#মায়াবতী
#পর্ব_৭
#সুলতানা_পারভীন
বোর্ড রুমে আসা প্রত্যেকটা মানুষ হা করে প্রজেক্টরের দিকে তাকিয়ে আছে। সাউন্ড নেই ফুটেজটাতে। তবুও সবটা সবার কাছে স্পষ্ট। কারো বুঝতে এক দন্ডও দেরি হচ্ছে না ঠিক কি হয়েছিল মায়ার কেবিনে। দ্বীপের নিজে থেকেই মায়ার কেবিনে যাওয়া, কথা কাটাকাটি, দ্বীপের বেরিয়ে যাওয়ার নাটক, ফিরে এসে রুমের দরজা লক করা, মায়ার সাথে জবরদস্তি করা, হাতাহাতি, আর শেষে দ্বীপের মাথায় মায়ার ফুলদানি ভেঙে দরজা খুলে দেয়া এতটুকু পর্যন্ত সবটা সবাই হা করে দেখলো। কেউ একটা কথাও বলতে পারলো না। এমন একটা অমানুষের সাথে একই অফিসে কাজ করছে ভাবতেও মেয়ে স্টাফদের গা শিউরে উঠছে।
এতোক্ষণ সবাইকে কি সুন্দর হাতে রেখেছিল দ্বীপ। জাস্ট একটা ভিডিও ওর সব পর্দা ফাঁশ করে দিলো। এভাবে ধরা খেয়ে যাবে সে একবারও ভাবে নি। আর ওই রুমের সিসিটিভি ফুটেজ রাহাতের কাছে কি করে এলো সেটাও দ্বীপ বুঝতে পারছে না। দুর্বল গলায় কিছু বলার জন্য মুখ খুললো দ্বীপ।
-সব এই মেয়ের কারসাজি–। এই ভিডিও নকল–। কাউকে টাকা দিয়ে করিয়েছে—।
-তাই নাকি মিস্টার দ্বীপ? তা কাকে টাকা দিয়ে এই ভিডিও বের করেছে উনি? আমাকে? কজ এই সিসিটিভি ফুটেজ তো আমার ল্যাপটপ থেকে নেয়া—। দেখছেন না?
-স্যার——-?
-সবার উপরে নজর রাখাটা অফিসের বসের দায়িত্ব–। সিসিটিভি দিয়ে প্রত্যেকটা রুমকে তো নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব–নয় কি? অফিসে কে কি করছে সেটা তো আমার জানার দরকার—-।
-স্যার? আসলে—-।
-আর কত মিথ্যে বলবেন? আপনি জানেন আপনি কি করেছেন–। বাকিদেরও তো জানা দরকার—। ওয়েট—-। মায়া?
রাহাত মায়ার হাত ধরে টেনে সবার সামনে দাঁড় করালো।
-এই মেয়েটাকে দেখুন সবাই–। আজ ওর জায়গায় কিন্তু আপনাদের মধ্যে যে কেউই হতে পারতো–। তাই না? তখন কি করতেন? সিসিটিভি ফুটেজ টা না হয় নকল বলবেন- কিন্তু এই মেয়েটার গায়ের চোটগুলো? দাগ গুলো? এসব মিথ্যে? সব সময় আমরা বলি মেয়েরা হ্যারাসমেন্টের শিকার হয় কজ তারা কিছু বলে না বলে–। আসলে কথাটা মোটেও ঠিক না–। মেয়েরা এই রকম হ্যারাসমেন্টের শিকার হয় আশেপাশের আপনাদের মতো মানুষদের কারণে। যারা মেয়েদের অসম্মানটা দেখেও না দেখার ভান করে। আর উল্টো মেয়েটাকে টিজ করে যে সে পুরুষদেরকে শরীর বিলিয়ে বেড়াচ্ছে—। আপনাদেরকে আর কি বলবো? গার্ডস–উনাকে থানায় দেয়ার ব্যবস্থা করো—-।
গার্ডদেরকে লাস্ট কথাটা বলেই মায়াকে নিয়ে বেরিয়ে এলো রাহাত। একেবারে গাড়িতে বসিয়ে হাত ছেড়েছে মায়ার। মায়াও হা করে এতোক্ষণ ধরে এই মানুষটাকে দেখছিল। মানুষটা অনেকটা রেগে গেছে। তাই সাহস করে কিছু বলতেও পারছে না মায়া। কি বলবে সেটাও ভেবে পাচ্ছে না বেচারি।
-মায়াবতী? বেশি কষ্ট হচ্ছে? ডক্টরের কাছে নিয়ে যাই?
-নাহ—। লাগবে না–। বাসায় যাবো স্যার–।
-হুম—। কিন্তু এভাবে?
-হুম—-। এভাবে বাসায় গেলে মা হয়তো টেনশন করবেন–। কিন্তু কি আর করবো বলুন?
সবই আমার কপাল।
-চুপ—। তুমি চুপ করে বসে থাকো—। আমি ব্যবস্থা করছি—।
-কি ব্যবস্থা——?
রাহাতের লাল চোখের দিকে তাকিয়ে কথাটা আর শেষ করতে পারলো না মায়া। মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো। রাহাত ড্রাইভের ফাঁকে ফাঁকে মায়ার মুখটা দেখছে। মায়াবতীটা ক্লান্ত হয়ে হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। কি ভেবে রাহাত গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে ড্রাইভে মন দিলো। অনেকক্ষণ পর মায়ার ঘুম ছুটলো কারো ডাকে। চোখ খুলে দেখলো রাহাত ডাকছে।
-এই মায়াবতী? উঠো না? কতোক্ষণ ধরে ডাকছি—। কি ঘুম রে বাবা!
-স্যার? এটা কোথায় আনলেন?
-আরে বাবা–। আমাদের বাড়িতে–। এই অবস্থায় বাসায় ফিরলে কাল থেকে তোমাকে হয়তো আর অফিসেই আসতে দিবে না–। সেই রিস্ক বাবা আমি নিতে পারবো না—।
-মানে?
-মানে হলো—। আপনি এখন কিছুক্ষণ এখানে রেস্ট করুন। ড্রেস চেইঞ্জ করুন—। খাওয়া দাওয়া করে তারপর যাবেন—–।
-কিন্তু স্যার? আপনার বাড়ির সবাই—-। কেউ কিছু মনে করবে না?
-কে আবার কি মনে করবে? বাবাই তো আছে-। যিনি তোমাকে জবটা দিলেন—।
-ওহ–। আর—?
-একটু চুপ থাকো না বাবা—। এসো?
মায়া গাড়ি থেকে নেমে আস্তে আস্তে বাড়ির ভিতরে পা রাখলো। রাহাত ওর পাশে পাশে হাঁটছে। মায়াবতীটা আজ প্রথম ওর বাড়িতে এলো। যদিও মেয়েটাকে এভাবে বাড়িতে আনতে হবে ভাবেই নি রাহাত। তবুও ভালো লাগছে রাহাতের। মায়াবতীটা যা দেখছে অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। সেই অবাক মুগ্ধ দৃষ্টিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে রাহাত। পৃথিবীর সমস্ত সুখের বিনিময়ে এই মায়াবতীটাকে তার চাই ই চাই।
রাহাত মায়াকে একটা রুমে বসিয়ে আলমারি আর ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলো। নিজে বাবার সাথে কথা বলতে গেল। বাবাকে সবটা জানিয়ে না রাখলে কখন কি হবে তার ঠিক নেই। মায়া ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে আলমারিটা খুলে জাস্ট হা করে তাকিয়ে রইলো। পুরো আলমারি জুড়ে শাড়ি আর শাড়ি। এতো শাড়ি হয়তো কোন শাড়ির দোকানেও পাওয়া যাবে না। শাড়ি পড়ার যাবতীয় খুঁটিনাটি জিনিসগুলোও একসাথে ভাঁজ করা। মায়া একবার ঢোক গিললো। এই বাড়িতে রাহাত আর তার বাবা ছাড়া নাকি কেউ থাকে না। তবে এই এতো শাড়ি সাজ পোশাক এলো কোথা থেকে! কার এগুলো!
ভাবতে ভাবতেই সব কটা শাড়িতে হাত বুলাচ্ছিল মায়া৷ একটা শাড়িতে চোখ আটকে গেল। কলা পাতা রঙা একটা জামদানি শাড়ি। দেখেই মায়ার পড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু দেখেই অনেক দামি মনে হচ্ছে শাড়িটা। সবগুলো শাড়িই দামি। পড়া ঠিক হবে কিনা কিছুই বুঝতে পারছে না বেচারি। এর মধ্যেই দরজায় নক পড়লো।
-মায়াবতী? কই হলো?
-স্যার?
-কি হলো? কোন প্রবলেম?
-স্যার–। শাড়ি পড়বো?
-হুম–। তোমাকে তো পুরো আলমারিটাই দিয়ে দিলাম—। নাকি চয়েজ হচ্ছে না—-? আরো লাগবে নাকি শাড়ি?
-এতো দামি শাড়ি ——-।
-শাড়িগুলো তো তোমাকেই পড়তে হবে—–।
-জি?
-তাড়াতাড়ি চেইঞ্জ করে বেরিয়ে এসো না? খেতে হবে—-।
-আসছি —–।
শাড়িটা সুন্দর করে পড়ে বের হলো মায়া। দরজা খোলার শব্দে এগিয়ে এসেই মায়াকে দেখে থ হয়ে গেল রাহাত। এ কাকে দেখছে সে? একেবারে কোন রকমের সাজ নেই মুখে। শুধু কলাপাতা রঙা জামদানি আর খোলা চুল। তাতেই মায়াবতীকে আরো মায়াবী লাগছে রাহাতের। চোখ ফেরানো দায় হয়ে গেছে রাহাতের। এদিকে রাহাতের এমন চাহনিতে লজ্জায় মাথাই তুলতে পারছে না মায়া।
চলবে