#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-১৩
লেখনীতে-তানিয়া শেখ
সন্ধ্যা উতরেছে। গলির সামনের হেডলাইট না থাকায় আঁধারে ছেয়ে আছে সরু রাস্তাটা। দু’পাশের বাড়িগুলোর গেট বন্ধ। বাড়িগুলোর ভেতর থেকে মাঝে মাঝে উচ্চস্বরের গলা শোনা যাচ্ছে। নিরুপমা হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনস্ক হয়। নেকাবের আড়ালের ঠোঁটে জড়ানো যে হাসি এই তো কিছুক্ষণ আগে জেগেছিল তা মিলিয়ে গেল কোথাও। চোখজোড়ায় নেমে এলো নির্মোহতা। যত এগোচ্ছে ততই মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে উঠল। ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করে না। মন চায় খালেদার বাড়িতে চিরতরে থেকে যেতে। গত চার ঘণ্টায় নিজেকে হাসি আনন্দে ভরপুর জীব বলে উপলব্ধি করেছে। খালেদা ওকে হাসিয়েছে। রূঢ় জীবনের থাপ্পড়ে যে হাসি পালিয়ে গিয়েছিল ওইটুকু সময়ে তা ফিরে এসেছিল নিরুপমার ঠোঁটে। ওর মন শান্তি শান্তি অনুভব করে। বুকের ভেতর হালকা লাগছিল। পৃথিবীতে সবই ক্ষণস্থায়ী। ওই শান্তি ও হাসিটুকুও তাই ছিল।
খালেদা নিরুপমার কলেজের বান্ধবী। অনেকদিন দেখা হয় না দুজনের। খালেদা খুব করে বলছিল দেখা করার জন্য। নিরুপমাকে না কি ও ভীষণ মিস করছে। মিস করা ছাড়াও খালেদা নিরুপমাকে নিজের সোনার সংসার, সুখ দেখাতে চেয়েছিল। নিরুপমা যখন ঘুরে ঘুরে ওর সুখ, সোনার সংসার ও ফুটফুটে দুটো সন্তান দেখল খালেদা তখন ওকেই দেখছিল। নিরুপমার চোখে বিষাদ ও হিংসা দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়েছিল কী একটু খালেদা? বান্ধবীর এহেন আচরণে মনে মনে কষ্ট পেলেও হেসে উড়িয়ে দেয়। সংসার সুখ সকলের কপালে জোটে না। যার জোটে সে ভাগ্যবান বা ভাগ্যবতী। জীবনের পরম পাওয়া এ। খালেদা তবে কেন দেখাবে না? কেন বুঝাবে না সেটা? নিরুপমা ওর জায়গায় থাকলে ভিন্ন কী করত?
খালেদা এ ছাড়া আর কিছু করেনি যাতে নিরুপমা কষ্ট পায় বরং ওর সাথে গল্প করে, সময় কাটিয়ে বর্তমান ভুলে ছিল ও। আচ্ছা, অসুস্থ মা যে ঘরে আছে সে ঘরে যেতে অনীহা প্রকাশ করাতে কি নিরুপমা কুসন্তান হলো? পঙ্গু মা’কে চার ঘণ্টা একা রেখে এলো। কোনো সুসন্তান করে এই আচরণ? মা দিনরাত গালিগালাজ করুক, মারুক, মানসিক কষ্ট দিক তবুও দিনশেষে তিনি ওর মা। ওকে গর্ভে ধারণ করেছেন, লালন-পালন করেছেন। তাকে নিঃসঙ্গ ফেলে এসে কী করে হাসতে পারল? কী করে ভাবল, মা ছাড়া জীবনই জীবন! নিরুপমার হৃদয় বিধ্বস্ত হয়। যে চোখে নির্মোহতা জেগেছিল তাই এখন পাপে জ্বলে। মাকে দেখার জন্য কাতর হয়। মায়ের নিরুপমা ছাড়া আর কে আছে!
নিরুপমা দ্রুত হাঁটে। গলি ছেড়ে প্রধান রাস্তায় উঠল। অটোতে গেলে ভালো হতো। নিরুপমা দশ টাকা বাঁচাতে হেঁটেই চললো। এই দশ টাকার সাথে আরও দশটাকা মিলিয়ে সে মায়ের পছন্দের ঝালমুড়ি কিনবে।
টিউশন আর মৃত পিতার ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়া ব্যাংকে রাখা টাকা থেকে মাসে মাসে প্রাপ্ত অল্প টাকায় এই দুর্মূল্যের বাজারে সংসার চালানো দুরূহ। আজকাল দু’টাকা সাশ্রয় করতে পারলেও করে সেটা ও।
প্রায় আধঘন্টা পরে পরিচিত রাস্তায় নামল। পথে ঝালমুড়ি আর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে কাঁধের ব্যাগে ভরে নিয়েছে। মেইন রাস্তার মতো এদিকে মানুষের ভিড় তেমন নেই। যত সামনে অগ্রসর হয় ততই মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে। সাথে আলোর তীব্রতা। নিরুপমার বাসাটা এই রাস্তা ধরে আরও অনেকটা ভেতরে। অতদূর গিয়ে কংক্রিটের রাস্তাটার বেহাল দশা হয়েছে। এবারো থেবড়ো, ধুলা ওড়ে, বৃষ্টি হলে হাঁটু সমান পানি জমে। যাতায়াত অসুবিধার কারণেই বাসা ভাড়া আশেপাশের এলাকার তুলনায় কম। জায়গাটাও অনুন্নত।
পাশা হকের বাড়িতে ডা*কাতি ও খু*নের ঘটনার পর থেকে রাতের বেলা এ রাস্তায় মানুষজন খুব একটা আড্ডা দেয় না। একা রাস্তায় নিরুপমার ভয় করছিল না। কেন করব? ওই খু*নি, ডা*কাতটা এত ভয় দেখিয়েছে যে এখন আর ভয় টয় নেই। মনে মনে যখন এসব ভেবে সাহসী সাহসী ভাব নিচ্ছিল তখনই টের পেল রাস্তায় আসলে ও একা না। কেউ একজন ওর পিছু পিছু এগোচ্ছে। প্রথম প্রথম কোনো পথচারী মনে করে নিশ্চিন্তে হাঁটতে থাকে। কিন্তু অনেকটা পথ আসার পরও যখন লোকটা ওর পিছু পিছু আসে ও সাবধানে পেছন ফিরে তাকায়। এদিকের হেডলাইটগুলো পুরোনো, ময়লা ধরা। আবছা আলো। তবুও নিরুপমা চিনতে পারল।
খালেদার বাসার গেট থেকে বেরোতেই এই বোরকা পরিহিতা নারীটিকে দেখেছিল। এক দেখায় কাওকে মনে রাখার কথা নয়। বিশেষ কারণে মনে পড়ল সহজে। তার পরনের ধুলো ময়লা ও ছেঁড়া বোরকা আর অদ্ভুত চাহনি নিরুপমাকে অস্বস্তি দিয়েছিল। দরিদ্র কিংবা ভিখারি হলে এমন লাগত না। নিরুপমা আর কিছু ভাবেনি। চুপচাপ পাশ কেটে চলে এসেছিল। একটু আগে যে সাহসীকতার বড়াই করেছিল তা আর ও নিজের ভেতরে খুঁজে পেল না। ভয় ভয় করছে। আশেপাশে কেউ নেই। যদি পাগল বা কোনো খারাপ মতলবধারী হয়!
নিরুপমা হাঁটার গতি আবার বাড়িয়ে দেয়। কালো বোরকা পরিহিতা নারীটিও তাই করে। যখন নিশ্চিত হলো ওকেই অনুসরণ করছে সে ওর ভয় তরতরিয়ে বেড়ে যায়। অতি ভীতিতে মানুষের মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করে না। ভুল করে বসে। নিরুপমাও তাই করল। দৌড় দিলো। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না। লোকটা ওর চেয়ে অনেক লম্বা। লোকটাই হবে। না কি জ্বীন! লম্বা লম্বা পা ফেলে নিরুপমাকে ধরতে গেলেই নিরুপমা চিৎকার দিয়ে ওঠে,
“আল্লাহ গ…”
জ্বীন বা লোক যেই হোক তার হাতের তলে নিরুপমার চিৎকার বিসর্জিত হলো। কেউ শুনতে পেলে বড়ো বাঁচা বাঁচে ও। ভাগ্য প্রসন্ন হলো না। আর্ত বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইল সামনের অন্ধকারে নিরুপমা। অন্ধকার না, কালো বোরকার কাপড়৷
“তোমাকে আমি কোয়েকাফ নিয়ে যেতে এসেছি, আমার মালেকা। আমার জ্বীন রাজ্যের রাণী হবে তুমি। তারপর আমাদের বিয়ে হবে, ভালোবাসা হবে। সেই ভালোবাসায় জন্ম নেবে জোড়ায় জোড়ায় সন্তান। আমি তো প্রথম জোড়ার নামও ঠিক করে রেখেছি। এরু আর রুরু। তোমার পছন্দ না হলে…পছন্দ হবে না কেন? চমৎকার নাম। দেখতেও কিন্তু ওরা চমৎকার হবে। আমাদের কম্বিনেশন বলে কথা।”
নিরুপমার আর্ত বিস্ফোরিত চোখদুটো চমকে ওঠে। ওপরে তাকায়। এই লোক আবার! আবার কি দুঃস্বপ্ন দেখছে? না, না। সত্যি সত্যি এই লোক আবার ওর জীবনে ফিরে এসেছে! বিস্ময় কাটতে দু হাতে এহসাসের বুক ঠেলে সরিয়ে দেয়। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে ভয় গোপন করে রেগে তাকায়,
“আপনি! আপনি আবার কেন?”
“একটু আগেই তো বললাম। তোমাকে কোয়েকাফ নিতে এসেছি, আমার মালেকা।”
“ফালতু বকবেন না। আমি তো কাওকে কিছু বলিনি, পুলিশেও যাইনি। তাহলে আবার কেন পিছু নিয়েছেন?”
এহসাস জবাব দেয় না। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে। নিরুপমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। চাপা গলায় বলে,
“বোবার মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? পুলিশ ডাকব তারপর পিছু ছাড়বেন? কিছু বলছি না বলে যা ইচ্ছে তাই করবেন না কি? এই কদিনে এমন কিছু করিনি যাতে আমার পিছু নেবেন। করেছি কি? কেন আমার জীবনটা ঝুকিপূর্ণ করছেন? কেন বিপদ ডেকে আনছেন? আপনাকে আমি চিনি না জানি না। দূর দূর পর্যন্ত আপনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে..”
এহসাস আনমনে বলল,
“আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই!”
নিরুপমা ভ্রু কুঁচকায়
“আছে কি?”
এহসাস আবার চুপ। নিরুপমা জানে রাগের মাথায় যা বলবে, করবে তাই বিপজ্জনক। কিন্তু চুপ থাকতে পারল না,
“আপনি আমাকে অসহায়, ভীতু ভাবলে ভুল করবেন। ভালোই ভালোই বলছি পিছু ছাড়ুন। নয়তো!”
“নয়তো কী?” এহসাস এগিয়ে আসতে নিরুপমা পিছালো। সামনে দুজন পথচারী আসতে দেখে নিরুপমা আশান্বিত হয়। এহসাস লক্ষ্য করে বলে,
“ভুলেও ও ভুল কোরো না অমাবস্যা। চুপচাপ বাসার দিকে চলো। তাড়াতাড়ি।”
“আপনি কী করে ভাবলেন আপনার কথা আমি শুনব। এখন আমি চিৎকার করব। তারপরে কী হবে জানেন তো, না?”
কীসের জোরে এহসাস ওকে ভয় দেখাবে? কথায় কথায় পি*স্তল দেখানো! কিন্তু পি*স্তল তো নেই! এবার নিরুপমার আনন্দের পালা।
“খবরদার নিরুপমা!”
এহসাস চোখ রাঙায়। নিরুপমা সামনে হাঁটতে লাগল। লোক দুটো আরও এগিয়ে এসেছে। নিরুপমা মুখ খুলতেই যাবে তখনই মেরুদণ্ড বরাবর ধাতব কিছু টের পেল। বরফের মতো জমে গেল সেখানে।
“এজন্যই লোকে বলে ভালো কথার কদর নেই। এবার দেখি অমান্য করো। তোমার মুখ থেকে শব্দ বের হওয়ার আগেই গুলি বেরিয়ে যাবে। কী যেন বলেছিলাম এর আগে! ওহ! মনে পড়েছে৷ খু*নীর জন্য একটা খু*নও যা তিনটেও তাই। এবার তো পি*স্তুলে সাইলেন্সার লাগানো। কাকপক্ষীও জানবে না।”
“আপনি কেন এমন করছেন আমার সাথে? কী করেছি আমি?”
নিরুপমা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। এহসাস বলে,
“অনেক কিছু। এখন নাকে কান্না থামিয়ে চুপচাপ বাসার দিকে চলো। অনেক খিদে পেয়েছে। কী রান্না করেছ আজ?”
নিরুপমার কান্নাও আসছে আবার রাগে চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। কী রান্না করেছ আজ? এমনভাবে বলছে যেন ওরা স্বামী স্ত্রী। দুঃস্বপ্নেও না। সম্ভব হলে বিষ রান্না করে খাওয়াবে নিরুপমা ওই লোকটাকে। হঠাৎ কাঁধের ত্বকে ধাতব বস্তুর শীতল স্পর্শে শিউরে ওঠে ও। পি*স্তলটা সুকৌশলে কাঁধের হিজাবের তলে আড়াল করেছে এহসাস। লোক দুটো আড়চোখে তাকিয়ে গল্প করতে করতে পাশ কেটে গেল। কী ভাবল ওরা? ক্লোজ বান্ধবী? লোক দুটো দূরে যেতে নিরুপমা সরে গেল।
“প্রশ্ন করলে জবাব দেবে অমাবস্যা।”
“কিছুই রান্না করিনি। হয়েছে!”
“তেজ দেখাবে না আমার সাথে। গু*লি করে খু*লি উড়িয়ে দেবো।”
“অসহায় পেয়ে আমার সাথে অনাচার করছেন। দেখবেন একদিন আল্লাহ এর উচিত বিচার করবে। যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে।”
নিরুপমা কাঁদতে লাগল। এহসাস গম্ভীর গলায় বলে,
“কাঁদবে না।”
নিরুপমা তবুও কাঁদে। এহসাসের ভালো লাগে না। ভয় দেখাতে ইচ্ছে করে না আর। বুকের ভেতর মেঘ মেঘ করে, বজ্রপাত হয় তারপর গুমোট বেঁধে যায়।
চলবে,,,