হৃদয়জুড়ে প্রেয়সীর আভাস পর্ব -০৪+৫

#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস
#পর্ব_০৪
#মোহনা_হক

-‘রুয়াত তুই না এখনো বিয়েতে রাজি না তাহলে এতো রাতে আমার দেবরের সাথে দেখা করতে এসেছিস কেনো?’

‘হাতে মোবাইল নিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে ইনিমা। এক মেয়েলী কন্ঠস্বর শুনে আয়াজ রুয়াত কে ছেড়ে দিলো। রুয়াত ছাড়া পাওয়ার পর ছিটকে দূরে সরে গেলো। যাকে নিয়ে এতো ভয় পাচ্ছিল সে এখন এসে হাজির। ভয়ে মাথা তুলতে পারছে না। একবার যদি তার বোন বাবা মায়ের কাছে এসব কথা বলে দেয় নিশ্চয়ই তার মান সম্মানের ছিটেফোঁটা ও থাকবে। আয়াজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আছে। রুয়াতের মনে শুধু একটাই ভয় ইনিমা আয়াজের শেষ কথাটা শুনে ফেলেছে কিনা! প্রথম প্রথম কি ভালো অভিনয় দেখায়। তারপরই নিজের আসল রূপে চলে আসে। রুয়াত নির্লজ্জ ভাবতে লাগলো আয়াজ কে। আর এমন আকস্মিক ঘটনা হবে মাথায় ও আসেনি তার। একরাশ বিশ্বাস নিয়ে এসেছিলো সে এখানে।’

‘ইনিমা এগিয়ে গেলো আয়াজের সামনে।’
-‘তুমি এতো রাতে আমাদের বাসার সামনে?’

‘আয়াজ জাফরি কে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বললো-‘
-‘আপনার বোন জাফরি কে দিয়ে কল দিয়েছিলো আসার জন্য। আর তার কথা কি ফেলে দেওয়ার মতো সাধ্য আমার আছে?’

‘ইনিমা হেসে দিলো। তার বোন যেনো মন থেকে মেনে নিক এটাই চাওয়া। আর এই ব্যাপারে মোটেও কিছু মনে করেনি সে। কিন্তু তৎক্ষনাত হাসি বন্ধ করে বললো-‘

-‘বিয়ের আগে এতো কিসের দেখাদেখি?’

‘ইনিমা তার বোনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রুয়াত ভয়ে বিরবির করছে। এভাবে ফেঁসে যাবে ভাবেও নি।’

-‘রুয়াত তুই কেনো এতো রাতে আমার দেবর কে ডেকে এনেছিস? তুই জানিস বাবা মা জানলে কি সর্বনাশ হয়ে যাবে। বা ওই বাড়ির কোনো লোকেরা যদি এটা জানে মান সম্মান থাকবে আমাদের? মোটেও কাজটি ভালো করিস নি।’

‘কি উত্তর দিবে বোনকে সেটাই খুঁজছে রুয়াত। আশে পাশে তাকালো। আর আয়াজ দু’বোনের কাহিনী শুধু দর্শকের মতো দেখে যাচ্ছে। তার কিছু বলার ভাষা নেই। এখন মনেহচ্ছে এখানে সে অতিথি। ‘

‘রুয়াত ভয়ে কান্না করে দিলো। বোনের কান্না দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ইনিমা। সে তো শুধু দুষ্টুমি করেছে। কিন্তু তার বোকা বোন কি তা বুঝবে? ইনিমা তার বোনের চোখের পানি মুছে দিলো। বোনের কাঁধে হাত দিয়ে বললো-‘

-‘আরে আমি তো মজা করেছি। পাগলি মেয়ে কোথাকার। তোকে তো আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি, জানি তুই কেমন মেয়ে। কাঁদিস না আমি শুধু তোকে একটু ভয় দেখানোর জন্য বলেছি। আর তুই আমায় উপর সম্পুর্ণ বিশ্বাস রাখতে পারিস, এসব কথা কেউ জানবে না। কাউকে বলবো না আমি।’

‘ইনিমা জাফরি কে কোলে নিলো। তারপর আয়াজের উদ্দেশ্যে বললো-‘

-‘শুনো এমপি মহোদয় আমার বোন কে মানানোর দায়িত্ব তোমার। যেহেতু তোমার মতামত নিয়েই বিয়েটা ঠিক হয়েছে। কেউ রুয়াতের থেকে কোনো রকম মতামত নেয়নি। আমার বোনের কষ্ট কিন্তু দেখতে পারবো না আমি। যদি তুমি না মানাতে পারো তাহলে এ বিয়ে হবে না। আর এতো রাতে দেখা করতে এসেছো, তোমাকে দাঁড়িয়ে রেখেছে অনেকক্ষন যাবত তাই তোমার উচিৎ ওকে এমনি এমনি ছেড়ে না দেওয়া। আর শুনো সব কাজ শেষ হলে আমার বোন কে নিজ দায়িত্বে বাসার দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবে। একদিন সময় করে এসো বাসায়। এখন বললেও আসবে না জানি। তাই এখন আর বলবো না বাসায় আসার জন্য। খুব ভালো করেই চেনা আছে তোমাকে। আসছি আমি।’

‘ইনিমা জাফরি কে নিয়ে চলে যায়। এখন তো বিপদে পড়েছে রুয়াত। মনে শুধু একটাই আক্ষেপ এখন তার বোন কেনো সাথে নিয়ে গেলো না তাকে। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়াজ। তার প্রেয়সী যে ছটফট করছে তা ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে। এক হাত দিয়ে চুল হাত বুলাচ্ছে আনমনে। প্রেয়সীর এমন কাহিনী উপভোগ করছে সে। তার ভাবী খুব বড় একটা সুযোগ দিয়ে গেলো। অবশ্যই তার যথাযথ ব্যবহার করা প্রয়োজন। ‘
‘রুয়াতের মনে হচ্ছে তার কপালে খুব জোড়ে কেউ আঘাত করলে ভালো লাগতো। এমন কপাল মোটেও পছন্দ হচ্ছে না তার। এক অসহনীয় যন্ত্রণা। এভাবে কি একটা পুরুষের সামনে কখনো দাঁড়িয়ে থেকেছে সে? তাও আবার এতো রাতে? আর তার বোনের কথা বলে ও বা কি হবে। সে তো নিয়ে গেলো না!’

‘আয়াজ রুয়াতের সামনে এসে দাঁড়ালো। গালে হাত দিয়ে মাথা তুলে দিলো। রুয়াতের চোখের কার্নিশে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। প্রেয়সীর এহেন অবস্থা দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না সে। হাতের একটি আঙুল পানিগুলো মুছে দিলো পুরোপুরি।’

‘কন্ঠ মিইয়ে এলো আয়াজের। নরম স্বরে বললো-‘

-‘কিছু হলে কাঁদতে হবে এমন কোনো কথা আছে? আর কখনো যেনো অন্তত আমার সামনে কাঁদতে না দেখি। আর কাঁদলেও আমি দেখে ফেলার আগেই চোখের পানি মুছে ফেলবে।’

‘রুয়াত অপলক ভাবে তাকিয়ে আছে। এই ব্যক্তি কি সে যে প্রথম দিন এতো গম্ভীরস্বরে কথা বললো? রুয়াত আসলে চিনতে পারছে না আয়াজের এরুপ রূপ। চোখেও পলক পড়ছে না। যেনো এক অচেনা পুরুষ কে দেখছে আজ।’

‘প্রেয়সীর এমন আচরণে আয়াজ আবেগে আপ্লুত। জমিয়ে রাখা সব ভালোবাসা কি উগ্রে ফেলবে আজ। নিজের ভিতর লুকিয়ে থাকা সে আয়াজ কি বের হয়ে আসবে? আয়াজ ছেড়ে দিলো রুয়াতকে।’

‘সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। এক ঘন নিঃশ্বাস বের হয়ে আসলো। আবারও রুয়াতের দু বাহুতে হাত দিয়ে বললো-‘

-‘তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা আজ কালকের নয়। সে ২ বছর আগে থেকে ভালোবাসি আমি তোমায়। ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের সাথে কম কথা বলতে পছন্দ করি বলেই তোমাকে ভালোবাসার আগে কখনো কথা বলিনি। আর যখন ভালোবেসেছি তখন কথা না বলার কারণ হচ্ছে তোমার প্রতি আমার কোনোরূপ অধিকার ছিলো না। যেদিন জাফরির পৃথিবীতে আগমন ঘটে ওদিন থেকে ভালোবাসি তোমায়। ভাবি কে আমাদের বাসা থেকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পর তুমি আর তোমার মা এসেছিলে কাঁদতে কাঁদতে। তোমার বোন ওটিতে থেকে যুদ্ধ করছে আর তুমি বাহিরে দাঁড়িয়ে থেকে কাঁদছো রীতিমতো। তখন আমার মাথায় শুধু একটাই কথা এসেছিল একটা মেয়ের কান্না এতো সুন্দর হতে পারে কিভাবে। কি তোমার মনে হচ্ছে না আমি পাগল? হ্যাঁ আসলেই আমি পাগল। শুধুমাত্র তোমার জন্য।’

‘কিছুক্ষনের জন্য থামলো আয়াজ। আবার বলা শুরু করলো।’

-‘সেদিন তোমাকে কাঁদতে দেখে মনের ভিতর এক ঝড় বয়ে চলেছিলো। বিশ্বাস করো এর আগে তোমাকে শুধু আমি আমার ভাইয়ের শালীকা হিসেবেই দেখতাম। তোমাকে ভালোবাসার পর ও কখনো অন্য রকম নজরে দেখা হয়নি। তুমি যদি সেদিন না কাঁদতে এই বরফের ন্যায় আয়াজ কখনো গলে তরল পদার্থে পরিণত হতো না। না আয়াজ তোমাকে কখনো ভালোবাসতো। ওইদিনের পর থেকে তোমাকে নিয়ে আমার কল্পনায় এক নতুন জীবনের শুরু হয়। যেখানে তুমি আমি ব্যতিত আর কেউই ছিলো না। নিজের মান সম্মানের কথা ভেবে তোমায় চেয়েছিলাম ভুলে যেতে, কিন্তু আমি ব্যর্থ। বরাবরের মতোই ব্যর্থ আমি। ভুলে যাওয়াটা দুঃস্বপ্নের মতো ছিলো আমার কাছে। ভালোবেসেছিলাম তাও অন্য পুরুষের মতো তার প্রেমিকার কাছে যেভাবে ভালোবাসার কথা বলে, সেভাবে বলতে পারিনি। আগের মতোই তোমার সাথে কথা বলা হতো না আমার। আমি ভাবতাম মানুষ কি বলবে আমায়! তুমি শুধু আমার ভাবীর বোন বলেই কথা বন্ধ রেখেছিলাম। আমার নিজের সম্মানের দিকে তাকিয়ে। এখন কেনো জোড় করেছি জানো? তোমাকে ছাড়া আয়াজ থাকতে পারবে না। পারছে না এখনো। অনেক কষ্ট হয়েছিলো আমার। না পেরে বাবা মা কে তোমার কথা জানাই। তারাও আলহামদুলিল্লাহ বলে দিলো। তোমার বাবা মা সবটা জেনেই রাজি হলো। তোমার মতামত কেনো নেওয়া হয়নি আমি বলেছিলাম। তোমার বাবার সাথে একান্ত কিছু কথা বলেছি আমি। আবার তোমার ভালোর জন্য ও তোমাকে এখন বিয়ে করিনি। সামনে এক্সাম তোমার তাই কোনো প্রেশার দিতে চাইনি তোমায়। যখন তোমায় ভালোবাসি তখন তুমি নিতান্তই ছোট একটা মেয়ে ছিলে। চাইলেও তোমাকে পাবো না তখন জেনে চুপ ছিলাম। কিন্তু এখন পরিস্থিতি কঠিন হওয়ার আগেই তোমাকে আমার করে নিলাম। তোমাকে ভালোবাসার জন্য আমার তোমার ভালোবাসার প্রয়োজন নেই। আমারটাই যথেষ্ট। এসব ভেবে নিজের মন কে ছোট করার কোনো মানেই হয় না প্রেয়সী। এই দু’মাসের ৩দিন চলে গিয়েছে। সময় ফুরিয়ে আসছে। এবার তুমিও একটু একটু করে ভালোবেসো। নাহলে আয়াজের ভালোবাসা একসাথে সব সহ্য পারবে না তুমি। কাল থেকে সম্পুর্ণ নজরদারি থেকে শুরু করে সব সময় না হোক কিছু কিছু সময়ে আয়াজ তোমার পাশে থাকবে। শুধুমাত্র তোমার মন পরিবর্তন করার জন্য। মানুষ বলে নিজের দুর্বলতা কারও কাছে প্রকাশ করতে নেই। আমি সব সময় কথাটা মেনে চলতাম। কিন্তু আজ তোমার জন্য সে নিয়ম লঙ্ঘন করেছি। আয়াজ তার প্রেয়সীর জন্য সব করতে পারে। আমি আমার সব দুর্বলতার কথা তোমায় বলেছি। ‘

‘রুয়াত আয়াজের কথা শুনে স্তব্ধ। আর এতোদিন তার বাবা মায়ের উপর অযথাই অভিমান করে বসেছিলো সে। কিছুক্ষণ আগে আয়াজের উপর জমে থাকা ঘৃণা ও বাতাসের সাথে উড়ে চলে গিয়েছে মনেহচ্ছে। একটি মানুষ এমন নিঃসার্থ ভাবে ভালোবাসতে পারে তা জানা ছিলো না আগে।’

‘আয়াজ রুয়াতের মাথাটা হালকা করে তার বুকের সাথে চেপে ধরলো। পরক্ষণেই বললো-‘

-‘এ স্পর্শ হারাম না প্রেয়সী। তুমি আমার বাগদত্তা। তোমার উপর আমার এখন সব রকম অধিকার আছে। একদম শুদ্ধ মনে স্পর্শ করেছি আমি তোমায়। যা পানির ন্যায় সচ্ছ। কখনো ভয় করো না আমার পেশা নিয়ে। আমি মা’রা গেলেও তোমাকে একদম অক্ষত রেখে যাবো। আমার শত্রুরা আমার কঠোর রূপ দেখে। সাধারণ জনগণ দেখে একজন নিষ্ঠাবান মানুষ হিসেবে। আর তুমি আমায় দেখবে তোমার ভয়ংকর প্রেমিক হিসেবে।’

#চলবে…#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস
#পর্ব_০৫
#মোহনা_হক

-‘তোমার মতামত আমি এখন চাই না। যখন তুমি আমায় ভালোবাসবে তখন চাইবো। আর সেটা হবে বিয়ের আগেই।’

‘রুয়াতের কিছু বলার ভাষা নেই। মানুষটার প্রত্যেকটা কথা তার কানে ভাসছে। এক একটা কথায় এতো হিংস্রতা। মানুষটা যে তাকে এতো ভালোবাসে তা জানা ছিলো না। এক হিসেবে এখানে এসে ভালোই কাজেই দিয়েছে মনেহচ্ছে রুয়াতের। অন্তত নিজের মনের যে কৌতূহল আছে তা মিটাতে পেরেছে। এরপর থেকে তো লোকটার সামনে আসা দুষ্কর হয়ে যাবে। ‘

‘প্রেয়সীর নিরবতা ভাঙ্গার জন্য আয়াজ বললো-‘
-‘কলেজে মোবাইল নিয়ে যাও?’

‘আয়াজের এহেন প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো রুয়াত। সে তো মোবাইল ইউজ করতে পছন্দ করে না, আর সে জায়গায় মোবাইল নিয়ে যাবে তাও আবার কলেজে? আয়াজের কথায় মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো। সে মোবাইল নিয়ে যায় না কলেজে। ‘

‘আয়াজ ভেবেছিলো রুয়াত মুখ দিয়ে কিছু বলবে। কিন্তু না সে ইশারায় দেখাচ্ছে। রেগে গেলো সে।’
-‘তোমার মুখ থেকে শুনতে চেয়েছি। ইশারায় নয়।’

‘রুয়াতের গলা শুকিয়ে আসলো যেনো। আবার সেই কঠোর রূপ দেখাচ্ছে তাকে। না বলেও তো উপায় নেই। চোখ মুখ খিঁচে উত্তর দিলো-

-‘না মানে কলেজে মোবাইল নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ। ‘

‘দু’হাত বুকে গুঁজে দাঁড়ালো কঠোর মানব। মুখ দিয়ে কথা বলতে কি সমস্যা হয় তার প্রেয়সীর সেটাই বুঝছে না। মেয়েটা অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির।’

-‘তো কথাটা কি মুখ দিয়ে বলা যেতো না? এরপর থেকে আমার সাথে ইশারায় নয় মুখে কথা বলবে। এর যেনো নড়চড় না হয় । ‘

‘রুয়াত মাথা নাড়িয়ে জ্বী বললো। তার প্রেয়সীর এমন কান্ডে নিঃশব্দে হেসে দিলো। এক অন্য রকম শান্তি লাগছে রুয়াত কে পাশে পেয়ে। মন চায় আজ সারারাত দু’জনে একসাথে শহরের অলিগলিতে হেঁটে বেড়াতে। কিন্তু তা অসম্ভব। ইচ্ছেটাকে বর্জন করে ফেললো আয়াজ। আগে বিয়েটা হোক শুধু। তারপর তার সমস্ত ইচ্ছে পূরণ করবে। ‘

-‘কলেজ শেষ হওয়ার পর আমি দেখা করবো। আমার গাড়ি যাবে তোমার কলেজের সামনে। এখন এই গাড়িটাকে দেখে নেও এটাই থাকবে। ধরে নেও আমার সাথে দেখা করা তোমার প্রতিদিনের রুটিন। না চাইলেও দেখা করতেই হবে।’

‘রুয়াত বুঝলো না প্রতিদিন দেখা করতে হবে কেনো? আর মানুষ কি ভাববে দেখা করলে। আয়াজের এ কথায় একদমই সায় দিতে পারলো না।’

‘একটা বড়সড় ঢোক গিলে রুয়াত বললো-‘
-‘দুঃখিত। আমি এভাবে দেখা করতে পারবো না প্রতিদিন। মানুষ জানলে বাজে কথা আমাকে নিয়ে।’

‘আয়াজের ভাব-সাব অন্য রকম।’
-‘তাই? তো এতো রাতে আমাকে ডেকে আনার সময় এটা মনে ছিলো না?’

‘রুয়াত লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। নিজের কাজের জন্য বেহাল দশা আজ। আর কক্ষনো ও এমন করবে না সে।’

-‘এর উত্তর আপনি দিতে পারবেন না জানা আছে। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে চলো বাসায় দিয়ে আসি।’

-‘আপনি চলে যান। আমি যেতে পারবো। ‘

‘আয়াজ রুয়াতের কোনো কথা শুনলো না। রুয়াতের হাত সুন্দর করে মুঠোয় নিয়ে নিলো। অতঃপর বাসার দরজা পর্যন্ত পৌছে দিলো ভাবীর কথা মতো। শেষ মুহূর্তে আয়াজ কিছু বলার সুযোগ দেয়নি। দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে ফেললো। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে তাই নিজ ইচ্ছেতেই সেখান থেকে চলে আসলো। প্রেয়সীর সামনে বেশিক্ষণ থাকলে বেসামাল হয়ে যাবে। এক তীব্র যন্ত্রণা অনুভব হয় তার। ‘

(*)

‘সকাল ৭টায় রুয়াতের ঘুম ভেঙে গেলো আচমকা। মাঝে মাঝে এই সমস্যা হয় তার। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আর ঘুম আসে না। তাই রুয়াত আর ঘুমানোর ও চেষ্টা করলো না। উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে আসলো। সোফায় বসে বসে ভাবছে আদোও কি আজ আয়াজ দেখা করবে নাকি! কাল রাতের কথা ভেবেই শিউরে উঠছে সে। কি ভয়ংকর রাত ছিলো। এ জীবন থেকে মুক্তি পেতে পারলেই বাঁচে সে।’

‘হান্নান মজুমদার ঘুম থেকে উঠে নিচে আসলো। তার ছোট মেয়েটা বসে আছে সোফায়। তাই তিনি সর্বপ্রথম সেখানেই গেলেন। মেয়ের পাশে বসলেন। রুয়াত তার বাবা কে দেখে জড়িয়ে ধরলো। হান্নান মজুমদার খুশি হয়ে আলতো করে মেয়ের মাথায় হাত বুলাচ্ছে। আজ চারদিন পর মেয়েটা একটু তার কাছে এসে বসলো। বিয়েতে তার মতামত নেওয়া হয়নি বলে সবার সাথেই কথা বলা কমিয়ে দিয়েছিলো। যখন রুয়াত দেখেছে সে কথা না বললে কেউই বলছে না, তার রাগ ও ভাঙ্গাতে আসছে না তখন আরও রাগ করে কথা বন্ধ করে দিয়েছে। হান্নান মজুমদারের কাছে তার মেয়েরাই তার মানসিক শান্তি। মেয়েদের জন্য তিনি জীবন ও দিয়ে দিতে পারবেন। দু মেয়েকেই অসম্ভব ভালোবাসা তিনি। মেয়ের ওমন রাগ করে কথা বলা বন্ধ করে দেওয়া মোটেও সইতে পারছিলেন না। কিন্তু মেয়ের ভালোর জন্যই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো। আর যে পুরুষ তার মেয়েকে ভালোবাসার পর ও একবারও কথা বলেনি সে নিঃসন্দেহে ভালো হবে তার ছোট মেয়ের জন্য। আজ যে তার মেয়ে নিজ থেকে তার কাছে এসেছে তার মানে মেয়ের রাগ একদম হাওয়া হয়ে গিয়েছে।’

‘রুয়াত তার বাবা কে জড়িয়ে ধরে টিভি দেখছে। হান্নান মজুমদার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন-‘

-‘আজ কলেজ যাবে না আম্মা?’

‘টিভিতে মগ্ন রুয়াত। বাবার কথায় ধ্যান ভাঙে তার। বাবার দিকে বললো-‘

-‘যাবো বাবা। এখনো সময় হয়নি!’

‘আবারও তাকালো টিভির দিকে। মেহরুবা ফাইরোজ এসে বাবা মেয়ের অমায়িক সুন্দর মুহুর্তের সাক্ষী হয়ে গেলেন। তার মেয়েটা অবশেষে স্বাভাবিক অবস্থায় এসেছে। হান্নান মজুমদারের সামনে এক কাপ চা দিয়ে গেলেন। আর রুয়াতের উদ্দেশ্যে বললেন-‘

-‘রুয়াত নাস্তা বানানো হয়েছে। খেতে আয়। টেবিলে দিচ্ছি আমি।’

‘রুয়াত হেলেদুলে টেবিলে এসে বসলো। কিছু সময় পর ইনিমা জাফরি কে নিয়ে এসেছে টেবিলে। রুয়াতের পাশের চেয়াটায় ইনিমা বসে পড়লো। বোন কে দেখে লজ্জায় কুঁকিয়ে গেলো। কিন্তু ইনিমা সুন্দর একটা হাসি উপহার দিলো।’

‘একটু রুয়াতের দিকে ঘেঁষে আসলো। গলার আওয়াজ কমিয়ে দিয়ে বললো-‘

-‘কিরে কাল রাতে কি হয়েছে? আমি শুনতে পারিনি তোর থেকে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। আমার দেবর কেমন? কিছু টের পেয়েছিস?’

‘রুয়াত ঘাবড়ে গেলো। বোনের দিকে তাকালো। বিষয় গুলো কে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বললো-‘
-‘কিছু হয়নি আপু।’

‘ইনিমার বিশ্বাস হলো না। যেভাবে আয়াজ রুয়াত কে ধরেছিলো সেখানে কোনোমতেই রুয়াতের কথা প্রযোজ্য নয়।’

-‘মিথ্যে বলিস না রুয়াত। আমি কি কাল কিছু দেখিনি মনে করেছিস? আমি সব দেখেছি এবং সবগুলো কথা শুনেছি। তুই যদি না বলিস তাহলে আমি কথাটা সবাইকে বলে দিবো।’

‘রুয়াত বোনের হাত চেপে ধরলো। এমন ডেঞ্জারাস বোন তার। একদম দুর্বল জায়গায় হাত দিলো। কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো-‘

-‘ওনি শুধু ওনার কথাগুলো ক্লিয়ার করেছিলেন। সত্যিই আর তেমন কিছু হয়নি। একটুও মিথ্যে বলছি না আমি।’

‘ইনিমা মানলো রুয়াতের কথা। যাই হোক তার বোন কখনো মিথ্যে বলেনি তার সাথে। তাই বিশ্বাস করলো।
রুয়াত তার বোনের কাছে মিথ্যে বলে চোরের মতো মুখটা করে ফেললো। নিজেকে অনেক বড় আসামী মনে হচ্ছে এখন তার। কিন্তু সত্যি কথা বললে যে তার বোন সারাদিন এগুলো নিয়েই তাকে ব্ল্যাকমেল করবে। সে ভেবে কথাটা লুকিয়ে গেলো। এখন তাড়াতাড়ি নাস্তা খেয়ে এখান থেকে উঠে যেতে পারলেই হলো। এভাবে চোরের মতো বসে থাকতেও লজ্জা লাগছে। আনমনে নিজেকে হাজার গালি দিয়ে ফেললো সে। ‘

(*)

‘কলেজ আসার পর রুয়াত সব খুলে বলে নিমি কে। নিমি রুয়াতের কথা শুনে বেশ মজা পেয়েছে। তার সহজ সরল ভোলাভালা বান্ধুবীর অবশেষে একজন ভয়ংকর প্রেমিক জুটলো। কপাল আছে বলতে হবে। আর রুয়াত কথার মাঝে অনেকবার চাপটি মেরেছিলো নিমির মাথায়। কারণ সে সব দোষ নিমিকেই দিচ্ছে। বেচারি বসে বসে বান্ধুবীর বকা শুনছে। তার বান্ধুবী কি আর এমন প্রেমিকের মূল্য বুঝবে? বুঝলে তো আর এতোগুলা মাইর দিত না। বান্ধুবীর অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে নিলো নিমি। একটাও শব্দ বের করলো না মুখ থেকে। আজ বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে রুয়াত কে।’

‘নিমি আমতাআমতা করে বললো-‘
-‘ যাইহোক তোর ওনি কিন্তু সেই।’

‘রুয়াত চোখ রাঙালো।’
-‘চুপ কর নিমি। কথা বলবি না তুই। তোর জন্য আমি লজ্জিত হয়েছি আপু ও ওনার সামনে।’

‘নিমি ঠোঁঠ উল্টে ফেললো-‘
-‘হুহ আমার কথা না শুনলেই হতো। আমি তো শুধু তোর ভালোর জন্য বলেছি। তুই কেনো কাজটা করতে গেলি। আমি তো জোর করিনি।’

‘রুয়াত উঠে পড়লো। নিমির থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়ালো। দু’জনে রওনা হলো ক্লাসের দিকে।’

‘কলেজ ছুটি হলো দুপুরে। নিমি আজ রুয়াত কে ছাড়ছে না। কতক্ষণ ধরে বকবক করেই চলেছে। রুয়াত না চাইতেও নিমির বকবক শুনছে। একটানা ক্লাস করে ক্লান্ত সে। কিন্তু নিমির মাঝে একটু ক্লান্তি নেই। মেয়েটা একটু অন্য রকম। মাঠের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে কথা বলছে তারা। রুয়াত আর নিমির মাঝে এক অচেনা ব্যক্তির আগমন ঘটলো। ‘

‘হাসি মুখে ছেলেটা বললো-‘
-‘আপুরা কেমন আছেন?’

‘অচেনা পুরুষের কন্ঠে দু’জনের দৃষ্টি সেদিকটায় গেলো। ভ্রু যুগোল কুচকে এলো রুয়াতের। নিমির মুখটা কুচকে তাকালো ছেলেটার দিকে।’

‘নিমি উত্তর দিলো।’
-‘কে তুমি ভাই?’

‘ছেলেটা হেসে দিলো।’
-‘আমি আপনাদের জুনিয়র আপু। ফ্রেন্ড হতে পারি কি আপনাদের? কি ভাবছেন সিনিয়র জুনিয়র কিভাবে ফ্রেন্ড হবে? বয়স আসলে একটা সংখ্যা মাএ। ‘

‘ছেলেটা আরও কিছু বলার আগে থামিয়ে দিলো নিমি। ‘
-‘শুনো ভাই এসব ফালতু কথা অন্য কারো কাছে গিয়ে বলো। যত্তসব পা’গ’ল। ভাগো এখান থেকে।’

‘নিমি রুয়াতের হাত ধরে কলেজ থেকে বের হয়ে আসলো। কলেজের বাহিরে সেই চেনা গাড়িটার দিকে বুক কেঁপে উঠলো রুয়াতের। সবেমাত্র গাড়িটা এসে থামলো। নিমির হাতটা চেপে ধরলো রুয়াত।’

‘নিমি ব্যস্ত হয়ে বললো-‘
-‘কি রে কি হলো।’

‘রুয়াত নিমির দিকে তাকিয়ে বললো-‘
-‘তুই বাসায় চলে যা। আমিও চলে যাবো এখন। টাটা হ্যাঁ।’

‘নিমি চলে গেলো রুয়াত কে বিদায় দিয়ে। কিন্তু সেখানে রুয়াত দাঁড়িয়ে রইলো। গাড়ির কাছে গেলো না আর।’
‘সাদা রঙের ইউনিফর্ম পড়ে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রেয়সী। গাড়ি থেকে বসে খেয়াল করেছে আয়াজ। এখন এই মুহুর্তে গাড়ি থেকে নামা যাবে না তার। আশেপাশে অনেক শত্রু আছে। কেউ একবার তার ব্যক্তিগত বিষয়ে জেনে গেলে সমস্যা হবে। তাই সে আর বের হলো না। সাহেদ কে বললো-‘

-‘সাহেদ তোমার ম্যাডাম কে নিয়ে এসো গাড়ির ভিতরে। যাও। আর অবশ্যই মাস্ক পড়ে বের হবে।’

‘সাহেদ আয়াজের কথা মতো রুয়াতের কাছে গেলো। রুয়াত প্রথমে সাহেদের সাথে আসতে চাইছিলো না। কিন্তু আয়াজের কথা শুনে রাজি হলো। গাড়িতে ঢুকেই রুয়াত আয়াজ কে দেখতে পেলো। সিটে মাথা হেলিয়ে দিয়ে আছে।’

-‘সাহেদ তুমি এখন চলে যাও। কাল তাড়াতাড়ি এসো।’

‘সাহেদ সালাম দিয়ে চলে গিয়েছে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলো। আয়াজ আগের মতোই রয়েছে। কিন্তু রুয়াত হাসফাস করছে। অস্বস্থি হচ্ছে খুব। কোথায় যাচ্ছে গাড়ি তাও জানে না। মুখ ফুঁটে আয়াজ কে কিছু বলবে সে সাহস ও নেই। সিটে মাথা হেলিয়ে দেওয়া মানবটা কে একবার দেখে নিলো। মানুষটার আসলে কি হয়েছে সেটাই বুঝছে না। একবার দেখার পর আবার চোখ সরিয়ে নিলো। এহেন মুহূর্তে হলো বিপত্তি। আয়াজ রুয়াতের একদম কাছাকাছি চলে গেলো। রুয়াতের হাতটা ধরলো সযত্নে। ঘাবড়ে গেলো মেয়েটা।’

‘নেতিয়ে যাওয়া কন্ঠে আয়াজ বললো-‘
-‘কেমন আছো?’

‘রুয়াত কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো-‘
-‘ভা ভালো।’

‘চোখ খুলে রুয়াতের দিকে তাকালো আয়াজ। মেয়েটার মুখটা লাল হয়ে গিয়েছে একদম। ‘

-‘আমার কপালে কি আছে দেখেছো?’

‘তৎক্ষনাত রুয়াতের চোখ গিয়েছে আয়াজের কপালের। ঘাম ঝড়ছে। রুয়াত মাথা নাড়লো। আয়াজ গম্ভীর স্বরে বললো-‘

-‘মুখে বলো।’

-‘জ্বী দেখেছি।’

‘আয়াজ একটা টিস্যু রুয়াতের হাতে দিলো।’
-‘মুছে দাও। আমার কপালে এমন কিছু দেখলে নিজ দায়িত্বে এসে মুছে দিবে আমি বলার আগেই। এখন তো টিস্যু দিলাম পরেরবার থেকে তোমার ওড়না দিয়ে মুছে দিবে বুঝেছো?’

#চলবে….

[আসসালামু আলাইকুম। আজ ভালো করে রিচেক দেওয়া হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

[আসসালামু আলাইকুম। রুয়াতের থেকে কেনো মতামত নেওয়া হয়নি তা নিয়ে অনেকের রাগ হয়েছিল। আজ সব ক্লিয়ার করে দিলাম। এরপর থেকে আপনারা শুধু আয়াজের ভয়ংকর প্রেম দেখবেন🙊। মাথা ব্যাথার কারণে পার্টটা বড় করতে পারিনি। এইজন্যই আজ ছোট করে দেওয়া। আমার ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here