#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_২৪ (এনে দাও ওঁকে!)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
“এভাবে যদি আবার হারিয়ে যাই?”
“আবার খুঁজব, আবার পাব..”
“চিরতরে গেলে?”
“আমিও পিছু নেব।”
“মরনেও?”
“পরকালেও।”
শুদ্ধ একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তনুজা মাথা নিচু করে ফেলল। বিরবির করে কেবল বলল, “আল্লাহ তোমায় সুখী করুক, শুদ্ধ। খুব সুখী করুক। আমাকে ছাড়াই..”
কথাটা শুদ্ধ শুনল। শব্দ করে সে বলে উঠল, “আমার ভাগেরটুকু তো আমি পাবই। হোক সেটা সুখ! কিংবা অসুখ..”
“আর মায়ায় জড়িয়ো না, ছেলে। আমি পিছলে যেতে পারি।”
“ক্ষতি কী?”
“আছে অনেক।”
“যেমন?”
“আমার মতো অনুভূতিশূন্য যাতে আর কোনো আবেগী কিশোরকে হতে না হয়!”
“আপনি আপন করে নিলেই পারেন!”
“সম্ভব নয়।”
“কেন?”
“কারণ অজানা?”
শুদ্ধ তাকাল। তনুজা চোখ বন্ধ করে ফেলল। হুট করেই একূল-অকূল না ভেবে, দু’হাত টেবিলের উপর দিয়ে এগিয়ে প্রথমবারের মতো শুদ্ধর বাড়িয়ে রাখা হাতে হাত রাখল। শুদ্ধর সর্বাঙ্গ অধিকতর উত্তেজিত হয়ে উঠল। তনুজা নিজ আঙ্গিকে সেই হাতের উপর মাথা ঠেকাল, চোখ দুটো বন্ধ করে নিল। কিছু না বলেও, শুদ্ধকে অনেক কিছু বোঝাল।
খানিকক্ষণ বাদে শুদ্ধ অনুভব করল—তার হাতের সিক্ততা। ত্বরিতে হাত সরিয়ে নিতে চাইল। কিন্তু তনুজা ছাড়ল না। শুদ্ধর হাতের পিঠে কপাল ঠেকিয়ে ঠোঁট কামড়ে বড়ো করে নিঃশ্বাস নিল। ভেতর থেকে সব দুমড়ে যাচ্ছে। বাইরের কিছু দেখার অবসর কোথায়? এই-যে, আশে-পাশের মানুষদের নজর ওদের উপর, তাতে ওদের খেয়াল কোথায়?
শুদ্ধর কেমন যেন লাগছে। অদ্ভুত রকমের যন্ত্রণা হচ্ছে বক্ষপিঞ্জরে। বোঝানো দায় তা! মনে হচ্ছে, কেউ তার কলিজাটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলছে নিজ-চোখের সামনেই; সে কিছু বলতেও পারছে না। তবে বলতে ইচ্ছে করছে। খুব করে বলতে ইচ্ছে করছে, “অলকানন্দা! আমার অলকানন্দা! আপনি কাঁদবেন না! আপনি কাঁদলে যেন আমার গোটা আকাশ কাঁদতে থাকে, বন্যা হয়ে যায় ধরিত্রীতে। সাঁতরে কূল পাই না! ডুবে যাই আপনার চোখের এই প্রেম-সাগরে; অথচ.. অথচ মরতে পারি না।”
শুদ্ধর মনঃকথন যেন তনুজা শুনতে পেল। বড্ড মিনমিনে গলায় ধীরবুলি আওড়াল, “শুদ্ধ, দোহায় লাগে! আমায় ছেড়ে দাও। এই মানসিক অশান্তি আমি আর নিতে পারছি না। একটুও পারছি না। এর চেয়ে মরণ যেন শ্রেয়! স্রষ্টার দেওয়া জীবনকে তো ফিরিয়ে দিতে পারব না, তাই তোমায় ফেরাচ্ছি। ফিরে যাও, প্লিজ!”
কথাগুলোর প্রতিটি শব্দ আলাদা আলাদাভাবে শুদ্ধর বুকে গিয়ে বিঁধল। শুদ্ধ এখন তনুজাকে কী বলবে—ভেবে পাচ্ছে না। তনুজার কথা মেনে নেওয়া অসম্ভবনীয়, আর এমনভাবে প্রিয় নারীর বলা কোনো কথা ফেলাও দুষ্কর। তথাপি বলে উঠল, “এভাবে আমার জান চেয়ে নিলে—আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে, মুচকি হেসে আপনার সামনে রেখে দিতাম! অথচ, আপনি চাইলেনই এমন কিছু…”
তনুজা মাথা ওঠাল। শুদ্ধ তনুজার চোখে চোখ রাখতে না পেরে নতমুখী হয়ে পকেট থেকে হ্যাংকিটা বের করে তনুজার দিকে এগিয়ে দিলো। তনুজা এদিক-ওদিক না-তাকিয়ে চোখ মুছে নিল। ক’বার নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “সৃষ্টিকর্তার দেওয়া জীবন যার-তার সামনে ফেলে দিতে হয় না। বহু মূল্যবান জিনিস আছে, জীবনের অধিক নেই।”
“আর আপনি তার চেয়েও অধিক.. আপনার জন্য মরতে রাজি।”
“বেঁচে না থাকলে আমাকে পাবে কী করে? অথচ, দেখো! আমি না থাকলেও তুমি বেঁচে থাকবে।”
“আমার গোটা জীবনকে বিপরীতে রেখে, আপনাকে চাইছি!”
“ওভাবে বোলো না, সৃষ্টিকর্তা নারাজ হবেন। তারপর..”
“তারপর?”
“তারপর আমাকে শান্তি দেবেন।”
“একটু ভালোবাসা কি আমি একেবারেই ডিজার্ভ করি না? এই এইটুকুন?”
হাত দিয়ে খানিকটা পরিমাপ করে দেখাল শুদ্ধ। তনুজা অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল, “সবার ভালোবাসা পাবে তুমি, কেবল..”
“আপনারটা ছাড়া, তাই-তো?”
“হ্যাঁ।”
“আর কারোর ভালোবাসা আমার চাই না।”
“যা চাই, তা কি আদতে আমরা পাই? আর যা পাই, তা কি সব চাই?”
“নাহ!”
“আমি না তোমার প্রিয় অনুশোচনা?”
শুদ্ধ তাকাল তনুজার চোখের দিকে। চোখে চোখ স্থির রেখে বোধহয় শেষবারের মতোই বলে উঠল, “আর আপনার মোহে জড়িয়ে, নিজের জন্য কেবলই আফসোস হয় আমার, অলকানন্দা।”
থামল শুদ্ধ, গভীর শ্বাস টানল। এক আকাশ সমান আফসোস নিয়ে বলে উঠল, “আমার অলকানন্দাকে দুঃখ স্পর্শ না করুক। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়েটি আমার অপ্রেমিকা হোক। তাঁর উপস্থিতি আমার না-হলেও, আমার অনুপস্থিত সুখ সারাটাজীবন তাঁরই হোক।”
______
আকাশে মস্ত বড়ো একফালি চাঁদ আর বাতাসের সাথে জোনাকি পোকার ঝিঁঝিঁ আওয়াজ! কী স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে! কী সুন্দর শোনাচ্ছে! প্রকৃতির এই শান্ত রূপ বোধকরি সবারই বড্ড প্রিয়। তবে সহ্য হচ্ছে না সিদ্দিকের।
বারান্দায় বসে একের পর এক সিগারেট জ্বালিয়ে ধোঁয়া ওড়াচ্ছে। মনটার বিষাক্ততা এই হাওয়ার চেয়ে কম নয়! সে কি আদতেই এত শক্ত পুরুষ—যতটা দেখাচ্ছে! আচ্ছা, তনুজাকে অন্যের পাশে ভাবতেই তার কেন এত খারাপ লাগছে?
ওদিকে তনুজা বিগত ৬-৭ বছর ধরে তাকে অন্য নারীর সাথে দেখে আসছে! মনের কোণায় প্রশ্ন এলো, ‘সে কী করে পারল, প্রিয়তমাকে ছেড়ে অন্যতে জড়াতে? কী করে পারল অন্য কারো সাথে ঘনিষ্ঠ হতে?’
আর ভাবতে পারছে না। অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে তনুজার জন্য; মেয়েটা আর কত সইবে? তারপরই ভেতর মন জবাব দিলো, “ওর সইতে হবে। ওর এভাবেই ইহজীবনটা কাটাতে হবে। সাহস কী করে হলো ওর—ছেড়ে যাওয়ার? নিজের জায়গা ও নিজেই ছেড়েছে। কী করে পারল এরকমটা করতে? আমি কি ওকে কম খুঁজেছি? ও কেন মায়ের কথায় এত বাজে সিদ্ধান্তে এলো?”
সিদ্দিক দাঁতে দাঁত পিষে চোখ বন্ধ করে ফেলল। যদি কোনোদিন তনুজার সামনে সে নিজেকে.. নিজের রাগকে সামলে রাখতে পারে, তবে শুধাবে, “যা চেয়েছিলি, তাই হয়েছে। খুশি নোস? নোস কি? হাসবি এখন। হেসে দে। জোরে জোরে হাস। আমার জীবনটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে বিজয়ীর হাসি হাস। সব তোর ইচ্ছে মতো হয়েছে, তোর ইচ্ছে মতোই হচ্ছে।”
সবশেষে বলবে, “তনুজা! তুই পাষাণ!”
ভাবনাগুলো দমবন্ধকর হয়ে আসছে! সিদ্দিক সিগারেটটা ফেলে মুখ কুঁচকে ফেলল। ভেতরটা তেতো হয়ে এসেছে। অনুভূতিরা যেন বিষ হয়ে গেছে!
____
তালুকদার বাড়িটা আজ একদমই খালি। ইয়াকুব তালুকদার আর এশহাদ তালুকদার কিছু ব্যবসায়িক কাজে চট্টগ্রাম গেছেন। বয়স সত্তরের কোঠায় গেছে, তবুও ইয়াকুব সাহেব এখনও ভীষণ শক্ত-সামর্থ্য চেহারার ব্যক্তি। মুখভাব দেখে বয়স আন্দাজ করাটা বেশ কঠিন। এই বয়সেও ব্যবসার হালটা পুরোপুরি ছেলের হাতে তুলে দেননি। ছেলেটা ছিল অশান্ত এবং উত্তেজিত স্বভাবের। তাই ভরসা করতে পারেননি; পাছে না এত সাধনার ব্যবসা রশাতলে যায়! তাই তো, একমাত্র নাতিকে নিজের মতন প্রখর জেদি-একরোখা-বুদ্ধিদীপ্ত তৈরি করেছেন। বয়সে খানিকটা অভিজ্ঞ হলেই, সবটা তার হাতে ছেড়ে দিয়ে শান্তির নিদ্রা নেবেন। অথচ, ছেলেটার বয়স বাড়ছে.. খাম-খেয়ালি কমছে না। তাই এখনও নিজের কাঠিন্য ধরে রাখতে হচ্ছে ইয়াকুব সাহেবকে।
রাতের বারোটার দিকে একা বাড়িতে বসে বসে একটা উপন্যাসের বই পড়ছিলেন সুভা বেগম। বাড়িতে সার্ভেন্টস ছাড়া কোনো ফ্যামিলি মেম্বার নেই। হুট করেই তিনি শুনতে পেলেন, কলিং বেলের তীব্র আওয়াজ। সব সার্ভেন্ট ঘুমিয়ে গেছে। এমন অসময়ে কে আসবে!
ত্বরিতে ফোনের সিসিটিভি মনিটরে বাইরের ক্যামেরাটা চেক দিলেন। দরজার সামনে শুদ্ধকে অন্যমনস্কভাবে, খুবই অগোছালো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্বিতীয়বারের মতো ভীষণ রকমের অবাক হলেন। এলোমেলো পায়ে দ্রুত গিয়ে সদর দরজার সামনে গেলেন, দরজা খুললেন।
দেখতে পেলেন—শুদ্ধর অস্বাভাবিকরকমের লাল চোখজোড়া। বুকটা ধুক করে ওঠে তাঁর। কলিজার টুকরোর এই অবস্থা কী করে! সুভা বেগমের রাগ-জেদ-অভিমান সবটাই অনেক বেশি। বৈশিষ্টানুসারে এখন তাঁর কেঁদে ফেলা উচিত। অথচ, তিনি তা করলেন না। ছেলের এই অবস্থার কীসের জন্য হয়েছে, তা বুঝতে বিচক্ষণ সুভার দেরি হলো না। প্রচণ্ড রকমের রাগ গিয়ে পড়ল, এর দায়ী মানবীর উপর।
সেই রাগ এগোনোর আগেই শুদ্ধ সুভা বেগমের চোখে চোখ রেখে বলল, “মা! মা!”
তাঁর মাতৃহৃদয়ে কেউ যেন আগুন জ্বালিয়ে দিলো, বুকটা জ্বলে যাচ্ছে। মূহুর্তেই চোখ দুটো ছলছল হয়ে এলো। শুদ্ধ বাচ্চাদের মতো ফোঁপাতে লাগল। ক্ষণিকের ব্যবধানে হাঁটু ভাঁজ হয়ে এলো, মাথা নত হয়ে গেল। চোখ দিয়ে বেরিয়ে এলো বেদনাশ্রু। বিরবির করে কী যে বলে যাচ্ছে!
সুভা বেগমের চোখ দিয়ে জল গড়ায়, এগিয়ে এসে শুদ্ধর খুব কাছাকাছি দাঁড়ান। কাঁপা-কাঁপা হাত বাড়িয়ে শুদ্ধর কোঁকড়াচুলের উপর রাখেন। শুদ্ধ তাকায় তাঁর দিকে।
মা-ছেলে দুজনেই কাঁদছে। আহ্লাদ পেয়ে শুদ্ধ সুভা বেগমের কোমড় জড়িয়ে ধরল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বাচ্চাদের মতো আবদার করে বসল স্বীয় মায়ের কাছে, যার কাছে একবার মজার ছলে তারা চাওয়াতে, তিনি কদিনের মাঝেই শুদ্ধর নামে একটা তারা কিনে দিয়েছিলেন; আর আজ কাঁদতে কাঁদতে চাইল, “মা, আমার ওঁকে লাগবে। এনে দাও, মা। এনে দাও! প্রমিস করছি, আর কিচ্ছুটি চাইব না।”
সুভা বেগম চোখ বুঁজে ফেললেন।
চলবে…
শব্দসংখ্যা-১২৬৭