#এক_সমুদ্র_প্রেম!
কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৫২)
মারিয়া ক্লান্ত হাতে বেল টিপল। তার চোখদুটো জ্বলছে। বুক পুড়ছে। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে গিয়ে দরজা খুললেন রোজিনা। মেয়েকে দেখে প্রতিদিনের মত শুভ্র হাসলেন। বিনিময়ে রোজকার দেয়া,প্রানবন্ত, উচ্ছল হাসিটা হাসতে ব্যর্থ হলো সে। তবুও,মায়ের খারাপ লাগবে ভেবে ভেতর থেকে হাতিয়ে আনল এক টুকরো মলিন হাসি । বাজারের ব্যাগটা এগিয়ে দিলো। রোজিনা তাতে একবার চোখ বুলিয়ে শুধালেন,
‘ এত রাতে বাজারে গিয়েছিলি?’
‘ না,রাস্তায় পেলাম। তাই এনেছি।’
কণ্ঠ ভীষণ ধীর-স্থির তার। যেন শ্রান্তিতে মুঁদে আসছে সব।
‘ তাহলে ব্যাগ?’
‘ মোড়ের দোকান থেকে কিনেছি।’
‘ ওহ,চা খাবি? বানিয়ে দেব?’
‘ না।’
‘ আচ্ছা,ফ্রেশ হ। খাবার দিই।’
‘ পরে খাব।’
প্রতিদিন মারিয়া বসার ঘরের সোফাটায় পা তুলে বসে। মায়ের হাতে বানানো চা খেতে খেতে সারাদিনের ঘটনার বর্ণনা দেয়। আজ এই করেছি,সেই করেছি। চেষ্টা করে মায়ের মস্তিষ্ক ব্যস্ত রেখে তাকে হাসিখুশি রাখার। অথচ আজ,নিজের হাসিই বিলীন!
কোনও মতে উত্তর দিয়েই,সোজা রুমে ঢুকল সে। রোজিনা অবাক হলেন এতে। ওতো এরকম করেনা। আজ কী হলো? শরী-টরির খারাপ না তো?
ভাবলেন,গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন। পা বাড়াতে যাবেন,এর আগেই দোর চাপানোর শব্দ হয়। মারিয়া স্বশব্দে লক টেনে দিয়েছে। রোজিনা থামলেন। বিস্ময় প্রগাঢ় হলো এবার। নিশ্চিত কিছু একটা হয়েছে। নাহলে রওনাকের মৃত্যু বার্ষিকী ব্যাতীত মেয়েটাতো এমন নিস্তব্ধ থাকে না!
মারিয়া কাধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে রেখে বিছানার দিক এগোয়। পা ঝুলিয়ে বসে। টলমলে চোখে চায় সাদা রঙের দেয়ালের পানে। অবিলম্বে ভেসে ওঠে সাদিফের শুভ্র আঁনন। ভীষণ সাদা দাঁত বের করে হাসার সেই চোখ জুড়ান দৃশ্য। তার চোখের দৃষ্টি। কথার মাঝে থুত্নীতে হাত বোলানোর অভ্যেস।
পরপর কানে বাজে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত কথা।
‘আমি পিউকে ভালোবাসি, আমি পিউকে ভালোবাসি।’
মারিয়া তৎপর হাতে দু-কান চেপে ধরল। সহসা রক্তজবার ন্যায় অধরদুখানি ভেঙে-চূড়ে আসে। একরকম আছড়ে পরে বালিশে। মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। সেই কান্না বাড়ল, সাদিফের সঙ্গে একের পর এক কাটানো মুহুর্ত গুলো মনে করতেই। বাড়ল আজ দুপুরের কথা ভেবে। পিউয়ের জন্য কেনা সাদিফের আংটিটা,তাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার ঘটনা সব কিছু বিষের ন্যায় বিঁধে থাকল গলায়। সে জানে,পিউ কোনও দিন সাদিফের হবে না। ও ধূসর ভাইকে ভালোবাসে। কিন্তু, তাও, লোকটাতো পিউকে মন দিয়ে বসেছে। আর যার মনে অন্য কারো বাস,সে ওর হবে? হবে না। ভালোবাসলে তাকে সহজে ভোলা যায়? সাদিফ ও ভুলবে না। তার নেত্রযূগলে পিউয়ের প্রতি সুগভীর ভালোবাসার কূপ দেখেছে মারিয়া। সেই কূপ হয়ত ভরাট হবে না,গোটা জীবনেও না। সে কাঁদতে কাঁদতেই বিড়বিড় করল,
‘ এক তরফা ভালোবাসার মত বিষাক্ত, ভয়ার্ত,আর রিক্ত অনুভূতি কিছুতে নেই সাদিফ?’
______________
সাদিফ সিড়ি বেঁয়ে নামছে। বিধ্বস্ত লাগছে তাকে। ফর্সা চেহারা লালিত। যেন চামড়া ফেটে রক্ত আসবে এক্ষুনি। বুকের ভেতরটা ছিড়ে যাচ্ছে ব্যথায়। মস্তিষ্ক থিঁতিয়েছে। স্বকীয়তা হারিয়েছে নিউরন। তারা এতটাই বিকল যে লিফটের কথাও ভুলে বসল সে। অত উঁচু দালানের দীর্ঘ সিড়ি, একটা একটা করে নামল সে।
সাদিফ গ্রাউন্ড ফ্লোরে এলো। থামল। অগোছালো চোখে চারপাশেষ তাকাল। ঝা চকচকে হোটেলের মধ্যেও তার হৃদয় ঘুটঘুটে তিঁমিরে ভরা। একটুও আলো নেই সেথায়। দ্বিগবিদ্বিক খুইয়ে যেদিক চোখ যায়, সাদিফ এগোলো। পদযূগলের দশাও টালমাটাল৷ মদ্যক,মাতাল কোনও লোকও হয়ত এতটা ভারসাম্যহীন হয়না।
কিছু দূর এগিয়ে খেয়াল হলো,এটা সদর গেট নয়। সে দিশা হারিয়ে সুইমিং পুলের কাছে চলে এসেছে। সাদিফ পেছন ফিরে চায়। অথচ ফিরে যাওয়ার শক্তি কূলোয়না। ধপ করে বসে পড়ে পুলের আঙিনায়। সবুজ, পরিচ্ছ্বন্ন জলের দিক অনিমিখি চেয়ে থাকে। তারপর সামনে ধরে মুঠোয় রাঙা সেই উপহার,যা পিউকে কোনও দিন দেয়া হবে না।
সাদিফের আকাশ ভেঙে কান্না পায়। বক্ষে উত্থালপাতাল ঘূর্নিঝড়। কিছুক্ষণ ঠোঁট চেপে ধরে নিজেকে সংবরণের আশায়। সেগুঁড়ে বালি ফেলে,ডুকরে কেঁদে ফেলল সে। অধৈর্য হাতে চশমা টা টান দিয়ে খুলে আছাড় মারল। কাঁচের বস্তুটার সহিত যেন তার হৃদয়টাও ভেঙে ছিন্নভিন্ন হলো।
অস্পষ্ট আওয়াজ বেরিয়ে এলো কণ্ঠনালী ফুঁড়ে। হাহাকার,হা হুতাশের এক তীব্র ভয়ানক কান্না তা। ভালোবেসেও ওপাশের মানুষটিকে হারিয়ে ফ্যালার কান্না,তাকে না পাওয়ার কান্না।
‘ কেন আমায় ভালোবাসলিনা পিউ? কেন ভাইয়াকে ভালোবাসলি? আমি কি এতটুকু কার্পণ্য করেছিলাম তোকে ভালোবাসায়? আমার কী খামতি ছিল এখানে? বলে যা পিউ,বলে যা।’
কণ্ঠ ভগ্ন,রুগ্ন শোনাল৷ সাদিফ কাঁদতে কাঁদতে পানির দিক তাকায়। ব্যথিত দুই লোঁচনে ভেসে ওঠে ধূসরের বুকে পিউয়ের ঝাপিয়ে পরার দৃশ্য। তার মাথায় ধূসরের চুমু খাওয়া। সাদিফ চোখ খিঁচে বুজে ফ্যালে। হাত দিয়ে বুকের বাম পাশ ঘষে। হা করে শ্বাস নেয়।
তখন মনে পড়ে,মারিয়ার একটি প্রশ্ন,
‘ যদি জানেন,পিউ অন্য কাউকে ভালোবাসে তখন?’
সাদিফ আকাশের দিকে চাইল। ছাদ ভেদ করে দেখা গেল না কিছু। তবুও সে বিড়বিড় করল,
‘ এই দেখুন ম্যালেরিয়া,আমি কাঁদছি। পিউ অন্য কাউকে ভালোবাসে শুনে আমি অসহায়ের মতো কাঁদছি। দেখছেন আপনি? দেখছেন?’
কান্নার দমকে কাশি উঠে গেল তার। কাশতে কাশতে চিৎ হয়ে শুয়ে পরল সেখানে। ডান হাতের তালুতে রাখা আংটির বাক্সর দিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। সামনে এনে বলল
‘ তোর আর কোনও কাজ নেই রে। আর কোনও কাজ নেই তোর।’
সেই শুয়ে থাকা দশায় আংটির বাক্সটাকে পুলের মধ্যে ছুড়ে ফেলল সাদিফ। ব্যস্ততা দেখিয়ে অতলে ডুবল সেটা। সেই চিত্র অমত্ত চোখে চেয়ে চেয়ে দেখল সে। তিরতির করে ভূমিকম্পের ন্যায় অধর কাঁপছে তখনও । বক্ষ চূর্নবিচূর্ন হচ্ছে ক্রমশ৷ কাঁচ ভাঙার মত ঝরঝরে আওয়াজটা স্পষ্ট কানে বাজছে। আংটিটা একা নয়, যেন সাথে ডুবছে পিউ,ডুবছে তার এতদিনের লুকিয়ে,পুষে রাখা, না পাওয়া ভালোবাসা।
_______________________
দু প্রান্তে দুটো মানুষ যখন নিজেদের ভালোবাসা না পাওয়ার বেদনায় ছটফটায়, এক সপ্তদশী কিশোরী সেখানে ভালোবাসা পাওয়ার আনন্দে দিশেহারা। একই দিন মারিয়া,সাদিফ,পিউ,তিনটে ভিন্ন মানুষ কাঁদছে। একে অন্যের সাথে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ দশায় জড়িত এরা। অথচ কান্নার কারণ গুলো কী ভিন্ন,আলাদা,ব্যতিক্রমী!
ধূসর অধৈর্য। সব সময়, সব কাজে তার ধৈর্য ভীষণ কম। অথচ আজ,তার এতটা সসহ্যক্ষমতা আগে দেখা যায়নি। দেখা যায়নি পিউকে একবারও বুক থেকে সরানোর তাড়া।
পিউ ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। অল্প স্বল্প শব্দ আসছিল তাতে। পাওয়া যাচ্ছিল নাক টানার আওয়াজ। হঠাৎ সে শব্দ থেমে যায়। একটু আলগা হয় তার পিঠ আকড়ে রাখা ওর শক্তপোক্ত মুঠোদ্বয়৷
বিষয়টা খেয়াল হতেই ধূসরের হাসিটা মুছে গেল৷ বেকে এলো জোড়া ভ্রু।
শরীরটাকে সামান্য ঝাঁকিয়ে ডাকল,
‘ পিউ!’
সাড়া নেই। ধূসর সচকিতে,সতর্ক ভাবে তার বুক থেকে পিউয়ের মুখ তুলল। ওমনি ওর মাথাটা হেলে পরল একপাশে। জ্ঞান হারিয়েছে বুঝতেই পুষ্প আঁতকে ওঠে। ত্রস্ত এগোতে গেলেই ইকবাল আঁচল টেনে ধরল,
‘ কী করছো মাই লাভ?’
‘ পিউ অজ্ঞান হয়ে গেল তো।’
‘ আরে, আমরা লুকিয়ে আছি না? এখন গেলে ধরা পরে যাব।’
পুষ্প নিঃসহায় বনে দাঁড়িয়ে থাকে। কাতর চোখে বোনের দিক চেয়ে রয়।
অথচ ধূসর মুচকি হাসল। পিউয়ের নাকের ডগায় হীরের মত চকচকে ঘামটুকু বৃদ্ধাঙুলে মুছে নিলো। চিকণ ওষ্ঠদ্বয় এগিয়ে একটা দীর্ঘ চুমু আঁকল তার বাম গালে। ইকবাল তৎক্ষনাৎ এক হাতে নিজের চক্ষু চেপে ধরে। পাশাপাশি ধরল পুষ্পরটাও। পরমুহূর্তেই দু আঙুলের ফাঁক দিয়ে চাইল। কটমট করে বলল,
‘ শালা মহা শয়তান,জেগে থাকলে মেয়েটাকে ধমকায়,আর জ্ঞান হারালে চুমু খায়?’
পুষ্প ‘ধ্যাত’বলে চোখ থেকে ইকবালের হাতটা নামিয়ে দিলো। বলল,
‘ আর কিছু দেখার দরকার নেই। পিউয়ের কাছে যাব আমি।’
‘ আচ্ছা,আচ্ছা।’
ইকবাল তাকে নিয়ে সিড়িতে নামল। গলা ঝাড়ল । কণ্ঠ উঁচু করে বলল,
‘ ধূসর,হয়েছে কী,খাবারটা একটু পরে দিয়ে যাবে।’
সাথে ধুপধাপ পায়ের শব্দ করল। বোঝাল তারা আসছে। ধূসর চটজলদি ঠোঁট সরাল পিউয়ের গাল থেকে। চোখ-মুখ স্বাভাবিক করল। ইকবাল-পুষ্প কিছুই হয়নি এমন ভাণ করে রুফটপের আঙিনায় আসে। পিউকে অচেতন দেখেই উদ্বীগ্ন কণ্ঠে শুধায়,
‘ একী, পিউপিউয়ের কী হয়েছে? কী করেছিস তুই ওকে?’
পুষ্প কনুই দিয়ে পেটে গুঁতো দিতেই, থতমত খেয়ে শুধরে বলল,
‘ না মানে, কী বলেছিস তুই ওকে?’
ধূসর ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ যা বলতে বলেছিলি,তাই।’
ইকবাল দাঁত চেপে ভাবল,
‘ মিথ্যে বলিস না হতচ্ছাড়া,একদম মিথ্যে বলিস না। সব শুনেছি আমি। ফাজিলের সর্দার, যা শিখিয়েছি একটা অক্ষরও তো বলিসনি। ‘
পুষ্পর ধ্যান-জ্ঞান সব পিউয়ের ওপর। সে চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
‘ ভাইয়া এখন কী হবে? পিউয়ের জ্ঞান ফেরাতে হবে তো। ওর কী শরীর খারাপ করল না কী!’
‘ কিছু হয়নি।
আমি ওকে রুমে রেখে আসছি। তোরা খাবার ওখানে দিতে বলিস।’
ওরা মাথা দোলাল। ধূসর জ্ঞান-হীন পিউকে পাঁজাকোলে তুলে নেয়।
পুষ্প যত্র ইকবালের বাহু ধরে বলল,
‘ আমার বোনের কিছু হবে না তো?’
ইকবাল হাসল। ওর দুগাল ধরে বলল,
‘ সামান্য কারণে এত ভয় পেতে নেই মাই লাভ! মাঝেমধ্যে এরকম হয়। স্নায়ুতন্ত্র অনাকাঙ্ক্ষিত, অবিশ্বাস্য কিছু পেলে তৎক্ষনাৎ গ্রহণ করতে পারেনা। ভয় পেলে,আঘাত পেলে মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়না? এই বিষয়টাও ঠিক সেরকম। পিউয়ের তিন বছরের অপেক্ষার ফল আজ এইভাবে ওর কাছে আসায়,ওকটু ওভারডোজ হয়ে পরেছে। এতে আহামরি চিন্তার কিছু নেই। বুঝলে?’
পুষ্প বুঝতে পেরেছে,ভঙিতে মাথা ঝাঁকাল।
‘ এখানকার সব কিছু নিয়ে নীচে এসো। আমি ধূসরকে দরজা খুলে দিই গিয়ে।’
ধূসর পিউকে নিয়ে ওর কামড়াতেই এসেছে। এখন মধ্যরাত। আবার চোখ খুলে নিজেকে একা রুমে দেখে ভয় না পায় তাই! কুকুর ডাকার আওয়াজ আজকেও তো কম নেই।
পিউকে শুইয়ে দিয়ে,এসি বাড়িয়ে কম্বল টেনে দিতে গেল। কিন্তু মাঝ-রাস্তায় এসে থামল তার হাত। পিউয়ের প্রসুপ্ত চেহারার দিক অভিনিবিষ্টের মত চেয়ে থাকল।
মনে পড়ল আজ দুপুরের কথা। দোকানে গিয়ে সে নিজে বেছে বেছে এই শাড়িটা কিনেছে। প্রত্যেকটা শাড়িতে পিউকে কল্পনা করেছে। কিন্তু যখন এটা হাতে নিলো, কল্পিত পিউয়ের ললিত মুখখানির শোভা হুড়মুড় করে চারগুন বেড়ে যায়। আর এক দণ্ড না ভেবেই শাড়িটা নিয়ে এসেছে ধূসর। আর দ্যাখো,তার ওই ক্ষণকালের অনুমানের চাইতেও মারাত্মক লাগছে মেয়েটাকে! যেন কালোর বেশে ঘুমিয়ে থাকা, এক শুভ্র -প্রতীমার মত মায়াবী হুর।
ধূসর কম্বল পিউয়ের বুক সমান টেনে দিলো। মাথায় হাত বোলাল। কান্নার দমকে লেপ্টে যাওয়া কাজল চোখের মেয়েটিকে পরোখ করল নিপুণ কৌশলে। পরপর, পরিপূর্ণ, প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল,
‘ দূর্বোধ্য হৃদয়ের যে স্থানে দূর্গের মত কঠিন দেয়াল ছিল, সেই দেয়াল ভেঙে এত অনায়াসে কী করে ঢুকে গেলি পিউ? হৃদয়ের চৈত্রের তাপদাহে জলসিক্ততা হারানো মরুভূমির আঙিনায় এক পশলা বৃষ্টি হয়ে কেন নেমে এলি? এখন,সারাজীবন এই কঠোর, নির্লিপ্ত, আনরোমান্টিক মানুষটাকে সহ্য করতে পারবি? পারবি তার পাথুরে হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে রাখা প্রচন্ড, অথচ অপ্রকাশিত ভালোবাসাটাকে মেনে নিতে?’
ধূসর বেশ অনেকক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। যাওয়ার আগে পিউয়ের তুলতুলে হাত মুঠোয় তুলে উল্টোপাশে ঠোঁট ছোঁয়াল।
দরজা আটকানোর শব্দ পেতেই, পিউ এপাশ ফিরে শুলো। বালিশ টাকে শক্ত করে খামচে, শরীর গুটিয়ে নিলো আরো। বিজয়ের ছলছলে, রিনিঝিনি হাস্যে মেতে উঠল ওষ্ঠপুট। নিশছিদ্র আষ্ঠেপৃষ্ঠে বন্দী হয় ভালোবাসার জালে। এই জাল যে স্বয়ং ধূসর ভাইয়ের বোনা,আর তার বহু সাধনার ।
ধূসরের ছুঁয়ে যাওয়া কপোলে হাত ছোঁয়াল পিউ৷ বক্ষস্পন্দন দ্বিগুন হলো আরো। সেও তেমনি করে আওড়াল,
‘আপনার এক ফোঁটা ভালোবাসা,আমার বাগিচার সমস্ত নেতিয়ে পরা ফুল জীবিত করতে যথেষ্ট ধূসর ভাই৷ আপনি যেমন,তেমন রূপেই আপনাকে চাই আমার। আপনার একটু স্পর্শ, একটু ফিরে তাকানো,ওই অগাধ স্বরের একটা কথাই যে আমার এক সমুদ্র প্রেমে শীতলতার আস্বাদন। ‘
পিউয়ের মানস্পটে ছবির ন্যায় ছাদের চিত্রপট ভাসে। মস্তিষ্ক নুইয়ে পরে সৃষ্টিকর্তার নিকট কৃতজ্ঞতার ভারে। দুচোখ বুজে,প্রাণ ভরে শুকরিয়া আদায় করল সে। অবশেষে ধূসর ভাই মনের কথা জানালেন। বউ বানাবেন ওকে? ধূসর ভাইয়ের বউ? শব্দটুকু ভাবলেও পিউয়ের বুক কাঁপে শিহরণে।
তার জ্ঞান লিফটেই ফিরেছিল। ইচ্ছে করে চোখ খোলেনি। তাকালেই তো সম্মুখীন হোতো দুটো ঈগল চোখের। তখন কীভাবে তাকাতো সে? কী করে মুখোমুখি হতো এই লজ্জ্বার, এই মিষ্টি যন্ত্রনার? পিউ চোখ বুজল। হঠাৎই প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে! কী আশ্চর্য, এতদিন যেই আশায় বুক বেধে বিনিদ্র কাটিয়েছে প্রতিটা রাত,আজ তা পেতেই আঁখিজোড়ায় রাজ্যের ঘুম নামছে?
_____
‘ স্যার,এনিথিং রং? আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?’
পুরুষালী স্বরে চোখ মেলল সাদিফ। কার্নিশ বেয়ে ফ্লোর ছুঁলো জল। ব্যস্ত হাতে মুছে উঠে বসল। চশমা ভাঙায় ঝাপ্সা দেখছে কিছুটা। তবে মুখের আঁদল পরিচিত ঠেকল। ওহ,রিসেপশনিস্ট ছেলেটা!
সাদিফ উঠে বসে। জবাব দেয়,
‘ আম অলরাইট!’
‘ আপনার ফ্যামিলিকে পাননি?’
সাদিফ মাথা তোলে। বলার মত কিছু খুঁজে পায়না। এই মুহুর্তে কথা বলারও আগ্রহ হচ্ছে না তার। আবার না বললেও বিপদ। সন্দেহ করতে কতক্ষণ! বলল,
‘ পেয়েছি। ‘
লোকটার ভেতর খচখচ শুরু হলো। ইনি সত্যিই ওই গেস্টদের পরিচিত তো? উল্টোপালটা কিছু ঘটলে কর্তৃপক্ষের নিকটা তাকেই জবাবদিহি করতে হবে। আগ্রহভরে শুধাল,
‘ তাহলে এখানে শুয়েছিলেন কেন? ওনারা তো রুমে চলে এসেছেন স্যার। মাত্র খাবার দিয়ে আসা হলো সেখানে।’
সাদিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
‘ আমার কাজ হয়ে গেছে মিস্টার…. ‘
‘ রুরাদ স্যার।’
‘ মিস্টার রুরাদ,আমি যেজন্যে এসেছিলাম সেটা শেষ। ক্লান্ত লাগছিল,আবার আপনাদের হোটেলের এই জায়গাটা ভালো, তাই এখানে এসে সময় কাটাচ্ছিলাম। এতে সন্দেহ করার মত কিছু হয়নি।’
রুরাদ লজ্জা পেলো। ভেতরের সন্দেহ ধামাচাপা দিয়ে হেসে ব্যতিব্যস্ত ভাবে জানাতে গেল,
‘ না না স্যার,আমিতো এমনি…’
সাদিফ কথা কেড়ে বলল,
‘ ছাড়ুন ওসব। আমার একটা উপকার করবেন?’
বড় কাতর তার কণ্ঠ। রুরাদ বলল,’ জি, নিশ্চয়ই, বলুন।’
‘ আমি যে এখানে এসেছিলাম,ওরা যেন না জানে।’
রুরাদ বিভ্রান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ কেন স্যার? ওনারাতো আপনার নিজের লোক তাইনা?
সাদিফ মাথা ঝাঁকাল। বোঝাল হ্যাঁ। কিন্তু তার চোখেমুখে পরিষ্কার বেদনার ছাপ। রুরাদ লোকটি কী বুঝলেন কে জানে! তিনি আর প্রশ্ন করলেন না। কথাও বাড়ালেন না। তবে তখন,কানে এলো সাদিফের কিছু বুলি, যা থেকে নিঙরে আসে সূক্ষ্ণ ব্যথার আঁচ।
‘ তোকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছিলাম,অথচ তোর দেয়া জীবনের সবচাইতে বড় সারপ্রাইজটা নিয়েই ফিরে যাচ্ছি পিউ। ‘
__________
পিউ গভীর ঘুমে তলিয়ে। পুষ্প এসে ডেকে তুলল। শাড়ি পালটে,মেক আপ উঠিয়ে একেবারে খাইয়ে দিয়ে ঘরে গেল নিজের। পুরোটা সময় পিউ টলেছে। পুষ্প বিস্মিত না হয়ে পারল না! এরকম একটা দিনে একটা মেয়ে এত ঘুমায় কী করে? ইকবাল যেদিন তাকে এক্সেপ্ট করল,তারতো গোটা সপ্তাহ, উত্তেজনায় ঘুম আসেনি। পিউটা যে কী!
পিউ গুটিশুটি মেরে কোলবালিশ জড়িয়ে আবার ঘুমোয়। এর মাঝে ধূসরের মুখখানি আর দ্যাখা হয়নি। যখন চোখ খুলল,তখন কাকভোর। চারপাশে ঠিকঠাক আলোও ফোটেনি। অথচ ফোন বাজছিল সমানে। শব্দে ডিভানে ঘুমানো ধূসর ও নড়েচড়ে ওঠে। ঘুমে ব্যাঘায় পাওয়ায়,কপালে ভেসে ওঠে ভাঁজ।
ফোন বালিশের নীচে ছিল। ভাইব্রেটের শব্দ বিদ্যুৎ গতিতে কানে পৌঁছাল পিউয়ের। ধূসরের ঘুম না ভাঙে,তাই তড়িঘড়ি করে ফোন সাইলেন্ট করল। স্ক্রিনে বাবার নম্বর দেখে উজ্জ্বল হাসল সে। রিসিভ করতেই আমজাদ হৈহৈ কণ্ঠে বললেন,
‘ শুভ জন্মদিন আমার ছোট মা। খুব সুখী হও জীবনে। ‘
পিউ আহ্লাদে গলে পরল৷ সচেতন ভাবে ফিসফিস করে বলল,
‘থ্যাংক ইউ আব্বু।’
আমজাদ আরো কিছু বলবেন,অথচ হা করার আগেই ফোন ছো মেরে নিলেন মিনা। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালেন। একে একে ওই একটা ফোন থেকেই প্রত্যেকে তাকে উইশ করল। আমজাদ আর ভাগেই পেলেন না। বারবার বলছিলেন,
‘ আরে তোমরা ফোন করোনা! আমার মেয়ের সাথে আমায় কথা বলতে দাও।’
কেউ কথা কানেই তুলল না। সবাই ব্যস্ত আলাপে।
‘ধন্যবাদ ‘দিতে দিতে পিউয়ের হাঁপিয়ে যাওয়ার অবস্থাপ্রায় । ধূসর বিরক্ত না হয়,তাই আস্তে আস্তে কথা বলছে সে। পিউ সবার সাথে কথা শেষ করতে করতে আলোয় আলোয় প্রকৃতি ভরল।
ফোন রাখতে যাবে এর মধ্যে আবার রিংটোন বাজে। আজমল কল দিয়েছেন। গত দুদিন হলো রাঙামাটি ফিরেছেন তিনি। পিউ রিসিভ করলে সেও লম্বা একটা শুভেচ্ছা জানাল। জিজ্ঞেস করল,কী চাই?’
পিউ জানাল, ‘ তুমি পরেরবার এলে নেব।’
পরিবারের সবার সাথে আলাপ শেষে বুক ভরে শ্বাস নিলো সে। একটা মেয়ে ঠিক কতটা ভাগ্যবতী হলে,ওমন একটা পরিবার পায়? পায় ধূসর ভাইয়ের মত একজন ভালোবাসার মানুষ?
ফোন পাশে রেখে আড়চোখে ডিভানের দিক চাইল পিউ। ধূসর টানটান হয়ে ঘুমিয়ে সেখানে। শুধু মাথাটা ঘোরানো ফোমের দিক। পিউ নিঃশব্দে বিছানা থেকে নামল। পা টিপে এগোলো ওদিকে। ধূসরের মাথার কাছে ফ্লোরে বাবু হয়ে বসল। তারপর গালে হাত দিয়ে চেয়ে রইল তার তামাটে মুখমন্ডলে।
ফেলে আসা তিন বছরে এই চোখ, এই নাক,এই ঠোঁট,এই গোটা মুখের গড়ন মুখস্থ করে ফেলেছে সে। যদি কি বলে,চোখে কাপড় বেধে ধূসর ভাইকে আঁকতে হবে, নিঃসন্দেহে জয়ী হবে পিউ।
আচমকা ধূসর চোখ মেলল। গভীর দুই লোঁচন প্রকট করে তাকাল পিউয়ের দিকে। হঠাৎ এইভাবে ওকে এত কাছে দেখে একটু চমকেছে। তবে সামলেছেও দ্রুত।
হঠাৎ এইভাবে তাকানোয়, পিউ ঘাবড়ে হেলে গেল পেছনে। ধূসরের ভ্রুয়ের মাঝে গাঢ় ভাঁজ পরল। গম্ভীর গলায় শুধাল,,
‘ আমাকে দেখা ছাড়া তোর আর কাজ নেই?’
পিউ থতমত খায়। জ্বিভে ঠোঁট ভেজায়। কী বলবে বুঝে উঠল না! তাড়াহুড়ো করে উঠে, ছুটে বেরিয়ে গেল নিজের রুমের উদ্দ্যেশ্যে। ফোনটাও নিলোনা।
ধূসর বোকার মত কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল দোরের দিক। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসল। কালকের পরেও,এই মেয়ের ওকে এত ভয়?
______
সাদিফ যখন বাড়ি ফিরল তখন চারপাশ নিস্তব্ধ। শুধু বসার ঘরের আলো জ্বলছে। বাকী সব অন্ধকার। কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি হয়ত। সে চুপচাপ নিজের ঘরে যায়,দরজা আটকে দেয়।
জবা বেগম ঠিকই টের পেয়েছেন। কিছু লাগে কী না,জিজ্ঞেস করতে পেছন পেছন এলেন,তার আগেই দরজা আটকাতে দেখে থমকালেন। ছেলে ক্লান্ত ভেবে আবার ফিরে গেলেন না ডেকে।
সেই ভোর থেকে দুপুর গড়াল,সাদিফ নীচে নামেনি। সুইচড অফ ফোনে কোনও কল ঢোকেনি। রাদিফকে ডাকতে পাঠালেও, সে আসেনি। শেষে চিন্তিত হয়ে পড়লেন সকলে। জবা নিজেই খাবার গুছিয়ে উঠে এলেন তিন তলায়।
রাদিফ ডেকে যাওয়ার পর আর উঠে দরজা লাগায়নি সাদিফ।
জবা ভেতরে ঢুকে,খাবারের প্লেট টেবিলে রাখলেন। সাদিফ উপুড় হয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে। গায়ে তখনকার সেই প্যান্ট,শার্টটাই। জবা বেগম কপাল কোঁচকালেন। অবাক লাগছে ওনার। এত গোছানো ছেলে, এত পরিপাটি,নিট এন্ড ক্লিন ছেলে সাদিফ, অথচ জার্নি করে এসেও জামাকাপড় ছাড়েনি আজ? ওতো সকালে রেখে যাওয়া গেঞ্জিটাও অফিস থেকে পরেনা। শরীরটা কি একটু বেশিই কাহিল?
তিনি এসে ওর মাথার কাছে বসলেন। আস্তে করে ডাকলেন,
‘ সাদিফ! খাবিনা বাবা?’
সাদিফ মাথা তুলল না। নড়লওনা। জবা আবার ডাকলেন। বেশ কয়েকবার ডাকার পর সাদিফ ভ্রু কুঁচকে চায়। চোখেমুখে ঘুমানোর রেশের বদলে দেখা যায় বিরক্তি। ভাঙা কণ্ঠে শুধায়,
‘ তোমাদের সমস্যাটা কী আম্মু,একটা মানুষকে একটু শান্তি দিতেও এত কষ্ট তোমাদের? একটা দিন বাড়িতে নিজের মত কাটাব তারও উপায় নেই?’
জবা বেগম ভেতর ভেতর আহত হলেন। পরমুহূর্তে সাফাই দেয়ার ভঙিতে বললেন,
‘ তুই না খেয়ে আছিস বলেই…’
সাদিফ কথা কেড়ে নিলো। উঠে বসল। তপ্ত কণ্ঠে বলল,
‘ এক বেলা না খেয়ে থাকলে আমি মরে যাব না। তোমরা এত ডাকাডাকি না করে আমায় প্লিজ একা থাকতে দাও। এত আহ্লাদ আমার সহ্য হচ্ছেনা। ‘
জবা বেগম হতবাক হয়ে পরলেন। প্রথম বার সাদিফ তার সাথে উচু গলায় কথা বলল। চোখ ছলছল করে উঠল ওনার।
নিঃশব্দে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
খাবার পরে রইল টেবিলে। সাদিফ মায়ের যাওয়ার দিক অসহায় চোখে তাকায়। তারপর স্বহস্তে মাথার চুল খামচে ধরে। শ্রান্ত ভঙিতে পিঠ এলিয়ে দেয় দেয়ালে।
বারান্দার গ্রিল গলে চোখ যায় দূরে। সেই সূর্যের উজ্জল রশ্মির দিক চেয়ে আওড়ায়,
‘ তোকে ভালোবাসা আমি কোনও দিন বন্ধ করব না পিউ। তবে বন্ধ করব, এই ভালোবাসা তোকে বোঝাতে চাওয়ার চেষ্টাটুকু। ‘
______
ইকবাল হাসছে। একবার পিউকে দেখে,আরেকবার ধূসরকে দেখে। যতবার ওর দিক চোখ পড়ছে,তার সাদা দাঁত দেখতে পাচ্ছে ওরা। পিউ কয়েকবার জিজ্ঞেস করল,
‘কী হয়েছে? হাসছেন কেন?’
ছেলেটা দুপাশে মাথা নাড়ে তখন। কিছু বলেনা,শুধু হাসে। পিউ শেষমেষ হাল ছাড়লো। আর জিজ্ঞেস করবেনা সিদ্ধান্ত নিলো। ওতো আর জানেনা,গতকাল তার আর ধূসরের সমস্ত কাণ্ডকারখানা মনে করেই হাসছে ইকবাল। ধূসরের সামনেও বারবার একী কাজ করলে, সে রে*গেমেগে বলল,
‘ গাধার মত হাসবিনা।’
ইকবাল যুক্তিবিদের মত বলল,
‘ তোর মত জ্ঞানীর কাছে এরকম ভুলভাল কথা আশা করা যায়না ধূসর! গাধারা কিন্তু কখনও হাসেনা। ‘
এদিক থেকে স্ট্রং হলো পুষ্প। সে সম্পূর্ন স্বাভাবিক। তার চেহারার ভাবগতি আগেও যেমন ছিল,এখনও তাই। যেন জানেইনা কিছু।
কেবল সকালের নাস্তা সেড়েছে চারজন। আর সেই নাস্তার টেবিলেই ইকবাল গমগমে গলায় জানাল,
‘ আজকের সম্পূর্ন দিন পিউয়ের মন মতো হবে। মানে ও যা চাইবে,যেখানে যেতে চাইবে তাই তাই হবে।’
পিউ এতক্ষণ গুটিয়ে ছিল। ধূসর পাশে বলেই। মানুষটাকে দেখলেই গতকালকের সব কথা মনে পড়ে। লজ্জা লাগে!
অথচ এই ঘোষণায়, মুহুর্তে লাফিয়ে ওঠে। প্রশ্ন ছাড়াই বায়না ছোড়ে, প্রথম দিনের মত ট্রলার করে ঘুরবে।
ধূসর মানা করতে গিয়েও করল না। তবে নাক চোখ কুঁচকে ওর দিক চেয়ে ছিল কিছুক্ষণ। সেদিন ভ*য়ে আধম*রা হয়ে যাচ্ছিল,এরপরেও এই মেয়ের শিক্ষা হয়নি?
পিউ স্লিপার খুলে হাতে নিয়েছে। সে আর পুষ্প হাঁটছে পাশাপাশি। ইকবাল-ধূসর গিয়েছে ট্রলার ঠিক করতে। পিউকে জুতো খুলতে দেখেই পুষ্প বলল,
‘ বালুর মধ্যে অনেক কিছু থাকে, কা*মড়াবে কিন্তু। ‘
‘ কিছু হবে না।’
‘ তুই বললেই হলো? শামুক আছে, অনেক ধাঁরাল! পা কা*টবে। জুতো পর।’
পিউ ঠোঁট উলটে বলল,
‘ একটু হাঁটিনা খালি পায়ে! আরাম লাগছে।’
পুষ্প ঝামটি মেরে বলল
‘ যা মন চায় তাই কর। একটা কথাও শুনিস না। এরপর আ*ছাড় খেয়ে পর শুধু, দেখিস কী কর…….’
কথা ভালো করে ফুটলও না,এর আগে পুষ্প নিজেই জুতোয় বেধে পরে গেল।
সারা শাড়ি বালুতে মেখে একাকার হলো ওমনি। পিউ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছিল। পরপর হু হা করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে পেট চেপে নুইয়ে পরল। পুষ্প ব্য*থা পায়নি,তবে দুহাত আর তার নতুন শাড়ির পাড়ে বালু ভরাতে ভীষণ দুঃ*খ পেয়েছে! সাজগোজ উঠে যাওয়ার ক*ষ্ট তো আছেই। বালুমাখা কাপড়চোপড় দেখে নাক সিটকাল সে।
পিউ হাসতে হাসতে, টেনে টেনে বলল,
‘ এইজন্যেই কবি বলিয়াছেন, অপরের জন্য গর্ত খু*ড়িলে, সেথা নিজেকেই পড়িতে হয়।’
পুষ্প ধম*ক দিলো,
‘ চুপ কর। হাসি থামিয়ে আমাকে তোল।’
ধূসরের ফোন এলে,একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল সে। আশেপাশের ট্রলারের ইঞ্জিনের শব্দে তেমন পরিষ্কার আওয়াজ পাচ্ছিল না সেখানে।
পুষ্প সমুদ্রের লবণ পানি দিয়েই হাত পা যতটা পারল ধুঁয়েছে।
ধূসরকে দেখেই পিউ ছুটতে ছুটতে তার কাছে এলো। পুষ্প পেছন থেকে সাবধান করল,
‘ পিউ, খবরদার কাউকে বলবি না। ‘
কে শোনে কার কথা! পিউ দৌড়ে ওর কাছে এসে থামে। ধূসর কথা শেষ করে পিঠ ফিরিয়ে তাকায়। পিউয়ের আঁদোল দীপ্তিময়। গোলাপি ঠোঁটের চারপাশে স্ফূর্তি। এসেই বলল,
‘ ধূসর ভাই, জানেন কী হয়েছে?’
ধূসরের চেহারায় অতটা কৌতুহল দেখা গেল না। সমুদ্র থেকে ছুটে আসা বাতাসে পিউয়ের খোলা চুল নাকেমুখে পরছিল। সে আলগোছে সেগুলো কানের পাশে গুঁজে দেয়। শান্ত ভাবে শুধায়,
‘ কী হয়েছে?’
পিউ যতটা উচ্ছ্বসিত মনে বলতে এসেছিল,নিমিষেই মিইয়ে গেল তা। এই যে ধূসর ছুঁলো, আবার কেমন করে চেয়ে আছে,এতেই মুখে তালা ঝুলল তার। পুষ্প বুঝতে পেরে মিটিমিটি হাসে। বিড়বিড় করে বলে,
‘ হয়েছে ওর বলা!’
এর মধ্যে ইকবাল এগিয়ে আসে। ট্রলার মালিকের সাথে করে আসা দর-দামের ব্যাপারে জানায়। পিউ যদি আবার তার আ*ছাড় খাওয়ার কথাটা বলতে নেয়,সেই আত*ঙ্কে ওর হাত টেনে নিয়ে গেল পুষ্প। বলল,’ চল ওদিকে যাই।’
ইকবাল মাথা চুল্কাতে চুল্কাতে
শুধাল,’ কী রে যাবি? ব্যাটাতো প্রথম দিনের থেকেও চারগুন বেশি দাম চাইছে । আর ওটা ছাড়া জাতের ট্রলারও দেখছিনা। আজ যা আছে সব ভাঙা*চোরা। যদি পানি ওঠে,ডু*বে যায়?’
ধূসর নির্লিপ্ত। সে ঠোঁট কা*মড়ে অন্য কথা ভাবছে। চিন্তিত ভঙিতে ঘাড় ঘষছে হাতে। ইকবাল নিজের মত বকবক করে থামল। ওপাশ থেকে উত্তরের আশায় তাকাল। ধূসরের মুখবিবর নিরীক্ষণ করে বলল,
‘ কিছু হয়েছে?’
‘ সোহেল ফোন করেছিল।’
ইকবালের চেহারায় উদ্বেগ এলো তৎক্ষনাৎ।
‘ কী বলল?’
‘ আশরাকের দলবল পার্লামেন্টের গেটে এসে ভা*ঙচূড় করেছে। শা*সিয়ে গিয়েছে ওদের। নির্বাচনের দিন জান নিয়ে ফিরতে দেবেনা, আরো কত কী!।’
ইকবাল চোয়াল ফুটিয়ে বলল
‘ কত বড় কু**রবাচ্চা! আমরা নেই টের পেয়েই এসেছিল। ‘
‘ সোহেল ঘাবড়ে আছে। খলিল ভাই বললেন ইমিডিয়েট আমাদের ওখানে যেতে। মিটিং বসাবেন। আর সাতটা দিনও কিন্তু বাকী নেই।’
‘ তাহলে চল আজই রওনা করব।’
পরমুহূর্তে নিভে গিয়ে বলল,
‘ কিন্তু…. আজ যে পিউয়ের জন্মদিন! কত বড় মুখ করে বললাম আজ সব ওর মন মত করব,তার কী হবে? ওতো ক*ষ্ট পাবে! ‘
ধূসর চোখ সরু করে দূরে তাকাল। পিউ আর পুষ্প সমুদ্রের ঢেউ একে অন্যের গায়ে ছেটাচ্ছে। খিলখিল করে হাসছে দুজন। সেখানে আরো দশাধিক মানুষ! সবাইকে ছাপিয়ে ছোট্ট মেয়েটির ওপর নজর পরে রইল তার। বলল,
‘ পিউকে আমি চিনি। সব শুনলে ও নিজেই রাজি হবে। তাও একবার বলে দ্যাখ।’
‘ বলব?’
‘ বল।’
ইকবাল ঘুরে তাকাল। মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে, ধূসরকে ফেলে ওদের দিক হেঁটে গেল। থমথমে চেহারা তার। কাছে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে খেয়াল করতেই, পিউ-পুষ্পর হৈ-হুল্লোড় থামল। হাসি কমল। দুজন তটস্থ চোখে একে অন্যকে দেখল একবার। পুষ্প শুধাল,
‘ কিছু হয়েছে ইকবাল?’
‘ একটা ঝামেলায় পরেছি মাই লাভ!’
পিউ উদগ্রীব হয়ে বলল,
‘ কী ঝামেলা ভাইয়া?’
ইকবাল মায়া মায়া নেত্রে পিউকে দ্যাখে। তার এখনি, এখান থেকে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। ম*রার বিপদটা আজই আসতে হলো? ধূসর যতই বলুক, সে জানে মেয়েটা সব শুনলে দুঃ*খ পাবে। বাচ্চা মেয়ে কি আর এত লজিক বুঝবে? প্রেমিকাদের মন বড়ই নাছোড়বান্দা! এরা প্রেমিকার ব্যস্ততা কে সতীন ভাবে সতীন। এসব তো আর ধূসরের নারকেল মাথায় ঢুকবে না।
সে ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে বলল,
‘ আমাদের পার্লামেন্টে বিপক্ষ দলের লোকজন এসে ভাঙ*চুড় করেছে। হুমকি দিয়েছে। আমি আর ধূসর সেখানে নেইত,ভ*য় পেয়ে আছে ওরা। খলিল ভাই মিটিং ডাকবেন কাল,ফোন দিচ্ছেন। ‘
ততক্ষনে ধূসর এসে পাশে দাঁড়াল ওর। ইকবাল বিরতি নিতেই পিউ চক্ষু প্রকট করে বলল,
‘ সেকী! তাহলে তো আপনাদের এখন ওখানে থাকা দরকার।’
‘ হ্যাঁ, কিন্তু আমাদের ফেরার কথা পরশু। আবার আজ যে তোমার জন্মদিন! এখন চলে গেলে তোমার মন খারাপ হবে না পিউপিউ?’
পিউ আশ্চর্য বনে বলল,
‘ মন খারাপ করব কেন? আমার জন্মদিন তো প্রতিবছর আসবে। কিন্তু আপনাদের নির্বাচন আসবে পাঁচ বছরে একবার। এটা নিয়ে আপনি, ধূসর ভাই কত খেঁটেছেন! এটাইত সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তাইনা? আপনারা আমার জন্মদিন নিয়ে একদম ভাববেন না তো ভাইয়া। চলুন, আমরা এক্ষুনি গিয়ে হোটেল থেকে চেক আউট করে ফেলি।’
‘ আপু চল,গোছগাছ করি গিয়ে।’
পুষ্পকে বিস্মিত দেখা গেল না। সেও মাথা দুলিয়ে পিউয়ের সাথে হাঁটা ধরল।
ইকবাল বিমূর্ত হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখল ওদের। তারপর ধূসরের দিক তাকাল। সে হাসছে, বাঁকা, শোধিত,বিজয়ের হাসি।
পরপর ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘ বলেছিলাম?’
ইকবাল শ্বাস ঝাড়ল।
‘ মানতে হবে ভাই,এত ছোট মেয়ের এমন ম্যাচুরিটি আমি দেখিনি!
তোর মত টিনের দোকানদার এমন হীরে পাচ্ছিস বলে কংগ্রাচুলেশন!’
ধূসর চোখ রাঙাতেই ইকবাল হেসে ফেলল। পরপর হাসল সেও।
ইকবালকে পেছনে রেখে দুপা সামনে এলো। পিউয়ের যাওয়ার দিক চেয়ে বলল,
‘ পিউয়ের প্রতিটি রন্ধ্র আমার চেনা,জানা পরিচিত। সিকদার ধূসর মাহতাবের পছন্দ সে,ইটস মাস্ট বি ইউনিক।’
________
জবা বেগম চোখ মুছতে মুছতে নীচে নামলেন। কাউকে কিছু বুঝতে দেবেন না বিধায়,মুখে তৎপর মেকি হাসি ঝোলালেন । অথচ নীচে নামতেই সুমনা বেগম ছুটে এলেন কাছে। আনন্দ চিত্তে বললেন,
‘ শুনছো আপা, কাল ওরা ফিরছে।’
জবা বেগমের অন্তরের মেঘটা মুহুর্তে কে*টে গেল। সদ্য ঝোলানো মিথ্যে হাসি প্রকান্ড হলো। গদগদ হয়ে বললেন,
‘ সে কী, ফোন করেছিল না কী?’
‘ হ্যাঁ, কেবল কথা হলো।’
‘ যাক বাবা,ঘরটা আবার হৈহৈ করবে। ‘
সুমনা ঘাড় নাড়লেন। আচমকা মুখ ভাড় করে বললেন,
‘ দুটোদিন ওরা বাড়িতে নেই বলে আমাদের কত খারাপ লাগছে না আপা? অথচ যখন সারাজীবনের জন্য পরের ঘরে যাবে,কী হবে তখন?’
জবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘ পুষ্পটাকে তো রাখতেই চেয়েছিলাম নিজেদের কাছে। ভাগ্যে ছিল না তাই হয়নি! এখন পিউটাকেও…’
সুমনা মাঝপথেই উচ্চাগ্রহে বলে উঠলেন,
‘ এখন পিউকে আবার সাদিফের বউ করতে চাও নাকি?’
জবা থামলেন। অদ্ভূত,অন্যরকম নজরে চাইলেন। তারপর হঠাৎই কী ভেবে মাথা নেড়ে বললেন,
‘ না বাবা! আমি আর এসব ভাবাভাবির মধ্যে নেই। দেখা গেল,নিজেরা ঠিক করলাম,মেয়ে আবার অন্য কাউকে পছন্দ করে বসে আছে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর চাইনা বাপু!’
_____
পিউ সদর গেট থেকেই মাকে ডাকতে শুরু করল। মেজো মা,সেজো মা,ছোট মা, চিল্লিয়ে সবাইকে ডেকে ডেকে মাথায় তুলল বাড়ি। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে পার হয়েছে ওদের। হূলস্থূল কণ্ঠের ডাক শুনে, প্রত্যেকে ঘর থেকে ছুটে ছুটে বের হলেন। এসেই পিউ,পুষ্পকে জড়িয়ে ধরলেন। যেন কতদিন দেখা হয়না! ওরা বাড়ি ছেড়ে একা একা এতটা দিন কোথাও থাকেনি আগে। ধূসর টুকটাক কথাবার্তা বলল সবার সাথে। তারপর ব্যস্ত পায়ে রুমের দিক এগোলো।
ইকবাল ক্লান্ত ভাবে বসে পরল সোফায়। বলতেও হয়নি,তার চেহারার অবস্থা দেখেই ঠান্ডা শরবত নিয়ে এলেন সুমনা।
পিউ-পুষ্প গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসেছে৷ এতদিন ওখানে, যা যা করেছে সবকিছুর নিপূন বর্ণনা! মিনা বেগম মেয়েদের দেখেই হুতাশ নিয়ে বললেন,
‘ এত কালো হয়ে গেছিস কেন? রোদের মধ্যে বেশি হাঁটতে বারণ করিনি?
পিউ-পুষ্প একে অন্যের দিক চাইল। তারপর হু হা করে হেসে উঠল। আগেই জানতো,মিনা এরকম বলবেন। রাস্তায় মায়ের এই কথাটাই বলতে বলতে আসছিল ওরা।
নিমিষে বাড়িটা ভরে উঠল,হলো প্রানবন্ত। ওরা বাড়ির সবার জন্য টুকিটাকি কেনাকাটা করে এনেছে। রিক্ত আর রাদিফ তাদের খেলার জিনিসপত্র নিয়ে ছুটল ঘরে।
অথচ এদের মধ্যে সাদিফ কোথাও নেই।
পিউ চোখে চোখে অনেকক্ষণ খুঁজেও পেলো না। অদ্ভূত ব্যাপার ছেলেটা ওকে উইশ ও করেনি। না মেসেজে,না কলে। এমনকি প্রতিবার ওর ছবি দিয়ে টাইমলাইনে পোস্ট করে,এবার সেটাও করল নাম ভুলে গিয়েছে হয়ত! কাজের যা চাপ!
পিউ শুধাল,
‘ সাদিফ ভাই কি অফিসে?’
জবা বেগম বললেন,’ না, বাড়িতেই।’
সে অবাক কণ্ঠে বলল,
‘ তাহলে নীচে এলেন না যে! আমরা এসেছি শুনলেতো ঘরে থাকার কথা না।’
মিনা মুখ কালো করে জানালেন,
‘ ওর যেন কী হয়েছে বুঝলি! কাল ফোন করে জানাল,অফিসের কাজে বাইরে যাচ্ছে। ফিরবেনা। ফিরল আজ ফজরের সময়। কিন্তু সেই যে এলো,আর বেরই হয়নি।’
জবা বেগম ভাবলেন,” আমার সাথে চিল্লিয়েও কথা বলেছে আপা, যা কখনও হয়নি। সেটাতো আর বলিনি তোমাদের।’
পিউ সহসা উঠে দাঁড়াল। সাদিফের জন্য কিনে আনা ঘড়িটা হাতে তুলে বলল,
‘ দেখে আসি, তোমাদের ছেলে দরজা দিয়ে কী করছে! ‘
স্ফূর্ত পায়ে ছুটল সে। পুষ্প নিজের ঘরে গেল কাপড় ছাড়তে। ইকবাল চলল তার পেছনে। সে আর ধূসর একটু বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পরবে। পার্লামেন্ট এর অবস্থা না দেখা অবধি স্থির হতে পারছে না।
পিউ জোরে জোরে দরজা ধা*ক্কাচ্ছে। শব্দে ছাদ ভে*ঙে পরার অবস্থা। প্রথমে ভদ্রতার সহিত ধা*ক্কালেও সাদিফ সাড়াশব্দ দেয়নি।
এই জোড়াল শব্দে বিরক্ত হলো সাদিফ। রীতিমতো তুঙ্গে উঠল মেজাজ। নেমে এসে শক্ত হাতে দরজা খুলল। কঠোর ভাষা বলতে হা করলেই পিউ দাঁত বের করে বলল,
‘ সারপ্রাইজ! ‘
সাদিফ সত্যিই চমকাল। হিসেব মত ওদের ফেরার কথা কালকের পরদিন। তাহলে আজ? এতক্ষণের বিরক্ত চোখেমুখে বিস্ময় এনে শুধাল,
‘ তুই? ‘
পিউ ভেবেছিল উইশ করা নিয়ে অভিযোগ করবে। কিন্তু সাদিফের অন্য রকম,অগোছালো চেহারা দেখে গিলে ফেলল সে কথা । বলল,
‘ ভেতরে ঢুকতে দেবেন না?’
‘ হ্যাঁ, আয়।’
সে একপাশে সরে দাঁড়াল। পিউ ঢুকতে ঢুকতে শুধাল,
‘ আপনার কি গলা বসে গিয়েছে ভাইয়া? ভা*ঙা ভা*ঙা শোনাচ্ছে কেন?’
সাদিফ ভাবল,
‘ যেখানে মনই ভে*ঙেছে,সেখানে কণ্ঠ আর কী !’
মুখে নিরুত্তর সে। তবে এক ধ্যানে চেয়ে রইল ওর দিকে। পিউ হঠাৎ ঘুরে চাইতেই গলা ঝেড়ে চোখ নামাল। পিউ ঘড়ির বাক্স দেখিয়ে বলল,
‘ এই দেখুন, আপনার জন্যে কী কিনেছি?’
সাদিফের মধ্যে হেলদোল দেখা গেল না। মন ভালো না থাকলে উপহারে কী এসে যায়! নিষ্প্রভ স্বরে শুধাল,
‘ কী?’
‘ কী সেটা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে কীভাবে দেখাব? এদিকে আসুন।’
সাদিফ ফোস করে শ্বাস ফেলে এগিয়ে যায়। মুখোমুখি দাঁড়ায়। পিউ বলল,
‘ হাত দিন।’
‘ হু?’
‘ হাতটা দিন।’
আগে হলে বলা মাত্র সাদিফ হাত বাড়াত। কিন্তু আজ সঙ্কোচে সঙ্কোচে জড়িয়ে গেল অন্তঃপুর। পিউয়ের দিক তাকালেই তার গতকালকের সব চোখে ভাসছে। ভীষণ অস্বস্তিতে বুঁদ হয়ে আসছে দেহ। তবুও পিউয়ের তাগাদায় হাতটা বাড়িয়ে দিলো। পিউ বক্স খুলল। বেরিয়ে এলো সোনালী রঙের দামী ঘড়িটি। এটা ওর পছন্দেই কেনা। তবে, টাকা দিয়েছে ধূসর।
তারপর সাদিফের কব্জিতে রেখে বেল্ট বাধতে বাধতে বলল,
‘ এটা দোকানের ডিস-প্লেতে সাজানো ছিল। কাচের বাইরে থেকে দেখেই ভালো লেগেছে আমার। আপনার হাতে মানাবে বলে ধূসর ভাই কিনে দিলো। ‘
সাদিফ কিছু বলল না। শুষ্ক ঢোক গি*লল শুধু। পিউয়ের মুখে ধূসর ভাইয়ের নাম কেমন বিস্বাদ ঠেকল।
এই যে তার চোখের ভাষা অন্য,ভিন্ন তার চাওয়া। এসব কি পিউ কোনও দিন বোঝেনি?
ওর চোখে-মুখে তো একটু জড়োতা,দ্বিধা কিচ্ছু নেই। কেন নেই? কারণ ও তাকে ভালোবাসে না। ওই টানা টানা চোখে সে কেবল ভাই,বড় ভাই। ওই নেত্রপল্লবের প্রতিটা ঝাপটা পতিত হয় ধূসরের নামে। এই মনোমুগ্ধকর,নির্মল হাসি স্খলিত হয় ধূসরের নামে। ভাগ্যিস, পিউকে কিছু বলা হয়নি কাল। এর আগেও কখনও বলেনি। নাহলে আজ এতটা সহজে পিউ কাছে আসতো? সামান্য বিয়ে ঠিক হওয়াতেই পুষ্পর সঙ্গে,অত সুন্দর সম্পর্কের তালাগোল পাঁকাল। মেয়েটা আগের মত তার চোখের দিক চাইতে পারেনা। অস্বস্তি দেখা যায় সেখানে। আর যদি পিউ জানত,সাদিফ নামের এই মানুষটা তাকে ভালোবাসে,তবে কী হোতো? এই ঘরেই হয়ত পা রাখতো না পিউ। সামনে আসতো কী না সন্দেহ।
সাদিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গতকাল ধূসর পিউয়ের একে অন্যকে জড়িয়ে ধরার দৃশ্য মনে করে ভাবল,
‘ পৃথিবীটা কী অদ্ভূত পিউ ! আমরা একই বাড়িতে থাকব,একই ছাদের নীচে। সামনাসামনি, কাছাকাছি, মুখোমুখি আবার। অথচ আমাদের মধ্য থাকবে আকাশ সমান দূরত্ব। যে আকাশের প্রতিটি মেঘ অসিত , কুচকুচে, শ্রী- হীন হবে। যেই তোকে এত গুলো বছর স্বযত্নে,নিজের হিসেবে কল্পনা করে এলাম, সেই তুই হবি এখন আমার বড় ভাইয়ের বউ। ‘
চলবে,