মন নিয়ে কাছাকাছি পর্ব -০১+২

১🌸

গলির মুখেই তিন চারটা কুকুর নিজেদের মধ্যে ঝামেলা পাকাচ্ছে। ওদের হিংস্র ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনেই মীরার কলিজা কেঁপে উঠল। কুকুর কে না ভয় পায়? তার উপর যদি সেই ভয়টা ছোট বেলা থেকেই হয়ে থাকে! মীরা ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে আশেপাশে দেখল। একটা মানুষও নেই। সে প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরছিল। সামনেই তার এসএসসি পরীক্ষা। চাচ্চু জোর করে মুবিন ভাইয়ের কাছে পড়তে পাঠাল। ভেবেছিল দু-এক দিন পড়ে কোন একটা বাহানা দিয়ে আর পড়বে না। বাহানা একটা ঠিক করেই রেখেছিল। মুবিন ভাই ভালো করে পড়াতে পারে না। উনার পড়া আমি কিছুই বুঝি না। সব মাথার উপর দিয়ে যায়। এটা বললেই ছোট চাচ্চু বলত, থাক তাহলে আর পড়তে হবে না। তোর জন্য অন্য মাস্টার দেখছি। কিন্তু মুবিন ভাই এত সুন্দর করে পড়ায় মীরার কাছে এখন হায়ার ম্যাথের মতো বিরক্তিকর সাবজেক্টও ভালো লাগতে শুরু করেছে। এখন সে আফসোস করে। ইশশ, আরও আগে কেন মুবিন ভাইয়ের কাছে পড়তে এলো না! এক মাসেই যদি তার এতটা উন্নতি হয়েছে তাহলে এক বছরে নিশ্চয় সব কয়টা সাবজেক্ট তিন চামচ চিনি আর অর্ধেকটা লেবুর রস দিয়ে গুলিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেলত। কিন্তু ওসব কথা এখন ভাবছে না সে। এই কুকুর গুলোকে পার করে কীভাবে বাড়ি যাবে? সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বাড়ি ফিরতে দেরি হলে বাবা, কাকারা হার্টের রোগী হয়ে বিছানা নিবে।

“ছাতার মাথা! কুত্তা গুলা যায় না কেন?”

মীরার রাগ উঠছে। সে ঠোঁট উলটিয়ে কুকুর গুলোকে গালাগালি করছে। কিছু তো করার নেই। তার ছোট কলিজায় এতটা সাহস নেই যে কুকুরের পাশ কাটিয়ে যাবে। মীরা ঠোঁট কামড়ে দুই হাতে দুই বিনুনি ধরে টানতে টানতে পা দিয়ে রাস্তায় ঠুকাঠুকি করছে। মীরা যখন মনস্থির করে নিয়েছে যতক্ষণ কুকুর গুলো না যাবে ততক্ষণ তাকে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, তখনই তাকে পাশ কাটিয়ে একটা লোক চলে গেল। মীরা পেছন থেকে দেখে যতটুকু চিনলো তাতে মনে হয়েছে, এটা তো মুবিন ভাইয়ের বড় ভাই, জায়িন ভাই। মীরার সাথে লোকটার আলাপ খুব কম। তিনি বাড়িতে থাকেন না। ঢাকা থেকে পড়াশোনা করেন। মুবিন ভাইয়ের মুখে শুনেছিল তার বড় ভাই ডাক্তারি পড়ছে। ইনি বাড়িতে এসেছেন মীরা জানত না। অথচ সে রোজ এবাড়িতে এক দুই ঘন্টা সময় কাটিয়ে যায়। তবুও মানুষটার সাড়াশব্দ পায়নি। তিনি বাড়িতে এলে মীরা যদিও সামনে পড়ে তাহলেও তিনি কথা বলেন না। সেবারের কথাই ধরা হোক না। মীরা জানতো মুবিন ভাইয়েরা দুই ভাই। তার বড় ভাই বাড়িতে থাকে না। লোকটাকে কোনদিনও দেখেনি মীরা তাহলে তাকে কীভাবে চিনতো? আন্টি তাকে ভীষণ পছন্দ করে। পড়া শেষ হলেও মীরা আন্টির সাথে গল্প করে বাড়ি ফিরে। সেদিন মীরা হলরুমে বসে রান্নাঘরে থাকা আন্টির সাথে বেশ উঁচু স্বরেই কথা বলছিল। হঠাৎ ওই লোকটা রুম থেকে বেরিয়ে এসে কেমন রাগ রাগ চোখে মীরাকে দেখে জোরে বলে উঠল,

“মা, এটা কি বাড়ি নাকি অন্য কিছু? শান্তিতে যে রুমে একটু বসব সেটাও তো হচ্ছে না।”

অচেনা এই লোকটাকে এতটা রাগতে দেখে মীরা ভরকে গেল। একেতো এই লোকটাকে সে চিনে না। তার উপর কেমন রেগে কথাগুলো বলল। মীরা থতমত মুখে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে লোকটার দিকে চেয়ে রইল। লোকটা মীরাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আবার রুমে চলে গেল। আন্টি রান্নাঘর থেকে ছুটে এলে মীরা বলল,

“এই শয়তান লোকটা কে আন্টি? কেমন অসভ্য দেখেছ!”

আন্টি মীরার কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল,

“এই অসভ্য শয়তান লোকটাই আমার ছেলে। মুবিনের বড় ভাই।”

মীরা জিভ কামড়ে বোকা বোকা হেসে আন্টির দিকে দেখল। আন্টি এখনও হাসছে। মীরা অপরাধী মুখে মিনমিন করে বলল,

“উনি তো বাসায় থাকে না। উনি যে এসেছেন আমি জানতাম না। জানলে পড়া শেষ করেই বাড়ি চলে যেতাম।”

সেদিনের পর লোকটা যতদিন বাড়িতে থেকেছে মীরা পড়া শেষ করে এক সেকেন্ডও দেরি করেনি।
বদমেজাজি মানুষের সাথে কথা বলারও কোন ইচ্ছে নেই ওর।
জায়িন ভাই চলে যাচ্ছে। মীরা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে এক হাত দূরত্ব রেখে জায়িনের পেছন পেছন হাঁটতে লাগল। কুকুর গুলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভয় লাগছিল। তাই আরেকটু কাছে চলে এলো। মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল জায়িন ভাই যেন এখন পিছনে ফিরে তাকে না দেখে। গলিটা পেরিয়ে এলে মীরা মুখ মুচড়ে দূরত্ব অনেকটা বাড়িয়ে নিল।

“শয়তান লোক। জন্মের সময় তো মুখে মধু দেয়ই নি। ছোটদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় এটাও শেখায়নি। আন্টি কত ভালো। মুবিন ভাইও তো ভালো। পড়া না পারলে বকে শুধু। পড়ার বাইরে কত সুন্দর করে কথা বলে। এই লোককে দেখে মনে হয় এক্ষুনি বুঝি গার্লফ্রেন্ড এর সাথে ব্রেকআফ করে এসেছে।”

মনে মনে যার গোষ্ঠী উদ্ধার করছিল পেছন থেকে একটা কুকুর রাগী চোখে ঘেউঘেউ করতে করতে তার দিকেই আসছে দেখে মীরা কূলকিনারা না পেয়ে দৌড়ে আবার ওই লোকটার কাছেই চলে এলো। বুকের ভেতর ধপাস ধপাস শব্দ হচ্ছে। এক্ষুনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে মনে হচ্ছে। কুকুরটা পাশ ঘেঁষে দৌড়ে চলে যেতেই মীরা ভয় পেয়ে “ও বাবাগো” বলে লোকটার শার্ট খামচে ধরল। চোখ বন্ধ করে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বিড়বিড় করতে লাগল। মনে হয় কোন দোয়া পড়ছে। তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। ভয়ে কলিজা বেরিয়ে যাচ্ছে। জায়িন শার্টের হাতায় টান অনুভব করে একটিবার চোখ বন্ধ করে কাঁপতে থাকা ভয়ার্ত মুখটার দিকে তাকাল। মীরার কাঁপা-কাঁপি দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে কতটা ভয় পাচ্ছে। জায়িন ওকে সান্ত্বনা দিতে আলতো করে হাতটা ধরলে মীরা শক্ত করে ওর হাত ধরে ফেলল। অস্ফুটস্বরে বলতে লাগল,

“ভয় লাগছে। ভয় লাগছে জায়িন ভাইয়া।”

মেয়েটার মুখ থেকে নিজের নাম ও ভাইয়া সম্বোধন শুনে না চাইতেও কপালে সূক্ষ্ম কয়েকটা ভাজ পড়েই মিলিয়ে গেল। মেয়েটা তাকে চেনে! জায়িন শান্ত কন্ঠে বলল,

“কুকুর চলে গেছে। কিছু করবে না।”

কুকুর চলে গেছে! মীরা ভয়ে একটা চোখের পাতা একটু ফাঁক করে দেখল। হ্যাঁ, সত্যিই চলে গেছে। সময় নিয়ে দু-চোখই খুলল। মীরা যখন লক্ষ করল সে জায়িনের হাত ধরে রেখেছে, তাৎক্ষণাৎ ছিটকে দূরে সরে গেল। জায়িনের দিকে তাকিয়ে লজ্জিত মুখে হেসে বলল,

“সরি ভাইয়া।”

“হু।”

মীরা লজ্জায় আর জায়িনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। একপ্রকার দৌড়ে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল। লোকটা কী ভাববে? অসভ্যের মতো হাত ধরে ফেলেছে। নিশ্চয় তিনি বিরক্ত হয়েছেন।

“মীরা তোর যে কেন এত ভয়! কুকুর কি তোকে খেয়ে ফেলত! বেশি বেশি করিস।”

🌸

মীরা বাড়ি এসে দেখল ছোট চাচ্চু তাকে আনতে যেতে বেরুচ্ছে। মীরাকে ফিরে আসতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

“আজ এত দেরি হয়েছে কেন আম্মু?”

“রাস্তায় কয়েকটা কুকুর ছিল চাচ্চু।”

“এ বাবা! ভয় পাওনি তো তুমি আম্মু? কীভাবে এসেছ?”

“ভয় একটু পেয়েছি। তবে একটা লোকের পেছন পেছন চলে এসেছি।”

“কাল থেকে পড়া শেষ হলে তুমি ওখানেই বসে থাকবে। আমি গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসব।”

মীরা আহ্লাদ করে চাচ্চুর একহাত জড়িয়ে ধরে বলল,

“তুমি কত ভয় পাও চাচ্চু। আমি কিন্তু এত ভয় পাই না।”

ওরা বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে মীরার ছোট চাচী এসে হাজির। তিনি মীরাকে বকতে লাগলেন।

“এই মেয়ে তুই কি এখনও ছোট। পড়া শেষে সোজা বাড়ি না ফিরে রাস্তায় রঙঢঙ করিস।”

মীরার ছোট চাচী সাত মাসের প্রেগন্যান্ট। তিনি তার বিশাল পেট নিয়ে এতক্ষণ মীরার চিন্তায় পুরো হলরুম জুড়ে পায়চারি করেছে। মীরা চাচীর কাছে এসে হেসে বলল,

“তুমি আমাকে বকছো তো! আমিও কিন্তু তোমার বাবুকে অনেক বকব। মারবও। তখন তুমি কিছু বলতে পারবে না।”

“তোর এসব মন ভোলানো কথাতে আজ আমি ভুলবো না। প্রতিদিন আমাদের এমন টেনশন দিলে তোর বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ।”

মীরা এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে না। এবাড়িতে আরও অনেক ছেলেমেয়ে আছে। কিন্তু সবার মধ্যে মীরাই একটু বেশি স্পেশাল। মা হারা মেয়ে বলে? না। আরেকটা কারণ আছে। কারণটা গল্প এগোবার সাথে সাথে জানা যাবে। সন্ধ্যায় মীরা পড়ার টেবিলে বই খুলে বসে আছে। একদিনও সে সন্ধ্যায় পড়তে বসে না। আজ বসার কারণ হলো তার ভাইবোন কেউ বাড়িতে নেই। থাকলে এখন মীরার ঘরে ওদের আড্ডা বসতো। বড়ো মা’র বাবা অসুস্থ। তনি আপু, ইভান ভাই, রুশমি সবাই দুপুরে নানুবাড়ি গেছে। আজকে ফিরবে না। হয়তো কালও ফিরতে না পারে। তনি আপুরা বাড়িতে নেই তাই আবির ভাইও আসেনি আজ। আবির ভাই তার ছোট ফুপুর একমাত্র ছেলে। ছোট ফুপুর বাসা কাছেই। তাই আবির ভাই বেশির ভাগ সময় তাদের সাথে এসেই আড্ডা দেয়। মীরা হাতের উপর মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে ভাবছে আজ তার সময় কীভাবে কাটবে? আজকে খাওয়াদাওয়াও হবে না।
#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
জেরিন আক্তার নিপা
২🌸

ছোট কাকী ফোন হাতে মীরার ঘরে ঢুকে। ছোট কাকীর হাতে ফোন দেখেই মীরা বুঝে গেল কে আছে লাইনে। মীরার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। সে মানুষটার সাথে কথা বলতে চায় না। তবুও কেন মানুষটা তাকে বিরক্ত করে। একটু কথা বলার জন্য ছোট কাকী অনুনয় করলে মীরা কাটকাট গলায় বলল,

“ছোট কাকী, তুমি উনাকে কেন বলে দাও না উনি যেন এখানে কল না করেন। উনার সাথে তো আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। উনি উনার ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভালো আছেন। আমরা কেমন আছি এটা জেনে তো উনার কাজ নেই।”

ছোট কাকী মীরার মাথায় হাত রেখে নিচু গলায় বলল,

“উনি তোর মা। তোর সাথে কথা বলতে চায়। এটা কি অন্যায়?”

মীরা রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলল,

“উনি আমার মা নন। আমি উনার মেয়ে না। আমি আমার বাবার মেয়ে। উনি আমার মা হলে আমাকে ফেলে রেখে কীভাবে চলে গেলেন? যাবার আগে আমার কথা ভাবেননি। তখন আমি ছোট ছিলাম। মা ছাড়া থাকতে পারতাম না। এখন আমার জীবনে মা নামের কোন ব্যক্তির প্রয়োজন নেই। তাহলে এখন কেন উনি আমার কথা ভাবছেন? আমি তো উনার একমাত্র সন্তান না। উনার তো আরও ছেলেমেয়ে আছে। তাদের নিয়ে থাকুক উনি। আমাকে নিয়ে যেন উনি চিন্তা না করেন। আমার মা’র প্রয়োজন হলে তুমি আর বড় মা তো আছো। উনাকে প্লিজ বলো রোজ রোজ যেন কল না করেন। আমাকে কি উনি ভালো থাকতে দেখতে পারেন না?”

ছোট কাকী ফোনের মানুষটাকে কিছু বোঝাতে বোঝাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে মীরা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। মা নামের এই মানুষটা তাকে তিন বছরের রেখে তার আগের স্বামীর কাছে ফিরে যায়। সেখানেও তার এক মেয়ে ছিল। স্বামী তাকে নির্যাতন করে এই অপবাদ দিয়ে তিনি ওই মেয়েকে রেখে স্বামীকে ছেড়ে চলে এসেছিলেন। মীরার বাবা সবকিছু জেনে তাকে বিয়ে করেছিল। তাদের সংসার প্রথম কয়েক বছর ভালোই কাটছিল। কিন্তু মীরা পেটে আসার পর থেকেই তার প্রাক্তন স্বামী আবার তার সাথে যোগাযোগ করতে চায়। মীরার বাবা স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসায় অন্ধ ছিলেন। তিনি হয়তো কোনদিন স্বপ্নেও কল্পনা করেনি মারিয়া তাকে, তার সন্তানকে ফেলে চলে যাবে। মীরা হবার এক বছর পরেই বায়েজিদ সাহেব বিজনেসে বড় একটা লস খেলেন। তখন তার অবস্থা এতটাই খারাপ মেয়ের দুধটাও ভাইদের টাকায় কিনতে হয়। সংসারে অভাব অনটন দেখে মীরার মা-ও ঝামেলা করতে লাগল। সাংসারিক জীবনে তাদের কলহ এতই বেড়েছিল স্বামীর সাথে রাগ করে মীরার মা ছোট্ট মেয়েটাকে কষ্ট দিতেও বুক কাঁপত না। মীরা কাঁদলেও দুধ দিত না। কোলে নিত না। একদিন, দু’দিন এই ঘটনা বায়েজিদ সাহেবের চোখ এড়ালো না। তিনি রাগে স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে লাগলেন। এর মাঝে মীরার মা তার প্রাক্তন স্বামীর সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করে। শেষে একদিন মীরাকে ফেলেই চলে যায়। মীরা এই ঘটনাটা আজও মেনে নিতে পারেনি। সবকিছুর জন্য তার নিজেকেই অপরাধী মনে হয়। মীরা তার ভেতরে চেপে রাখা কষ্ট গুলো কাউকে বুঝতে দেয়না। তার সামান্য মন খারাপেও যেই মানুষগুলো অস্থির হয়ে পড়ে মীরা তাদের কষ্ট দিতে চায় না। ওই মহিলার নাম শুনলেই মীরার সবকিছু জ্বালিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। এত বছর পর ওই মহিলা কেন তার খোঁজ নিতে চায়? মীরা কাঁদতে কাঁদতে চেয়ারে বসে টেবিলের উপর মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ল।

🌸

মীরা বড্ড ঘুমকাতুরে। সবকিছুর আগে তার ঘুম। মীরা কেমন ঘুমকাতুরে বলা যাক। কাজিন মহলের আড্ডা যেদিন দশটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত গড়িয়ে যায়, মীরা চুপটি করে কাউকে কিছু না বলে উঠে চলে আসে। রুমে এসে আরামসে ঘুম দেয়। যেদিন তার রুমেই আড্ডা বসে সেদিন সে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়ে। জেগে থাকতে পারে না এটা কি তার দোষ? এজন্যও তনি আপুর কাছে একচোট বকা খায়।

“তুই ভদ্র মেয়ের মতো টাইমলি ঘুমিয়ে পড়িস। তোর ঘুমে ডিস্টার্ব করে আমরা আড্ডা দিই বলে মা একচোট বকে। আলাপ আলোচনা বাকি থাকলেও আড্ডা ভেঙে যার যার রুমে চলে যেতে হয়। এরজন্য সব দোষ তোর। কাল থেকে দেখি তুই কীভাবে ঘুমাস। চোখের পাতা টেনে খুলে স্কচটেপ লাগিয়ে রাখব। তোর ঘুম আমাদের সবার শত্রু।”

ছোট কাকী এই নিয়ে তৃতীয় বার মীরাকে ডাকতে এসেছে। মেয়েটাকে যতই ডাকে সে একটু নড়ে আবার শুয়ে থাকে। ছোট কাকী মীরার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে ডাকছে,

“মীরা। মীরা উঠবি না। পরীক্ষাটা শেষ হলে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা ঘুমাস। সমস্যা নেই। কিন্তু এখন তো কোচিং এ যেতে হবে মা। ভালো রেজাল্ট না করতে পারলে তোর স্বপ্ন কীভাবে পূরণ করবি বল তো।”

মীরার ঘুম একটু আগেই ভেঙে গিয়েছিল। তবুও আলস্য করে না উঠে বিছানায় পড়েছিল। জানত পাঁচ মিনিটের ভেতর ছোট কাকী ডাকতে আসবে। হলোও তাই। মীরা ঘুম জড়ানো গলায় বলল,

“স্বপ্ন পূরণ হবে। আমি ঠিকই একদিন আকাশে উড়ব।”

“আমরাও তো এটাই চাই রে মা। তোর স্বপ্নই আমাদের স্বপ্ন।”

আদুরে সকাল টায় ছোট কাকীর ভালোবাসায় রাতের মন খারাপ ভাবটা একেবারে কেটে গেল। মীরাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, পৃথিবীতে কে তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে? মীরা এক সেকেন্ডও সময় না নিয়ে বলবে, ছোট কাকী। তাকেও যদি এই প্রশ্ন করা হয়, তুমি কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো? মীরা জবাব দিবে, ছোট কাকীকে।
এর আগেও ছোট কাকীর দুটো বাবু মারা গেছে। একজন পেটেই মারা গিয়েছিল। আরেকজন দুনিয়ায় আসার কয়েক মিনিট পর। মীরা মনপ্রাণ দিয়ে আল্লাহর কাছে একটা জিনিসই চায়। এবার যেন ছোট কাকীর বাবুটা সুস্থ ভাবে দুনিয়ায় আসে। আল্লাহ যেন ছোট কাকীর পরীক্ষা নেওয়া এখানেই শেষ করেন। ভালো মানুষ গুলো এত কষ্ট কেন পাবে?
পরীক্ষার আর মাত্র একমাস আছে। পড়ার প্রচন্ড চাপে মীরার ওজন কয়েক কেজি কমে গেছে। সে রেডি হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে নাকেমুখে ব্রেকফাস্ট করে নিল। মাহিমার আজ এখান থেকে তাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ছোট ফুপুর মেয়ে মাহিমা। ওরা একই ক্লাসে পড়ে। মীরা গেটে আসতেই মাহিমার দেখা পেল। মাহিমা দূর থেকেই বলল,

“একটু লেট হয়ে গেছে রে। কী করব তোর ঘুমের জ্বীন আমার উপর ভর করেছে।”

মীরা মাহিমাকে ভেতরে যেতে বললে মাহিমা বলল,

“পরীক্ষার পর মামুর বাড়ি চিনব। এখন আপাতত ভুলে গেছি আমার কোন মামার বাড়ি আছে। চল চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

মীরাদের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই মুবিন ভাইদের বাড়ি। প্রতিদিন মুবিন ভাইদের বাড়ি পেরিয়েই যেতে হয়। মাঝে মধ্যে এক-দুই দিন মুবিন ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে যায়।
ওরা রিকশায় উঠে দুই দিনের জমে থাকা কথা গুলো একে অপরকে বলতে লাগল।
মাহিমা বলল,

“তনি আপুরা নানুর বাড়ি গেছে এটা পুরোনো খবর। নতুন খবর থাকলে বল।”

মীরা ভ্রু জোড়া সামান্য কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

“আমাদের বাড়ির খবর তুই আমি বলার আগেই জেনে যাস। এই রহস্য আমি আজও সমাধান করতে পারলাম না।”

মাহিমা রহস্য করে হেসে বলল,

“তোর মতো গাধী পারবিও না। আমি কি তোর মতো ঘাসে মুখ দিয়ে চলি? চোখ কান খোলা রাখলেই আশেপাশে কী ঘটছে জানা যায় বস।”

“আমি চোখ কান বন্ধ রেখে চলি তোর মনে হয়? ”

“এক হাজার বার। নইলে এক বাড়িতে থেকেও তুই আজ পর্যন্ত জানতে পারলি না আমার ভাইয়ের সাথে তনি আপুর ইটিস পিটিস চলছে।”

এই কথাটা সত্যিই মীরা জানত না। সে অবিশ্বাস্যে প্রায় চিল্লিয়ে উঠেই বলল,

“সত্যি! কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? ওরা তো ভাই বোন।”

“আরে দূর! মা’র পেটের ভাইবোন ছাড়া সব ফাউ। আর ইসলাম ধর্মে চাচাতো, মামাতো ভাইবোনের বিয়ে জায়েজ আছে।”

“তা আছে। কিন্তু ভাইবোনের মাঝে ওসব ফিল আসে কীভাবে? আমার সব আবির ভাই, ইভান ভাই ওদের আপন ভাই-ই মনে হয়।”

“যার লগে যার মনে ভাব। তুই আমি বললেও তো কিছু হবে না।”

“এজন্যই তুই আমাদের বাড়ির সব খবর আগে আগেই পেয়ে যাস। তুই আবির ভাই, তনি আপুর রিলেশনের কথা জানতি আমাকে বলিস নি তো।”

“নিজেই শিওর ছিলাম না। সন্দেহের কথা জানিয়ে লাভ কি?”

“এখন যে তুই জানিস এটা আবির ভাই জানে?”

“কচু জানে। আমার ভাইয়ের আমাকে শিশু মনে হয়। প্রেম ভালোবাসা জিনিসটা যে আমিও বুঝি এটা আমার ভাইয়ের মগজে আসে না। সে আমাকে তোকে এখনও লজেন্স খাওয়া বাচ্চা ভেবে আমাদের চোখের সামনে চুটিয়ে প্রেম করে। আমিও ভাইয়ের বিশ্বাস ভাঙি না। সব জেনেও ভাইয়ের সামনে গাধা সেজে থাকি। ইচ্ছে করেই এমন এমন সব প্রশ্ন করি ভাইয়া হাসতে হাসতে লুটোপুটি খায়। তুইও তনি আপুর সামনে গাধা সেজে থাকবি বুঝেছিস।”

“তনি আপুকে আমিও সন্দেহ করেছিলাম। কিন্তু সেটা আবির ভাইয়ের সঙ্গে কল্পনা করিনি।”

“ওদের আর কী? লাইফ সেট৷ আমার মা ভাইজি বলতে অজ্ঞান। এই খবর জানাজানি হলে দুই পরিবারই মেনে নিবে। মামাটা তো মাটির মানুষ। মামী একটু ঝামেলা করতে পাবে অবশ্য।”

“ভালোই হবে না! আমরা সবাই মিলেমিশে থাকব।”

“কীভাবে থাকব বেহেন? তোর আমার তো কেউ নেই। আমাদের তো দূরেই যেতে হবে।”

চলবে…

_
#মন_নিয়ে_কাছাকাছি “১”
#জেরিন_আক্তার_নিপা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here