আলো আঁধারের লুকোচুরি পর্ব -১৩

#আলো_আঁধারের_লুকোচুরি
#Part_13 (ধামাকা)
#Writer_NOVA

‘কি খবর মিসেস মাহবুব?’

রুহানি পাল্টা নিজের হাতের রিভলবার ইয়াসফির দিকে তাক করে উত্তর দিলো,

‘আমার খবর তো ভালো, আপনার কি খবর মিস্টার মাহমুদ?

‘মাহমুদ, কে মাহমুদ? আমার নাম ইয়াসফি মাহবুব। আমি মাহমুদ নই।’

রুহানি কিট কিটিয়ে হেসে উঠলো। ট্রিগারটা জোরে চেপে হিস হিসিয়ে বললো,

‘একদম নাটক করবেন না দেবরজী। আমি আপনাকে ভালো করে চিনি৷ আপনার অব্দি পৌঁছাতে আমার কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। প্রথমে মাসুমকে মাহবুব সাজালাম। এরপর রোহিতকে দিয়ে ভিডিও ভাইরাল করালাম। শফিক গাজীকে হুমকি-ধমকি দিলাম। সালমানকে উঠিয়ে কেলালাম। আপনার বাসায় কাজের বুয়া সাজলাম। এমনি এমনি এত কিছু করেছি? আমার স্বামীর জায়গায়, তারই কারেক্টারে, তারই যমজ ভাই মাহমুদ সমানতালে অভিনয় করে যাচ্ছে আর আমি চিনবো না তা কি হয়? তবে আপনার অভিনয়ের স্কিল ভালোই আছে। নয়তো এতো কম সময়ে কারো কারেক্টারে ঢুকে গিয়ে তার মতো আচার-আচরণ, জীবন-যাপন করা সহজ কথা নয়। স্ট্রেঞ্জ! আমি নিজেও প্রথমে ভুল করতে বসেছিলাম।’

ইয়াসফি খ্যাত ছেলেটি রিভলভার নামিয়ে খাটে চুপ করে বসলো। হতাশ গলায় বললো,

‘ শফিক গাজী আর সালমানকে কেন উঠিয়েছিলে?’

রুহানি রিভালভারের আগার দিকটা মনোযোগ সহকারে দেখছিলো। চোখ উঠিয়ে মুচকি হাসলো। এরপর মুখটাকে বাচ্চাদের মতো করে ঠোঁট উল্টে বললো,

‘কি করবো? এছাড়া কোন উপায় ছিলো না। মাহবুবের সকল খবরাখবর সালমান জানতো। কারণ সালমান ছিলো মাহবুবের পি এ। আর শফিক গাজীর সাথে মাহবুবের ভালো সম্পর্ক ছিলো৷ কাছের মানুষরাই পিঠে ছুরি মারে। সালমান মাহবুবের যাবতীয় তথ্য আপনাকে দিয়ে সাহায্য করতো। সাথে শফিক গাজীও ছিলো। সালমানকে মোটা অঙ্কের টাকাও দিয়েছিলেন। সালমান এসব ভেজালে আর জড়াতে চায় না বলে আপনার টাকা দিয়ে একটা হার্ডওয়্যার দোকান দিয়ে বসেছে। তার ইচ্ছে ছিলো টাকা পেলে কানাডা চলে যাবে। কিন্তু তার ভিসা আসতে দেরী হচ্ছিলো। ভিসা দেরীতে আসার ব্যবস্থা আপনি করেছেন। কারণ আপনি চান না একা ধরা পরতে। মরলে একসাথেই মরবেন।’

মাহমুদ ফ্যাল ফ্যাল করে রুহানির দিকে তাকিয়ে রইলো। কোন উত্তর দিলো না। কি উত্তর দিবে সে? কিছু বলার আছে তার? চোখ দুটো টলমল করছে। ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে রুহানিকে বললো,

‘নিজের স্বামীকে চিনতে পারছো না রুহ?’

রুহানি চমকালো। স্বামী, এই ছেলে কেনো তার স্বামী হবে। এই ছেলে তো তার দেবর। চাহনি, কথা বলার ধরন ইয়াসফির মতো। রুহানি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো সে কোথাও ভুল করছে না তো?

‘মিথ্যে কথা। ও তোমার স্বামী নয় দেবর। ওর কথায় গলো না রুহ।’

মাসুমের সাথে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে উপরোক্ত কথাগুলো বললো ছেলেটি। মাসুম চমকে একবার মাহমুদের দিকে আরেকবার সাথের ছেলেটির দিকে তাকালো।

‘রাস্তা আর কতদূর আকবর?’

ড্রাইভার আকবরকে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন আজিম সারোয়ার। চিন্তায় তার মাথা হ্যাং হয়ে আসছে। তার গন্তব্য এখন ইয়াসফির বাসা। সঠিক সময় না গেলে সব ভেস্তে যাবে। সে হাতেনাতে সব প্রমাণ চান। তার মাথা কাজ করছে না। নিজের মনে বিরবির করে উঠলেন,

‘সে তো লাপাত্তা ছিলো হঠাৎ এলো কোথা থেকে? ভুলটা আমারি। আমি বিষয়টা খুঁটিয়ে দেখিনি। এভাবে আল্লাহর ওয়াস্তে ছেড়ে দেওয়া একদমই ঠিক হয়নি। একদমই নয়।’

নিজের কপালে নিজে একটা চাপর মারলেন। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। না, অন্য কারোর ওপর নয়। স্বয়ং নিজের ওপর।

‘স্যার, ডানে নিমু নাকি বামে?’

ড্রাইভারের কথায় নাক কুঁচকে এলো তার। এমনি সে চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে এর মধ্যে ছোকরা ছেলেটা রংতামাশা শুরু করছে৷ মেজাজ হারিয়ে বললেন,

‘আমার মাথার উপর দিয়ে নে।’

‘কন না স্যার, কোনদিকে নিমু?’

পুরনো ড্রাইভার বাদ দিয়ে নতুন ড্রাইভার নিয়ে আজিম সারোয়ার পরে গেছেন বিপাকে। এই ছোকরা বয়সী ছেলেগুলো বাদড় টাইপের হয়। ইচ্ছে করে বিরক্ত করে। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সংবরণ করে বললো,

‘তোর যেদিক দিয়ে মন চায় সেদিক দিয়ে নে। শুধু আমাকে একটু মুক্তি দে।’

আজিম সারোয়ারের কথা বলার ধরনে আকবর সাবধানে মিটমিট করে হেসে উঠলো। জোরে হাসলে নয় নাম্বার বিপদ সংকেত আছে। যা তার জন্য মোটেও সুখকর নয়।

চেচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেছে ওমরের। উঠে বসে ঝিম মেরে রইলো। সে আসলে বুঝতে পারছে না আওয়াজটা আসছে কোথা থেকে। আশেপাশে কোন বাসা নেই। ইয়াসফির এই দোতলা ডুপ্লেক্স বাড়িটা বলা যায় নিরিবিলি পরিবেশে৷ প্রধান সড়ক থেকে অনেক দূরে। ইয়াসফির তার মামার মতো নিরব পরিবেশ পছন্দ। ওমরেরও ভালো লাগে। শহরে নিত্যদিনের হাউকাউয়ের থেকে হাজার গুণ ভালো।

কাঁথা সরিয়ে রেখে জুতা পরে নিলো। এখানে আসার সময় তার মা নকশি কাঁথাটা দিয়ে দিয়েছিলেন। টাউজারের ফিতা ঠিক করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। ইয়াসফির রুম থেকে অনেক মানুষের শব্দ ভেসে আসায় ওমরের কপাল কুঁচকে গেলো। এতো মানুষ কোথা থেকে এলো। পরমুহূর্তেই অজানা আশংঙ্কায় বুক কেঁপে উঠলো। ইয়াসফির কেউ ক্ষতি করতে আসেনি তো? পড়িমরি করে ছুট লাগলো। দৌড়াতে গিয়ে তার এক জুতা ফেলেই ভেতরে ঢুকলো। দরজা ঠেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

‘আপনি ঠিক আছেন ভাই?’

হঠাৎ কারো আওয়াজ পেয়ে পুরো রুমের মানুষ শান্ত হয়ে গেলো। মাসুম আর তার পাশের ছেলেটি ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালো। এবার ওমর মৃদু আৎকে উঠলো। একি রকম দেখতে দুজন মানুষ! কোনটা আসল ইয়াসফি? জোরে চেচিয়ে উঠলো,

‘ভাই আপনি কোনটা?’

মাসুম ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘তুমি কার কথা জিজ্ঞেস করছো?’

‘ইয়াসফি ভাইয়ের কথা।’

মাসুমের সাথের ছেলেটি গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
‘আমি ইয়াসফি।’

অপর ইয়াসফি যাকে রুহানি মাহমুদ বলে সম্বোধন করেছিলো সে উচ্চস্বরে বললো,

‘মিথ্যে কথা। আমি আসল ইয়াসফি। ও নকল। আমার যমজ ভাই তানিম মাহমুদ। আমি ইয়াসফি মাহবুব।’

ছেলেটি চোখ লাল করে উত্তর দিলো,
‘আর একটা মিথ্যে কথাও বলবি না।’

‘তুই বলিস না। আমার থেকে আমার ক্ষমতা, টাকা-পয়সা, প্রিয়জন এমনকি আমার বউকেও তুই কেড়ে নিতে এসেছিস।’

‘আমি কেড়ে নিতে আসিনি তুই কেড়ে নিছিস।’

দুজনে এগিয়ে এসে দুজনের শার্টের কলার ধরলো। বর্তমান মন্ত্রী হিসেবে যে ইয়াসফি সে শাসিয়ে বললো,

‘এখনও সময় আছে এখান থেকে চলে যা।’

‘আমিও বলছি এখনও সময় আছে তুই চলে যা। আমাকে আটকে রেখে আমার জায়গা তুই দখল করে রেখেছিস। দিনের পর দিন মুখে কালো কাপড় পেচিয়ে আমাকে অমানবিক নির্যাতন করেছিস। আমার হাতে পরলে তুই বাচবি না।’

এক কথায়, দুই কথায় দুজনের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হলো৷ এরপর উড়াধুরা ঘুষি। রুহানি নিজেও বুঝতে পারছে না কি করবে। মাসুম খাটের ওপর বসে এ্যাকশন সিন উপভোগ করছে। এই ছেলেটা এমনি। মারপিট দেখলে না থামিয়ে সেটা ইনজয় করতে বসে যায়। আর ওমর দুটো ইয়াসফিকে একসাথে দেখে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরিস্থিতি খারাপের দিকে। দুজনের শার্ট ছিঁড়ে ফাতাফাতা। মুখ, ঠোঁট কেটে রক্ত বের হচ্ছে। তবুও কেউ থামছে না। রুহানি মাসুম ও ওমরকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘কি ব্যাপার তাকিয়ে কি দেখছো তোমরা? দুজনকে ধরো।’

দুজনে এবার নড়েচড়ে উঠলো। লাফ দিয়ে দুই ইয়াসফিকে ধরে দুদিকে টানতে লাগলো৷ দুজনের একজনকেও ছুটানো যাচ্ছে না। মিনিট খানিক জোরজবরদস্তি করে মাসুম, ওমর তাদের দুজনকে ছুটাতে পারলো। তেড়ে পুনরায় মারামারি করতে গেলে রুহানি চিৎকার করে উঠলো,

‘স্টপ!’

দুজনে দাঁড়িয়ে গেলো। মাসুম, ওমর এতটুকুতেই কপোকাত। কি শক্তি দুজনের! কারো থেকে কেউ কম না। আটকিয়ে রাখা যায় না।

‘তোমরা দুজনেই দাবি করছো তোমরা দুজনেই ইয়াসফি। ঠিক আছে মানলাম। আমি পরীক্ষা করবো কে আসল কে নকল।’

দুজন একে অপরের দিকে ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সমস্বরে চেচিয়ে উঠলো,

‘আমি রাজী।’

রুহানি বড় করে দম নিলো। এগিয়ে আসলো প্রথম জনের কাছে। যে কিনা বর্তমানে মন্ত্রী হিসেবে আছে। জিজ্ঞেস করলো,

‘আমাদের প্রথম দেখা কোথায় হয়েছিলো?’

সে ঝটপট উত্তর দিলো,
‘আশুলিয়ার রাস্তায়। তুমি বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি পাচ্ছিলে না। আমি তখন সিএনজি দিয়ে ভার্সিটি যাচ্ছিলাম। তোমাকে দেখে সিএনজি ওয়ালাকে থামাতে বলেছিলাম। তুমি সেদিন আমার সাথে বাকি রাস্তাটুকু গিয়েছিলে। সেটাই ছিলো আমাদের প্রথম দেখা।’

‘আপনার উত্তর সঠিক কি না ভুল তা আমি পরে বলছি। এবার আপনি বলুন আমাদের বিয়ে কবে হয়েছিলো।’

দ্বিতীয় জনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো রুহানি। যে কিনা এই কয়দিন তার বাসায় ইয়াসফি হিসেবে ছিলো।

‘এতো সহজ একটা প্রশ্ন করলে?’

সে হাসলো। এরপর থেমে গড়গড় করে বলতে আরম্ভ করলো,

‘২৫ শে সেপ্টেম্বর বিকেল ৫ টা ৩৪ মিনিটে। ভৈরবপুর কাজী অফিসে। আর কিছু দিন পর আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী।’

রুহানি চমকে গেলো৷ চোখ দুটো গোল আলু করে বিস্মিত গলায় বললো,

‘এটা কি করে সম্ভব! দুজনে সঠিক উত্তর দিয়েছে। আমি এখন নিজেও কনফিউশানে পরে গেছি কে আসল কে নকল?’

দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে রুহানিকে উদ্দেশ্য করে আজিম সারোয়ার বললেন,

‘একজনও আসল নয়, দুজনেই নকল। একজন ইয়াসফির জময ভাই তানিম মাহমুদ। আরেকজন প্লাস্টিক সার্জারি করে ইয়াসফির চেহারা ধরন করা ইয়াসফির বন্ধু বোরহান।’

এই রাতের বেলা আজিম সারোয়ারকে দেখে সবাই অবাক। রুহানি যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এগিয়ে এসে বিস্মিত চোখে জিজ্ঞেস করলো,

‘মানে, কি বলছেন মামা?

‘সত্যি বলছি।’

‘তার মানে এই দুজনের কেউ ইয়াসফি নয়?’

‘না, যে মন্ত্রী সেজে আছে সে ইয়াসফির ভাই। তোমার কাছে যে ছিলো সে ইয়াসফির বন্ধু।’

‘তাহলে আমার ইয়াসফি কোথায়?’

আজিম সারোয়ার চুপ হয়ে গেলেন। সারা রুমে পিনপিনে নীরবতা ছেয়ে গেলো। ওমর, মাসুম কোন কথা বলছে না। তারা আগামাথা কিছুই ঠাওর করতে পারছে না৷ ইয়াসফির চেহারাধারী দুজন একেবারে নিশ্চুপ। রুহানি জোর গলায় চেচিয়ে উঠলো,

‘কি হলো মামা, কথা বলছেন না কেনো? আমার ইয়াসফি কোথায়?’

আজিম সারোয়ার বেদনার শ্বাস ছেড়ে কাটা কাটা সুরে উত্তর দিলো,

‘মারা গেছে।’

রুহানি মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। যেই ইয়াসফির জন্য সে যুদ্ধ করলো সেই ইয়াসফি মারা গেছে। এর থেকে বড় শকিং নিউজ আর কি হতে পারে? সারা পৃথিবী ঘুরছে তার। ধীরে ধীরে বোধ শক্তি হারিয়ে ধপ করে মেঝেতে পরে গেলো।

#চলবে

কাহিনি মে টুইস্ট আরো বাকি আছে🥱। নেক্সট, নাইস বাদ দিয়ে ধামাকাটা কেমন হয়েছে অবশ্যই জানাবেন। আপনারা আবার রুহানির মতো অজ্ঞান হয়ে যাইয়েন না🤭।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here