#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৭ (পত্র-পরিণতি)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
“মামা, মাস কয়েক আগেই জানতে পারি—আমি আর কখনও মা হতে পারব না। চেকআপের পর দেখা যায়—সব কম্পলিকেশন আমার মধ্যে। জরায়ুর সমস্যার জন্য আমি কনসিভ করতে পারছি না; ডাক্তার বলেছে পারবও না। সে-রাতে আমি প্রচুর কেঁদেছি। সাহারা হিসেবে কারো কাঁধ পাইনি। বুকটা ফেঁটে যাচ্ছিল আমার। বন্ধ্যাত্ব একটা নারীর জীবনে সত্যিই অভিশাপস্বরূপ। আমি ভেঙে পড়েছিলাম খুব।
সিদ্দিক নিজেও এসব জেনে হতাশ, আমাকে কী স্বান্তনা দেবে? সে ইদানিং বাসায় খুব দেরিতে আসে। এসেও আমার সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। ও আমার কম্পলিকেশনের ব্যাপারটা মা-বাবাকে জানাতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু, এত বড়ো কথা আমি না-জানিয়ে পারিনি। পরদিন বিকেলে মা-কে বলে দিই। এরপর যা হবার হলো। এখন তারাও আমার সাথে কথা বলে না। প্রথমে খুব হা-হুতাশ করলেও, এখন কিচ্ছু বলে না। তবে বিরক্ত হয় প্রচণ্ড। আমাকে দেখলেই চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। আকারে-ইঙ্গিতে কত কিছুই বোঝায়!
সেদিন বিকেলে বাসায় ঘটক এলো। ভেবেছিলাম সিঁথি আপুর জন্য। পরে খেয়াল করি, ঘটক পাত্রীর ডিটেইলস বলছে। বুঝতে পারি, আমার উপস্থিতিতেই আমার বরের জন্য মেয়ের সন্ধান করা হচ্ছে। আমি কিচ্ছু বলতে পারিনি। মাথা নিচু করে প্রস্থান ঘটিয়েছে। মা দিনকে দিন আমার প্রতি রূঢ় হতে লাগলেন। আগে এই বাড়িতে যা-ও থাকতে পারতাম। এখন একদমই পারি না।
ঘটনাটা গত পরশু সিদ্দিককে অফিস থেকে ফেরার পর জানাই। ও তেতে ওঠে। আমাকে বলে, ‘জানাতে নিষেধ করেছিলাম না? আমার কথা তো শুনলে না। এবার তাদের কথাই শোনো!’
আমার থুতনি গিয়ে বুকে ঠেকে। ও-বাড়িতে ধীরে ধীরে আমার মাথা নিচু হতে লাগে। আমি যেন একটা বোঝা বই কিছুই না। বিষয়টা নিয়ে সিদ্দিককে কী বলব? ও কী বলবে? আমার আর বলার কিছুই নেই। সিদ্দিকও তো এখন আর আমার হয়ে নেই। সে ঝুঁকেছে অন্যত্র।”
“এক মিনিট! সিদ্দিকের ব্যাপারটা ক্লিয়ার করো।”
শফিক সাহেব এতক্ষণ শান্ত হয়ে ভাগ্নির কথা শুনছিলেন। তার মনের কোথাও একটা সিদ্দিকের প্রতি আস্থা ছিল, যেটা মাত্র বলা তনুজার কথাটিতে নড়বড়ে হয়ে গেল। তাই পুনরায় নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করল।
তনুজা শাড়ির প্রান্তদেশ দিয়ে চোখের পানি মুছে নিয়ে আবার বলা শুরু করল, “আশামণি! সিদ্দিকের কলেজ ফ্রেন্ড ছিল। এক সময় ওদের মধ্যে সম্পর্কও শুরু হয়। তারপর আশা আপুর বিয়ে হয়ে যায়। সিদ্দিক কিছুদিন আপসেট থাকলেও, এরপর নিজেকে গুছিয়ে নেয়। আমাদের বিয়ের পরের বছর, সিদ্দিকের সাথে ওর অফিসেই আশা আপুর দেখা হয়; নিউ এমপ্লয়ী হিসেবে। সিদ্দিকের আন্ডারেই কাজ করে প্রথম তিন মাস। এরপর প্রোমশন পেয়ে যায়। ধীরে ধীরে পুরোনো প্রেম আবার জাগতে থাকে!”
ঘৃণায় মুখ লুকোয় তনুজা। শফিক শাহেব শুধালেন, “সিদ্দিকের যে আগে একটা সম্পর্ক ছিল, এটা কার কাছ থেকে জানতে পেরেছ? মানে, কে বলেছে?”
“সিদ্দিক বলেছে।”
“ও নিজেই?”
“হুম।”
“আচ্ছা। আর এই-যে, সিদ্দিকের সাথে আশার আবার দেখা হওয়াটা, এটা কীভাবে জানলে?”
“এটাও সিদ্দিক বলেছে।”
“প্রেমের বিষয়টাও?”
“না না, এটা না।”
“তবে এটা কী করে জানলে?”
“যেদিন চেকআপে গিয়েছিলাম, সেদিন আমাকে হসপিটালে নিয়ে যেতেই ওর ফোনে একটা কল আসে। ৫ মিনিট পর কথা বলে এসে আমাকে বলে, ওর যেতে হবে। খুব দরকার নাকি!
আমি আটকাইনি। তবে আমার চেয়েও জরুরি ওর জন্য কিছু আছে যে, এটাই ভাবতে পারছিলাম না। সিদ্দিক বেরোতে বেরোতে আমাকে বলল, ফেরার সময় ও নিয়ে যাবে। আর আসতে না পারলে সিঁথি আপুকে পাঠিয়ে দেবে।
আম শুধু মাথা নাড়লাম। সিদ্দিক বেরিয়ে গেল। যাবার আগে ভুলে ভালে নিজের ফোনটা রেখে গেল। কৌতুহলবশত ফোনটা ধরতেই দেখতে পাই, নোটিফিকেশন প্যানেলে একটা ম্যাসেজ। লেখা, ‘জলদি এসো, আবরার।’
ম্যাসেজটা পাঠিয়েছে, ‘আশা।’
আমি মন খারাপ করে ফেলি। অত কিছু বুঝিনি তখনও। কেবল বুঝেছিলাম, সিদ্দিকের লাইফে আমার চেয়েও ইম্পর্ট্যান্ট কিছু আছে।”
“ওয়েট! আশার না বিয়ে হয়ে গিয়েছিল?”
“হুম, তবে টেকেনি। বছর ছয়েক আগেই ডিভোর্স হয়েছে।”
“এটাও সিদ্দিক বলেছে?”
“হ্যাঁ।”
“সব কথাই তো বলে। তবে পরকীয়ার বিষয়টা লুকোল কেন?”
“মামা, এই ওয়ার্ডটা স্কিপ করুন। খুব বিশ্রী শোনায়।”
“আচ্ছা। তো এই গোপন বিষয়টা জানলে কবে?”
“জানলাম, কদিন পরেই। আমি একদিন লুকিয়ে সিদ্দিকের ফোনের লক দেখে নিই। এরপর আরেকদিন ফোন চেক করি।”
“বিষয়টা একদমই ঠিক না। যাকে বিশ্বাস করো, তাকে সবটা দিয়েই বিশ্বাস করা উচিত। সেই বিশ্বাসে এইটুকু পরিমাণ খুঁত থাকলে, সম্পর্কের চরম অধঃপতন হয়। এক্সাম্পল তুমি নিজেই!”
তনুজা মিনমিনে স্বরে বলল, “কী করব বলুন? আমার মাথা ঠিক ছিল না। নিজের অস্তিত্বের উপর থেকেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছিলাম আমি। কিন্তু সন্দেহটা বৃথা ছিল না।”
“কী দেখেছিলে ফোনে?”
“দেখেছিলাম, আশার সাথে আমার বিষয় নিয়ে সিদ্দিকের ক্ষোভগুলো। দেখেছিলাম, কীভাবে ওই আশা আমার বরকে স্বান্তনা দেয়, হুটহাট নিজের ফ্ল্যাটে ডাকে, আমার খুঁতগুলো চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দেয়। তারপর দেখলাম, সে কীভাবে আমার বরকে ধীরে ধীরে আমার থেকে দূর করতে লাগে!”
“তুমি শিওর? এমনও তো হতে পারে, যা দেখেছ তা ভুল ছিল!”
“না। ভুল না, ভুল না। আমি ঠিক দেখেছি, ঠিক বুঝেছি। আমার সিদ্দিককে তো আমি চিনি। এই সিদ্দিক আমার সিদ্দিক নয়। ও অনেক পালটে গেছে। আপনাকে আমি বোঝাতে পারব না খুলে।”
কথাটা বলতে বলতে দুহাতে নিজের চুলগুলো মুচড়ে ধরল। শফিক সাহেব প্রিয় বোনের একমাত্র মেয়ের এই দশা মেনে নিতে পারছেন না। বহুবছর পর সে তনুজার খোঁজ পেয়েছে। বোন তো সেই দুই যুগ আগেই একজনের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। প্রথমে বাড়ির কেউ মেনে নেয়নি। এরপর যখন পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়, তখন আর তনুজার মায়ের খোঁজ পায়নি। পাবে কী করে? ততদিনে সে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে গিয়েছে। এরপর, এত বছর পর, শফিক সাহেব বোনের মৃত্যুর খবর জানতে পারেন। জানতে পারেন বোনের স্বামীর অকাল মৃত্যু, বোনঝির অবস্থা। তারপরই তনুজার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। অতীতের বিষয়গুলো খুলে জানান। তনুজা আবেগে আপ্লুত হয়ে কেঁদে দেয়। এরপর একে একে নিজের জীবনের সব ঘটনা তুলে ধরে।
এই পর্যায়ে এসে শফিক সাহেব ক্রন্দনরত তনুজার মাথায় হাত রেখে বলল, “তুমি যা চাইবে, তাই হবে।”
তনুজা মাথা তুলে অশ্রুসজল নয়নে তাকাল। কান্না গিলে নিয়ে শক্ত হয়ে বসল, কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে দৃঢ় মনোবল নিয়ে বলে উঠল, “ডিভোর্স চাই!”
_______
পৃথিবীতে কিছু ধরনের মানুষ থাকে, যারা খুবই নির্লিপ্ত, খুবই ধৈর্যশীল; তাদের সহজে রাগ লাগে না, রাগ ঝারে না, কান্না তো মোটেই করে না, তবে ভালোবাসে অফুরন্ত। কিন্তু, সেই ভালোবাসাটাও তার প্রাপ্ত মানুষটির একটি মাত্র ভুলের জন্য নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। প্রচণ্ড ভালোবাসা হুট করেই শূন্যের কোঠায় নেমে যেতে পারে। ধীরে ধীরে সেই মানুষটি হয়ে যেতে পারে ইস্পাতের ন্যায় কঠিন। আবেগ-অনুভূতি থেকে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে বের করে ফেলতে পারে। তারা মৃত নয়, তারা কেবল বেঁচে থাকে। বাঁচার জন্য বেঁচে থাকে, ভালো থাকার জন্য নয়।
তেমনই একজন শক্ত-পোক্ত পুরুষ হচ্ছে আজওয়াদ আবরার সিদ্দিক। গায়ের গরন বেশ আকর্ষনীয়। তার চেয়েও বেশি টান আছে তার দৃঢ়-কঠিন ঘোলাটে দৃষ্টি, অকম্পিত আওয়াজ, ইস্পাত-কঠিন নার্ভস আর রূঢ়ভাষী স্বভাবটায়!
হাত বাড়িয়ে অতিপ্রিয় তেতো কফির কাপটা তুলে চুমুক দিলো, দৃষ্টি সামনের ফাইলেই; সবটায় নজর বুলিয়ে যাচ্ছে। ঠিক সেই সময় কেবিনে নক করল একজন স্টাফ।
কাঁপা কণ্ঠে কান্তা শুধাল, “মে আই কাম ইন, স্যার?”
সিদ্দিক দৃষ্টি সরাল খানিকটা। কান্তার দিকে তাকিয়ে, ঠোঁটের ভাঁজ হালকা নেড়ে বলল, “ইয়েস্!”
সে কথার শব্দ হলো না। তবে কান্তা বুঝতে পারল, সিদ্দিকের ইতিবাচকতা। সিদ্দিক আর কিছু না বলে আবারও দৃষ্টি ফাইলের মাঝে আঁটকে ফেলল। অনুমতি পেয়ে কান্তা জলদি ভেতরে এসে গেল। সিদ্দিককে সে অকারণেই ভয় পায়। যেভাবে তাকায় না, যেন একেবারে জানে মেরে দেবে! সেই ভয় থেকেই হাতের এনভেলপটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “স্যার! আপনার লেটার এসছে!”
সিদ্দিক না তাকিয়ে আস্তে-ধীরে বলল, “জাস্ট লিভ ইট হেয়ার।”
কান্তা সিদ্দিকের সামনে এনভেলপটা রেখে ডানে-বাঁয়ে না তাকিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। সিদ্দিক সময় নিল। হাতের কাজ শেষ দিয়ে, এনভেলপটা হাতে নিল। এনভেলপের গাঁ থেকে ভেসে আসছে এক চিরপরিচিত শুকনো বকুলের সুবাস। সিদ্দিক প্রাণ ভরে সুবাসটা টেনে নিল।
এরপর গিয়ে দাঁড়াল জানালার সামনে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করল। একটা সিগারেট ঠোঁটের ভাঁজে গুঁজে নিল। দুইবার টান দিয়ে সিগারেটটি হাতের দুই আঙ্গুলের ভাঁজে রেখে বাইরে তাকিয়ে রইল। এরপর ফিরে তাকাল এনভেলপের দিকে।
বেশ কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল, দেখা যেন শেষ হয় না। এরপরই লাইটার দিয়ে এনভেলপের এক মাথায় আগুন জ্বালিয়ে সেটা শেষ অবধি জ্বলার আগ পর্যন্ত হাতে ধরে রাখল। তাপ শরীরে মাত্রাতিরিক্ত স্পর্শ করলে সে অর্ধ-ভস্ম হওয়া এনভেলপটি বিনে ফেলে দিলো। পুড়ে সম্পূর্ণটা ছাঁই হওয়া নাগাদ তাকিয়ে রইল, একদৃষ্টে। ছাঁই হওয়ার পরও দেখে গেল। তারপর শেষ করল আরও তিনটে সিগারেট।
এই ছাঁই দেখলে সিদ্দিকের শরীরের রক্ত গরম হতে থাকে, মস্তিষ্ক অশান্ত হয়ে যেতে লাগে। বিগত ৭ বছরের প্রথমটি বাদে বাকি ৬টি চিঠি সিদ্দিক এভাবেই পুড়িয়েছে। তবুও যেন আশ মেটে না। প্রতিবারের মতো আজও বলে উঠল, “ভাগ্যিস! তুই এখানে নেই, তনু! নয়তো এই ৬টা চিঠি দেওয়ার সাধ্য তোর হতো না। প্রথম বারেই আমার উপকারার্থে বাপের কাছে চলে যেতিস! এই চিঠির জায়গায় তুই হতিস!”
চলবে?
শব্দসংখ্যা-১৩৫৫