#নীরবে_তুমি_রবে
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ১৫
.
সকাল পেরিয়ে বেশ অনেকটা সময়। চারদিকে রোদের প্রতিফলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। পর্দা ও থাই গ্লাস ভেদ করে কড়া রোদের আলো পুরো রুম ছড়িয়ে গেছে, সাথে বিছানাও দখল করে ফেলেছে। তবুও নির্দ্ধিধায় ঘুমিয়ে আছে রূপা। এর মাঝে রুমে ঢুকলো তাসফি, রূপাকে এতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকতে দেখে এবার বেশ চিন্তিত হলো। তবুও খুব একটা পাত্তা দিলো না, ভাবলো এখনো হয়তো ঘুমটা ভাঙে নি মেয়েটার।
এক নজর রূপার দিকে তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিলের কাছে এগিয়ে গেল তাসফি। গায়ের শার্ট’টা ইন করতে লাগলো।
ঘড়ির কাটা আট ‘এর ঘর ছাড়িয়ে চলেছে, তাসফির হাত দ্রুত চলছে। ভার্সিটিতে যাবার জন্যই রেডি হচ্ছে সে। এত তাড়াতাড়ি ক্লাস নেই তার, তবুও কোন কারণে যেতে হবে। তাই চটজলদি রেডি হয়ে বেরিয়ে যাবার তারা। নিচে গিয় মা’কে নাস্তার কথা বলতেই তৈরী করে দেয়, জিজ্ঞেস করে রূপার কথা। ঘুমাচ্ছে বলতেই আর কথা বাড়ায় না রেহেনা। ভাবে প্রতিদিন’ই তো তাড়াতাড়ি উঠে, একটা দিন ঘুমাক মেয়েটা।
আবারও বিছানায় থাকা রূপার দিকে তাকালো তাসফি, একহাতে চিরুনি চালিয়ে চুল আঁচড়াতে লাগলো। হঠাৎ হালকা গোঙানির আওয়াজ কানে ভেসে আসতেই হাত থেমে গেল তাসফি। পিছন ঘুরে তাকালো বিছানার দিকে। ভাবলো রূপা হয়তো ঘুমের ঘোরে এমন করাছে। বিশেষ পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজে মন দিলো, কিন্তু বেশিক্ষণ পারলো না। আবারও ভেসে এলো রূপার মৃদু কান্নার আওয়াজ। আর দাঁড়ালো না তাসফি, বিছানার কাছে এগিয়ে এসে হাঁটু গেঁড়ে বসলো। বলে উঠলো,
“এ্যাই রূপা, কি হয়ছে?”
তাসফির কণ্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই নড়েচড়ে উঠলো যেন মেয়েটা। গোঙরানি আওয়াজ বাড়লো কিছুটা। এবার কিছুটা উত্তেজিত হয়ে গেল তাসফি। এক হাত রূপার গালে রাখলো, শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আন্দাজ করতেই যেন অবাক হলো। গালে উষ্ণ ছোঁয়া অনুভব করতেই কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো, মিটমিট করে চোখ মেলে চাইলো রূপা, আবছা চোখে দেখলো তাসফি কে।
“এই রূপা, কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?”
মেয়েটা জবাব দিতে পারলো না যেন। ভিজে উঠলো চোখ দুটো। এই মুহুর্তে ওয়াশরুমে যাওয়াটা বেশ জরুরি, কিন্তু অসহ্য পেট ব্যাথায় উঠতে পারছে না যেন। তবুও তাসফির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে উঠার চেষ্টা করলো। তাসফিও ধরে উঠাতে সাহায্য করতে লাগলো। বলতে লাগলো,
“এ্যাই মেয়ে, শরীর খারাপ লাগছে? কথা বলছো না কেন? গা টাও তো বেশ গরম।”
জবাব দিলো না রূপা। এতক্ষণে তাসফির সাহায্যে উঠে বসেছে, তাকে সরিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টায় আছে। কিন্তু তাসফি তাকে যেতে দিলো না, দু’হাতে ধরে জানতে চাইছে —কেমন লাগছে তার। এবারও জবাব দিলো না রূপা, বরং এক হাতে মুখ চেপে উহু হু করতে লাগলো, সরিয়ে আসতে চাইলো তারফির থেকে। কিন্তু পারলো না। উপায় না পেয়ে মাথা সরিয়ে নিলো তাসফির সামনে থেকে, গড়গড় করে বমি করে দিলো মেঝেতে’ই। তাসফি কে রক্ষা করতে গিয়েও হলো না, শার্টের একাংশে লেপ্টে গেল যেন। তবুও রূপাকে ছাড়লো না তাসফি, বরং আগের চেয়েও অধিক জড়িয়ে নিলো।
দূর্বল শরীর নিয়ে তাসফির বুকে মাথা এলিয়ে দিলো রূপা। সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো তাসফি। হঠাৎ এমন অসুস্থ হয়ে গেল মেয়েটা, সেটা নিয়েই যেন বেশ চিন্তা হলো তার। শরীরের তাপমাত্রাও বেশ। ক্লান্ত শরীরে চোখ বুজে তাসফির বুকে মাথা এলিয়ে আছে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে’ই ধীর কণ্ঠে তাসফি বললো,
“আর বমি হবে?”
মাথা ঝাকালো রূপা, বোঝালো না। তাসফি আবারও জিজ্ঞেস করলো, “ওয়াশরুমে যাবে? জামা তো নষ্ট হয়ে গেছে।”
আবারও হালকা করে মাথা ঝাঁকিয়ে না করলো রূপা। তাসফি বুঝতে পারলো একটু বেশি’ই খারাপ লাগছে তার। বলে উঠলো,
“বেশি’ই খারাপ লাগছে কি?”
“পেট ব্যাথা করছে।”
ধীর গলায় বলতেই আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না তাসফি। বিছানার হতে রূপার ওড়নাটা নিয়ে মুখ থেকে গলাটা মুছে দিলো, জামার অংশ’টাও মুছিয়ে দিয়ে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে শুইয়ে দিলো রূপাকে। বললো না উঠতে, আসছে বলে বেড়িয়ে গেল রুম ছেড়ে। সিঁড়ির কাছে গিয়েই হাক ছেড়ে ডাকলো রেহেনা কে, জলদি করে আসতে বললো উপরে। তারপর রুমে কোন রকমে ফ্লোর পরিষ্কার করতে লাগলো। এর মাঝেই ছেলের ডাক শুনে চলে আসলো রেহেনা। রুমে ঢুকেই জিজ্ঞেস করে উঠলো —কি হয়েছে? তারপরই নজর গেল ফ্লোরে ও বিছানায় থাকা রূপার দিকে। এর মাঝেই রূপার অবস্থানের কথা জানিয়ে দিলো তাসফি। এতক্ষণে রূপার কাছে এগিয়ে এসেছে রেহেনা, তাসফির কথা শুনেই ব্যস্ত হয়ে দেখতে লাগলো রূপাকে। হঠাৎ এমন অসুস্থ হয়ে পড়লো কেন বারংবার বলতে লাগলো। বরাবরের মতেই ফুপির আদর মাখা গলায় আহ্লাদি হয়ে উঠলো রূপা, এক হাতে পেট জড়িয়ে হু হু করে কাঁদতে লাগলো।
ফুপি ভাতিজীর কান্ডে বরাবরের মতোই বিরক্ত হলো তাসফি, তবুও চুপচাপ কোন রকমে ফ্লোর পরিষ্কার করলো। তারপর গায়ের শার্ট’টা খুলতে খুলতে মা ‘কে উদ্দেশ্য করে বললো,
“ওকে ফ্রেশ করিয়ে জামাটা আগে চেঞ্জ করে দাও আম্মু। এভাবে থাকলে কিন্তু আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
বলেই আরেক’টা শার্ট ও মোবাইল’টা নিয়ে রুম ছেড়ে বেড়িয়ে গেল। আজকে আর ভার্সিটিতে যাওয়া হবে না তার, মূলত রূপাকে অসুস্থ অবস্থায় রেখে যেতে মন সায় দিলো না। কাউকে কল দিতে দিতে নিচে নেমে গেল।
সময়ের সাথে সাথে রূপার পেটে ব্যাথা ও জ্বর বেড়েই গেল যেন। কিছু খাইয়ে ওষুধ খাওয়াতে চাইলেই আবারও বমি করে সব বের করে দিলো। এমতাবস্থায় মেয়েটাকে আর বাসায় রাখতে চাইলো না তাসফি, রেহেনা’কে সাথে নিয়ে রূপাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার দেখেই ও সমস্যার কথা জেনে নিয়ে রূপাকে ইনজেকশন ও স্যালাইন দিলো। আধা ঘণ্টা পেরিয়ে যেতেই পেট ব্যাথা কমে আসলো, কিন্তু স্যালাইন চলার কারণে জ্বরের মাত্রা দ্বিগুণ হলো। যাবতীয় পরীক্ষা করে ডাক্তার জানালো —চিন্তার কোন কারণ নেই, ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া না করার ফলে শরীর দূর্বল ও এমনটা হয়েছে। এ্যাসিডিটির ফলে পেট ব্যাথা ও বমি হয়েছে।
সব শুনে খানিকটা স্বস্তি’ই পেল তাসফি। বেশ রাত পর্যন্ত হসপিটালে থেকেই তারপর বাড়ি ফিরতে হলো তাদের।
.
দু’দিন পর সেই জ্বর ছাড়লো রূপার। নিয়মিত ওষুধ খাওয়ার ফলে শরীরের দূর্বলতাও কেটে গেল। এর সবটাই নিয়মমাফিক রুটিন চালিয়ে গেল তাসফি। এই দু’টো দিন ভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়ে রূপার অসুস্থতার জন্যই কাটিয়ে নিলো, সবটাই নিজ হাতে সামলে নিলো। রূপাও যেন আলাদাভাবে আবিষ্কার করলো তাসফি কে। তাকে তাসফি’র সেবা করা, সবসময় তাকে কেয়ার করা, ভালোবেসে যত্ন নেওয়া সবটাই গভীরভাবে নজরে রেখেছে রূপা। ভেবেছে —এগুলো কি শুধুই স্ত্রী’র প্রতি তাসফির দ্বায়িত্ব? পরমুহূর্তেই ভেবেছে —উহুঁ! মোটেও না। কিঞ্চিৎ ভালোবাসা না থাকলে মোটেও এগুলো মন থেকে আসবে না। সে নিজেও তো করতো না। তাহলে কি তাসফি তার মতোই তাকে ভালোবেসে ফেলেছে?
কথাটা ভাবতেই বুকের টিপটিপ শব্দের প্রতিধ্বনি বৃদ্ধি পেল রুপার। হ্যাঁ! সে ভালোবেসে ফেলেছে তাসফি কে, গভীর ভাবে প্রেমে পড়েছে। হয়তো প্রেমে পড়ার সেই অনুভূতি’টা কি তা জানে না, কিন্তু তাসফি নামক টই মানুষ’টাকে এক মুহুর্তও কাছ ছাড়া করতে মন সায় দেয় না। এক মুহুর্ত চোখের সামনে না দেখলে শান্তি পায় না, মনটা ছটফট করতে লাগে যেন। গত দু’দিনে এটা যেন বেড়েই চলেছে রূপার মাঝে, সাথে তাসফি বুকে মাথা রাখার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়েছে।
“এতটাই সুন্দর লাগছে আমাকে? এভাবে তাকিয়ে আছো?”
হুট করে তাসফির বলা কথায় থতমত খেয়ে গেল রূপা। মাথা ঝুকিয়ে নিচের দিকে তাকালো। দু’দিন পর আজকে ভার্সিটিতে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলো তাসফি। রূপাকে খাইয়ে, ওষুধ খাইয়ে বসে ছিলো বিছানায়। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ানো তাসফি’র রেডি হওয়া দেখছিলো, আর ভেবে চলেছিলো তাসফি কে নিয়ে নানান ভাবনা।
সামান্যক্ষণ পর মাথা তুলে তাসফি’র পানে তাকালো রূপা। একটু সময় নিয়ে বলে উঠলো,
“মোটেও না। কখন বললাম সুন্দর লাগছে? বলছিলাম না, ছেলেদের সুন্দর লাগে না।”
“ভালো লাগছে না, বলছো?”
“উহুঁ! তবে এতটাও খারাপ লাগছে না।”
হাসলো তাসফি। চুল’টা দু’হাতে একটু ছুঁইয়ে এগিয়ে এলো বিছানা, রূপার কাছে। ধীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
“তাইলে? কি দেখছো এভাবে?”
“জানি না।”
সহসায় জবাব দিলো রূপা, হেঁসে ফেললো সামান্য। তাসফির ঠোঁটের হাসিটা বজায় রেখেই একটু ঝুঁকে এলো রূপার কাছে। বললো,
“জানো না? না কি বলতে চাও না?”
“দুটোই।”
“আচ্ছাআ! তাহলে আমি বরং নিজেই অনুভব করে নেই।”
বলেই রূপার দিকে আরও ঝুঁকে এলো তাসফি, ঘুচিয়ে দিতে চাইলো মাঝের দুরত্ব। তাসফি কে এতটা কাছে আসতে দেখে গলা শুকিয়ে গেল রূপার, শুঁকনো ঢোক গিললো। আমতা আমতা করে কিছু বলতে গিয়েও আঁটকে গেল তার কথা। এসবের কোন কিছুতেই পাত্তা দিলো না তাসফি, নিজের কাজ’টা মনোযোগ দিয়ে করতে লাগলো। তাসফি’কে নিজের অতি নিকটে আসতে দেখে হঠাৎই চোখ বন্ধ করে ফেললো রূপা, নিশ্বাসের আনাগোনা বেড়ে গেল। মাথায় চলতে লাগলো উল্টাপাল্টা ভাবনা।
কিছু সেকেন্ড অতিক্রম হলেও যখন যখন কোন স্পর্শ অনুভব করলো না রূপা, তখন চোখ মেয়ে তাকালো। তাসফি ‘কে ঠিক একইভাবে ঝুঁকে থাকতে দেখে অবাক হলো। এই মুহুর্তে হেঁসে উঠলো তাসফি। ঠোঁটের হাসিটা বজায় রেখেই,
“কিইইই? এই ছোট্ট মাথায় এত উল্টা পাল্টা ভাবনা আসে কেমনে? হু!”
বলেই সরে আসতে চাইলো তাসফি, কিন্তু পারলো না। হঠাৎই তাসফির বুকের কাছ’টায় শার্ট খামচে ধরলো রূপা। কিঞ্চিৎ পরিমাণও ভয় পেল না, বরং জোরে জোরে নিশ্বাস টেনে বুকে মাথা রাখলো তাসফি’র, অপর হাতে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলো। এই মুহুর্তে তাসফি’কে জড়িয়ে না ধরলে মোটেও শান্তি পেত না সে, শান্ত করতে পারতো না নিজেকে।
রূপার হঠাৎ এমন কান্ডে ব্যাপক আশ্চর্য তাসফি। অবাকের ন্যায় স্থির হয়ে রইলো যেন। এমনটা সে কল্পনাতেও ভাবে নি। নিজেকে স্বাভাবিক করতেই যেন আধা মিনিটের মতো লাগলো তাসফি’র। তারপর অজান্তেই দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো রূপা’কে। ঠিক সে মুহুর্তেই ঘোর লাগা কণ্ঠে ভেসে আসলো রূপার গলা। বলে উঠলো,
“আপনি….. আপনি অনেক বজ্জাত একটা মানুষ, একটু বেশিইইই।”
.
.
চলবে……
তাড়াহুড়ায় লেখা, রি-চেক দেওয়া হয় নি। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন।