সবুজ বেশ জোড়েসোড়েই দরজাটা লাগিয়ে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিমের দিকে তাকালো। গোলাপ আর রজনীগন্ধার মিষ্টি সুগন্ধ ওকে মাতাল করে দিতে লাগলো। বধুর বেশে ঘোমটা দিয়ে লজ্জাবতী তিথির মুখটা ও একটুকুও দেখতে পাচ্ছে না। ওর নার্ভাসনেসটা আরো বেড়ে যেতে লাগলো। ইতস্তত করে ফুলগুলো একটু সরিয়ে খাটের কিনারায় বসে পড়লো।
মিম আচমকা সবুজকে চমকিয়ে দিয়ে, খাট থেকে অনেকটা লাফ দেয়ার মত করে পড়লো। সবুজ ভেবে পায়না সদ্য বিবাহিত বউ এমন আচরণ কিভাবে করতে পারে? তাছাড়া মিম ওর আপন মামাতো বোন। হঠাৎ করেই মিমের বাবা-মা রোড এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর থেকেই ওদের বাড়ীতেই ওর বাবা -মায়ের আশ্রয়ে লালিত পালিত হয়েছে। যদিও মিমের সাথে সবুজের যথেষ্ট আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকার কথা ছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ওকে বাহিরে থেকেই পড়াশোনা কমপ্লিট করতে হয়েছে, তাই সেইরকম সখ্যতা গড়ে উঠার সময় আর সুযোগ কোনটাই হয়নি। পড়াশুনো শেষ হতেই সবাই বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগলে, সবুজই প্রথম মিমের কথা বলে উঠে। কাজল চোখের মায়াহরিনী, দীঘল কেশের কেশবতী, শুভ্রতার সমস্ত রঙ গায়ে মাখিয়ে, মিম যখন গগনবিদারী হাসি হাসতো, সবুজের ঘুম ভাংগা চোখে যেন একঝাক স্বপ্ন ডানা মেলে উড়ে যেতো ।
বারবার মনে হতো এই মানবীর জন্যই ওর জন্ম হয়েছে। ওকে ছাড়া জীবন বড়ই অর্থহীন। তবে মিমের ভাবন ঘরের খবর জানার সময় বা ইচ্ছে কোনটা ই ওর হয়নি। সব কিছু ফ্যামিলির উপর ছেড়ে দিয়েই ও নিশ্চিন্ত ছিলো।
সবুজ আরেকদফা অবাক হওয়ার চরম সীমায় পৌছে যায় মিমের দরজা খোলার শব্দে।
” কোথায় যাচ্ছো ?”
” আমার রুমে।”
দাতে দাত চেপে কথাটা বললো মিম।
“মানে কিছু কি আনতে যাচ্ছো?”
বিছানা থেকে নেমেই সবুজ কথাটা বললো।
” নাহ, ঘুমাতে যাচ্ছি।”
নির্লিপ্তভাবে কথাটা বললো মিম।
” আজকে থেকেতো এটাই তোমার ঘর। আমাদেরতো একসাথে এই বিছানায় ঘুমানোর কথা। আমি বুঝতে পারছিনা। হুয়াট’স হ্যাপেন্ড।”
অনেকগুলো পশ্নবোধক চিন্হ নিয়ে সবুজ মিমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আজকে মিমকে অনেক সুন্দর লাগছে। ওর খুব ইচ্ছে করছে মিমকে খুব কাছ থেকে দেখতে। মনে হচ্ছে বুকের খাঁচায় এই পাখিটাকে সারাজীবন পোষ মানিয়ে রাখতে।
সবুজের ভাবনায় ছেদ পড়ে ঠোট বাকিয়ে মিমের কথা বলার ভঙ্গী দেখে।
” আয়নায় দেখেছেন কখনো আপনাকে?
আমি যথেষ্ট সুন্দরী এবং স্মার্ট। ভার্সিটিতে কত স্মার্ট, হ্যান্ডসাম ছেলে আমার পিছে ঘুরে আপনি জানেন?
কপালটাই খারাপ শেষে কিনা আপনাকেই.
আনস্মার্ট, খ্যাত,মোটকু, তুলার বস্তার সাথে আর যাই হোক এক রুমে থাকা জাস্ট ইম্পসিবল। আমার জাস্ট গা ইর ইর করে আপনাকে দেখলে..”
বড্ড কাটাকাটা ভাবেই কথাটা বলেই মিম সবুজের দিকে তাকায়।
সবুজ যেন আকাশ থেকে পড়ল। শুভ্র কাচের মত মনটা মুহূর্তেই ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেল। স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি উল্টোদিকের মানুষটা ওকে এতোটা অপ্রছন্দ করে। নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে সবুজ মিমের দিকে প্রশ্ন ঠেলে দেয়,
” মিম এই কথাগুলো আগে কেন বলোনি?
তাছাড়া আমাদেরতো বিয়ে হয়ে গেছে এখন এইসব বলে কি লাভ?”
” আজ যদি বাবা-মা বেচে থাকতো তাহলে হয়তোবা এই বিয়েই হতোনা।
তাছাড়া আপনাদের ঋণের বোঝাতো দিন দিন বেড়েই চলেছে কমছেতো আর না।
কি করে ফুফা-ফুফুর মুখের সামনে স্বার্থপরের মত না করতাম বলতে পারেন? কিন্তু আপনিতো পারতেন। আমি কি চাই সেটা একবারের জন্যেও জিজ্ঞাস করতে? বলুন পারতেন না?”
মিমের দুচোখে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সবুজের বড্ড অপরাধবোধ হতে লাগলো। আজকে ওর জন্যই মিমের চোখের জল বাধ মানছে না।
সবুজের এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে জীবনের হিসেব নিকেষে বোধ হয় বড্ড গোলমাল বেধে গেল। বড্ড ভুল হয়ে গেছে। বিয়ের আগে অন্তত মিমের সাথে একবার কথা বলে নেয়া উচিৎ ছিলো।
সবুজ সিগেরেট ধরাতে ধরাতে পুরো রুম ধোয়ায় মুড়িয়ে দিতে লাগলো। ওর কাছে মনে হচ্ছে ওর পুরো পৃথিবী যেন এক জটিল ধোয়াশায় আচ্ছন্ন। এ জাল কেটে না ও বের হতে পারবে। না ধোয়াশাকে আঁকড়ে ধরতে পারবে?
হাতে ধরা সিগেরেটটা এশট্রেতে নিভিয়ে, সবুজ কি জানি মনে করে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। সত্যিকি ও দেখতে এতোটাই খারাপ?
নাহ্ সবিতো ঠিকি আছে। হ্যা বাকী সবার থেকে ওর ওয়েট একটু বেশিই বলা চলে, তাই বলে মিম ওকে আনস্মার্ট, মোটকু, তুলার বস্তা বলতে পারলো? এইটা শোনার পর ওর ইচ্ছে হচ্ছে এখনি মরে যেতে?
স্বপ্ন যেখানে থমকে দাড়ায়, জীবন সেখানে চরম মূল্যহীন।
——————————————————–
” মিম তুই একা কেন?
যাহ, সবুজকে ডেকে নিয়ায়।”
শিউলি চৌধুরী মিমের দিকে মিষ্টি হাসি দিয়ে তাকায়।
” হ্যা ফুঁপি যাচ্ছি।”
” ফুঁপি কিসের আজকে থেকে মা বলবে কেমন।
আর যেন বলে দিতে না হয়।”
মিম একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে দু’তলায় সবুজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। কালকে রাতে নিজের রুমে আসার পর সবুজের রুমে আর যাওয়া হয়নি। অবশ্য ওকে বলেই এসেছে যাতে দরজা নক না করে ঘুমায়। অন্যদিন হলে এতোক্ষনে ব্রেকফাস্ট করতে ঠিক এসে পড়তো। কিন্তু আজকেই আসছে না।
সবুজ ওর কথায় কষ্ট পেলে ওর কিছু করার নেই। তাছাড়া ও সবুজকে মেনে না নিতে পারলে কি করবে? ওতো চেয়েছিলো সবটা মেনে নিতে কিন্তু সবুজকে দেখলে যে ওর অসহ্য লাগে। রগচটা শরীরে আগুন দাও দাও করে জ্বলে উঠে।
মিম রুমে ঢুকে সামনের দিকে আগাতে গিয়ে, সবুজের সাথে হালকা ধাক্কা খায়।
সবুজ মাত্র ওয়াশরুম থেকে এসেছে ওর খোলা শরীরের দিকে তাকিয়ে মিমের বুকে কাপণ ধরে যায়। নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে মিম আবার সবুজের দিকে তাকায়,
” সবুজ ভাই, ফুঁপি আপনাকে টেবিলে যেতে বলেছে।”
” তুমি কষ্ট করে এই ঘরে না আসলেও পারতে? আমি এমনিতেই যেতাম।”
অন্যদিকে তাকিয়ে কথাটা বললো সবুজ। ওর কথায় স্পষ্ট অভিমান ঝড়ে পড়ছে
” হ্যা ফুঁপি বলেছিলো তাই।
নইলে আমার বিন্দুপরিমাণ ইচ্ছে ছিলোনা……।”
সবুজ খপ করে এসে মিমের হাত ধরে ফেলে।
মিমের হাতে খুব চাপ লাগতেছিল কিন্তু সবুজের চোখের দিকে তাকিয়ে কোন কিছু বলার সাহসে কুলোচ্ছিলো না। সবুজ মিমকে একেবারে ওয়ালের সাথে সজোরে ধাক্কা দিয়ে লাগিয়ে দিলো।
সহসাই সবুজের এমন আচরণে মিম স্তব্ধ হয়ে যায়।
” সব সময় অন্যের ইচ্ছের দায়ভার নিজের ঘাড়ে কেন নাও? প্রতিবাদ করতে পারোনা। এইভাবে চুপচাপ সবার ইচ্ছের বলি হলে নিজের কোন অস্তিত্বই থাকবে না।”
উচ্চ স্বরে কথাটা বলে উঠে
সবুজ।
” উঁহু লাগছেতো ছাড়ুন।”
সবুজ মিমের হাত, বেশজজোড়েসোড়েই ঝাড়া মেরে ছেড়ে দেয়। মিমের মনে হচ্ছে ওর হাত বুঝি কাধ থেকে এখনি খুলে পড়ে যাবে।
মিম রাগিণী চাহনী দিয়ে সবুজের দিকে তাকায়।
” আস্ত কুমড়া একটা। ”
” কি বললে?”
” না শুনে থাকলে আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন? যা বলি একবারই বলি। শুনলে আছে না শুনলে নাই।”
মিম গটগট করে চলে যেতে লাগোলো।
” দাড়াও..?”
মিম কি জানি কি ভেবে দাঁড়িয়ে গেলো।
সবুজ আলমারী থেকে একটা বক্স বের করে মিমের দিকে হাত বাড়ায়।
” এটা তোমার। কালকে তোমাকে দেয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আমাদের মাঝে ওই সিচুয়েশনটাই তৈরী হয়নি তাই দেয়া হয়নি। তাছাড়া যার জীনিস তার কাছে থাকাটাই বেটার। তুমি চেইনটা পড়লে আমি খুবই খুশি হবো।”
” লিসেন, আপনাকে খুশি করার কোন ইচ্ছে আপাতত আমার নেই। সো সরি। আর হ্যা কালকে, যে সিচুয়েশন তৈরি হয়নি সেটা আদৌ কোন দিন তৈরী হবে কিনা তার কোন গ্যারেন্টি নাই। তাই এটা নেয়ার প্রশ্নই আসেনা। ”
চ্যাটাংচ্যাটাং করে মিম কথাটা বলে উঠলো।
সবুজ বক্সটা মিমের সামনে আবার আলমারিতে সস্থানে রেখে দেয়।
” যদি কোনদিন ইচ্ছে হয় পড়ো। ”
মিম মুখ বাঁকিয়ে চলে যায়।
চলবে…
#ভ্রান্তির_অগোচরে
লেখা আশিকা জামান
কাহিনী Froza Akhter
পার্ট ০১