#প্রেমোবর্ষণ
৯+১০.
শ্রাবণের শেষ বৃষ্টি হয়ত আজই হচ্ছে। সেই ভোর পাঁচটায় আকাশ কালো করে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল সেই বৃষ্টি এখন সন্ধ্যেতেও চলছে অবিশ্রান্ত। কখনো ঘোর বর্ষণ আবার কখনো ছিল ইলশেগুঁড়ি, কখনো আবার শিয়ালের বিয়ের রোদময় বৃষ্টিও ছিল তবুও থেমে নেই। বড় চাচী তো পার্লার থেকে সেজে এসেছিল। কিন্তু গাড়ি থেকে কনভেনশন হলের গেট পেরুতেই বৃষ্টির কয়েক ছাঁটে ভারী মেকআপে ফাঁটল দেখে কেঁদেই ফেলল। বড় চাচু তখন সবেই কাচ্চির মাংস মুখে তুলেছিল চাচীর কান্নায় সেটা হাত থেকে পড়ে গেল। আঁতকে উঠে জানতে চাইলেন, কি হলো কাঁদছো কেন?
-দ্যাখেন বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে আমার মেকাপ নষ্ট হয়ে গেছে…..
চাচীর কান্নার ধরণ দেখে আশপাশের অনেক আত্মীয় একসাথে জড়ো হয়ে গেল। বরযাত্রী তখনো এসে পৌছায়নি। সামান্য মেকাপের জন্য পঞ্চাশ বছর বয়সী কোন নারী যে এমন হুলস্থুল কান্ড করতে পারে তা কলির বড় চাচীকে না দেখলে কারো জানা হতো না। চাচু অবশ্য এমন কান্ডে প্রচণ্ড রেগে চাচীকে ধমকে উঠলেন, বুড়ি মহিলা ছেলের বউদের সাথে তাল মিলিয়ে এ বয়সে মেকাপ করে এখন ন্যাকা কান্না শুরু হয়েছে! যত্তসব, দিলো খাবারের বারোটা বাজিয়ে।
চাচীর রাগ হলো চাচুর আচরণে তিনি মুখ ঝামটা মেরে চলে গেলেন সেখান থেকে। এখন তাকে আরিফ ভাইয়ার বউকে খুঁজতে হবে মেকাপটা ঠিক করানোর জন্য। এদিকে কলির বড় বোন কেয়া সেই কখন থেকে লেহেঙ্গার দু পাশ ধরে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। দুলাভাই এখনো সিঁড়ির কাছে যায়নি। কলির সাথে পাল্লা দিয়েই আপু লেহেঙ্গা কিনেছে কলির বিয়েতে পরবে বলে। এখন সেই লেহেঙ্গার ওজনের সাথে হিল পায়ে কেয়া চলতেই পারছে না। বহু কষ্টে পার্লার থেকে গাড়ি আর গাড়ি থেকে হলের সিঁড়ি অবধি এসে আটকে গেছে। এ নিয়ে আর নিজেকে টেনে উপরে ওঠা দায় বলে দুলাভাইকে কল করে বলেছে, জলদি এসে নিয়ে যাও আমায়।
কিন্তু বেচারা বাচ্চার কান্নাকাটি সামলাতে গিয়ে ভুলে গেছে সে কথা আর আপু আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে। আশফাক ভাইয়া অবশ্য একবার জোরাজুরি করলো, আয় কেয়া আমি নিয়ে যাচ্ছি তোকে।
কেয়া শোনেনি সে কথা। যাবে সে তার বরের সাথেই এবং এই যে তাকে অপেক্ষা করতে হলো এর জন্যও বেচারাকে ভোগ করতে হবে শাস্তি৷ তারপর আসি মেজো চাচুর কথায়। খালি পেটে তাঁর ডায়বেটিস আজ সকালেও ছিল বারোর ঘরে। সকাল বিকাল ইনসুলিন তার প্রথম ভরসা আর বরাবরই তার জন্য মিষ্টি খাবার নিষিদ্ধ এদিকে ব্লাড প্রেশারও হাই। ইদানীং চাচুর চেহারাতেও তাঁর অসুস্থতা স্পষ্ট৷ বাবা আর বড় চাচুর সামনে দাঁড়ালে মেজো চাচুকেই দেখতে বৃদ্ধ লাগে এই রোগভারে নুয়ে পড়া শরীরে। খাবারের ব্যাপারে তিনি একদমই অসচেতন আর তাই চাচী সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখেন৷ এই যে মাত্রই চাচী কোন কাজে কলির মায়ের কাছে যেতেই চাচু গিয়ে এক গাদা মিষ্টি প্লেটে নিয়ে লুকিয়ে পড়লো কলির স্টেজের উল্টোপাশে। ওদিকটা মূলত কনের প্রয়োজনে রেস্ট আর মেকআপের জন্য রাখা। সেখানে প্রায় চার পাঁচজন মেয়ে, মহিলা চাচু সবাইকে চুপ থাকতে বলে গপাগপ দুটো মিষ্টি মুখে পুরে ফেলল৷ হঠাৎই চাচুর কোটে টান পড়ায় পেছনে ফিরতেই বড় একটা ঢোক গিলল। তবে উপকার হলো ঢোক গিলতেই মুখে থাকা দুটো মিষ্টির একটা পেটে চালান হলো। মেজো চাচীর চোখ মুখ ভয়ানক রকম লাল হয়ে উঠেছে। আত্মীয়স্বজন মহিলারা সকলেই তাদের অবস্থা দেখে মুখ টিপে হাসছেন। কলি উঁচু স্টেজটায় বসে পুরো হলের চারপাশে নজর বুলিয়ে নিজের পরিবারকেই দেখছিল। ওই যে হলের উত্তর দিকে একেবারে রেলিং দেয়া অর্ধ দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো আরিফ ভাই। তার পাশেই তার নব্য বিবাহিতা সুন্দরী স্ত্রী। যে আরিফ ভাই এলাকায় প্রেমিকযুগল পেলেই কঠিন থেকে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতেন গত সপ্তাহেই সেই আরিফ ভাই ক্যাটরিনা কাইফের মত সুন্দরী এক মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে এসেছে। না বলা মেয়ে তাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছে। মেয়েটিকে তিনি নিজে না বরং মেয়েটি ভাইয়াকে পটিয়ে কোন এক জাদুবলে বিয়ে করতে বাধ্য করছে। কঠিন মনের আরিফ ভাইটা এখন এক সপ্তাহেই বউ পাগলা। কেমন করে সকল আত্মীয়ের মাঝেই কখনো বউয়ের মেকআপ ঠিক করে দিচ্ছে, কখনো শাড়ির আঁচল উঠিয়ে ভাবীর হাতে দিচ্ছে আবার কিছুক্ষণ পরপর ছবিও তুলে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে কলি সবাইকে দেখলো একে একে শুধু চোখে পড়লো না বাবাকে। আম্মুও কি দারুণ সেজেছে আজ তারওপর মুখভর্তি হাসি তো আছেই, থাকারই কথা। আম্মুর সবচেয়ে আদরের ভাতিজা এখন আম্মুর মেয়ে জামাই হতে যাচ্ছে। বলতে নেই, আম্মুর অনেক বছরের সাধ ছিল পরশ ভাইকেই নিজের মেয়ের জামাই করবে কিন্তু পরিস্থিতি আর পারিবারিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নাম এসেছিল পিয়াল ভাইয়ের। ভাগ্য অবশ্য ওপরওয়ালা আগেই লিখেছেন শুধু কয়েকজনের দোয়ায় বোধহয় একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দিক পরিবর্তন হয়েছে। কে জানে আল্লাহ কি রেখেছিলেন তবে যা দিলেন তা আলহামদুলিল্লাহ। কলি মনে মনে ওপরওয়ালার শুকরিয়া জানিয়ে আবারও চারপাশে দৃষ্টি রাখলো। নাহ্ তার বাবাটা এখানেই নেই। বুকের ভেতর টনটনিয়ে উঠলো এক ব্যথা। আর তো মাত্র কয়েক ঘন্টা তারপরই সে চলে যাবে কতকটা দূর৷ আলগা হয়ে যাবে জন্মান্তরের প্রথম সুতো। চাইলেও যখন তখন মা, বাবা, ভাই বোনকে আর পাশে পাবে না৷ বর্তমানের সহজ জীবনটা আটকা পড়ে যাবে কিছু নতুন সুতোয়, কিছু দ্বায়িত্বের বাঁধনে৷ চোখ ভরে এলো কলির। প্রাণপন চেষ্টা করছে যেন জল না গড়ায় এক ফোঁটাও। কর্ণকূহরে একটি বাক্য গোচর হতেই সফল হয়েছে সে এই অশ্রুধারায় বাঁধ টানতে। ‘বর এসে গেছে’ হল জু্ড়ে শুধু এই এক ধ্বনির আলোড়ন। উপচে পড়া জলোচ্ছ্বাস এখন হলের গেইটে। কলি দেখলো তার ফোনে মেসেজ এসেছে। মেসেজ ওপেন করতেই ঠোঁট জুড়ে নেমে এলো প্রশস্ত হাসি।
‘বউয়ের মুখ না দেখে গেইটে আমি একটি টাকাও দেবো না।’
কলি জানে পরশ ভাই যে কথাটা বলল ঠিক সেটাই করবেন। কিন্তু এত আত্মীয়ের ভীড়ে কনে উঠে বেরিয়ে গেলে কেমন দেখায়! গেইট বরাবর মিনিট খানেক সময় তাকিয়ে থেকে খেয়াল করলো পূর্ব দিকে গেইট হলেও দক্ষিণের একপাশ খোলা রেলিং। ওখান থেকে উঁকি দিলে হয়ত দেখা যাবে কিছুটা। কিন্তু সে ওই অব্দি যাবে কি করে! আবারও তার দৃষ্টি ঘুরলো হল জুড়ে। ছোট ভাবীকে দেখা গেল কারো সাথে কথা বলছেন। তৎক্ষনাৎ সে কল দিলো ভাবীর নম্বরে। কলির কল দেখতে পেয়ে ভাবী চলে এলো কলির কাছে।
-কিছু লাগবে কলি?
-ভাবী একটু ওদিকটায় যাব।
-কোন সমস্যা?
কলি ফোন তুলে ভাবীকে দেখালো পরশের মেসেজ। মুচকি হেসে ভাবী তাকে ধরে নিয়ে গেল দক্ষিণ দিকের খোলা অংশটায়। একটুখানি উঁকি দিতেই চোখে পড়ল কালোরঙা শেরোয়ানিতে সিঁদুররাঙা মুকুটের মত পাগড়ি পরা পরশ ভাইকে। ক্লিন শেভড গাল আলোর ঝলকানিতে চমকাচ্ছে দারুণ। আলতো হাতে সে রিপ্লাই লিখল, উপরে তাকান।
মেসেজ পেয়ে সরাসরি উপরে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলেন তিনি। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চোখও টিপলেন প্রেয়সীকে। তারপর বিনা বাক্যেই শ্যালক-শালিকাদের আবদার পূরণ করে গুণে গুণে পুরো বিশ হাজার তুলে দিলেন তাদের হাতে। পরশের কান্ড দেখে রেগে গেল পরশের বন্ধু আর পিয়াল। তারা কত প্ল্যান করলো গেইটে একটা টাকাও দেবে না। কিন্তু এই পরশ তো বিয়ের নামে পাগলই হয়ে গেল৷ আর হবে নাইবা কেন কত সাধনার বিয়ে তার!
রাত নয়টার মধ্যেই বিয়ে হয়ে গেল পরশ কলির। দশটার মধ্যে বরপক্ষ রওনা হবে রাজশাহীর জন্য তাই যতোটা সম্ভব দ্রুত সব আয়োজন শেষ করতে চাইছে সবাই। বিয়ের পর বর কনের মিষ্টিমুখ করাবে বলে পরশকে আনা হলো কলির স্টেজে। পাশাপাশি বসিয়ে তোলা হলো নানা পোজে হাজারো ছবি। স্মৃতির পাতায় জমা থাকবে সকল ফটো -ভিডিও সেই আয়োজনেই কেটে গেল আরও একটি ঘন্টা৷ সময় হলো বিদায়ের। কলির বাবা পুরো সময়ে মাত্র একটিবারই এসেছিলেন মেয়ের সামনে। যখন বিয়ের কাজ চলছে তখন তিনি উপস্থিত ছিলেন। কলি দেখেছিল তার বাবার রক্তিম ফোলা দুটো চোখ। বাবা কেঁদেছে লুকিয়ে তা বুঝতেই যেন কলির কান্না বাড়লো। কবুল বলা মুহূর্তে জ্ঞান হারালো কলি, জ্ঞান হারালো তার মাও৷ যে মানুষটা পুরোটা দিন আনন্দে আটখানা হয়ে হাসিতে ঝলমল করেছিল পুরো সময় সে মানুষটা যে শেষ মুহূর্তে ঢলে পড়বে কেউ ধারণাই করতে পারেনি। বিদায় মুহূর্তে বাবার কাঁধে কলি আর পরশের কাঁধে ছিলেন কলির মা। ফুপুকে আদর, আহ্লাদে সামলে নিয়ে তবেই সে কলিকে নিলো নিজের হাতে। সব আয়োজন নির্বিঘ্নে হলেও ঝামেলা বাঁধলো গাড়িতে বসা নিয়ে। জার্মানে থাকাকালীন কলির সাথে কথায় কথায় পরশ জানতে চেয়েছিল বিয়ে নিয়ে কলির ইচ্ছে। সে বলেছিল তার শখ বিয়েতে সে বাইকে করে শ্বশুর বাড়ি যাবে। পরশ তখন হাসি ঠাট্টায় বলেছিল যদি কড়া রোদ কিংবা বৃষ্টি থাকে তখন! কলি হাসতে হাসতে বলেছিল, হোক রোদ কিংবা বৃষ্টি যাবো তো আমি বাইকে করেই। বরের পিঠে মাথা এলিয়ে এগিয়ে যাব নতুন গন্তব্যে। পরশ ভোলেনি সে কথা। সেও পুরো প্রস্তুতি নিয়েই বিয়ের আয়োজন রাতে রেখেছিল৷ তার ধারণা ছিল রাতের বেলা রোদ থাকবে না কিন্তু বৃষ্টি নিয়ে তার টেনশন নেই। দুটো রেইনকোট সে আগেই কিনে রেখেছিল। আষাঢ় মাসে বিয়ের ডেট বৃষ্টির কোন গ্যারান্টি নেই ভেবেই তার প্রস্তুতি। কিন্তু দু পরিবারের কেউ রাজী হলো না পরশের সিদ্ধান্তে। রাত করে ঢাকা টু রাজশাহী ভীষণ লম্বা সফর বাইকে করে অসম্ভব! তার ওপর বিয়ের কনে ডাকাত, ছিনতাইকারীর কবলে পড়লে রক্ষা নেই। পরশ মানলো না কোন যুক্তি তার সাথে আরও বন্ধুরা আছে। সবাই ইচ্ছে করেই বাইকে করে এসেছে। পরিকল্পনা তাদের ঠিক তিন বছর আগের সেই দিনটির মতই ছিল। শেষ পর্যন্ত রওনা হলো পরশের ইচ্ছেমতই। ঢাকা ছেড়ে দু ঘন্টার পথ পেরুতেই বাইক থামালো পরশ। বৃষ্টিধারা তখন থেমেছে সবে। রাস্তার ধারে বাইক থামলো একে একে সবকটাই। বন্ধুরা সকলে সারি সারি দাঁড়িয়ে পড়লো সামনে তাকিয়ে পরশ কলি পড়ে রইলো সবার পেছনে। পরশের এই বাইকে যাওয়ার পরিকল্পনা কলি অনেক আগেই টের পেয়েছিল কিন্তু এখন আবার কি করবে। শুনসান হাইওয়েতে একটু পরপর সাঁই সাঁই করে চলে যাচ্ছে বাস, ট্রাক। কলি এদিক সেদিক তাকিয়ে আবার ফিরল পরশের দিকে। বলতে চাইলো কৌতূহলী কিছু কথা৷ পরশ সুযোগ দিলো না। কলি মুখ খোলার আগেই পরশ আঁকড়ে ধরলো কলির ঠোঁট৷ গাঢ় অন্ধকার, বৃষ্টিহীন এখন শীতল হাওয়ার রাজত্ব চারপাশে৷ কলির চোখ দুটে বুঁজে এলো আপনাআপনি গাল গড়িয়ে পড়লো তপ্ত স্রোতধারা। পরশ ছাড়লো না অনেকটা সময়। দম আটকে আসার আগ মুহূর্তে বুঝি ছাড়লো সে কলিকে। এরপর বিরতিতে পার হলো মাত্র সেকেন্ড ত্রিশ তারপর আবারও অধর নিলো নিজ দখলে। আকষ্মিক এমন প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ে কলির নিথর দশা। আবারও শুরু হচ্ছে টিপটিপ বৃষ্টি কিন্তু কারো কোন তাড়া নেই, কারো কোন সাড়াও নেই। পরশ থামলো, সময় নিলো কলির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, শাস্তি তোর কম হয়েছে। পূরণ করব বাড়ি গিয়ে প্রথম দফা এখানেই দিলাম। বাড়ি গেলেই আর তোকে ভাগে পাব না অনেকটা সময় কিন্তু আমি তো অত সইতে পারব না। প্রথমটা ছিল আমাকে তিনটি বছর বিরহে রাখার শাস্তি দ্বিতীয়টা ছিল সেই দিনের যেদিন কাজী অফিসে আমায় ভালোবাসিস না বলেছিলি তারজন্য। কলির মনে পড়ে গেল পরশ ভাইয়ের সেই রক্তিম চোখ৷ বছর তিন আগের সেই দিন কলির বাবাও যখন কাজী অফিসে উপস্থিত ছিলেন কলি ভয় পেয়েছিল খুব৷ তার মনে হচ্ছিল পরশ ভাই আর আনিকা মিলে তাকে ধোঁকা দিলো। তার বাবার চোখে তাকে দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট কন্যাটি বানিয়ে দিলো৷ বাবা যখন তাকে ধমকে উঠলেন, পরশকে ভালোবাসিস হ্যা বা না তে জবাব দে৷ কলি ভয় পেয়েছিল খুব৷ পরশ আশায় ছিল কলি মিথ্যে বলবে না কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে কলি মিথ্যে বলেছিল। সে বলেছিল, ‘না পরশ ভাইকে আমি ভালোবাসি না।’
কলির এই মিথ্যে স্থায়ী হয়েছিল মাত্র পাঁচ মিনিটের মত। কলির না শুনে তার বাবা তক্ষুনি হাত তোলেন পরশের গালে। পর পর থাপ্পড় লাগান অনেকগুলো তা দেখেই কলি কান্নার জোয়ারে বলে দেয় সে ভালোবাসে পরশ ভাইকে। বিয়েটা সেদিন হয়নি তাদের। পরশ শূন্য আত্মা হয়েই সেদিন দেশ ছেড়ে যায়। কলির বাবা কন্যাবিমুখ হয়ে পড়েন। দিন কাটে ছন্নছাড়া হয়ে পরশ কলির তবুও কেউ কারো সাথে কোন যোগাযোগ রাখে না। এরই মাঝে পরশের বাবাও শেষ মুহূর্তে ছেলের লোকেশন ট্রেস করে এসে পৌঁছায় এয়ারপোর্ট। ঝামেলা করার ইচ্ছে নিয়ে এলেও ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি থমকে যান সেদিন৷ বিদায় মুহূর্তে না চাইতেও বুকে জড়িয়ে ধরেন ছেলেকে। পরশ দেশ ছেড়েছে জানতে পেরে ত্রয়ীর বাবা আক্রোশে ফেটে পড়েন৷ তিনি হুমকি দেন তার মেয়েকে পরশ ছেড়েছে তিনি কিছু বলবেন না যদি পিয়ালের সাথে বিয়ে দেন৷ পিয়াল প্রথমেই নাকোচ করে তার প্রেমিকাকে ছাড়া কাউকেই সে বিয়ে করবে না। এমনকি ত্রয়ীর মুখের ওপর বলেছিল, অন্যের ইউস করা মাল আমি কোন দায়ে নিতে যাব যেখানে আমার ইনটেক লাভই আছে।
ত্রয়ীর সেদিন লজ্জা লেগেছিল খুব। আত্মসম্মান যেখানে একদমই ছিল না সেদিন হুট করেই যেন তার আত্মসম্মান জাগলো। নিজের বাবাকে থামিয়ে দিল সকল প্রকার জোরজবরদস্তি থেকে। পিয়াল আর দেরি করেনি এরপর। বাবার অনুমতি ছাড়াই সে বিয়ে করে ফেলে। মনে মনে ভীত ছিল বাবা বোধহয় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে বাড়ি থেকে কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি৷ বাবা বদলে গেছেন পরশ ভাইয়ের চলে যাওয়ায়। মায়ের সাথেও সম্পর্কে তিনি শিথিলতা এনেছেন। পরশ ভাই প্রথম ছয়টি মাস কারো সাথে কোন যোগাযোগ রাখলেন না। কলির বাবাও কলির কোন খোঁজ রাখলেন না মেয়ের। বড় চাচু নিজে খোঁজ নিতে সেই সাথে কলির পড়ার, হলে থাকার খরচও দিতে থাকলেন। ভাইয়েরাও পিছিয়ে রইলেন না এ দিক থেকে তবুও দিন শেষে কলির অন্তর ফাঁকা রয়ে গেল।তার প্রিয় দুটি পুরুষের সাথেই যখন যোগাযোগ শূন্য তখন হঠাৎ একদিন বড় মামা এলেন কলির সাথে দেখা করতে। অনেকটা সময় নিয়ে কথা বলে জানতে পারলেন পরশ তার সাথেও কোন যোগাযোগ রাখেনি৷ মামা এরপর গেলেন বোনের বাড়ি বোনের কাছে। দু হাত তুলে ক্ঢমা চাইলেন কলির বাবার কাছে সেই সাথে আবদার রাখলেন সব ভুলে ভাগ্নিকে ছেলের বউ করার। কলির বাবারও মন নরম হয়ে গেল। পরশের দেশ ছাড়ার ছয় মাসের মাথায় দু পরিবার মিলেমিশে ঠিক করে ফেলল পরশ কলির বিয়ে অথচ এ খবর জানলো স্বয়ং বিয়ের পাত্রই। প্রত্যেকেই আশায় রইলো পরশ ফোন করবে আর তারা সুখবর দেবেন। নাহ্ তাদের আশা পূর্ণ হলো না। ছয় মাস গিয়ে ঠেকলো সাত মাসের মাথায়। কলিও অপেক্ষায় দিন গুনতে গুনতে একসময় অধৈর্য্য হয়ে পড়লো। তারপর হঠাৎ একদিন তার মনে হলো পরশের কানে বিয়ের খবর পৌছানোর উপায় সে পেয়ে গেছে। কলির বান্ধবী আনিকার বিয়ে হয়ে গেছে কিছুদিন আগেই আর পাত্র ছিল পরশেরই কোন বন্ধু। পরশ কলিকে এক করার পরিকল্পনা করতেই গিয়ে আনিকার প্রেম হয়ে যায় পরশের রাজশাহীরই এক বন্ধুর সাথে। কলি আর দেরি না করে আনিকার সাথে দেখা করে। কথায় কথায় বিয়ে ঠিক হওয়ার কথা আনিকাকে জানালে সেও তার বরকে জানায় সে কথা। আনিকা জানতো না পরশের সাথে যোগাযোগ আছে এখনও তার বরের। অন্যদের মত সেও ভাবতো পরশপর খোঁজ বন্দুরাও জানে না। কিন্তু কলির ধারণাই ঠিক পরশের সাথে তার সকল বন্ধুরই যোগাযোগ আছে। ঠিক দু দিনের মাথায় পরশের ফোন এলো তার বাবার কাছে এর পরের ফোনটা এলো কলির বাবার কাছে। এবং সর্বশেষ কলটা এলো কলির কাছে৷ মনে মনে কলি ঠিক করেছিল কতশত শাস্তি দেবে সে পরশ ভাইকে। কিন্তু একি হলো! উল্টো পরশ ভাই তাকেই শাস্তি দিলো মধ্যরাতের আঁধার ঘেরা বর্ষণের রাতে। প্রেমের বর্ষণে তাকেই ভাসিয়ে দিলো নাম না জানা অনুভূতির সাগরে। শাস্তি পর্ব শেষ করে আবারও যাত্রা শুরু হলো গন্তব্যে। আঁধার কেটে এগিয়ে এলো পরশ কলি নতুন ভোরের পথে। ভালোবাসার প্রণয়বর্ষনে ভিজতে ভিজতেই সমাপ্তি হলো প্রমেবর্ষণের।
-রূবাইবা মেহউইশ
___________সমাপ্ত__________
(