আলো আঁধারের লুকোচুরি পর্ব -১৫

#আলো_আঁধারের_লুকোচুরি
#Part_15
#Writer_NOVA

‘ইয়াসফি!’

বারান্দায় দাড়িয়ে পুরনো দিনের কথা ভাবছিলো ইয়াসফি। মামার ডাকে ধ্যান থেকে ফিরলো। হাতের মগে থাকা কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে বহু আগে। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে মামার দিকে ঘুরলো।

‘কিছু বলবে?’

‘হ্যাঁ, তুই যতদ্রুত সম্ভব এখান থেকে সরে যা। তোর ভাই যেকোনো সময় তোর ওপর আক্রমণ করে বসতে পারে। ওকে দিয়ে বিশ্বাস নেই।’

ইয়াসফি মামার কথাকে পাত্তা দিলো না। মগটাকে বারান্দায় থাকা ছোট টেবিলের ওপর রেখে তীক্ষ্ণ নজর দিলো।

‘রুহানিকে মিথ্যে কেন বললে? আমি ইায়সফি, বোরহান নই। বোরহান নামে আমার কোন বন্ধু নেই।’

‘সেটা তুই আমি জানি অন্যরা নয়। তোকে সেইফ রাখতে আমি জেনেশুনে মিথ্যে বলেছি।’

‘আর রুহানি! সে কি আমায় চিনতে পারলো না? এতোদিন ওর কাছে ছিলাম, একই বিছানায় ঘুমিয়েছি, হাজারবার স্পর্শ করেছি৷ তবু ও কি আমায় চিনতে পারলো না?’

আজিম সারোয়ার ভাগ্নের কাঁধে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,

‘মেয়েটার ওপর ধকল তো কম যায়নি। তোর জায়গায় মাহমুদ আসার পর মেয়েটা কি অন্যদের মতো বসে রয়েছে বল? শক্তি, সাহস, বুদ্ধি নিয়ে তোকে খোজার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। এতো প্যাচ, কনফিউশান, চিন্তায় বেচারি তালগোল পাকিয়ে গেছে। মাথা ঠিক হলে দেখবি ছুটতে ছুটতে হাজির।’

‘তাই যেনো হয় মামা। আমার আর কিছুই ভালো লাগছে না। আমি ইয়াসফি হয়েও আমার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এতোটা বাজে সময় আমি আগে কখনো পার করিনি।’

‘তোর ভাইয়ের ভালো ট্রিটমেন্ট দরকার। আমি ওর মুখ থেকে সত্যটা বের করে বড় মানসিক হসপিটালে দিয়ে দিবো।’

‘বুঝলে মামা, হুমায়ুন আহমেদ তার কুটু মিয়া উপন্যাসে একটা কথা বলেছিলো, “বন্যপশু থেকে বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ বেশি ভয়ংকর”। তখন কথাটা আমলে না নিলেও এখন হারে হারে টের পাচ্ছি। কোন সুস্থ মানুষ কি ভালোবাসার মানুষকে ফ্রিজিং ড্রয়ারে সংরক্ষণ করে রাখে?’

‘তুই যখন পুরো বিষয়টা আমাকে খুলে বললি আমি নিজেও হতভম্ব। আমাদের আরো আগের থেকে সচেতন হওয়া উচিত ছিলো। যাইহোক এখন বোরহান সেজে থাক। আমি দেখি কি করা যায়।’

ইয়াসফি চুপ হয়ে গেলো। আজিম সারোয়ার ভাগ্নের পিঠে চাপর মেরে চলে গেলেন। এখানে বেশি সময় থাকা উচিত নয়।

এবার পুরো বিষয়টা আপনাদের বুঝিয়ে বলি। ইয়াসফি মারা যায়নি। ইয়াসফির বন্ধু বোরহান নামে যাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে সেই হলো আসল ইয়াসফি। রুহানির কাছে আসল ইয়াসফি ছিলো। আজিম সারোয়ার ইয়াসফিকে বাঁচাতে সবার কাছে মিথ্যে বলছে।

———-★

৩৪ বছর আগের কথা….

স্থানীয় মেয়র মাহফুজ ও তার স্ত্রী ইয়াসমিনের ঘর আলো করে এলো যমজ পুত্র সন্তান। তিন মিনিটের বড় সন্তানের নাম রাখা হলো ইয়াসফি মাহবুব। ছোট ছোট সন্তানের নামকরণ করা হলো তানিম মাহমুদ। দুই সন্তান নিয়ে মেয়র সাহেবের সংসার ভালোই চলছিলো। গুটি গুটি পায়ে মাহবুব, মাহমুদের বয়স যখন চারে পরলো তখুনি রাজনৈতিক শত্রুতার জের ধরে মাহফুজ মেয়র গুম হয়ে গেলেন৷ সারা এলাকা, আশেপাশের জায়গা খুঁজেও তার হদিস পাওয়া গেলো না৷ লোকে বলতে লাগলো তাকে মে’রে লাশ কোথাও পুঁতে ফেলেছে। তাই বলে মৃতদেহটাও পাওয়া যাবে না? এখনকার মতো আইন ততটা উন্নত ছিলো না। এর জন্য লশটাও পাওয়া গেলো না।

ইয়াসমিন দুই ছেলে নিয়ে অকূল পাথারে পরে গেলো।
মাহফুজ সারাদিন রাজনীতি নিয়ে পরে থাকায় তার অন্য কোন ইনকাম সোর্স ছিলো না। রূপবতী নারী তার মধ্যে ছোট দুটো বাচ্চা। চারিপাশের নোংরা মানুষ লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাতো। তখন এগিয়ে এলো তার বড় ভাই আজিম সারোয়ার। বোন, ভাগ্নেদের নিজের বাসায় নিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু ইয়াসমিন খুব আত্মসম্মানবোধ নারী। সে স্বামীর ভিটা থেকে নড়তে চায়নি। ভাইকে বললো একটা চাকরি জোগাড় করে দিতে। একমাত্র বোনকে বুঝিয়ে যখন লাভ হলো না তখন ভাই বাধ্য হয়ে বোনকে চাকরি খুঁজে দিলো। দুই সন্তান, চাকরি নিয়ে চলতে লাগলো ইয়াসমিনের জীবন। ছেলে দুটোর বয়স পাঁচ বছর হওয়ার পর স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেয়া হলো। ধীরে ধীরে সাত বছরে উপনীত হলো মাহবুব, মাহমুদ। সাত বছর হওয়ার পর ইয়াসমিন খেয়াল করলো তার দুই ছেলের চেহারা এক হলেও আচার-ব্যবহার, চরিত্র, বৈশিষ্ট্য অনেক ভিন্ন। মাহবুব ছোট থেকেই একটু চুপচাপ স্বভাবের। কথা কম বলে। অপ্রয়োজনে বাক্য ব্যয় করতে পছন্দ করে না। অন্য দিকে মাহমুদ ভীষণ ধূর্ত প্রকৃতির। এতটুকু বয়সেই নিজে কোন অপরাধ করলে নির্দ্বিধায় ভাইয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতো। যদিও তার এই বিষয়টা ইয়াসমিন জানতো৷ তাই মাহবুবকে কখনো শাস্তি দিতো না। দিন গড়াতেই ইয়াসমিন আরোকটা বিষয় খেয়াল করলো। মাহমুদ তার ভাইয়ের নকল করতে পারতো। তাও এতোটা নিখুঁতভাবে যে তার মা ধরতে পারতো না। যেই বৈশিষ্ট্যটা মায়ের পিলে চমকে দিয়েছিলো তা হলো মাহমুদ পশু-পখী, প্রাণীকে নীরবে কষ্ট দিতে পছন্দ করতো তাও অকারণে। মাহবুব এই বিষয়টা পছন্দ করতো না। তাই মাঝে মধ্যে দুই ভাইয়ের মধ্যে মারামারি লেগে যেতো৷ যদিও শুরুটা মাহমুদই করতো। ইয়াসমিন দুই ছেলেকে সুন্দর করে বুঝাতেন। মাহবুব যতটা বাধ্য ছিলো মাহমুদ ছিলো ততটা অবাধ্য। দুই ভাই দুটো চরিত্রের অধিকারী ছিলো। আট বছর পেরুতেই ইয়াসমিন ব্রেণ ক্যান্সারে মারা গেলো। মায়ের হঠাৎ মৃত্যুতে দুই ভাই শোকে বিমূঢ়। চাচা, ফুপুরা কেউ এতিম ছেলে দুটোকে নিতে চাইলো না। এমন সময় তাদের ঠাঁই মিললো মামার বাড়ি।

আজিম সারোয়ারের স্ত্রী নাসিমা বেগম কোমল হৃদয়ের মানুষ। বাবা-মা হারা দুই সন্তানকে আপন করে নেন। নিজের সর্বস্ব দিয়ে দুই ছেলেকে আগলে রাখেন। এরপর একে একে তার কোল জুড়ে তিশা, তুষ্টি এলো। কিন্তু তার কাছে দুই ভাগ্নের আদর কমলো না। দেখতে দেখতে মাহবুব, মাহমুদ কলেজের গন্ডি পার করলো৷ মাহবুব নিজেকে মামার পরিবারের সাথে মিশিয়ে নিয়েছিলো। আর মাহমুদ চার দেয়ালের ভেতর নিজেকে আবদ্ধ করে নিয়েছে। তার ছোটবেলার অস্বাভাবিক আচারণ কিন্তু কমেনি। বরং বেড়ে চলেছিলো। কিন্তু সে ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ হওয়ায় সেগুলো পরিবার অব্দি পৌঁছাতে পারেনি। তবে মাহবুব বিশেষ নজরে রাখতে ছোট ভাইকে। তাই সপ্তাহে দুই-তিনদিন দুই ভাইয়ের মধ্যে তুমুল ঝগড়াঝাটি, মারামারি হতো। বাধ্য ছেলে হওয়ায় আজিম সারোয়ার মাহবুবকে পছন্দ করতেন। ততদিনে মাহবুব ছাত্র সংগঠনে যোগ দিয়েছে। যার রক্তে রাজনীতি আছে সে কি এসব থেকে দূরে থাকতে পারে? ভার্সিটির শুরুতে মাহমুদের নামে বিভিন্ন বিচার-আচার আসা শুরু করলো। আজিম সারোয়ার বিরক্ত হয়ে গেলেন। কিছু দিন পর সে এমপি পদে দাঁড়াবেন এখন ভাগ্নের নামে বিচার আসলে তার রেপুটেশন নষ্ট হবে৷ তাই মাহবুবের সাথে বুদ্ধি করে মাহমুদকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সেখানে গিয়ে মাহমুদপর পরিচয় হলো একি জেলার মেয়ে ফ্লোরার সাথে। অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে মাহমুদ ধীরে ধীরে হয়ে গেলো আরো ভয়ংকর।

ভার্সিটি লাইফ শেষের দিকে মাহবুবের পরিচয় হলো রুহানির সাথে। বছর চার সম্পর্কের পর মামার সহয়তায় রুহানির পরিবারকে রাজী করিয়ে একদম লুকিয়ে চুরিয়ে গতবছর তাদের বিয়েটা হয়। রুহানির পরিবার রাজনীতির সাথে যুক্ত ছেলের সাথে বিয়ে দিতে রাজী ছিলো না। কিন্তু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নেওয়া ছাড়া কোন কিছু করারও ছিলো না। মেয়ের খুশি তাদের খুশি।

———-★

সারাদিন হেলায় ফেলায় কাটলো রুহানির। অশান্ত মনটা কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। তার মন বলছে ইয়াসফি বেঁচে আছে। অবাধ্য মনটা ছটফট করে তাই জানান দিচ্ছে। চোখ দুটো এক বিন্দু সময়ের জন্যও বন্ধ করতে পারছে না। জানালার পাশে নারিকেল গাছে একটা হুতুম প্যেঁচা হু হু করে ডাকছে। আজ আকাশে চাঁদ নেই। তবে ক্ষীণ আলোয় পরিষ্কার সব দেখা যাচ্ছে। গলির মোড়ে থাকা কুকুরগুলো কিছু একটা দেখে আর্তনাদ করে উঠলো। রুহানির বুকটা অজানা আশংঙ্কায় হাতুড়ি পেটাচ্ছ। ছোটবেলায় দাদীর কাছ থেকে শুনেছিলো গভীর রাতে কুকুরের আর্তনাদ আর পেচার ডাক নাকি অমঙ্গলের ছায়া। যদিও সে জানে এটা কুসংস্কার। কিন্তু তার মন আজ সেটা মানতে নারাজ। এপাশ ওপাশ করে উঠে বসলো। ততক্ষণাৎ তার মোবাইলটা ভাইব্রেট করে উঠলো। আজও আননোন নাম্বার। তবে গতকালের নয়। কাঁপা কাঁপা হাতে রিসিভ করে কানে দিতেই অপরপাশ থেকে হাসি হাসি কন্ঠে সে বলে উঠলো,

‘আসসালামু আলাইকুম ভাবীজান। কি খবর? বিধবা হয়ে কি শোকে পাথর গয়ে গেলেন?’

রুহানি চমকে উঠলো।
‘মাহমুদ।’

মাহমুদ কিট কিটিয়ে হেসে বললো,
‘এই তো ঠিক চিনেছেন। অবশ্য চিনবেন না কেনো? দশটা না পাঁচটা না একটামাত্র দেবর আপনার।’

রুহানির চাপা রাগ হলো। ঠোঁট কামড়ে রাগ সংবরণ করে চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করলো,

‘কেনো কল করেছেন?’

আবারো মাহমুদের অট্টহাসি কানে ভেসে আসলো। শুনতে বিরক্ত লাগলেও রুহানি কান থেকে মোবাইল সরালো না।

‘কি যে বলেন না ভাবী! ভাই মারা গেছে বলে কি ভাবীর খোঁজ খবর নিবো না?’

‘কোন দরকার নেই।’

মুহুর্তে মাহমুদের গলার স্বর পাল্টে গেলো। রাগে থরথর করে কেঁপে উঠলো।

‘দরকার আছে। আপনার স্বামী মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। নয়তো আমি নিজ হাতে ওকে মেরে ফেলতাম। ওর এতো যশ, খ্যাতি, আপনজন আমার সহ্য হচ্ছিলো না। তাই তো চারমাস আগে ওকে সরিয়ে নিজে ওর জায়গা দখল করেছি। সবকিছু আমার প্ল্যান মতোই চলছিলো। কিন্তু ভেজাল লাগালেন আপনি। আমি ভেবেছিলাম সাধারণ মেয়ে কি আর করতে পারবে। কিন্তু ভাবিনি এতো ধানী লঙ্কা হবে।’

রুহানির ঠোঁট প্রসস্থ হলো। বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। গানের সুরে বললো,

“শোনরে সুজন আমি বলিও তোরে,
চাঁদ ভেবে আগুন নিয়ে খেলিস না রে।”
‘আমাকে চাঁদ ভাবলে ভুল করবেন দেবরজী। আমি আগুন। আমাকে ছোঁয়া এতো সহজ নয়।’

‘হ্যাঁ, তাতো বুঝতেই পারছি। তবে আপনি একটা মারাত্মক অপরাধ করছেন। তা হলো আমার থেকে আমার ফ্লোরাকে কেড়ে নিছেন। আমিও আপনার থেকে আপনার কোন প্রিয় মানুষ কেড়ে নিবো। তখন বুঝবেন প্রিয়জন হারানোর ক্ষত কতটা গভীর। ইচ্ছে তো ছিলো ইয়াসফিকে মারবো। কিন্তু মরা মানুষকে তো মারা যায় না। তাই জীবিত মানুষকে মারি।

রুহানির ভাবান্তর হলো না। তবে সে ভেতর ভেতর একটু ভয় পেলো। মাহমুদ ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ। এই মানুষগুলোর থেকে সাবধানে থাকতে হয়। রুহানি কিছুটা মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো,

‘আপনি এমনটা করতে পারেন না।’

‘পারি। একটা সিক্রেট শুনবেন।’

‘কি সিক্রেট?’

‘ফ্লোরা আসলে মারা যায়নি। আমি ওকে মেরে ফেলেছি। আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। তাই মেরে সারাজীবন নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি সব গন্ডগোল পাকিয়ে দিলেন। এর মাশুল আপনাকে খুব খারাপভাবে দিতে হবে।’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here