১৩
রিপের হাত পুরোপুরি সুস্থ হতে প্রায় মাসখানেক সময় লাগলো। ব্যান্ডেজ নিয়ে ফেলার পর ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছে ঔষধ প্লাস মলম মালিশের পাশাপাশি হাতের ব্যায়াম করতে। মাসখানেক পর কাজে হাত দেয়ায় রিপের ব্যস্ততা বেড়ে গেলেও তা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য নীরা তো আছেই। সময় করে ঔষধ, মলম মালিশ করে দেয়া, ব্যায়ামের লোহার ভারী জিনিসটি রিপের হাতে তুলে দেয়া তার নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সে ভাত খেতে ভুলে যাবে কিন্তু রিপের সেবাশুশ্রূষা করতে ভুলে না। সে মনেপ্রাণে বিশ্বের করে মানুষটা ভালো থাকলেই সে ভালো থাকবে। তার সামনে থাকলে সে শান্তি পাবে। তাকে ভালো না বাসুক সে বাসে। এটাই তার কাছে গর্বের, আনন্দের।
পরীর বার্থডে ইংরেজি জুন মাসের সাত তারিখ। চৌধুরী বাড়ি থেকে দাওয়াত এসেছে। সন্ধ্যায় সবাই মিলে গোল মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিল তারা যাবে। না গেলে এসব দ্বন্দ্ব সংঘাত মিটবে না কভু।
যে-ই ভাবা সেই কাজ পরীর জন্য কেনাকাটা করা হলো। ওই বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য মিষ্টান্ন ফলমূল আর যাবতীয় সরঞ্জাম কেনাকাটা করা হলো। সবকিছু যদিও রিপ সামলে নিয়েছে।
রান্নাঘরে রান্না চড়েছে। পরীর জন্য কিছু স্পেশাল রান্না আর পায়েস রান্না করা হচ্ছে। মুনা নিজের হাতে রান্না করছে। নীরা তো আছেই কেটেবেছে দেয়ার জন্য।
রিপের সাথে তার ভাবসাব অত না জমলেও আগের মতো জটিল নেই সম্পর্ক। বেশ সহজতর হয়েছে। আগের মতো একে অপরকে দেখলে চোখ সরিয়ে নেয়ার বদলে এখন চোখজোড়া স্থির রেখে একটু হেসে সরিয়ে নেয় কিংবা কোনো আকার ইশারা করে সরিয়ে নেয়। সম্পর্ক স্বাভাবিক হচ্ছে ধীরেধীরে কিন্তু গভীর হয়ে উঠেনি।
তবে রিপ আজকাল অফিস আর নিজের কাজের বাইরেও নিজের ঘরে সময় দেয়ার চেষ্টা করে। কেউ মনে করিয়ে না দিলেও তার মনে পড়ে নীরার সঙ্গে বসে তার দুটো কথা বলা দরকার। হাত ভাঙার দরুন সে বুঝতে পেরেছে সে কথা বললে নীরা খুশি হয় । হাসিখুশি থাকে। এটা তাকে প্রশান্তি দেয়। এতদিন সে চাইলেও পারেনি নীরার সাথে সহজ হতে তাই নীরা কষ্ট পেত এটা দেখেও না দেখার মতো ছিল। তার জন্য কেউ কষ্ট পাক সে কস্মিনকালেও চায় না। নীরা তো একদম না।
নীরা না থাকায় তালহা বেগম কথা বলার সুযোগ পেলেন।
আর ক’দিন বাঁচি ঠিক নেই। নিজের বংশের কোনো বাতি তো দেখলাম না। ওই পরের মেয়ে কি এই বাড়ির উত্তরাধিকার হবে? ওই ডাক্তার তার মেয়েকে ছাড়বে বলে মনে হয় তোমার?
মুনা চুপ করে থাকে। তার মন কাঁদে পরীর জন্য। বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে পরীকে নিয়ে। নইলে তাদের দুকূলে কেউ নেই। বিশেষ করে রিকের কথা ভাবতে গেলে তার বুক ভার হয়। মানুষটা তাকে ভালোবেসে কিচ্ছু পায়নি। সন্তানসুখ দিতে পারেনি সে। যাও পরী তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে উঠলো কিন্তু তাও অস্থায়ী হয়ে উঠলো। কে জানে ভবিষ্যৎ কি হবে?
ছোট বউ কিছু বলেছে?
আমি ওকে বলেছি আম্মা। নীরুকে ওসব বলে কোনো লাভ হবে না। রিপ কি এত সহজে সবকিছু মেনে নেবে?
সেটাই তো। তার তো সবসময়ই কাঁটার প্রতি ঝোঁক। ভুল আমাদেরই হয়েছে। ভুল তো আমরা করেছি। নাহলে আজ অন্যরকম হতো সবটা। মেয়েটার কি দোষ দেব? পরের মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে এসে ভরসা পায় স্বামীর কারণে সেখানে স্বামীই যদি বাঁকা হয়ে বসে কপালে দুঃখ ছাড়া কিছু নাই। ছেলেটাকে কে বুঝাবে বলো? ওসব বলার তো মুখ নেই আমার। আমাদের দোষে আজ সবকিছু এলেবেলে হয়ে আছে।
নীরা দরজার দ্বারে দাঁড়িয়ে রইলো নিশ্চুপ।
মুনা বলল
আপনি খেয়াল করলে দেখবেন ওদের মাঝে স্বাভাবিক ব্যাপারটা নেই। নীরা কষ্ট পায় সেটা আমি বুঝি।
কষ্ট পেলে কি আর হবে? তার কপালে যেটা আছে সেটা হবে। সে তো সবটা জানে। আমরা বোকামি না করলে আজ কাউকে কষ্ট পেতে হতো না। কম ঝড় কি গিয়েছে সবার উপর? ইশুর উপরও কম ঝড় যায়নি। আমাদের ভুলে ওরা দুজনেই কষ্ট পেয়েছে। আমাদের হাতেই তো ইশুকে দিয়ে লন্ডনে গিয়েছিল সে। আমরাই ওকে যত্ন করে রাখতে পারিনি। তাই এসব ঘটলো। দিনগুলো আবার ফিরিয়ে আনতে পারলে সব শোধরে নিতাম।
তালহা বেগমের গলায় আফসোস ঝড়ে পড়লো।
সবটা নীরার অন্তর্ধান হতেই সে সরে পড়লো সেখান থেকে। আর শুনতে ইচ্ছে করছে না।
পা দুটো জমে আসছে। হেঁটে ঘর অব্ধি যেতে পারছে না।
ঘরের দরজার কাছে গিয়ে সে থামলো। রিপ তার শার্ট আইরন করছে। নীরা তার দিকে পলকহীন তাকিয়ে ভাবে মানুষটা শুধু তার একান্ত। একদম নিজের। সে ভালোবাসে মানুষটাকে। মানুষটাও তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। তার অতীত পুরোনো, ধোঁয়াশার মতো, সবটা মিথ্যে। এখন তার জীবনে সত্যি একমাত্র নীরা। নীরা ছাড়া বাকিসব মিথ্যে।
নীরার উপস্থিতি টের পেয়ে বিছানায় বিছিয়ে রাখা শাড়ি একটা অঙুলি দ্বারা দেখিয়ে দিয়ে রিপ বলল
নীরা তুমি এটা পড়ো। ঠিক আছে?
নীরা কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রিপ পেছনে ফিরলো। নীরা দরজার সাথে লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিপ ভ্রুকুটিমিশ্রিত নয়নে তাকালো। কিছু বলার আগেই ফোন বেজে উঠলো। রিপ ফোন হাতে নিয়ে দেখলো আদি ফোন করেছে। ফোন কানে দিয়ে বলল
হ্যা বল।
কবে বেরুচ্ছিস তোরা?
মা আর আপা কিসব রান্না বান্না করছে। ওদের হলে বেরিয়ে পড়বো।
নে তোর বোনের সাথে কথা বল।
ইশার কাছে ফোনটা দিতেই ইশা বলে উঠলো
কতবার বলেছি তাড়াতাড়ি আসতে তাও তোমরা দেরী করছো। ভাবি, নীরু আর মামীকে তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দাও দরকার পড়লে। তোমাদের দেরী হলে ধীরেসুস্থে এসো।
দেরী ওদের হচ্ছে ইশু। আমরা তো রেডি আছি। আচ্ছা রাখ আমি দেখছি ওদের কতখানি হলো।
ইশা ফোন রেখে দিতেই রিপ পুনরায় নীরার দিকে তাকালো। নীরার চোখগুলো ভেজা দেখালো। চেহারা জীর্ণশীর্ণ। যেন প্রাণ নেই। আষাঢ়ের জলভরা দিঘীর মতো কানায় কানায় ভরা চোখদুটো থেকে জল যেন আরেকটু হলেই চোখের দেয়াল উপচে গড়িয়ে পড়বে। রিপকে এবার উদ্বিগ্ন দেখালো। সে এগিয়ে গিয়ে বলল
তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?
নীরা মাথা দুলালো।
কি হলো আবার? আচ্ছা ভেতরে এসো। শাড়ি কোনটা পড়বে?
নীরা হাত ছাড়িয়ে নিল। বলল
আপনি আজ ওখানে যাবেন না।
রিপ কথাটা বুঝতে পেরেও বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলো
কোথায়?
ওই বাড়িতে।
কেন যাব না?
কারণ আমি যাব না।
তুমি কেন যাবেনা সেটাই তো জানতে চাইছি।
নীরা কোনো কথা না বলে ওর বুকে ঝপাৎ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠে বলল
আপনি যাবেন না মানে যাবেন না। আমায় ভালোবাসলে আপনি যাবেন না। একটুও ভালো না বাসলে যান আমি বাঁধা দেব না।
রিপ অতি বিস্ময়ে বোবা হয়ে রইলো। এ কেমন কথা!
চলবে………