ভ্রান্তির অগোচরে পর্ব ২

#ভ্রান্তির_অগোচরে
লেখা আশিকা জামান
পার্ট ০২

সামনে বসা মানুষটার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সবুজের ভারী ক্লান্ত লাগছে। তাছাড়া কালকে ভালো করে ঘুমও হয়নি।
কথাটা মাথায় আসতেই, সবুজ নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলো।
” আর ঘুম! যার জীবনটাই শুরু হওয়ার আগেই থেমে যায়। তার আবার স্বাভাবিক ঘুম…।”

সোহেল চৌধুরী হকচকিয়ে উঠে ছেলের দিকে তাকালেন,

” কখন এসেছো?
আমাকে ডাকোনি কেন?”

” নাহ্ মানে তুমিতো ফাইলটা অনেক্ষন ধরে ঘাটতেছিলে। আসলে তোমার কনসেন্ট্রেশন নষ্ট করতে চাইনি।”

” হ্যা দেখতেইতো পাচ্ছ কত কাজ। আচ্ছা যে জন্য ডেকেছিলাম।
তুমি বাসায় ফিরে যাও।

এইভাবে,
অফিসে না আসলেও পারতে। তাছাড়া এইভাবে বিয়ের পরেরদিন কেউ অফিসে আসে? সবাই কি ভাবছে বলোতো। এখনতো তোমাদের নিজের মধ্যে টাইম স্পেন্ড করার কথা। তা না ছেলে আমার অফিসে!
তাজ্জব ব্যাপার, আরে এটা তোমার বাপের অফিস। চাকরী যাওয়ার ভয়তো নাই নাকি!
সারাজীবন তোর মায়ের মত আনরোমান্টিকই থেকে গেলি। ”
সবুজ শব্দ করে হেসে উঠলো।
” কিন্তু বাবা আমার কাছে কাজটাই আগে। আজকেতো একটা মিটিং আছে ওখানে এটেন্ড করাটা খুবই জরুরী। ”

” তুই কি যাবি। নাকি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব। আমাকে আসছে কাজ দেখাতে। আরে তুই আমার বাপ না আমি তোর বাপ।”
ভ্রুকুচকে ছেলের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন সোহেল চৌধুরী।

সবুজ বিনাবাক্যব্যায়ে প্রস্থান করে।

বাসায় থাকলে বারবার মিমের কাছে যেতে ইচ্ছে করে। কি থেকে কি করে বসি কে জানে?
কাজের মধ্যে ডুবে থাকলে অন্তত ওকে ভুলে থাকা যাবে। কিন্তু সে আর হলো কোথায়?
আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে দরজায় একটা ধাক্কা দিয়ে সবুজ রুমে ঢুকে। অস্ফুট কোন শব্দে সবুজ চমকে উঠে সামনে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে।
চোখ মুখ শক্ত করে মূর্তির মত ড্রেসিং টেবিলের সামনে মিম দাঁড়িয়ে।
সবুজ ওর দিকে আপাদমস্তক তাকায়। গোলাপি রঙা পেটিকোট আর ব্লাউজ পড়া উন্মুক্ত শরীরের বাকী অংশগুলো শাড়ী দিয়ে ঢাকার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে মিম। কোমড়ের পাশের তিলটা দেখে মুহূর্তেই চমকে উঠে সবুজ। অনিচ্ছাসত্ত্বে মিমের দিকে এক পা করে এগুতে থাকে। আর অজানা ভয় আর একরাশ শংকা নিয়ে মিম পিছনে পিছিয়ে ওয়ালে ঠাই ঘেঁষে যায়।
” এই খবরদার আর একপাও আগাবেন না। দেখছিলেনতো ড্রেস চেঞ্জ করছিলাম। রুমের বাহিরে না গিয়ে। অসভ্যের মতো আমার দিকে ঝড়ের বেগে ধেয়ে আসছেন কেন?”

মিমের ভয়ে কুঁচকে যাওয়া মুখখানা উপর দিকে তুলে, চোখে চোখ রেখে সবুজ বলে উঠে,
” তোমার উপর তাণ্ডবলীলা চালাতে।”

” এই প্লিজ অসভ্যের মত তাকাবেন না বলে দিলাম।”

” চোখের আর কি দোষ বলো? চোখের সামনে যদি ক সবকিছু এইভাবে খুলে রাখ তাহলে চোখতো যাবেই..।
আর তুমি কি আমার খালা লাগো! যে এত হেজিটেট করছো। নরমাল থাকো।”
আচমকা মিমের ধাক্কায় সবুজ পিছিয়ে যায়।
বুকের উপড় শাড়ীর আরো ভালো করে দুই হাত দিয়ে ধরে মিম সবুজের দিকে তাকায়।
” এই দেখুন একদম চান্স নেয়ার চেষ্টা করবেন না।আপনাকে দেখলে আমার ইরিটেশন হয় বুঝেন আপনি বুঝেন?”
বড্ড কর্কশভাবে কথাগুলো বলেই মিম চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেই, মেঝেতে পড়ে থাকা শাড়ীর সাথে পা আটকে যায় কোন কিছু বোঝার আগেই পড়ে যেতে লাগলে সবুজ ধুম করে এসে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে। মিম চোখ বড় করে সবুজের দিকে তাকায়।
সবুজ ওকে ছেড়ে দিয়ে ওখান থেকে চলে যায়।

—————–
——————

মানুষটা দুপুরেও ঠিক করে খায়নি আর ওর দিকে একবারের জন্যেও তাকায়নি। এতে অবশ্য ওর খুশি হবারই কথা কিন্তু অদ্ভুতভাবে উলটো রাগ হচ্ছে।
আজকে সবুজের প্রছন্দের ফ্রাইড রাইস করতে ইচ্ছে হচ্ছে। মিম বরাবরের মতোই ওর ইচ্ছের দাশ। ইচ্ছে হয় আর করে ফেলে এতোকিছু ভাবতে যায়না।
মিম পেয়াজের খোসাগুলো ফেলে দিয়ে, চপিং বোর্ড এর উপর পেয়াজ টা আলতো করে রাখলো।পাশে রাখা ছুরিটা হাতে তুলে নিয়ে কাটতে লাগলো।
খাবার টেবিলে সবুজের বিষন্ন মুখটা ওকে খুবই আহত করেছে। ওর কাছে মনে হচ্ছে ওই মুখে যেন এক গভীর মায়া আছে। হয়তোবা কোনদিন ভালোভাবে তাকানো হয়নি তাই চোখেও পড়েনি।
হঠাৎ মিম ব্যাথায় কুকড়ে উঠলো। রক্ত! ভুলে ছুরিটা হাতে চালিয়ে দিয়েছিল। অন্যমনষ্ক থাকায় এতক্ষণ চোখেই পড়েনি।

” মিম, তোর হাতে কি হইছে রক্ত কেন। দেখি দেখি?”

” ফুঁপি সরি মা, উহু হাত কেটে ফেলেছি।”

” আল্লাহ কতোটা কেটে গেছে। ডান হাতটাই কাটলি? একটু সাবধানে কাজ করবিতো। আর তোকে কে কিচেনে আসতে বলেছে? বিউটি কোথায়?”

” আমি ওকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি। বেশ করেছো।
সবুজ? সবুজ? এই সবুজ?
তাড়াতাড়ি আয়।”

সবুজ ড্রইংরুমের সোফায় বসে টিভি দেখছিলো। মায়ের ডাকে টিভিটা মিউট করে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে যায়।

” মা, কি হয়েছে?”
” তোর বউ হাত কেটে ফেলেছে। ওকে নিয়ে হাত ব্যান্ডেজ করে দে তাড়াতাড়ি। দেখতো কতটা কেটেছে। আমি চশমা ছাড়া ভালো করে চোখেও দেখিনা।”

সবুজ আর দেরি না করে মিমের হাত ধরে ফেলে।
” কোথায় কেটেছে?”
” এইখানটায়।”
মিম হাত মেলে সবুজকে দেখায়।
” আসো আমার সাথে।”
মিম সবুজের পিছুপিছু রুমে এসে বিছানার উপর আয়েশ করে বসে পড়ে।
” একটু মনোযোগী হলেও পারতে? কতোটা কেটেঁছে কোন খেয়াল আছে।”
হাত ওয়াশ করতে করতে মিমের দিকে তাকায় সবুজ। মেয়েটা ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে ফেলেছে।

” খুব জ্বালা করছে?”

” একটু…
সমস্যা নাই। আপনি ব্যান্ডেজ করে দিন। আচ্ছা আজকে আমি খাবো কোন হাত দিয়ে? ”

সবুজের মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠলো মিমের ছেলেমানুষি কথা শুনে।

” তুমি আজকে না খেয়ে থাকবে । এতো ক্যালাস কেন তুমি? এটা তোমার শাস্তি।”

” উহু। আমি একদম না খেয়ে থাকতে পারিনা। তারউপর আজকে ফ্রাইড রাইস! অসম্ভব! নাহ হবেনা। আমি খাবো। ”

” এইভাবে নড়াচড়া করলে আমি কাজটা করবো কি করে? তাছাড়া এখনো ডিনার টাইম হয়নি। এতো খাই খাই করো কেন?”

” এই দেখুন, আমি একদম খাই খাই করিনা। কে খায় সেটা চেহারা দেখলেই বুঝা যায়।
সারাদিন গাণ্ডেপিণ্ডে গিলে আর মোটু হয়…
পেটুক।”

” জাস্ট সেটাপ।”
সবুজের ধমকে মিম চুপসে যায়।
হাতের ব্যান্ডেজটা করে দিয়ে সবুজ ওখান থেকে চলে আসে। ওর বিন্দুপরিমাণ ইচ্ছে নেই, মিমের থেকে বারবার অপমানিত হওয়ার।

—————————–

মিম টেবিলে বসে আছে। অনেক ক্ষুধা লেগেছে কিন্তু কাটাঁ হাত দিয়ে খাবে কি করে?
সবুজটা বসে বসে গিলছে? মিমের দিকে একবারের জন্যেও তাকাচ্ছে
না? সমস্ত মনোযোগ খাবারের দিকে। মনে হচ্ছে সবুজের জন্মই হয়েছে খাওয়ার জন্য।
” কি ব্যাপার তুমি এইভাবে তাকায় আছো কেন?
আচ্ছা আবার নজরটজর দিও নইলে আবার পেট খারাপ হবে।”
ঠোট উল্টিয়ে মিমের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো সবুজ।

” এই দেখুন মোটেও খারাপভাবে তাকাইনি। যা খুশি তাই বলবেন না। আপনার যদি পেট খারাপ হয়না তবে সেটা আপনার অতিরিক্ত খাওয়ার দোষেই হবে। যত্তসব..”
মিম রাগান্বিত হয়ে চলে যেতে লাগলে সবুজ খপ করে ওর হাত ধরে ফেলে।
সবুজের হাতের স্পর্শে মিম কেপে উঠে। আরেকটা হ্যাচকাটানে সবুজ ওকে চেয়ারটায় সজোরে বসিয়ে দেয়।
প্লেটে থেকে খাবার তুলে নিয়ে মিমের মুখের দিকে এগিয়ে দেয়।
” খাবার ফেলে উঠে যেতে নেই। নাও হা করো। তোমার খুব খিদা লাগছে, বুঝতে পারছি। ”
মিম নিঃশব্দে হা করে খাবার মুখে নেয়। সবুজের চোখের দিকে তাকিয়ে খাবার খেতে ওর ভারী মজা লাগছে। নিজেকে পিচ্চি পিচ্চি লাগছে। কতদিন কেউ মুখে তুলে খাইয়ে দেয়নি। আগে সবসময় আব্বু আম্মু মুখে তুলে খাইয়ে দিতো।
মিমের চোখে নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here