#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৮
” চল, একটু প্রেমিকের সাথে দেখা করে আসি।”
শুভ্রতার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না ফাউজিয়া। প্রেমিক মানে? তার তো কিছুদিন আগে ডিভোর্স হয়েছে তাহলে এখন প্রেমিক কোথা থেকে এলো! আগ্রহ দমন করতে না পেরে ফাউজিয়া প্রশ্ন করেই ফেলে,
” প্রেমিক মানে? তুই কি আবার কারো সাথে সম্পর্কে আছিস?”
শুভ্রতা মুখ টিপে হাসে। সে জানে প্রেমিকের কথা বললে ফাউজিয়া বোকা বোকা মুখভঙ্গিতে এই প্রশ্নটা করবেই। সে হাসতে হাসতে বলে,
” আমার প্রেমিক না, আমার চাচাতো বোনের প্রেমিক।”
শুভ্রতা ফাউজিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে তার মনে এখন হাজারটা প্রশ্ন। শুভ্রতা একে একে বলে,
” আরে শোন, আবিরা আপুকে এখানে এই সদরে যে হাসপাতাল আছে ওখানকার ডাক্তার পছন্দ করে। আবিরা আপুও পছন্দ করে কিন্তু বাড়িতে আগেই কিছু বলতে পারছে না। আমি তো একবার ঠকেছি সে ভয়টা আপুর মাঝেও কাজ করছে৷ তাই উনাকে চেক করব।”
” চেক করবি মানে?”
” আমি কেমন দেখতে বল তো?”
” সুন্দর। ”
” শুধু সুন্দর? প্রেমে পড়ে যাবে এমন সুন্দর না?”
” কেন তুই কি প্রেমে ফেলতে চাইছিস?”
শুভ্রতা মাথা ঝাঁকিয়ে না বলে। ফাউজিয়া আবার জিজ্ঞেস করে, ” তাহলে?”
” আমি শুধু দেখতে চাই উনি কতটা লয়্যাল। তার জন্য একটু ছ্যাচড়ামি করতে হবে কয়েকদিন। দেখব যে উনি সুন্দরী কোন মেয়ের প্রেমে আবার পড়ে কি না। আমি তো জানি আমি সুন্দরী তাই অন্যকাউকে দিয়ে পরিক্ষা করানোর দরকার নেই। ”
” আসছে আমার বিশ্বসুন্দরী। তাড়াতাড়ি চল, রিকশা নে একটা।”
~
শুভ্রতা বাসায় ফিরেছে সন্ধ্যার খানিকক্ষণ আগে। এসে গোসলে ঢুকেছে প্রায় একঘণ্টা কিন্তু বের হওয়ার কোন নাম নেই। আয়েশা বেগম বারবার ওয়াশরুমের দরজায় নক করে যাচ্ছেন। ভেতর থেকে শুধু একটা কথাই ভেসে আসছে, ” বেরোই মা, একটু শাওয়ার নিতে দাও খুব গরম।”
আয়েশা বেগম হাল ছেড়ে দিয়ে নিজের রুমে যান। শাহাদাত সাহেব বসে বসে কারো জমির দলিল লিখছিলেন। আয়েশা বেগম পাশে এসে বসলেন। স্ত্রীকে চিন্তিত দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ” কি হয়েছে, মুখ এমন করে আছো কেন?”
” তোমার বড় মেয়ে গোসলে গিয়েছে এক ঘণ্টার বেশি হলো এখনো বের হবার কোন নাম নেই। ওর গোসল করতে এত বেশি সময় লাগে না। বিশ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে আসে। আজ কি হলো বলো তো!”
” চিন্তা কোরো না, ও বের হোক আমি দেখছি।”
” হুম দেখো, ও তো তোমাকে সব বলে।”
” ঠিক আছে, তুমি চিন্তা কোরো না।”
শাহাদাত সাহেব সব কাগজপত্র ঠিক করে রেখে টিভিতে খবর দেখতে শুরু করলেন। দেশের যা পরিস্থিতি! এই পরিস্থিতিতে নিম্নমধ্যবিত্তরা না খেয়ে ম*র*বে। এক লাফে জিনিসপত্রের যা দাম বেড়েছে তা বলার মতো না। উচ্চ-মধ্যবিত্তদেরও মাঝেমাঝে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
শাহাদাত সাহেব খেয়াল করলেন শুভ্রতা কারো সাথে কোন কথা না বলে ছাদে চলে গেল। আয়েশা বেগম নিষেধ করলেও কথা না শুনে চলে গেল। দুজন এবার নিশ্চিত হলো মেয়ের কিছু না কিছু নিশ্চয়ই হয়েছে। নইলে সপ্তাহ দুয়েক তো খুব হাসিখুশি ছিল। এখন আবার কি হলো কে জানে!
শুভ্রতা ছাদে এসে একপাশে পা ঝুলিয়ে রেলিংয়ের ওপর বসে আছে। পাশের ছাদে আবিরা হয়তো কারো সাথে কথা বলছে। কথা বোঝা না গেলেও অস্পষ্ট শোনাচ্ছে। শুভ্রতা হঠাৎ রেলিং থেকে নেমে পায়চারি শুরু করল। তার বুকের বা’পাশটা এখনো ব্যথা করছে, তীব্র ব্যথা মনে হচ্ছে ওখানে পোকায় খুবলে খুবলে খাচ্ছে। মনে একটা প্রশ্ন ওঠে তার, মরণ যন্ত্রণা কি এর চেয়েও ভয়াবহ! মানুষ তার প্রিয়মানুষের কাছে সবসময় কেন প্রিয় থাকে না! কেন তারা চলে গেলেও দমবন্ধ করা কষ্ট দিয়ে যায়? কেন কষ্টগুলো কিছু সময় পরপর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে!
কান্না পাচ্ছে তার। বুকের বা’পাশটা খুব শক্ত করে চেপে নাড়াচ্ছে। এত ব্যথা করছে কেন এখানে আজ! কেমন যেন ভেতরে খচখচ করছে। সমস্ত শরীর অসার হয়ে আসছে। মাথাটাও কেমন ঘুরাচ্ছে। মনে হচ্ছে সমস্ত দুনিয়া ভনভন করে ঘুরছে। এমন সময় বুক থেকে হাত মাথায় নিল সে। দুই হাত দিয়ে মাথার দু’পাশ চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে আছে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছে না। পা দুটো সমস্ত শরীরের ভার বহন করতে পারলো না। সে সেখানেই লুটিয়ে পড়লো, ভারী কিছু পড়লে যেমন শব্দ হয় ঠিক তেমন শব্দ হলো। শুভ্রতা জ্ঞান হারানোর আগে হয়তো বাবার গলাও শুনতে পেল। তারপর, তারপর আর কিছু মনে নেই তার।
~
শুভ্রতার রাতে জ্ঞান ফিরলো। ডাক্তার তাকে চেকআপ করে কিছু ওষুধের সাথে ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেলেন। আয়েশা বেগমকে বললেন মেয়ের দিকে খেয়াল রাখতে। সে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে না এমনকি রাতে ঘুমাতেও পারে না। পরপর সাতদিন যেন অর্ধেক করে ঘুমের ওষুধ সে খায়। ডাক্তার চলে যাওয়ার সাথে সাথে আয়েশা বেগম ভাত নিয়ে এসে নিজে হাতে মেয়েকে খাইয়ে দিলেন। এখনো মেয়েকে ভাত খাওয়াতে যু*দ্ধ করতে হয়! খাবার খাইয়ে নিজেই ওষুধগুলো খেয়ে নিলেন। শাহাদাত সাহেব খুব চিন্তিত ছিলেন। মেয়েটা বাহিরে হাসিখুশি দেখালেও ভেতরে ভেতরে গুমড়ে ম*রছে। তবে আজ হঠাৎ কি ঘটেছে যার জন্য এমন হলো! শুভ্রতার খাওয়া শেষ হলে তিনি আয়েশা বেগম এবং স্নিগ্ধাকে রুম থেকে যেতে বলেন। তারা চলে গেলে তিনি একটা চেয়ার টেনে মেয়ের দিকে এগিয়ে এসে বসেন।
বেশ খানিকটা চিন্তিত হয়েই বলেন,
” আজকে কি কিছু ঘটেছে তোর সাথে?”
শুভ্রতা বাসায় এসব নিয়ে কিছু জানাবে না ভেবেছিল। এমনিতেই সবাই তাকে নিয়ে চিন্তিত তাই সে হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করে কিন্তু হুটহাট এমন কিছু সামনে এসে যাবে আর ভালো থাকার যু*দ্ধটা মাঠে মে*রে দিবে এটা সে কখনো ভাবে নি।
শাহাদাত সাহেব আবার বলে ওঠেন, ” কি হলো কি ভাবছো? আমি বেশ বুঝতে পারছি কিছু একটা হয়েছে। শুধু এই অধমের কাছে থেকে কিছু লুকিও না।”
” কিছুই হয় নি বাবা, এমনি শরীরটা খারাপ লাগছিল।”
” বাবার কাছে তো আগে কিছু লুকাতি না রে মা। ওহ এখন তো তোরা বড় হয়ে গেছিস। আচ্ছা ঠিক আছে বলতে হবে না।”
বাবার কথায় এবার ভীষণ খারাপ লাগতে থাকে শুভ্রতার। কেমন অসহায় লাগছে নিজেকে, বাবার এমন কথা শুনে। শুভ্রতা কখনো বাবার সাথে লুকোচুরি করেনি। তাহলে এখন কেন লুকোতে যাবে! শুভ্রতা এবার বলার প্রস্তুতি নেয়।
” বাবা, রাগ কোরো না প্লিজ।”
” আমার রাগ নেই।”
” জানো তো তোমার মেয়ে খুবই স্ট্রং তবে মাঝেমাঝে একটু ভেঙে পড়ে এই আর কি।”
” আজ কি হয়েছে ভেঙে পড়ার মতো শুনি?”
” আমি আমার বাড়ির সামনে ইমতিয়াজকে দেখেছি, বাইকের পিছনে মোনালিসা ছিল। ওদের একসাথে দেখে একটু খারাপ লেগেছে।”
শুভ্রতার কথায় এতক্ষণে সব পরিস্কার হলো। কিন্তু ইমতিয়াজ বাড়ির সামনে অন্য মেয়েকে নিয়ে কি করছিল! দেখাতে এসেছিল শুভ্রতাকে? শাহাদাত সাহেব এবার সিদ্ধান্ত নেন নিহানকে এবার তাড়াতাড়ি আসতে বলতেই হবে। মেয়েটার একাকীত্ব দূর করতে তাকে খুব করে প্রয়োজন। শুধুমাত্র নিহানই পারবে শুভ্রতাকে স্বাভাবিক করতে।
শাহাদাত সাহেব মেয়ের সাথে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটান মেয়ের মন ভালো করতে। রাত অনেক হলে শুভ্রতাকে ঘুমের জন্য বলে নিজেও চলে যান। শুভ্রতার ঘুম ঘুম ও পাচ্ছে। হয়তো রাতটা ঘুমিয়ে পার করতে পারলে শরীরটা ভালো লাগবে। মাথাটাও হালকা হবে। টানা দেড় মাসের বেশিই ঘুম হয় না তেমন। ঘুমের ওষুধটা হয়তো রাতের কষ্টটা একটু হলেও কমিয়ে দেবে শুভ্রতার।
ফোনে মেসেঞ্জারের টুং করে শব্দ হতেই ঘুম ঘুম চোখে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে আবিরা মেসেজ দিয়েছে। সকালে বাসায় যেতে বলেছে তাকে। শুভ্রতা মেসেজের কোন উত্তর না দিয়েই ঘুমিয়ে যায়।
#চলবে……
আগামীকালের পর্ব আজই দিলাম। আগামীকাল পাবেন না। কেউ ভুলে যাবেন না কিন্তু আমাকে। কালকের পরদিন নতুন কেউ আসছে। তার জন্য রেডি থাকুন সবাই।