আলো আঁধারের লুকোচুরি পর্ব -১৪

#আলো_আঁধারের_লুকোচুরি
#Part_14
#Writer_NOVA

রান্নাঘর বসে পটলের খোসা ছাড়াচ্ছেন মিশি বেগম। মুখে তার রাজ্যের বিরক্তি। বিরক্ত হওয়ার কারণ তার ছেলে পিয়াল৷ কখন থেকে বলছে বাজারে গিয়ে কিছু কাঁচা শাকসবজি নিয়ে আয়। সেই কথা তার কানেই ঢুকছে না। সে সোফায় এলোমেলো হয়ে বসে মোবাইলে ফ্রী ফায়ার খেলেছে। মিশি বেগম রান্নাঘর থেকে ফের চেচিয়ে বললেন,

‘কিরে পিয়াল তুই এখনো উঠিসনি? আমি এলে কিন্তু খুন্তির বারি খাবি।’

পিয়ালের কোন উত্তর এলো না। মিশি বেগম রাগান্বিত হয়ে মিটসেফের ওপর কাঙ্ক্ষিত বস্তুটাকে খোজাখুজি আরম্ভ করলেন। এক সময় পেয়েও গেলেন। খুন্তিটাকে হাতে নিয়ে তেড়ে গেলেন। মায়ের ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ পেতেই পিয়াল সচকিত হয়ে গেলো। মোবাইল ফেলে সোফার পিছনে নিজেকে আড়াল করলো।

‘হারামজাদা, এখন পালাচ্ছিস কেনো? দাঁড়া বলছি। সারাদিন-রাত পরে পরে ঘুম আর মোবাইল। পড়াশোনা নেই, ঠিকমতো কলেজ যাওয়া নেই। ঘরের একটা কাজ করতে বলি তাও করবে না। নবাব পুত্তর পালতেছি। পিটিয়ে ছাল-বাকল তুলে ফেলবো বজ্জাত।’

‘মা, যাচ্ছি তো। শুধু শুধু রণমুর্তি ধারণ করছো কেনো?’

‘এইচএসসি তে ফেল করলে তোকে বাসায় রাখবো না।’

‘সবেমাত্র ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। এইচএসসি আসতে দেরী আছে।’

পিয়ালের কথায় মিশি বেগম আরো চটলেন।
‘ইন্দুরের বাচ্চা, আবার মুখে মুখে কথা বলিস।’

পিয়াল একটু ভাবুক স্বরে বললো,
‘তার মানে তুমি আর আব্বু ইন্দুর?’

মিশি বেগম হাতের খুন্তি ছুঁড়ে মারলেন। পিয়ালের বাহু বরাবর লাগলো। ছুঁড়ে মারার জন্য হাতের কাছে আরো কিছু খুঁজছিলেন। তখুনি কলিং বেল বেজে উঠলো। ছেলের দিকে তাকিয়ে দাঁত কটমট করতে করতে দরজার দিকে পা বাড়ালেন।

দরজা খুলতেই মিশি বেগম হতভম্ব। এলোমেলো, বিধ্বস্ত অবস্থায় তার আদরের মেয়ে রুহানি দাঁড়িয়ে আছে। সাথে মাসুম। নিখোঁজ মেয়েকে এতদিন পর দেখে মায়ের দিশেহারা অবস্থা। চোখ দুটো নোনাজলে ভর্তি হয়ে গেলো। মা কে দেখে রুহানির চোখও ছলছল করে উঠলো। মায়ের বুকে মাথা রেখে কান্নাভেজা কন্ঠে বলে উঠলো,

‘মা, মা গো! আমার সব শেষ।’

আজিম সারোয়ার গম্ভীর মুখে ইজিচেয়ারে বসে আছেন। দুই ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট ধরা। সে সচারাচর সিগারেট ফুঁকেন না। অতিরিক্ত টেনশনে যখন টিকতে না পারেন তখন সিগারেটের সহয়তা নেন। টি-টেবিলের ওপর এস্ট্রেতে সিগারেট গুঁজে সামনের দুজনের দিকে নজর দিলেন।

‘তোমাদের সমস্যাটা কি? শেষ বয়সে এসে কি আমাকে একটু শান্তি দিবে না?’

‘মামা আমি…..

মাহমুদ কথা শেষ হওয়ার আগে আজিম সারোয়ার হাত দিয়ে থামিয়ে দিলেন।

‘তুমি একটা শব্দও করবে না। যত নষ্টের গোড়া তুমি। কি ভেবেছো? তোমাকে অন্য কেউ চিনতে না পারলেও আমি চিনতে পারবো না? প্রথমেই চিনে ফেলেছি।’

মাহমুদ রাগে নীরবে ফুঁসতে লাগলো। চোখ লাল করে পাশের জনের দিকে তাকালো। দাঁত পিষে লঘুস্বরে বললো,

‘তুই আমার সব প্ল্যান বরবাদ করেছিস। তোকে আমি ছাড়বো না।’

সাথের জন হাই তুলে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললো,
‘যা মন চায় কর গিয়ে। তবে মনে রাখিস, সত্যের জয় সর্বদা হয়।’

আজিম সারোয়ার তীর্যক চোখ পুরোটাই পর্যবেক্ষণ করলো। চোখ নামিয়ে দুজনকে বললো,

‘তোমরা এখন আসতে পারো।’

মাহমুদ হনহন করে চলে গেলো। বোরহান সরলো না। দুই হাত পাঞ্জাবির পকেটে গুঁজে কপাল ভাজ করে স্পষ্ট গলায় বললো,

‘তুমি কি করতে চাইছো বলো তো মামা?’

‘তোমার এখন না জানলেও চলবে। দিয়েছে তো পুরো পরিকল্পনায় পানি ঢেলে।’

‘আমার জায়গায় মাহমুদ থাকছে আমার তো চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না।’

‘হ্যাঁ যাও, নিজের বদন খানা পাবলিককে দেখাও। আর মন্ত্রী পদটাকেই হারাও।’

আজিম সারোয়ারের কন্ঠে ক্ষুব্ধ শোনালো। বোরহান ঘাটলো না। এখন কিছু বলা মানে মামার রাগের শিকার হওয়া। এর থেকে ভালো সে সটকে পরুক। পরে যখন রাগ কমবে তখন জিজ্ঞেস করা যাবে। দরজা দিয়ে বের হতে নিলেই তিশার সাথে দেখা হলো। বাবার জরুরি তলব পেয়ে সে একটু আগে মাহবুব ভিলায় পৌঁছিয়েছে। দুজনে চোখাচোখি হতেই পাশ কাটিয়ে বোরহান চলে গেলো। তিশা ভেতরে ঢুকলো।

‘বাবা, কাহিনি কি? দুজন একসাথে। লাপাত্তা মানুষ এলো কোথা থেকে?’

‘হাওয়ায় গা ভাসালে মৃত মানুষও হাজির হবে।’

‘হ্যাঁ, তাইতো দেখছি। এখন কি করবে তুমি?’

আজিম সারোয়ারের মুখে এক টুকরো রহস্যময় হাসি ফুটে উঠলো। মাথা নাড়িয়ে হাসির ছটা প্রসারিত করে বললো,

‘দেখা যাক, কে জিতে। পরিকল্পনা আমারো আছে। এমনি এমনি এবার কাউকে ছেড়ে দিচ্ছি না।’

স্ত্রীর কল পেয়ে দেরী করেনি পলাশ হায়দার। এতোদিন পর মেয়ে ফিরে এসেছে শুনে কাজকর্ম ফেলে ছুটে এসেছে। মেয়ের রুমে গিয়ে দেখে স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। বাবাকে দেখে রুহানির কান্নার শব্দ বেড়ে গেলো। এগিয়ে এসে বাবা বলে জড়িয়ে ধরতে গেলে পলাশ হায়দার কষিয়ে একটা চড় মারলেন। উপস্থিত সবাই হতভম্ব। পিয়াল, মাসুম একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো। মিশি বেগম আৎকে উঠলেন। রুহানি গালে হাত দিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট কামড়ে নিজের সাথে যুদ্ধ করছে যাতে কান্নার দমকা হাওয়া বেরুতে না পারে। মাসুম পিয়ালের কানের কাছে মুখ নিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হলো?’

পিয়াল ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
‘অভিমান, রাগ। একটু পরই দেখবে বুকে জড়িয়ে কাঁদছে। আপি বাবার অনেক আদরের।’

পিয়ালের বলতে দেরী, পলাশ হায়দার এবার নিজের চোখের পানি ছেড়ে দিতে দেরী নয়। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্না গলায় বললো,

‘কোথায় ছিলি এতোদিন? তোকে কত খুঁজেছি তার কোন আইডিয়া আছে তোর? আমি পাগলের মতো এদিক সেদিক গিয়েছি। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কারো বাসা বাকি রাখিনি। আমাকে মারার বন্দোবস্ত করছিলি? তোর কিছু হলে তোর এই বাপ যে মরেও শান্তি পেতো না।একটা বার কল দিয়ে বলা যেতো না, বাবা আমি অমুক জায়গায় আছি তুমি চিন্তা করো না। বল, বলা যেতো না?’

রুহানি কান্নার দরুন হেচকি উঠে গেছে। নিজেকে কিছুটা শান্ত করে ধরা গলায় বললো,

‘আমি তোমাদের বিপদে ফেলতে চাইনি।’

মিশি বেগম এগিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
‘এরপর থেকে এমনটা করিস না মা। আমাদের চিন্তা হয়।’

মাসুম মিনমিনে সুরে বললো,
‘আন্টি, কিছু খাবার কি পাবো? ইদুরে পেটের ভেতর ড্রাম বাজাচ্ছে।’

পলাশ হায়দার মাসুমের গলার কন্ঠ পেয়ে মাথা উঠিয়ে তাকালো। চোখ সরু করে রুহানিকে জিজ্ঞেস করলো,

‘এই বাদড়টা এখানে কি করছে?’

পিয়াল বললো,
‘মাসুম ভাই তো এতদিন আপির সাথে ছিলো।’

পলাশ হায়দার মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পিয়ালের কথা শুনেনি। কিন্তু মিশি বেগম ঠিক শুনেছেন। সে ভ্রু কুঁচকে শুধালো,

‘তুই জানলি কি করে?’

পরিস্থিতি বেগতিক। অন্য দিকে যাওয়ার পথে। রুহানি সেটা টের পেয়ে মায়ের কাছে আবদারের সুরে বললো,

‘মা ভাত দাও। খিদে পেয়েছে। কতদিন তোমার হাতের রান্না চেঁচেপুঁছে খাই না।’

মেয়ের খুদার কথা শুনে মিশি বেগম জগৎ ভুলে গেলেন। হন্তদন্ত পায়ে টেবিলে খাবার সাজাতে ছুটলেন। পলাশ হায়দার মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বললো,

‘ফ্রেশ হয়ে জামা-কাপড় ছেড়ে আসি। আজ সবাই একসাথে খেতে বসবো।’

পলাশ হায়দার চলে গেলেন। রুহানি চোখ ছোট করে দুই হাত কোমড়ে রেখে পিয়ালের দিকে এগুলো।

‘তোর পেটে কি কোন কথা থাকে না?’

পিয়াল জিহ্বায় কামড় দিয়ে পড়িমরি করে সেখান থেকে ছুট লাগালো। তার পিছন পিছন রুহানিও নিরুদ্দেশ। মাসুম শব্দটা করে হেসে উঠলো। নাহ্ এবার বাড়ি ফিরতে হবে। কতদিন ধরে তার বোনের সাথে টম এন্ড জেরী যুদ্ধ হয় না।

নিশুতি আঁধারে ঢাকা পুরো পৃথিবী। জানালার বাইরে থেকে ভেসে আসছে রাত পোকার ডাক। আকাশে এক ফালি চাঁদ। তাতেও ক্ষীণ আলো। মাঝে মধ্যে কালো মেঘ এসে সেই আলো ঢেকে দিচ্ছে। আলো আঁধারের চমৎকার লুকোচুরি খেলছে। যেমনটা খেলছে রুহানি জীবন। শীতল হাওয়ায় রুহানির চুলগুলো এলোমেলো ভাবে উড়ছে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরছে নোনাপানি। হাতে ইয়াসফি আর তার ছবি।ছবিতে গম্ভীর মুখে ইয়াসফি দাঁড়িয়ে। রুহানির হাসিমুখে পেছন থেকে ওর দুই গাল টেনে ধরে রেখেছে। ছবিটা তোলা হয়েছিলো ভার্সিটি লাইফে। কঠোর ব্যক্তিত্বের এই মানুষটাকে যে রুহানি কি দেখে ভালোবেসেছিলো তা মাঝে মাঝে ভাবতে বসে। এই মানুষটা ছিলো একান্তই তার। চার মাস আগে হঠাৎ করে মানুষটা নিখোজ হলো। রুহানির আশা ছিলো একদিন নিশ্চয়ই মানুষটার খোঁজ পাবে। কিন্তু এভাবে পাবে তা কখনো ভাবেনি। তার মন মানতে নারাজ যে ইয়াসফি বেঁচে নেই। তারই চেহারার আরো দুটো মানুষ আছে। কিন্তু চেহারা তো নয় রুহানি মানুষটাকে ভালোবেসেছে।

‘আমাকে একা ফেলে কোথায় চলে গেলেন মন্ত্রী সাহেব? আপনার বিরহ আমি সহ্য করতে পারবো না। আমাকে কেন সাথে নিয়ে গেলেন না?’

ডুকরে কেঁদে উঠলো রুহানি। বুকের ভেতরটা শূন্য শূন্য লাগছে। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছে জাগছে। ঘোর কাটলো মোবাইল রিংটোনে। চোখ মুছে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে আননোন নাম্বার। রিসিভ করে কানে দিতেই আপর পাশের মানুষটা করুন গলায় বলে উঠলো,

‘আমাকে চিনতে পারলে না রুহ? এই ভালোবাসো আমায়?’

সাথে সাথে কানেকশন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। টুট টুট করে জানান দিলো তা। রুহানির বুকটা ধ্বক করে উঠলো। এই কন্ঠ, এই কন্ঠ তার বহু বছরের চেনা। তার মানে সে যা ভাবছে তাই কি সত্যি? তাড়াহুড়ো করে কল ব্যাক করলো। সিম বন্ধ। তার শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হচ্ছে। মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। কোথাও একটা ঘাপলা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু কোথায় সেটা? রুহানি কি আবারও ভুল করে বসলো?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here