#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৪
.
আজও নীরদকে দেখা যাচ্ছে, গলির মাথায় দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে ক্যারাম খেলছে। অর্ঘমা সাইকেল নিয়ে আসার সময় একবার চোখাচোখি হলো নীরদের সাথে। প্রতিদিনের মতো আজও দোকান থেকে কতগুলো সেন্টার ফ্রুট কিনে ব্যাগে ভরলো। নীরদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সেন্টার ফ্রুটস সমেত একটা পলিথিন তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে গেল। দু’হাতে পলিথিন ক্যাচ ধরে অর্ঘমার দিকে তাকিয়ে হাসল নীরদ। অর্ঘমাও পাল্টা হেসে কিছু না বলে চলে গেল।
নীরদের বন্ধুরা অবাক হলো না এসব দেখে। কারণ প্রায় প্রতিদিনই তাদের এসব দেখতে হয়। অর্ঘমা কোচিংয়ে যাওয়ার সময় যেদিনই নীরদকে দেখতে পাবে সেদিনই কিছু না কিছু নীরদকে দিয়ে যাবে। যেমন গতকাল আইসক্রিম দিয়ে গিয়েছিল। এর আগের দিন একটা ডিউয়ের বোতল দিয়ে গিয়েছিল। আবার নীরদও মাঝে মাঝে অর্ঘমাকে এসব দিয়ে থাকে। নীরদের বন্ধুদের ভেতরে থাকা আসিফ বলল,
-“এসব কী ভাই? তোরা প্রেম করস না, কিছু না তবুও এসব কী?”
আরেক বন্ধু বলল,
-“ঠিক। প্রেম করলে তাও মানা যেত। কিন্তু প্রেম না করলে এসব আদান-প্রদান কেন চলে তোদের ভেতরে?”
আসিফ সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করল,
-“সত্যি করে বলতো, তোদের ভেতরে কিছু চলছে না তো?”
-“চললে তোরা জানতি না মনে হয়?”
নীরদের উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারল না কেউই। আসিফ ভাবুক সুরে বলল,
-“অর্ঘমাকে দেখলে মনে হয় ও তোকে পছন্দ করে।”
জবাব দিল না নীরদ। হাসিমুখে একটা সেন্টার ফ্রুটের প্যাকেট খুলে মুখে দিল। বাকি সেন্টার ফ্রুটগুলো পলিথিন থেকে বের করে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। বন্ধুরা অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। আসিফ কিছু একটা ভেবে জিজ্ঞেস করল,
-“তোর খবর বল। তুই বাই এনি চান্স অর্ঘমাকে পছন্দ করিস না তো?”
-“এমনটা মনে হওয়ার কারণ?”
-“তোর ভাবসাব দেখলে আমার তাই মনে হয়।”
-“এত ভেবে কী করবি? ভাবনা বাদ দিয়ে ক্যারামে মনোযোগ দে। লাস্টে পড়ে আছিস। তুই তো হারবি।”
-“আগেই ভবিষ্যৎ বাণী করস কেন? আমি হারি কিনা জিতি তুই শুধু দেখ।”
আসিফ পুরো দমে ক্যারামে মনোযোগ দিল। এমনকি সব বন্ধুরা ক্যারামে মনোযোগ দিল। নীরদ তা দেখে হাসল। চুলগুলো হাত দিয়ে একটু ঠিক করে সে নিজেও ক্যারামে মনোযোগ দিল।
স্কুল ছুটির পর নিধির সাথে গল্প করতে করতে বের হলো অর্ঘমা। স্কুলের গেট পেরোতেই মুখোমুখি হলো শাকিলের। মাঝে কয়েকটা মাস ছেলেটা গায়েব ছিল। অর্ঘমা ভেবেছিল ছেলেটা অবশেষে তার পিছু ছেড়েছে। কিন্তু আজ হঠাৎ এভাবে উদয় হওয়ার মানে কি! শাকিলকে বেশ পরিবর্তন লাগছে। বেশভূষা, হাবভাবেও পরিবর্তন হয়েছে কিছুটা। শাকিল গলা ঝেড়ে জিজ্ঞেস করল,
-“মিস করেছো আমাকে এই ক’দিন?”
অবাক হলো অর্ঘমা। মিস! সে কেন এই ছেলেকে মিস করতে যাবে? মাথাটা গেল নাকি ছেলেটার! অবাকতার রেশ টেনেই অর্ঘমা বলল,
-“আপনাকে মিস করব কেন? কোন দুঃখে মিস করব? বরং আপনি এতদিন না আসায় আমি শান্তিতে ছিলাম। এই যে আজ হঠাৎ আবার আপনি আমার সামনে আসলেন, এখন বিরক্ত হচ্ছি।”
-“আমি আসলে চাকরির জন্য পড়াশোনা করছিলাম।”
-“তো! আমাকে কেন বলছেন এসব?”
-“আসলে আমার চাকরি হয়ে গেছে।”
-“কংগ্রাচুলেশন। এবার অন্তত চাকরির টানে পড়ে আপনি আমার পিছন ছাড়বেন।”
-“তুমি জানো আমি তোমাকে পছন্দ করি। তবুও এমন কর কেন আমার সাথে?”
-“কারণ আমি আপনাকে পছন্দ করি না। আর জোর করে কাউকে পছন্দ করা যায় না।”
-“আমি আমার পরিবারে তোমার কথা বলেছি। তারা সবাই তোমাকে দেখতে চান। তাই আমি চাইছি তোমার পরিবারকে প্রস্তাব দিতে।”
-“হোয়াট! আর ইউ আউট অফ ইওর মাইন্ড? যেখানে আমি আপনাকে পছন্দই করি না সেখানে প্রস্তাব দেওয়ার কথা আসছে কোথা থেকে?”
-“একসাথে থাকতে থাকতে একসময় না একসময় পছন্দ হয়েই যাবে। আমি শুধু তোমাকে জানাতে এসেছিলাম ব্যাপারটা। তোমার কথা এতদিন শুনেছি। এখন আমি আমার মনের কথা শুনব। তাছাড়া তোমার পরিবারের আপত্তি করার কোনো কারণ নেই। আমি পড়াশোনা জানা ছেলে। ভালো চাকরি করছি। আর সবথেকে বড় কথা হলো আমি একমাত্র ছেলে। আমার এক বোন আছে। তার বিয়ে হয়ে গেলে পুরো বাসায় তোমার রাজত্ব চলবে। এছাড়াও টাকাপয়সা মোটামুটি ভালোই আছে আমাদের।”
-“পৃথিবীতে মেয়ের নিশ্চয়ই অভাব পড়েনি! তাহলে আপনি হাত ধুয়ে আমার পেছনেই কেন পড়ে আছেন? আমার আপনাকে একটুও পছন্দ না। তাছাড়া আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি।”
চোখমুখের পরিবর্তন ঘটল শাকিলের। চোখ ভরতি রাগ নিয়ে বলল,
-“আমি তোকে পছন্দ করেছি মানেই তুই আমার। কোন শু*** বাচ্চাকে পছন্দ করিস তুই? তাকে একবার সামনে পেলে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবো মাটিতে। এতদিন ভালোভাবে বলেছি গায়ে লাগেনি। এখন থেকে আর ভালোভাবে বলব না। আগামীকাল আমার পরিবার নিয়ে যাব তোদের বাসায়। তোর বাপ-মাকে বলে দিবি, যদি নিজেদের ভালো চায় তাহলে যেন বিয়েতে কোনো বাগড়া না দেয়। নাহলে এই শাকিলের জঘন্য রূপটা তারা দেখতে বাধ্য হবে।”
অর্ঘমা হতবিহ্বল নয়নে তাকিয়ে রইল। শাকিলের এমন রূপ বদল তার ঠিক হজম হচ্ছে না।
বাসায় ফিরেই ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল অর্ঘমা। তার কানে এখনো শাকিলের বলা কথাগুলো বাজছে। আজকে শাকিলের বলা কথার ধরনই বুঝিয়ে দিয়েছে ও কেমন ধরনের ছেলে। এমন একটা জঘন্য ছেলের নজরেই কেন পড়তে হলো তাকে? ভীষণ কান্না পাচ্ছে অর্ঘমার। আজকে শাকিলের ধমকিতে যে সে ভয় পেয়েছে তা আর বলার বাকি রাখে না। অভ্র বাসায় নেই এই মুহূর্তে। এমনকি তার বাবা-মাও বাসায় নেই। বাসায় একা থেকে সে অভ্যস্ত। কিন্তু আজ কেন যেন খুব ভয় করছে অর্ঘমার। কাঁদতে কাঁদতেই ফোন নিয়ে অভ্রর নম্বরে কল দিল। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই অর্ঘমা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তার কান্নার আওয়াজ শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়ল অভ্র।
-“হ্যালো অর্ঘ! অর্ঘ কী হয়েছে, কাঁদছিস কেন? হ্যালো! অর্ঘমা! কথা বল। কোথায় তুই? কী হয়েছে?”
-“বা..বাসায় এসো ভা..ভাইয়া।”
তৎক্ষনাৎ কল কেটে গেল। অর্ঘমা দু’হাতে মুখ চেপে ধরে কাঁদতে লাগল।
মিনিট দশেক পেরোতেই বাসায় এসে হাজির হলো অভ্র। বেল না বাজিয়ে চাবি দিয়েই দরজা খুলল। তাদের বাসার প্রত্যেকের কাছে এক সেট করে চাবি আছে। অনেক সময় বাসায় কেউ না থাকলে তখন এই চাবি কাজে লাগে। আজ অর্ঘমা বাসায় থাকলেও তার কান্নামাখা কণ্ঠস্বরটা শুনে অভ্রর মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেছে। বিন্দুমাত্র অপেক্ষা করার আগ্রহ তার মধ্যে নেই, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। দরজা খুলেই হনহনিয়ে অর্ঘমার রুমের দিকে গেল। রুমে ঢুকেই দেখল দু’হাতের মাঝে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে অর্ঘমা। অভ্র প্রথমে তার মাথায় হাত রাখল। হঠাৎ কারো আভাস পেয়ে অর্ঘমা চমকে উঠল। পরক্ষণেই ভাইকে দেখে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। এই মুহূর্তে কোনো প্রশ্ন করল না অভ্র। অর্ঘমা কিছুটা শান্ত হতেই অভ্র শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
-“কী হয়েছে? কে কি বলেছে ফুল ডিটেইলসে বলবি।”
অভ্রর শান্ত ভঙ্গিই অর্ঘমাকে জানান দিচ্ছে সে ঠিক কতটা রেগে আছে। রেগে থাকার কারণটা অর্ঘমার চোখের পানি। অর্ঘমা ভাইয়ের দিকে তাকাতেই তার চোখ গেল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নীরদের দিকে। নীরদকে এখানে দেখে বেশ অবাক হলো অর্ঘমা। তার অবাক দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে তাকাল অভ্র। নীরদকে দেখে মনে পড়ল, সে নীরদের সাথেই ছিল বাইরে। তখন অর্ঘমার ফোন পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে চলে আসার সময় নীরদও এসেছে তার সাথে। বোনের চিন্তায় নীরদকে বেমালুম ভুলে বসেছিল অভ্র।
নীরদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অর্ঘমার দিকে। এতক্ষণ যাবত সে শুধু অপেক্ষা করছে অর্ঘমার কান্নার কারণ জানার জন্য। কি এমন হয়েছে যার জন্য এভাবে কান্না করছিল মেয়েটা? অভ্র হয়তো নীরদের চোখের ভাষা পড়তে পারল। তাই অর্ঘমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-“বল।”
নীরদকে সামনে দেখে অর্ঘমা কিছুটা ইতস্তত করছে দেখে অভ্র বলল,
-“বলতে পারিস। কিচ্ছু হবে না।”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আজকের ঘটনা সম্পূর্ণ খুলে বলল অর্ঘমা। নীরদ সামনে আছে বলে শুধু নিজের পছন্দের ব্যাপারটা চেপে গেল। সবটা শুনে অভ্র, নীরদ দু’জনেই বেশ ক্ষেপে গেল। অভ্র রেগে বলল,
-“ওই শালার কলিজা কত বড় আমিও দেখব। ও কার বোনের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছে জানে না। এর শেষ আমি দেখে ছাড়ব। আর তুই! আগামীকাল থেকে আমি তোকে স্কুলে দিয়ে আসব আবার আমিই তোকে নিয়ে আসব। মনে থাকবে?’
-“হু।”
-“এখন কান্না বন্ধ করে গিয়ে চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে আয়। খাবার টেবিলে তোর জন্য অপেক্ষা করছি আমি।”
অর্ঘমা মাথা নাড়িয়ে উঠে গেল। অভ্র আর নীরদ রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
খাবার টেবিলে গিয়ে দেখতে পেল নীরদ আর অভ্র কি নিয়ে যেন আলোচনা করছে। অর্ঘমা চেয়ার টেনে ভাইয়ের পাশে বসে পরল। অভ্র তিন প্লেটে খাবার বেড়ে যার যার দিকে এগিয়ে দিল। নীরদ চলে যেতে চেয়েছিল কিন্তু অভ্র তাকে যেতে দেয়নি। অর্ঘমা চুপচাপ বসে কোনোমতে একটু খেয়ে উঠে রুমে চলে গেল। অভ্র আর নীরদ নিজেদের মধ্যে কথা বলে সব গুছিয়ে নিল।
চলবে…#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৫
.
সোফায় বসে আছেন অর্ঘমার বাবা-মা। সামনের সোফায় বসে আছে অভ্র আর নীরদ। তাদের চেহারা বেশ গম্ভীর। অর্ঘমার বাবা একটু নড়েচড়ে বসে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কী হয়েছে? এত জরুরি তলব করলে যে!”
-“অর্ঘমাকে একটা ছেলে ডিস্টার্ব করছে।”
অভ্রর কথা শুনে তার বাবা বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা এতটুকুতে থেমে নেই। কারণ ঘটনা যদি এতটুকু হত তাহলে অভ্র কখনো তাদের ডাকত না।
-“অর্ঘমা কোথায়?”
-“ঘুমোচ্ছে। ওকে এখানে ডাকার দরকার নেই। যা বলছি তা শোনো।”
-“বলো।”
অর্ঘমাকে দেওয়া শাকিলের হুমকির ব্যাপারটা জানিয়ে অভ্র বলল,
-“শাকিল ওর পরিবার নিয়ে আগামীকাল আমাদের বাসায় আসবে। প্রস্তাব রাখবে অর্ঘমাকে বিয়ে করার জন্য।”
-“এখন?”
অর্ঘমার মা কিছু একটা ভেবে বললেন,
-“আচ্ছা, ছেলে যদি ভালো হয় তাহলে তো আপত্তির কোনো কারণ আমি দেখছি না।”
নীরদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
-“অর্ঘমার কী বিয়ের বয়স হয়েছে আন্টি? ও সবেমাত্র ক্লাস টেনে পড়ে। এখনই এসব চিন্তা আপনারা কীভাবে করতে পারেন?”
মুখ কালো করে ফেললেন অর্ঘমার মা। অভ্র বলল,
-“মাকে কিছু বলে লাভ নেই। অর্ঘমা ক্লাস সিক্সে থাকাকালীন থেকে মা ওর বিয়ে নিয়ে পাগল হয়ে আছে। শুধু আমি আর বাবা মত দেই না বলে মা কিছু করতে পারছে না।”
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল নীরদ। মেয়েটার বয়সই বা কত? এই বয়সেই ওইটুকু মেয়েটাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য কেউ কীভাবে পাগল হতে পারে?
-“ওই ছেলে মানে শাকিলের ব্যাপারে কিছু জানো?”
নিজের বিস্ময় ভাব লুকিয়ে নীরদ বলল,
-“আমি আমার বন্ধুদের দিয়ে খোঁজ নিয়েছি। আজ সারাদিন আমার বন্ধুরা এসব ডিটেইলস বের করার কাজেই ছিল। প্রথমেই যেটা জানতে পেরেছে তা হলো শাকিলের পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো না। শাকিলের বাবার তিন বিয়ে। প্রথম স্ত্রীর বাচ্চা হচ্ছিল না বলে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে হচ্ছে শাকিল। শাকিল হওয়ার পর তিনি নিজের কর্মক্ষেত্রের এক ক্লিনার মহিলার সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীতে সেই মহিলা প্রেগন্যান্ট হওয়ায় তাকে বিয়ে করে ঘরে তোলেন। সেই পক্ষের একটি মেয়ে আছে। তিন স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে এক বাসাতেই থাকেন। এরপরেও নাকি কয়েকবার ওনাকে অন্যান্য মহিলাদের সাথে বিশ্রী অবস্থায় পাওয়া গেছে। এগুলো তো গেল শাকিলের বাবার ঘটনা। এবার আসি শাকিলের ঘটনায়। শাকিলের নামে থানায় দুটো কেস চলছে। এর মধ্যে একটা হলো গার্লস হোস্টেলের সামনে গিয়ে এক মেয়েকে ফিজিক্যাল হ্যারাসমেন্ট করার জন্য। আর…”
-“থামো! আর কিছু শুনতে চাই না। ওই পরিবারের লোকজন যেন আমার বাসার চৌকাঠও না মাড়ায়। এমন পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করার কথা চিন্তা করাও অনুচিত।”
অভ্র বলল,
-“তাদের এখানে আসাটা আমরা আটকাতে চাচ্ছি না। তারা আসুক। আমরা সামনা-সামনি বলে দেবো আমরা তাদের সাথে কোনো প্রকার আত্মীয়তা করতে চাচ্ছি না।”
-“যদি কোনো ঝামেলা করে তখন?”
-“ঝামেলা করতে পারবে না। আমি আর নীরদ আমাদের বন্ধুদের আগে থেকেই খবর দিয়ে রাখবো। উল্টো পাল্টা কিছু করলে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য তারা থাকবে।”
নীরদ অর্ঘমার বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
-“তারা আসার পর কোনোভাবেই যেন অর্ঘমাকে সামনে না আসতে হয় সেদিকটা খেয়াল রাখবেন। এই রকম চরিত্রের লোকদের সামনে অর্ঘমার যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আর তাদের কথা বাড়ানোর কোনো সুযোগ দিবেন না। যা বলার সোজাসুজি বলে দিবেন। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কোনো কথা হবে না।”
-“ঠিক আছে।”
-“আরেকটা কথা! মাথা গরম করবেন না। মাথা গরম করলে অর্ঘমার সমস্যা হবে এটা মাথায় রাখবেন।”
-“কাল তাহলে আমি বাসাতেই থাকব। তোমরাও বাসাতেই থেকো।”
-“জি।”
___
নীরদ আর অভ্রর বন্ধুরা গলির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে শাকিলদের। শাকিলদের গাড়ি দেখা মাত্রই তারা নীরদ আর অভ্রকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিবে। তারপর শাকিলরা বাসার ভেতরে ঢোকার পর তারা অর্ঘমাদের ফ্ল্যাটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে। কোনো ঝামেলা করলেই ভেতরে গিয়ে দু’চার ঘা বসিয়ে দিবে। এমনটাই কথা হয়েছে অভ্র আর নীরদের সাথে তাদের।
___
ছাদের একপাশে দাঁড়িয়ে অভ্র আর নীরদ নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াচ্ছে। তারা দু’জনই আজ কী হবে এই ভেবে চিন্তিত। নীরদ তার বড় বোন নুসরাতের সাথে এই ব্যাপারে আলোচনা করে অর্ঘমাকে তার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। মেয়েটা বাসায় থাকলে এসব ঝামেলা দেখে ভয় পেয়ে যেতে পারে। নুসরাতের ছুটি থাকায় সে বাসাতেই ছিল। তাই সে নিজেই এসে অর্ঘমাকে নিয়ে গেছে বাসায়। অভ্র ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জিজ্ঞেস করল,
-“সিগারেট খাও কবে থেকে? এতদিন কিন্তু আমি তোমায় সিগারেট খেতে দেখিনি।”
-“আমি সবসময় খাই না। টেনশনে থাকলে বা মন খারাপ থাকলে খাই।”
-“কবে থেকে?”
-“ক্লাস টেন থেকে। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে এই বদঅভ্যেসটা হয়ে গেছে।”
-“ড্রিংক্স কর?”
-“সত্যি বলব না মিথ্যা?”
-“মিথ্যে তুমি বলবে না তা আমি বেশ ভালো করেই জানি।”
নীরদ হেসে বলল,
-“ড্রিংক্স করা হয় হঠাৎ। মানে কোনো পার্টি থাকলে তাহলে। ওই বছরে দু-একবার আরকি।”
-“প্রেম কয়টা করেছ এই পর্যন্ত?”
-“একটাও না। মন মতো কাউকে পাইনি প্রেম করার জন্য।”
-“কোনো মেয়ের সাথে ক্লোজও হও নি আজ পর্যন্ত?”
-“না। আমি এখনো ইনটেক।”
হেসে ফেলল অভ্র। নীরদও হাসছে। হাসি থামিয়ে বলল,
-“সব প্রশ্ন আমাকেই কেন? তুমিও বল!”
-“সিগারেটের অভ্যাস আমার ক্লাস এইট থেকে। ওই বন্ধুদের পাল্লায় পড়েই আরকি। আমি আবার প্রায় প্রায়ই স্মোক করি। আর ড্রিংক্স করা পড়ে হঠাৎ হঠাৎ। তোমার মতোই কোনো পার্টি থাকলে তাহলে। অথবা সব ফ্রেন্ডদের মুড ফ্রেশ থাকলে তাহলে। প্রেম একটাই করেছি। এখনো চলছে। এটাকেই পার্মানেন্ট রাখতে চাই। একটা ভালো চাকরির অপেক্ষায় আছি। তাহলেই ওর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাব।”
-“একটা প্রশ্ন বাদ পড়ে গেল তো।”
-“কোনটা?”
-“ক্লোজ হও নি?”
হো হো করে হেসে উঠল অভ্র। বলল,
-“চার বছর ধরে প্রেম করছি। কাহিনী কতদূর পর্যন্ত গড়াতে পারে তা নিশ্চয়ই তোমাকে বলে বোঝাতে হবে না!”
-“থাক থাক আর বলতে হবে না। আমি তোমার ছোট। এসব কী বলো আমার সামনে?”
-“ফিডার খাওয়ার মতো ছোট?”
-“আরে ধুর!”
অভ্র, নীরদ দু’জনেই হেসে ফেলল। এর মাঝে দু’জনের ফোন একসাথেই বেজে উঠল। একে অপরের দিকে তাকিয়ে কল রিসিভ করে কথা বলে কল কেটে দিল। সিগারেটে শেষ বারের মতো টান দিয়ে ফেলে দিল। হাতে করে নিয়ে আসা স্প্রাইটের বোতল খুলে দু’জনে মিলে খেয়ে নিল। যাতে মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ না আসে। স্প্রাইট খাওয়ার পর নীরদ সেন্টার ফ্রেশ এগিয়ে দিল অভ্রর দিকে। দু’জনে দুটো সেন্টার ফ্রেশ মুখে দিয়ে নিচে নেমে গেল। ফ্ল্যাটের দরজার সামনে এসে বন্ধুদেরকে এখানেই থাকতে বলে ভেতরে ঢুকল অভ্র আর নীরদ।
___
সোফায় অর্ঘমার বাবা-মা বসে আছে। ঠিক তাদের সামনের সোফায় চারজন বসে আছে। তাদের দিকে তাকাতেই একজনকে দেখে চেহারায় বিস্ময় খেলে গেল অভ্রর। সামনের ব্যক্তিও বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বাবার ডাকে অভ্র সোফায় গিয়ে বসল। তার পাশে বসল নীরদ।
শাকিলের বাবা হাসিমুখে পরিচিত হলেন। অর্ঘমার বাবা গম্ভীর মুখে বসে আছেন। তিনি বললেন,
-“এখানে আসার কারণটা যদি বলতেন!”
-“জি জি, এখনই বলছি। আমার মাত্র দুটো ছেলেমেয়ে। এটা হলো আমার ছেলে শাকিল। আর ও হলো আমার মেয়ে রিয়া।”
অভ্র একবার চোখের পলক ফেলে রিয়ার দিকে তাকাল। সে জানত না শাকিলের বোন রিয়া। রিয়া কখনো তাকে নিজের পরিবারের ব্যাপারে বেশি কিছু বলতো না। অভ্রও তাকে ঘাটায়নি কখনো। রিয়া তখনো নিজের বিস্ময় ভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
-“আমার ছেলে শাকিল কিছুদিন আগেই চাকরিতে জয়েন করেছে। খুব ভালো চাকরি। তাছাড়া ছেলে আমার এম এ পাশ। দেখতে শুনতেও ভালো।”
শাকিলের বাবা একগাল হেসে শাকিলের মাথায় হাত বুলিয়ে আরও বললেন,
-“এখন মূল কথায় আসি। ও আপনার মেয়েকে পছন্দ করে। আমাদের এতে কোনো আপত্তি নেই। আমার ছেলের পছন্দ বরাবরই ফার্স্ট ক্লাস। তাই আর সময় নষ্ট না করে ছেলের পছন্দকে দেখতে চলে আসলাম।”
শাকিলের বাবা আরও অনেক কথাই বললেন। অর্ঘমার বাবা-মা শুধু চুপচাপ শুনে গেলেন সব। একটা কথাও বললেন না তারা। অভ্র আর নীরদও চুপচাপ বসে আছে। শাকিলের কাছে ব্যাপারটা ঠিক লাগল না। এরা এত চুপচাপ কেন? তাছাড়া অর্ঘমাই বা কোথায়? আশেপাশে নজর বুলিয়ে নিল শাকিল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সবাইকে অবলোকন করল সে। সবাইকে চিনলেও নীরদকে সে চিনতে পারেনি। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। ভ্রু কুঁচকে সবাইকে দেখে নিয়ে বাবার হাতে চাপ দিল শাকিল। চোখের ইশারায় কিছু একটা বুঝালো। শাকিলের ইশারা বুঝে তার বাবা বললেন,
-“আচ্ছা, অনেক তো কথা হলো। এবার আপনাদের মেয়েকে নিয়ে আসুন। তাকে একটু দেখি। ছেলের পছন্দকে দেখে আমরাও একটু চোখ জুড়াই।”
-“অর্ঘমা বাসায় নেই। ও ওর খালার বাসায় গিয়েছে ঘুরতে।”
শাকিলের বাবা-মা একে অপরের দিকে তাকিয়ে শাকিলের দিকে তাকালেন। শাকিলের দৃষ্টিতে থাকা রাগ তাদের দৃষ্টিগোচর হলো না। গলা ঝেড়ে তিনি বললেন,
-“খালার বাসা কী বেশি দূরে? দূরে না হলে ওকে চলে আসতে বলেন।”
অভ্র গম্ভীর গলায় বলে উঠল,
-“আমার বোন এখানে আসবে না।”
চলবে…