ের বেঁচে থাকার আশা সেদিনই শেষ হয়ে গিয়েছিল যেদিন তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে আসে। জোর গলায় নিধিকে ডেকে সৎ মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল নিধির বাবা। ঘরের ভেতর থেকে সবটা শুনে ভেঙে পরলেন নিধির মা। দিন দিন তার শরীর আরও খারাপ হতে লাগল। এদিকে নিধির সৎ মা এসে থেকেই নিধিকে সকল প্রকার ফরমায়েশ দিতে শুরু করলেন। বাড়ির সমস্ত কাজ নিধিকে দিয়ে করাতে লাগলেন। পান থেকে চুন খসলেই নিধির কপালে সেদিন সৎ মায়ের মার জুটত। ইচ্ছে মতো মনের খায়েশ মিটিয়ে পেটাত তাকে। মাঝে মাঝে সারাদিন না খেয়ে থাকতে হত তাকে। যেদিন খাবার পেত সেদিন খাবারের দিকে তাকিয়ে নিধির আর খেতে ইচ্ছে হত না। পাতিলের নিচে থাকা পোড়া ভাত অথবা আগের দিনের পঁচে যাওয়া বাসি ভাত তার কপালে জুটত। এসব দেখে নিধির মা কিছু করতে পারতেন না। রাতের বেলা নিধির হাত ধরে শুধু কাঁদতেন।

হঠাৎ একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে নিধি দেখতে পেল তার মায়ের শরীরটা কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে আছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গেলে কপালে ছোঁয়া লাগতেই কেঁপে উঠল নিধি। এতদিন তো তাও সহনীয় জ্বর ছিল। তবে আজ জ্বরের মাত্রা ভয়ংকর। বালতি ভরে পানি এনে মায়ের মাথা ধুইয়ে দিল। ঘন্টাখানেক জলপট্টি দিল। তবুও জ্বর কমল না। সেদিন বিকেলেই নিধির মায়ের প্রচন্ড জ্বরের কারণে শ্বাসকষ্ট উঠল। তারপর একসময় স্থির হয়ে গেল তার শরীর। সৎ মাকে কথাটা জানালেও তিনি আসলেন না। শেষে প্রতিবেশী কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে এলো নিধি। তারা এসে নিধির মাকে দেখে জানালেন তিনি মারা গিয়েছেন। নিধির পৃথিবীটা সেখানেই থমকে গিয়েছিল সেদিন।

অর্ঘমার সাথে নিধির পরিচয় ক্লাস ওয়ান থেকে। নিধিকে অনেকদিন ক্লাসে আসতে না দেখে নিধিদের বাড়ি চলে গিয়েছিল অর্ঘমা। যদিও নিধির বাড়িতে তার তেমন একটা আসা হয় না। সেদিন নিধির বাড়িতে গিয়ে জানতে পারল নিধির মায়ের মৃত্যুর ঘটনা। নিধিকেও আর স্কুলে যেতে দিচ্ছে না নিধির সৎ মা। এসব জেনে অর্ঘমার প্রচন্ড খারাপ লাগার পাশাপাশি প্রচন্ড রাগও হলো। নিধির ব্যাপারটা নিয়ে অর্ঘমা তাদের স্কুলের প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সাথে কথা বললে তিনি নিজে নিধিদের বাড়িতে আসেন। নিধির সৎ মাকে পুলিশের হুমকি ধামকি দিয়ে বাধ্য করেন নিধিকে আবারও স্কুলে পাঠাতে। আর নিধি ভালো ছাত্রী হওয়ায় প্রিন্সিপাল ম্যাডাম নিধিকে সম্পূর্ণ ফ্রি-তে পড়ার সুযোগ করে দেন স্কুলে। নিধির বইখাতা থেকে শুরু করে যাবতীয় সকল জিনিসপত্র প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কিনে দেন। মাঝে মাঝে অর্ঘমাও দেয়।

চলবে…#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৯
.
-“খালা আমার বিয়ে ঠিক করেছে অর্ঘ। গতকাল এর প্রতিবাদ করায় তিনি আমাকে অনেক মেরেছেন। গলা টিপে ধরেছিলেন। শেষে চুলা থেকে জ্বলন্ত লাঠি নিয়ে মেরেছেন। আমার সারা শরীর অসহ্য ব্যথায় কুঁকড়ে আছে। এভাবে তিলে তিলে মেরে ফেলার থেকে একেবারে কেন মেরে ফেলছে না আমায় বলতো! আমার আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই।”
অর্ঘমা বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। শক্ত হয়ে বসে তাকিয়ে রইল নিধির দিকে। গোলগাল চেহারার মিষ্টি একটা মেয়ে। দেখতে আহামরি সুন্দরী না হলেও অর্ঘমার চোখে নিধিকে সুন্দরই লাগে। তাছাড়া হাসলে নিধিকে বেশি সুন্দর লাগে। সৎ মায়ের অত্যাচারে নিধির চেহারার উজ্জ্বলতায় ভাঁটা পড়েছে। মলিনতা ভর করছে সারা দেহে। বিষণ্নতায় ঘেরা মুখখানি দেখলে বড্ড মায়া লাগে। অর্ঘমা নিধির পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
-“কার সাথে বিয়ে ঠিক করেছে তোর সৎ মা?”
-“আমাদের পাড়ার এক বুড়োকে তুই একদিন ইচ্ছে মতো অপমান করেছিলি মনে আছে?”
-“আমার সাথে অসভ্যতা করার চেষ্টা করেছিল যে বুড়ো সেটা?”
-“হ্যাঁ। ওই পঞ্চাশোর্ধ বুড়োর সাথেই খালা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। বুড়োর আরও দুইজন বউ আছে। খালাকে টাকার লোভ দেখিয়ে রাজি করিয়েছে বুড়ো। আর আমার বাবাও বাঁধা দেননি এতে। তিনি মত দিয়েছেন।”
-“তুই ওই লোককে বাবা বলে ডাকিস কীভাবে? ঘেন্না হয় না তোর?”
-“হলেও তো কিছু করার নেই। আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, তুই তো জানিস! প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আর কতদিন দেখবেন আমাকে? ক্লাস টেনে পড়ছি। এসএসসি’র পর তিনি আর দেখবেন না। তাছাড়া বুড়োর সাথে একবার বিয়ে হয়ে গেলে আমাকে বোধহয় আর পড়তেও দিবে না।”
-“বিয়ে কবে?”
-“সামনের সপ্তাহে।”
অতঃপর নীরবতা পালন করল দু’জন। আসলে আর কিছু বলার মতো পাচ্ছিল না কেউ। ক্লাসের ঘন্টা পড়ে যাওয়ায় উঠে গেল তারা। আজ আর টিফিন করা হলো না কারোরই। নিধির মনের বিষণ্ণতা আজ অর্ঘমার মনেও প্রবেশ করেছে। বাকি সময়টা একদম চুপচাপ কাটাল দু’জন। ক্লাসে আর মনোযোগী হতে পারল না সেদিন।
___
অর্ঘমার মন খারাপকে ভালো করতে বিকেলের দিকে নীরদের কল এলো অর্ঘমার মায়ের ফোনে। অর্ঘমার ফোনটা এখনো অভ্র ব্যবহার করছে। অর্ঘমার মায়ের ফোনের তেমন একটা দরকার পড়ে না। তাই বাসায় থাকাকালীন ফোনটা অর্ঘমাই ব্যবহার করে। কল রিসিভ করতেই নীরদ বলল,
-“তৈরি হয়ে নাও। আমরা বের হব। ভাইয়ার সাথে কথা হয়েছে। তিনি পারমিশন দিয়েছেন।”
-“কখন বের হবেন?”
-“আমি বাসার গলির সামনে বসে আছি বন্ধুদের সাথে। তুমি তৈরি হয়ে চলে আসো। অপেক্ষা করছি আমি।”
-“ঠিক আছে।”
কল কেটে অর্ঘমা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিল। লাল রঙের একটা সেলোয়ার-কামিজ পরে হালকা সেজে নিল। খোলা চুলগুলো আঁচড়িয়ে বের হলো বাসা থেকে।
___
নীরদ সবেমাত্র হাই তুলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সামনে চোখ পড়তেই তার আর হাই তোলা হলো না। চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল। নীরদকে এভাবে হ্যাবলার মতো সামনে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার বন্ধুরাও সামনে তাকাল। অর্ঘমা আসছে। তাকে দেখে বন্ধুদের বুঝতে বাকি রইল না নীরদের এমন অভিব্যক্তির কারণ। সব বন্ধুরা মুখ টিপে হাসল। আসিফ নীরদের কানে ফিসফিস করে বলল,
-“পরী লাগছে না?”
-“হ্যাঁ। ভীষণ সুন্দর লাগছে। একদম নতুন বউ লাগছে।”
নীরদ কথাটা ঘোরের মাঝে থেকেই বলল। সব বন্ধুরা একসাথে ‘হোও’ বলে চিল্লিয়ে উঠতেই চমকে উঠল নীরদ। বন্ধুদের দিকে বেকুবের মতো তাকিয়ে থেকে বলল,
-“কী হয়েছে?”
-“বেশি কিছু না। শুধু অর্ঘমাকে নতুন বউয়ের মতো লাগছে এই আরকি।”
বিষম খেল নীরদ। তাকে খুকখুক করে কাশতে দেখে আসিফ পাশের দোকান থেকে একটা পানির বোতল এনে তার হাতে ধরিয়ে দিল। ততক্ষণে অর্ঘমা এসে দাঁড়িয়েছে তাদের সামনে। নীরদ পানি খেয়ে আড়চোখে বন্ধুদের দিকে তাকাল। তার বন্ধুরা মিটমিটিয়ে হাসছে। অর্ঘমা সবাইকে সালাম দিতেই সবাই সালামের জবাব দিল। সবার সাথে টুকটাক কথা বলে নীরদের সঙ্গে বেরিয়ে পরল। অবশ্য যাওয়ার আগে নীরদ তার বন্ধুদের চোখ রাঙাতে ভুলেনি।
___
একটা রিকশা ভাড়া করে অর্ঘমাকে উঠতে বলল নীরদ। অর্ঘমা উঠে বসতেই তার কাঁধের পাশ থেকে ওড়না সরে গেল। কাঁধের ওড়না ঠিক করে দিয়ে পাশে পড়ে থাকা ওড়নার বাকি অংশটুকু কুড়িয়ে নিয়ে অর্ঘমার কোলের মাঝে দিয়ে দিল। বিষয়টা প্রচন্ড ভালো লাগল অর্ঘমার। নীরদ তার পাশে বসে পেছনে হাত দিয়ে রিকশা ধরে রাখল। অর্ঘমার মনে একরাশ ভালো লাগা কাজ করছে।

প্রথম দিন থেকে নীরদকে শুধু পছন্দ করলেও ধীরে ধীরে তার এই ভালো লাগার রোগটা ভীষণভাবে বাড়ছে। নীরদ নিজের ছোট ছোট যত্ন দ্বারা অর্ঘমার মনে কতখানি জায়গা দখল করে নিয়েছে তা কি সে জানে? উঁহু, জানে না। এই যে আজ কতগুলো দিন যাবৎ অর্ঘমার মন মস্তিষ্কে নীরদ নামক মানুষটা কিলবিল করছে, এক মুহূর্তের জন্যও নীরদকে ভুলে থাকতে পারছে না; এতে তো অর্ঘমার পাগল হওয়ার জোগাড়। মনের ভেতরে হাজারো উল্টো পাল্টা চিন্তা ভর করে বসে আছে তার। এই যেমন এখন তার মন চাইছে নীরদের কাঁধে মাথা রেখে হাতে হাত রেখে বাকিটা পথ রিকশা ভ্রমণ করতে। কিন্তু কথাটা সে নীরদকে বলতে পারছে না। তাছাড়া নীরদই বা শুনলে কী বলবে?
আড়চোখে নীরদের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। দু’জনেই অপ্রস্তুত ভাবে চোখ সরিয়ে নিল। আশেপাশে তাকিয়ে আবারও একে অপরের দিকে তাকাল। হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু হাসিটা ঠিক মানালো না ওদের। তাই আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে প্রকৃতি দেখায় মন দিল।
নীরদ ঘাড় ঘুরিয়েই জিহ্বে কামড় দিল। না জানে মেয়েটা কী ভাবছে! সারা রাস্তা টুকটাক গল্প আর একটু পর পর একে অপরের দিকে আড়চোখে তাকিয়েই সময় কাটাল দু’জন।

রিকশা থেকে নামার সময়ও নীরদ সাহায্য করেছে অর্ঘমাকে। এটা একটা রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে ফুটপাত। ফুটপাতের পাশ দিয়ে সারি সারি হাজারো গাছের সমারোহ। বেশিরভাগই ফুল গাছ। অর্ঘমার যেটুকু মন খারাপ ছিল তা কোথায় যেন কর্পূরের মতো উবে গেল। মেজাজটা ফুরফুরে হয়ে গেল। মুখে দীর্ঘ হাসি ফুটে উঠল। নীরদের মনটা ভালো হয়ে গেল অর্ঘমার হাসি দেখে। এখানে আসা সার্থক মনে হলো তার।
-“ভালো লেগেছে জায়গাটা?”
-“ভীষণ।”
-“কিছু খাবে?”
-“উম.. আইসক্রিম।”
-“আচ্ছা, এসো আমার সাথে।”
কিছুটা সামনে এগিয়ে যেতেই একটা আইসক্রিমের দোকান চোখে পরল। সেখান থেকে দুটো আইসক্রিম কিনে একটা অর্ঘমার দিকে বাড়িয়ে দিল। হাসিমুখে আইসক্রিমটা নিয়ে প্যাকেট খুলে খেতে লাগল অর্ঘমা। আইসক্রিম খাওয়ার পাশাপাশি ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে লাগল তারা। আশেপাশে আরও অনেকেই রয়েছে। এই রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কম। হঠাৎ দু’একটা গাড়ি শাঁই শাঁই করে চলে যাচ্ছে। এছাড়া রাস্তা ফাঁকাই বলা যায়। কয়েকজন কাপল আছে। তারা নিজেদের মতো ব্যস্ত।

কিছুটা সামনে এগোতেই লেকের দেখা পেল তারা। লেকের ঠিক সামনে বড় একটা গাছ। গাছটার নাম জানে না অর্ঘমা। তবে গাছের পাতাগুলো তার কাছে ভীষণ ভালো লাগে। ছোট ছোট পাতাগুলো দেখতে কিছুটা গোলাকৃতির। সবুজ আর হলুদের মিশেলে এই পাতাগুলো লেকের সৌন্দর্য যেন আরো বাড়িয়ে তুলেছে।

নীরদের আইসক্রিম খাওয়া শেষ। অর্ঘমার হাতের কোণ আইসক্রিমটা এখনো রয়েছে। নীরদকে পেছনে ফেলে অর্ঘমা এগিয়ে গিয়েছে লেকের ধারে। তার মধুর হাসিতে নীরদের মন বারবার প্রশান্তিতে ছেয়ে যাচ্ছে। ফোন বের করে ফটাফট অর্ঘমার কতগুলো ছবি তুলে ফেলল। কিছুদূর তাকাতেই দেখতে পেল এক লোক ফুল বিক্রি করছে। অর্ঘমার দিকে একবার তাকিয়ে দৌড়ে গেল সেই ফুলওয়ালার কাছে। তরতাজা লাল টকটকে দেখে ছয়টা গোলাপ ফুল কিনল। পাঁচটা গোলাপ দিয়ে একটা তোড়া বানিয়ে একটা গোলাপ আলাদা করে নিয়ে ফিরে এলো অর্ঘমার কাছে। ততক্ষণে অর্ঘমার আইসক্রিম খাওয়া শেষ। ওড়না খুলে মাথায় ঘোমটা দিয়ে পেছন ঘুরতেই নীরদকে এদিকেই আসতে দেখল। তার হাতে গোলাপ দেখে কিছুটা অবাক হলো। একবার ভাবল জিজ্ঞেস করবে গোলাপ কার জন্য? কিন্তু পরক্ষণেই সেই ভাবনা বাতিল করে চুপ করে রইল। অর্ঘমার মাথায় ঘোমটা দেখেই পা জোড়া থেমে গেল নীরদের। অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মৃদু হাসল। আবারও পা চালাল। কাছে এসেই গোলাপের তোড়াটা এগিয়ে দিল অর্ঘমার দিকে। অবাক চোখে চাইল অর্ঘমা। নীরদের হাসিমাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আমার জন্য?”
-“আমি কী অন্য কারো সাথে এসেছি?”
-“না।”
-“তাহলে?”
অর্ঘমার হাসির রেখা দীর্ঘ হলো। গোলাপের তোড়াটা হাতে নিয়েই ঘ্রাণ নিল প্রথমে। নীরদের হাতে থাকা একটা গোলাপের দিকে তার নজর গেল। এটা কার জন্য? প্রশ্নটা মনে মনে করলেও মুখে করার সাহস হলো না। তার হাতে পাঁচটা গোলাপ থাকার পরও নীরদের হাতে থাকা ওই একটা গোলাপকেই তার হিংসে হচ্ছে। অর্ঘমার আড়চোখে একটা গোলাপের দিকে তাকানোটা নীরদের চোখ এড়ালো না। মৃদু হেসে অর্ঘমার আরো কাছে এগিয়ে এসে গোলাপটা তার কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলল,
-“এখন একদম পারফেক্ট লাগছে।”
চমকালো অর্ঘমা। পর পর তাকাল নীরদের দিকে। দৃষ্টির মিলন ঘটল। গোধূলি বিকেলের সোনালী আভা এসে পরল তাদের মুখের ওপর। নীরদের দৃষ্টি অর্ঘমার মুখপানেই স্থির হয়ে গেল। তার দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল যা ধরতে পারল না অর্ঘমা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here