কিশোরী কন্যার প্রেমে পর্ব -০৬+৭

#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৬
.
ড্রয়িংরুমে থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। শাকিল আর তার বাবা-মা অভ্রর পানে তাকিয়ে আছে। তাদের প্রশ্নবোধক দৃষ্টি দেখে অভ্র শীতল চাহনি নিক্ষেপ করল তাদের দিকে। অতঃপর বলল,
-“এখানে আসার আগে আপনাদের ভাবা উচিত ছিল, যে মেয়ের জন্য আপনারা প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছেন, আপনার ছেলে আদৌ সেই মেয়ের যোগ্য কিনা।”
-“আমার ছেলেকে কোন দিক দিয়ে তোমার অযোগ্য মনে হলো?”
-“একজন মানুষের যেদিকেটা সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আপনার আর আপনার ছেলের সেই দিকটাই ঠিক নেই আঙ্কেল।”
ভ্রু কুঁচকে তাকালেন শাকিলের বাবা। অভ্র মৃদু হেসে বলল,
-“আপনাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের খবর আমার জানা আছে। আপনাদের পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া শেষ। আশা করি এর থেকে বেশি কিছু আমাকে বলতে হবে না। আপনারা বুঝদার মানুষ।”
শাকিলের বাবা চুপ হয়ে গেলেন। লজ্জায়, অপমানে তিনি মাথা নিচু করে রইলেন। অথচ তার দৃষ্টিতে রাগ স্পষ্ট।

শাকিল হাত মুঠ করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। সে শর্ট টেম্পার মানুষ। কখন কি করে বসে তার ঠিক নেই। অভ্রকে যেন নিজের চোখ দিয়েই সে ভস্ম করে দিবে। অভ্র চোখ গেল শাকিলের পাশে বসে থাকা রিয়ার দিকে। যে বর্তমানে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অভ্র মাথানিচু করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রিয়ার দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে সে নিজের ভাইয়ের পক্ষেই আছে। অভ্র রিয়াকে উপেক্ষা করে শাকিলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“তোমাকে যেন আমার বোনের আশেপাশেও না দেখি। যদি দেখি তো ভাবতেও পারছো না তোমার কি হাল করব আমি। আজ ভদ্রভাবে বলছি। কিন্তু পরবর্তীতে এত ভদ্রতা আমি দেখাতে পারব না। আশা করছি তুমি বুঝতে পেরেছো আমার কথা। আমি আবারও বলছি। আমার বোনের আশেপাশে তোমার ছায়াও যেন না পড়ে।”
শাকিল রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে। অতিরিক্ত রাগে উঠে দাঁড়াল সে। সবাই ভাবল এখন হয়তো গণ্ডগোল শুরু করবে শাকিল। কিন্তু না! সবাইকে অবাক করে দিয়ে শাকিল হেসে উঠল। হাসিমুখে দাঁতে দাঁত চেপে অভ্রকে বলল,
-“বোনকে সামলে রেখো। দিনকাল ভালো না। বলা তো যায় না কখন কি হয়ে যায়! দেখা গেল তোমার বোন একদিন স্কুলে গিয়েছে। অথচ স্কুল ছুটির পর সে আর বাড়িই ফিরল না। কোচিং-এ থেকে আসার পথেও হতে পারে। আজকাল কিন্তু রাস্তাঘাটের অবস্থা একদম ভালো না।”
অভ্র উঠে শাকিলের কলার চেপে ধরতেই নীরদ তাকে টেনে সরিয়ে নিল। তাদের একটা ভুল পদক্ষেপ অর্ঘমার জীবনে কাল ডেকে নিয়ে আসতে পারে। নীরদ মৃদু হেসে শাকিলকে বলল,
-“তুমি নিজের খেয়াল রেখো। আসলেই আজকাল রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো না। দেখা গেল রাস্তা দিয়ে বেখেয়ালি ভাবে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ একটা গাড়ি এসে তোমাকে পিষে দিয়ে গেল। তোমার বাবা-মায়ের একটা মাত্র ছেলে তুমি। তোমাকে হারালে তাদের সামলাবে কে? তাই তুমি বরং নিজের খেয়াল রেখো!”
শাকিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নীরদের দিকে তাকিয়ে রইল। নীরদ আবারও হাসিমুখে বলল,
-“বাসার দরজাটা ওইদিকে। আপনারা এবার আসতে পারেন।”
লজ্জায়, অপমানে থমথমে চেহারা নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল সকলে। যাওয়ার আগে রিয়ার সাথে অভ্রর দৃষ্টি মিলন হলো। রিয়ার দৃষ্টিতে স্পষ্ট ছিল ক্ষোভ।
___
-“আগামীকাল থেকে তুই আর স্যারের বাসায় কোচিং করতে যাবি না।”
অভ্রর কথায় অবাক হলো না অর্ঘমা। এরকম কিছু একটাই সে আন্দাজ করেছিল। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তাহলে পড়া বুঝব কীভাবে?”
-“সেই ব্যবস্থা আমি করে দিব। বাসায় টিচার রেখে দিব।”
-“আচ্ছা। আর স্কুলে?”
-“এ মাসে আমি দিয়ে আসব আর আমিই নিয়ে আসব। আগামী মাস থেকে স্কুল বাসে যাতায়াত করবি।”
-“আচ্ছা।”
অভ্র অর্ঘমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বরাবরের মতো একটা কিটক্যাট সামনে রেখে চলে গেল। তবে আজ অর্ঘমা খুশি হলো না। তার ভীষণ মন খারাপ। নিজের ইচ্ছে মতো আর চলাফেরা করতে পারবে না। সবসময় কেউ না কেউ সাথে থাকবেই এখন থেকে। যদিও এসব ওর ভালোর জন্যই। তবুও!
___
পর পর চারটে সিগারেট শেষ করে ফেলেছে অভ্র। তার চেহারায় রাগ ছাপ স্পষ্ট। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে কপাল জুড়ে। চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। সম্পূর্ণ ছাদ জুড়ে সমানে পায়চারি করে চলেছে। হাতে ফোন। স্ক্রিন ফেটে আছে ফোনের। রাগের বশে কিছু সময় আগে ফোনটাকে আছাড় মেরেছিল। তারই ফল বশত স্ক্রিন ফেটে গেছে। টাচে কাজও করছে না ঠিকঠাক মতো। প্রায় মিনিট দশেক পর কল এলো তার ফোনে। ফাটা স্ক্রিনে ‘লাভ’ নামটা জ্বলজ্বল করছে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর কল রিসিভ করতে সক্ষম হলো অভ্র। সাথে সাথেই গর্জে উঠল সে।
-“কখন থেকে কল দিচ্ছি? কই যেয়ে মরেছিলে এতক্ষণ? ইচ্ছে করেই ফোন রিসিভ করছিলে না তাই না?”
-“ঠিক ধরেছ। কেন রিসিভ করব তোমার ফোন? আমার পরিবারকে অপমান করে মন ভরেনি? আরও অপমান করতে চাও?”
-“মেজাজ খারাপ করবি না। তোর ওই বখাটে ভাই কোন সাহসে আমার বোনের দিকে নজর দেয়, হ্যাঁ? আর তোর পরিবার যা, আমি তাই বলেছি।”
-“ভুলে যেয়ো না আমার পরিবারের মধ্যে আমিও পড়ি। আর আমার পরিবার যেমনই হোক এটা আমার পরিবার। অতএব তুমি তাদের ব্যাপারে কোনো কটু কথা বললে আমি বরদাস্ত করব না।”
নিজের রাগটাকে গিলে ফেলে অভ্র শান্ত কণ্ঠে বলল,
-“আমি কিন্তু তোমার পরিবারকে কোনো কটু কথা বলিনি। আমি শুধু তোমাদের পরিবারের নিয়ে আসা প্রস্তাবটা নাকচ করেছি। কারণ আমার বোনের জন্য তোমার ভাইকে আমার সঠিক মনে হয়নি।”
-“বেশ তো! থাকো তুমি তোমার বোনকে নিয়ে। তবে একটা কথা আমি জানিয়ে রাখছি। যদি অর্ঘমার সাথে আমার ভাইয়ের বিয়ে না হয় তাহলে তোমার সাথেও আমার আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। আমার কাছে আগে আমার ভাই।”
-“রিয়া!”
-“একদম চেঁচাবে না। যে ছেলের সাথে তোমার বোনের বিয়ে দিতে পারবে না সেই ছেলের বোনের সাথেও তোমার প্রেম করার দরকার নেই।”
-“তুমি নিজেও তোমার ভাইয়ের ক্যারেক্টার সম্পর্কে ভালো ভাবেই জানো। তবুও তুমি এই কথা বলছো?”
-“হ্যাঁ, বলছি। কারণ অর্ঘমাকে আমার ভাই পছন্দ করেছে। আমার ভাই যেমনই হোক না কেন আমি চাইবো অর্ঘমার সাথে যেন তার বিয়ে হয়। তাছাড়া পুরুষ মানুষের অমন একটু আধটু লুজ ক্যারেক্টার হয়েই থাকে। এটা কোনো বড় ব্যাপার না।”
অভ্র যেন বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল। রিয়াকে আজ তার বড্ড অচেনা লাগছে। এই রিয়ার কথার ধরনেই একদিন মুগ্ধ হয়েছিল অভ্র। কিন্তু আজ রিয়ার কথার ধরন শুনে সে যেন পাথর হয়ে গেছে। একটা মানুষ এত জলদি কীভাবে পরিবর্তন হয়ে যায়? নাকি রিয়া এতদিন তার সামনে মুখোশ পড়ে চলাফেরা করত বলে সে ধরতে পারেনি এই রিয়াকে!
অভ্র অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। ওপাশ থেকে রিয়া হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে। অভ্র স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
-“তাহলে তোমার কথাই রাখলাম।”
রিয়া খুশি হয়ে বলল,
-“তার মানে তুমি অর্ঘমা আর ভাইয়ার বিয়ের জন্য রাজি!”
-“না।”
মুহূর্তেই খুশিটা উবে গেল। রিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“তাহলে?”
-“তোমার সাথে আমার সম্পর্ক এখানেই সমাপ্ত।”
থমকে গেল রিয়া। সে ভেবেছিল অভ্রকে এভাবে ব্ল্যাকমেইল করলে অভ্র রাজি হয়ে যাবে অর্ঘমার বিয়ের জন্য। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
-“কী বলছো অভ্র? তুমি না আমাকে ভালোবাসো?”
-“তার থেকেও হাজার গুণ বেশি আমি আমার বোনকে ভালোবাসি।”
-“অভ্র!”
-“এখন চেঁচাচ্ছ কেন? তুমিই না একটু আগে বললে, যে ছেলের সাথে আমার বোনের বিয়ে দিতে পারব না, সেই ছেলের বোনের সাথেও আমার প্রেম করার দরকার নেই।”
-“তুমি আমাকে ছেড়ে দিতে রাজি। অথচ আমার ভাইয়ের সাথে তোমার বোনের বিয়ে দিতে রাজি না!”
-“না। তোমার সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ। অতএব আমাদের যোগাযোগও এখানেই শেষ। রাখছি আমি। আর কখনো ফোন দিবে না।”
লাইন কেটে দিয়ে থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল অভ্র। তার চোখের কার্ণিশে জল জমেছে। ফোনটাকে আরও একটা আছাড় মেরে ধপ করে বসে পড়ল ছাদের মাঝে। চুলগুলো টানতে টানতে পাশের দেয়ালে জোরে জোরে দু’বার ঘুষি মারল। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল। তারপর হুট করেই সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরলো। তার ভেতরে বয়ে যাওয়া ঝড় আপাতত এই নিকোটিনের মাধ্যমেই শান্ত করতে হবে।

চলবে…#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৭
.
নোটঃ গল্প যাদের কাছে পৌঁছাবে তারা সবাই রেসপন্স করবেন।
.
সকালে অর্ঘমা স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে অভ্রর রুমে গেল তাকে ডাকতে। ঘুমের মাঝে অভ্রর চেহারাটা বড্ড মলিন দেখাচ্ছে। পাশের টেবিলেই ভাঙা ফোনটা পড়ে আছে অবহেলায়। ভ্রু কুঁচকাল অর্ঘমা। অভ্রর চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে তাকে ডাকতে লাগল। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকিয়ে অর্ঘমাকে দেখে অভ্র বলল,
-“আমি আজ যেতে পারব না তোর সঙ্গে।”
-“তাহলে কী আমি আজ স্কুলে যাব না?”
-“যাবি। আমি নীরদকে বলে রেখেছি। ও তোকে দিয়ে আসবে স্কুলে। আবার ও-ই তোকে নিয়ে আসবে।”
-“আচ্ছা। কিন্তু তোমার ফোন ভাঙল কী করে?”
-“গতকাল রাগের মাথায় আছাড় মেরেছিলাম। এবার যা। তোর দেরি হয়ে যাচ্ছে। নীরদ মনে হয় দাঁড়িয়ে আছে তোর জন্য।”
-“ঠিক আছে, যাচ্ছি।”
অর্ঘমা নিজের রুমে গিয়ে তার ফোনটা নিয়ে সিম খুলে ড্রয়ারে রেখে দিল। আবারও ফিরে এলো অভ্রর রুমে। ঘুমন্ত অভ্রকে আবারও জাগিয়ে তুলে বলল,
-“নতুন ফোন না কেনা অব্দি আমার ফোন ইউজ কর। আমি সিম খুলে রেখেছি।”
-“লাগবে না। আমি ম্যানেজ করে নিব।”
-“অবশ্যই লাগবে। আমার তো ফোনের তেমন একটা দরকার পড়ে না। কম্পিউটার তো আছেই বাসায়। আমি নাহয় কম্পিউটারে টাইম পাস করব। তুমি এটা নাও।”
অভ্র জানে ফোন না নেওয়া পর্যন্ত অর্ঘমা মানবে না। তাই ফোন নিয়ে টেবিলে রেখে বলল,
-“নিয়েছি। এবার যা, দৌড় দে।”
সত্যি সত্যি অর্ঘমা দৌড়ে বেরিয়ে গেল। কারণ তার স্কুলের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে।
___
তিন তলায় এসে দেখল নীরদ দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে ফোন টিপছে। পায়ের আওয়াজ শুনে সামনে তাকিয়ে অর্ঘমাকে আসতে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ঘড়ি দেখে বলল,
-“এত দেরি হলো কেন?”
-“ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলাম।”
-“আচ্ছা, এসো এখন।”
-“চলুন।”
যেতে যেতে অর্ঘমা বলল,
-“আপনাকে সকাল সকাল এভাবে জ্বালানোর জন্য দুঃখিত।”
-“জ্বালানোর কী আছে? আমি সকালেই উঠি। ছোটবেলার অভ্যাস আমার।”
-“কী করেন এত সকালে উঠে?”
-“একটু হাঁটাহাটি করি, ছাদের গাছগুলোতে পানি দেই, বই ঘাটি, মাঝে মাঝে ফোনে ভিডিও দেখি।”
-“বাহ!”
-“শুনলাম তোমার নাকি অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষা গেল কিছুদিন আগে!”
-“হ্যাঁ।”
-“কেমন হয়েছে?”
-“মোটামুটি ভালোই। প্রশ্ন একেবারে কঠিনও আসেনি আবার একেবারে সহজও আসেনি। মাঝামাঝি অবস্থায় এসেছে। তাই আমার পরীক্ষাও অমনই হয়েছে।”
-“রেজাল্ট কবে দিবে?”
-“পরশু দেওয়ার কথা।”
-“আচ্ছা। কিছু কিনবে?”
অর্ঘমা সামনে তাকাল। তারা স্কুলের সামনে চলে এসেছে। অর্ঘমা খেয়াল করল তার মনটা ভালো হয়ে গেছে। গতকাল থেকে তার মন খারাপ ছিল। তবে নীরদের সাথে কথা বলে তার মনটা এখন বেশ ফুরফুরে লাগছে। অর্ঘমা নীরদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল,
-“না, কিছু কিনব না। পৌঁছে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমি তাহলে আসছি এখন।”
-“গেইটের ভেতরে গিয়ে একটু দাঁড়াও। আমি আসছি এখনই।”
অর্ঘমা মাথা নাড়িয়ে স্কুল গেইটের ভেতরে ঢুকে একপাশে দাঁড়াল। নীরদ ছুটে কোথায় যেন গেল। অর্ঘমা হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল। তার ক্লাস শুরু হতে দশ মিনিটের মতো বাকি এখনো। নীরদ ফিরে এলো পাঁচ মিনিটের মাথায়। হাতে একটা পলিথিন ব্যাগ। সেটা অর্ঘমার দিকে এগিয়ে দিতেই অর্ঘমা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। নীরদ মুচকি হেসে বলল,
-“সকালে নাস্তা করে আসো নি আমি নিশ্চিত। তাই এটা রাখো। ক্লাসের এক ফাঁকে খেয়ে নিয়ো। আর বাকিটা টিফিন টাইমে খেয়ো।”
পলিথিন ব্যাগটা হাতে নিয়ে অর্ঘমা দেখল ভেতরে একটা কেকের প্যাকেট, একটা চিপস, একটা জুস আর কিছু চকলেট রাখা। একগাল হাসল অর্ঘমা। নীরদ হুমকি দেওয়ার মতো করে বলল,
-“আমি না আসা পর্যন্ত স্কুল গেইটের বাইরে এক পা-ও রাখবে না। বুঝেছো?”
-“হ্যাঁ, বুঝেছি। এবার আপনি বাসায় যান। আমিও ক্লাসে যাই। টিচার মনে হয় ক্লাসে ঢুকে গিয়েছে।”
-“আচ্ছা, যাও। সাবধানে থেকো।”
মাথা নাড়িয়ে ক্লাসের দিকে অগ্রসর হলো অর্ঘমা। নীরদ আরও মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। যদি অর্ঘমা কোনো কিছুর দরকারে আবার ফিরে আসে, এই ভেবে। তারপর চলে গেল বাসার উদ্দেশ্যে।
___
স্কুল ছুটির পর অর্ঘমা গেইটের বাইরে উঁকি দিতেই দেখতে পেল নীরদ একদম গেইটের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তাকে আর অপেক্ষা করতে হলো না ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। নিধির সাথে বাইরে আসতেই অর্ঘমা পরিচয় করিয়ে দিল নীরদকে। অভ্রর বন্ধু হিসেবেই পরিচয় দিল। তাছাড়া নিধিকে সে আজ সবই বলেছে। তাই নাম শুনেই নীরদকে চিনে গেছে নিধি। অল্প কুশলাদি বিনিময় করে নিধি চলে গেল নিজের বাসার উদ্দেশ্যে। অর্ঘমাও নীরদের সাথে চলতে লাগল নিজের বাসার উদ্দেশ্যে।
___
বাসায় গিয়ে ফ্রেস হয়ে বসতেই অভ্র এসে জানালো এখন থেকে নীরদ পড়াবে অর্ঘমাকে। আজ বিকেল থেকেই আসবে সে। অর্ঘমা কপাল কুঁচকে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“ব্যাপার কী বলতো? সবকিছুতে তুমি নীরদ ভাইকে টানছো কেন?”
-“তোর তো আরও ভালো লাগার কথা। তোর ক্রাশ এখন থেকে সবসময় তোর আশেপাশে ঘুরঘুর করবে।”
-“সেসব কথা বাদ দাও। তাকে কীভাবে রাজি করালে সেটা বলো।”
-“আমি শুধু বলেছিলাম তুই যেখানে কোচিং করতে যাস সেখানে শাকিলের বাসা। তাই তুই আর কোচিং করতে যাবি না। কিন্তু তোর টিচার দরকার বাসায় পড়ার জন্য। ব্যস! ও নিজে থেকেই বলল ও পড়াবে তোকে। আমিও রাজি হয়ে গেলাম।”
-“তোমরা আবার আমার পিঠ পিছে কোনো খিচুড়ি পাকাচ্ছ না তো!”
-“আরে নাহ!”
-“না হলেই ভালো।”
-“আচ্ছা, এখন খেতে চল। আম্মু ডাকছে।”
-“ভাবীর কী খবর?”
রুম থেকে বের হতে গিয়েও থেমে গেল অভ্র। রিয়ার কথা অর্ঘমাকে এখনো জানানো হয়নি। জানতে পারলে অর্ঘমা শুধু শুধু নিজেকে দোষারোপ করতে শুরু করবে। তাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে মনে মনে ভেবেচিন্তে বলল,
-“ওকে আর ভাবী ডাকবি না।”
-“কেন?”
অবাক হয়ে গেল অর্ঘমা। অভ্র রিয়াকে কতটা ভালোবাসে তা অর্ঘমা ভালো মতোই জানে। তাহলে হঠাৎ এই কথার মানে কী?
-“ব্রেকআপ হয়ে গেছে।”
-“তোমাদের তো দু’দিন পর পরই ব্রেকআপ হয়। আবার দু’দিন পরেই ঠিক হয়ে যায়। এবারও ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা কর না।”
-“এবার আর কিছু ঠিক হওয়ার নয়। ওর বাসা থেকে বিয়ে ঠিক করেছে। রিয়া নিজেও রাজি। আমি বেকার বলে আমাকে গতকাল ফোন করে অপমান করেছে। আর আমাদের সম্পর্কটাও শেষ করেছে।”
অর্ঘমা যেন মুহূর্তেই থমকে গেল। রিয়ার এহেন আচরণের কথা এর আগে কখনো শুনেনি। তাহলে আজ হঠাৎ কী হলো? তবে অর্ঘমার রাগও লাগল এই ভেবে যে রিয়া তার ভাইকে অপমান করেছে। অভ্রর হাত ধরে বলল,
-“মন খারাপ কর না। তোমাদের জুটি ওপর থেকে লেখা ছিল না তাই তোমরা আলাদা হয়ে গিয়েছ। জানি কষ্ট পাচ্ছ। আর এই কষ্ট কমতে সময় লাগবে। তবুও বলব, নিজের মনকে শক্ত কর। যে মেয়ে তোমাকে অপমান করতে পারে সেই মেয়ে কখনো তোমার ভালোবাসা হতে পারে না।”
অর্ঘমার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেল অভ্র। বাইরে এসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। অর্ঘমা মিথ্যে কথাগুলো না বললে অর্ঘমা বারবার রিয়ার ব্যাপারে জানতে চাইত। আর অর্ঘমা যদি একবার জানতে পারে তার কারণেই রিয়ার সাথে অভ্রর ব্রেকআপ হয়েছে তাহলে মেয়েটা মানতে পারত না। হয়তো শাকিলের সাথে বিয়েতেও রাজি হয়ে যেত তাদের সম্পর্ক ঠিক করার জন্য।
___
বিকেলে নীরদ যখন বাসায় আসলো তখন অর্ঘমা ঘুমোচ্ছে। অভ্রও বাসায় ছিল না। অর্ঘমার মা রুমে গিয়ে অর্ঘমাকে ডেকে উঠিয়ে ফ্রেস হয়ে আসতে বলে বাইরে এসে নীরদকে বলল অর্ঘমার রুমে যেতে। নীরদ অর্ঘমার রুমে ঢুকে দেখল অর্ঘমা বিছানায় বসে ঝিমাচ্ছে। হেসে ফেলল নীরদ। অর্ঘমার সামনে গিয়ে তার মাথায় একটা টোকা দিতেই অর্ঘমা চোখ মেলে তাকাল।
-“ফ্রেস হয়ে আসো। এখন পড়ার সময়। তাছাড়া একটু পরেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। এই সময় ঘুমানো ঠিক না।”
-“আমার শান্তির ঘুম কারো সহ্য হয় না। সবার আমার ঘুমের সাথে এত কিসের শত্রুতা?”
-“সেটা পরে বসে ভেবো। এখন চটজলদি ফ্রেস হয়ে আসো।”
-“ধুর!”
মেঝেতে পা দিয়ে লাথি মেরে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল অর্ঘমা। নীরদ হেসে পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে বসল। টেবিলের উপরে একটা উপন্যাসের বই নামানো। বইটা হাতে তুলে নিল নীরদ। হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা ‘অপেক্ষা’। এই উপন্যাসটা সে পড়েছে। অর্ঘমার রুমের আশেপাশে তাকিয়ে বিছানার অপর পাশের কোণায় একটা বুকশেলফ দেখতে পেল। বুকশেলফ ভরতি উপন্যাসের বই।

ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজে সেদিকে তাকাল নীরদ। অর্ঘমা ওয়াশরুম থেকে বের হতেই নীরদের সাথে চোখাচোখি হলো তার। অর্ঘমার সারা মুখ ভরতি বিন্দু বিন্দু জলকণা।
-“মুখ মুছোনি কেন?”
-“টাওয়াল বারান্দায়।”
বারান্দায় গিয়ে টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছে ঘরে ফিরল। নীরদের পাশে চেয়ার টেনে বসতেই নীরদ জিজ্ঞেস করল,
-“তুমি উপন্যাস পছন্দ কর?”
-“হ্যাঁ। আব্বুর থেকে পাওয়া গুণ। আব্বু অবসর সময়ে উপন্যাস পড়তে পছন্দ করেন। তার দেখাদেখি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল পড়ার। এরপর থেকেই নেশার মতো হয়ে গেছে।”
-“এটা বেশ ভালো নেশা। আমার বাসায় অনেকগুলো উপন্যাসের বই আছে। আমি এনে দেবো তোমাকে। আসলে আমার আগে পড়ার অভ্যাস ছিল। এখন আর পড়া হয় না। যখন পড়তাম তখন কিনেছিলাম ওগুলো।”
-“আচ্ছা।”
-“এখন পড়ার বই বের কর। কোন বিষয়ে সমস্যা সেটা দেখাও।”
পরবর্তী সময়টা পড়ার মাঝে কেটে গেল অর্ঘমা আর নীরদের। এর মাঝে অর্ঘমার মা এসে নাস্তা দিয়ে গিয়েছিলেন। নীরদ প্রথম দিনেই বুঝতে পারল অর্ঘমাকে পড়াতে তার খুব একটা কষ্ট হবে না। বেশ ভালো ছাত্রী মেয়েটা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here