অরূপ জ্যোৎস্না পর্ব -১৪

#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-১৪
লেখনীতে-তানিয়া শেখ

ইকরাম আজাদ গম্ভীর মুখে বসে আছেন লিভিং রুমের কাউচে। মাথাটা পেছনে হেলে দিয়েছেন। চুলগুলো এলোমেলো। পরনের টি-শার্টটি কুঁচকে আছে। রাত ভর অতন্দ্র চোখদুটো ফ্যাকাসে আর লাল। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। একটু একটু করে শুরু হওয়া মাথা ব্যথা এখন তীব্র। এক হাতের বৃদ্ধা আঙুল আর শাহাদত আঙুলে কপালটা টিপে টিপে ব্যথা দূর করার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন।

লিভিং রুমে আগত পায়ের আওয়াজে সামনে তাকালেন। হাতটা সরালেন কপাল থেকে। মনসুর সামনের কাউচে বসল। ওকেও বিপন্ন দেখাচ্ছে। এহসাস নামক ঝড় এ বাড়ির প্রতিটি জীবকে নাজেহাল করে ছেড়েছে। ঝড়! না, ও টর্নেডোর চাইতেও এখন বেশি ভয়ানক তাদের কাছে।

“খবর পেলি কোনো?” ইকরাম জিজ্ঞেস করলেন। মনসুর ওপর নিচে মাথা নাড়াতে বুকের ভেতর চেপে থাকা ভারটা নেমে গেল।

“কোথায় ও?”

“নিরাপদ স্থানেই আছে। আজ কালের মধ্যে সেটা পুরোপুরি নিরাপদ করে আসব।”

ইকরাম আজাদ বিরক্তে ভুরু কুঁচকে বলেন,

“হেঁয়ালি করছিস কেন? জিজ্ঞেস করেছি কোথায় হারামজাদাটা। স্ট্রেইট জবাব দে।”

মনসুর কথা বলে না।

“মনসুর!”

“ক্যামেলিয়া!”

মনসুর লাফিয়ে ওঠে। দৌড়ে চলে যায় জানালার কাছে। একরাম কিছু বুঝে উঠলেন না। জানালার দিকে তাকাতে তাঁর বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। এক লাফে জানালার কাছে ছুটে এলেন।

“ইয়া আল্লাহ! ও ওখানে কী করে?” প্রশ্নের সাথে সাথে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন ইকরাম। ক্যামেলিয়া দোতলার খোলা ব্যালকনির রেলিঙের ওপর উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কী করতে চায় ও! মনসুর এবং তিনি টলোমলো পায়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় এলেন। ক্যামেলিয়ার পরনে সেই হালকা গোলাপী রঙের শাড়ি। আঁচল উড়ছে। কোমর ছাড়ানো মেঘ কালো চুল হাওয়ার তালে নাচছে সাপের মতো। ক্যামেলিয়া নিজের মধ্যে নেই। রেলিঙের ওপর ভর করে দাঁড়ানো পা দুটো কাঁপছে। ইকরামের বুকের মতো। ক্যামেলিয়া চোখ বন্ধ করতে ইকরাম আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার করে ওর কাছে গেলেন। এক হাত ধরে বুকের ওপর টেনে আনলেন। ক্যামেলিয়ার আচমকা ভারে করিডোরের মেঝেতে পড়ে গেলেন। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন বুকের সাথে ওকে। মনসুর নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করল।

ক্যামেলিয়ার তখনও হুশ নেই। ইকরামের নিঃশ্বাস দ্রুত চলছে। ক্যামেলিয়ার সমস্ত শরীর তার দেহের সাথে চুম্বকের মতো চেপে আছে। দুজনের দেহ কাপড়ে আবৃত। তার পরেও ইকরাম স্পষ্ট অনুভব করছেন ক্যামেলিয়ার দেহের উষ্ণতা। যৌবনে প্রথম নারী স্পর্শে পুরুষ যেমন কেঁপে ওঠে তাঁরও অবস্থা কতকটা তেমন। অথচ, তিনি যুবক নন, ক্যামেলিয়া তাঁর জীবনের প্রথম নারীও নয়। বুক ধড়ফড় করছে। দু’হাতে ক্যামেলিয়াকে সরিয়ে বসলেন। এক হাত দুরত্ব রাখলেন মাঝে।

“কী করতে গিয়েছিলে তুমি ক্যামেলিয়া?” শুকনো গলা চিঁড়ে বড়ো কর্কশভাবে বেরিয়ে এলো কথাটা। ক্যামেলিয়া খানিক কেঁপে উঠল। কিন্তু চোখ তুলে তাকালো না। ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

“জবাব দাও। কী করতে উঠেছিলে রেলিঙের ওপর?”

“মরতে! মরতে উঠেছিলাম আমি। আপনি এবারও মরতে দিলেন না। কেন বারবার আমার আর মৃত্যুর মাঝে বাঁধা হয়ে আসেন? কী অধিকারে? স্বামীর?”

ক্যামেলিয়া ম্লান হাসে। ভেজা রক্তিম দু চোখ। চুলগুলো ওর মুখের লাজ ঢেকেছে। ইকরাম শক্ত মুখে উঠে দাঁড়ালেন। ক্যামেলিয়ার এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার ইচ্ছে তাঁর নেই। ক্যামেলিয়ার পাশে এখন কাউকে সার্বক্ষণিক রাখা দরকার। আজকের ঘটনার পর ওকে একা ছেড়ে দেওয়া বিপজ্জনক। মনসুরটা আবার গেল কোথায়!

“মনসুর!”

পা বাড়ান সিঁড়ির দিকে। আচমকা ক্যামেলিয়া তাঁর হাত ধরে বসে। খুব সামান্য ব্যাপার হয়তো। কিন্তু ইকরামের সমস্ত শরীরের রক্তে শিহরণ বয়ে গেল। কী বিরক্তিকর!

“আপনি আমাকে কেন মরতে দিচ্ছেন না, সৈয়দ সাহেব?” অশ্রুরুদ্ধ গলায় বলল ক্যামেলিয়া। ইকরাম হাতটা সরিয়ে নিতে চাইলেন। নিরুত্তর চলে যাবেন বলে ভাবলেন। যেতে আর পারলেন না। ক্যামেলিয়ার হাতটা হাতে নিলেন। হাতই তো। ওর মুখোমুখি আবার বসলেন। নরম গলায় বললেন,

“তাকাও আমার দিকে, ক্যামেলিয়া।”

ক্যামেলিয়া তাকালো। সলজ্জে ওর চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। ইকরামের দৃষ্টি সেই পাতা নামতে দেয় না।

“এভাবে নিজেকে শেষ করে দিয়ে ওদের পাবে তুমি? সুখ পাবে?”

“বেঁচেও যে পাচ্ছি না, সৈয়দ সাহেব। নিজের সব গেল তো গেল, কিন্তু আমার কারণে আপনার, আপনাদের বাঁচা দায় হয়ে গেছে এই জ্বালায় আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমার কারণে এহসাস আজ কুপথগামী। আপনার জীবনে অশান্তি। এত পাপ নিয়ে বেঁচে থাকা কত কষ্টের কী করে বুঝাই আপনাকে আমি সৈয়দ সাহেব। কী করে বুঝাই!”

ক্যামেলিয়া দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ওঠে। ইকরাম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ওর উন্মুক্ত রেশমি চুলে হাত বুলিয়ে বললেন,

“তোমার কোনো দোষ নেই ক্যামেলিয়া।”

“আমারই সব দোষ, আমারই সব দোষ।” ক্যামেলিয়া মাথা নাড়ায় দু দিকে। ইকরাম ওর মাথার দুপাশ ধরে তাকাতে বাধ্য করেন।

“আমাকে বিশ্বাস করো, ক্যামেলিয়া?”

ক্যামেলিয়া ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মাথা ওপর নিচ করে চোখ নামিয়ে ফেলল। ইকরাম মুচকি হাসলেন। কেন যেন তাঁর জীবনের এত অশান্তিতে ওইটুকু কথা ভালো লাগার আবির ছড়িয়ে দিলো।

“তাহলে বিশ্বাস করো তুমি নির্দোষ। যা ঘটছে তা হয়তো আমাদের অদৃষ্টের লিখন অথবা কর্মফল। তোমার এতে কোনো হাত নেই ক্যামেলিয়া। নিজেকে দোষ দিয়ো না। এহসাস যা বলেছে না জেনে বলেছে। একদিন ও সত্যি জানবে। জানবে কতটা সয়েছ তুমি। সেদিন যদি তুমি না থাকো? তুমি নিজেকে শেষ করে দিয়েছ এ কথা জানার পর এহসাস ঠিক থাকবে? ক্ষমা করতে পারবে নিজেকে? ওকে তুমি ভালো করেই চেনো ক্যামেলিয়া। ভালোবাসার মানুষগুলোর কিছু হলে এহসাস পাগল হয়ে যায়। ভুল ভাঙলে ও ফিরে আসবে। তোমার কিছু হলে ও যে আমাকেও তখন মাফ করবে না। আমি ওর চোখে বারবার খারাপ হতে পারব না ক্যামেলিয়া।”

ইকরাম হাঁপ ছাড়লেন। ক্যামেলিয়া মাথা নুয়ে বসে আছে তাঁর সামনে। মৃদু মৃদু কাঁপছে কান্নার দমকে ওর দেহখানি। ইকরাম সংকোচ কাটিয়ে ক্যামেলিয়াকে একপেশেভাবে জড়িয়ে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে শব্দ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল ক্যামেলিয়া। দু’হাতে খামচে ধরল ইকরামের বুকের শার্ট। ইকরাম মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁর চোখ গেল সামনে। ঈপ্সা আহত, ক্ষুব্ধ মুখে দাঁড়িয়ে আছে। পরক্ষণেই ওর দৃষ্টিতে আগুন জ্বলে উঠল। সেই আগুনে ভস্ম করতে চাইল ক্যামেলিয়াকে। ভাগ্যিস ও দেখেনি।
ইকরামের মনে তো পাপ নেই। এই জড়িয়ে ধরা নিছক সান্ত্বনা। ঈপ্সাকে কী করে বুঝাবেন! মেয়ের ঘৃণাভরা সজল দৃষ্টির সামনে অসহায়ভাবে বসে রইলেন। ঈপ্সা ঘুরে হনহনিয়ে চলে গেল। ইকরাম মেয়েকে থামাতে গেলেন না। তাঁর কেমন অসাড় অসাড় লাগছে। ক্যামেলিয়াকে জড়িয়ে ধরা হাতটা খসে পড়ল। কিন্তু ক্যামেলিয়া তাঁকে এখনও জড়িয়ে ধরে আছে। ওকে ছাড়াবেন কী করে?

দুপুরে নামাজ আদায় করে নিরুপমা খেতে বসল মায়ের সাথে। নিলুফা বেগম খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন,

“তোর বান্ধবী কি এখনও ঘুমায়?”

নিরুপমার মুখে ভাত জমে যায়। তারপর ধীরে ধীরে ভাত চাবাতে চাবাতে মাথা দুদিকে নাড়ায়।

“তাইলে খাইতে ডাক। আমাগো লগে খাক। ও মাইয়্যা, শুনছো? ও… তোর বান্ধবীর নাম কী রে?”

নিরুপমা ভাত গিললো না যেন নুড়ি। গত রাতে এহসাস আবার যখন ভয় দেখিয়ে জোর করে ওর সাথে বাসায় এলো তখন ওর মা জেগেছিল। এহসাসকে আপাদমস্তক দেখে প্রশ্ন করেছিল,”এ কে?” বোরকাতে এহসাসকে সামান্য মেয়েলি লাগছিল। তার ওপর নোংরা ও ছেঁড়া বোরকা ওর মায়ের সন্দেহ জাগাতে পারত। নিরুপমা সেটা এড়াতে দ্রুত বলে দেয়,” ও আমার বান্ধবী। কিছুদিন এখানেই থাকবে।”

মা’কে আর কোনো প্রশ্ন করতে না দিয়ে ঠেলে এহসাসকে রুমে নিয়ে এসেছে। বেশ উপভোগ করেছে সেসব এহসাস। কিন্তু মুখে কিছু বলেনি। এরপর সে রাতে নিরুপমা ও রুমে একবারই গিয়েছিল, একসাসকে খাবার দিতে। এহসাস ফরমায়েশ করেছিল গোরুর মাংস ভুনা খাবে। ফ্রিজে মাংস ছিল না। আসার সময় চারটা ডিম নিয়ে এসেছিল নিরুপমা। তাই ভুনা করেছিল। রান্না শেষ করতে বেশ রাত হয়। খাবার দিতে গিয়ে দেখল এহসাস ঘুমিয়ে পড়েছে। নিরুপমা ডাকেনি। খাবার সেখানে ঢেকে চলে আসে। তারপর আর ও রুমের দিকে ভুলেও পা বাড়ায়নি।

“কী রে কথা কস না যে? নাম কী তোর বান্ধবীর?”

“খা..খালেদা।”

মেয়ের দেরিতে জবাব দেওয়ার কারণে বিরক্তি ঝেড়ে নামটা ধরে ডাকতেই যাবেন নিরুপমা বাধা দেয়,

“ও খাবে না মা। মানে, এখানে খাবে না। একা রুমে বসে খাবে ও।”

“কেন? এখানে খাইলে সমস্যা কী?”

নিরুপমা কী বলবে এখন?

“ও পর্দা করে তো। তাই একাই খাবে।”

নিলুফা বেগম ভুরু কুঁচকে বললেন,

“আমি কি বেগানা বেডা? ওই ছেরি বেডি মানুষ আমিও তো তাই। আমার সামনে কীসের পর্দা? ডাক ওরে।”

নিরুপমার ইচ্ছে করছে গলা ছেড়ে কাঁদতে। এত মিথ্যা ও ওর জীবনে বলেনি। এখনও কী সহজে পারছে?

“তুমি বুঝতে পারছো না মা। আসলে কী হয়েছে, ওর স্বামী ভালো লোক না। রাতদিন অত্যাচার করত। সেদিন আবার একটা বিয়ে করে করেছে নতুন। ও ভারী কষ্টে আছে মা। একা থাকবে বলেই আমার এখানে আসছে। মানুষ দেখলে ওর না কি কান্না পায়। স্বামীকে খুব ভালোবাসত। কিন্তু কোন মেয়েই স্বামীর ভাগ দিতে পারে বলো? বেচারি মনে দারুন ব্যথা পেয়েছে বুঝলে। একা থাকলে নিজেকে বুঝ দিতে পারবে৷ ওকে ওর মতো কদিন থাকতে দাও। মন ভালো হলে নিজে এসেই খাবে।”

নিরুপমা একসাথে এত মিথ্যা বলে হাঁপাচ্ছে। কী যে অসংলগ্ন বকলো! মা বিশ্বাস করলেই হয়। কিন্তু দেখা গেল ওর মা একটু গভীর ভেবে মুখ কালো করে বললেন,

“তাইলে থাক আর ডাকিস না। পরে মনে করে খাবার দিয়ে আসিস।”

নিরুপমা সজোরে মাথা নাড়িয়ে বলে,

“খাওয়া শেষ করেই যাচ্ছি।”

সামনের প্লেটের ভাত দেখে পেট মুচরে ওঠে। খিদে মরে গেছে। ওই রুমের বন্ধ দরজায় তাকালে এখান থেকে উঠতেও ইচ্ছে হয় না। কী করে ওই দরজা এড়ানো যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই ভাবনায় কাটলো।

চলল……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here